উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব সাত
- রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব এগারো
- রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। শেষ পর্ব
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব দুই
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব তিন
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব চার
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব ছয়
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব সাত
সাত
অগ্রহায়ণ মাস। নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসবের মাতম। ঘরে ঘরে পিঠা-পুলির আয়োজন। কলা পিঠা, তেলের পিঠা, চিতই পিঠা, নলা পিঠা, দুধ চিতই—কত রকম পিঠা তৈরি করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বোন, বোন-জামাই দাওয়াত করে ঘটা করে খাচ্ছে প্রতিটি পরিবার। দুধ চিতই পিঠা তৈরির জন্য গাভীর দুধ ও আখের গুড় বড়ো পাত্রে ফুটিয়ে ঠান্ডা হবার পর তাতে মাটির পাতিলে ভাজা মোটা মোটা ফুটিওয়ালা চিতই পিঠা ভিজিয়ে রাখে পরের দিন ভোরবেলা খাওয়ার জন্য। কিন্তু আজিরনের ঘরে পিঠা তৈরির সাধ্য নাই। কারণ, তার সংসারে আছে শুধু অভাব। তাছাড়া স্বামী তার দূরদেশে কাজে গেছে। ইচ্ছা থাকলেও সে নিরূপায়। তার আয়োজনের শক্তি যে বড়োই সীমিত। তাই বসে বসে পান চিবোচ্ছে আর ভাবছে কী করা যায়। প্রকৃতিজুড়ে হিমেল ঠান্ডা হাওয়া বিরাজমান। হালকা কুয়াশা রাতের অন্ধকারের সাথে যোগ হয়ে আকাশের লক্ষ কোটি তারকারাজির ক্ষীণ আলোকে ম্লান করে দিয়েছে। তখন রাতের প্রথম প্রহর প্রায় শেষ। গ্রামের কারোরই সে সময় জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু আজিরন জেগে আছে বছির উদ্দিনের চিন্তায় মগ্ন হয়ে। কনকনে শীত, না জানি স্বামী তার কোন হালে রাত পার করছে। দূরের আসর থেকে ভেসে আসা আবহমান গীতে কখন যেন আজিরন পান খাওয়া ঠোঁট নড়ে ওঠে, তা ঠাওর করতে পারে না।
আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে—
বিলের জলে কোড়ারে ভাসে
কোড়ার ডাকে ঘুম ভাঙিয়া যায় ওরে
এমনও কি দরদী হবে?
বিলের কোড়া ধইরা রে দিবে
তারে করিতাম সোনার যৌবন দান ওরে
প্রাণের সোয়ামি নিঠুরিয়া
ভুইলা রইছে দূরদ্যাশে রে গিয়া
তারে ছাড়া মোর জীবন রাখা দায় ওরে
কচ্পুাতার টলমল পানি
নারী লোকের যৌবন রে জানি
ঝইড়া গেলে করবে হায় হায় ওরে।
এবার আইসলে প্রাণের হিয়া
বাইন্ধা রাখবো মাথার কেশ রে দিয়া
তারে ছাড়া এই জীবন রাখা দায় ওরে।
আমি নারী হই অবলা
পতি বিনে কে বুঝবে রে জ্বালা
সোয়ামি বিনে মন উতালা হয় ওরে।
স্বামী-পরবাসী তাই আজিরন জর্দা দিয়ে পান খায়। স্বামীর কথা মনে পড়লে,চিন্তায় বাড়লে পান খেয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ভুলে থাকাটা বড়ো কষ্টের। ইচ্ছা করলেই মনে করা যায়, ইচ্ছে করলেই কী আর সব ভুলে থাকা যায়? নাকি ভুলতে চাইলেই ভোলা যায়?
আজিরন যখন নানা ভাবনায় বিভোর তখন সুফিয়া ঘুম থেকে জেগে বলে, ‘মামি ঘুমাওনি?’
‘নারে ছুরি, কেমন জানি ঘুম ধরছে না। পরানডার মধ্যে তোর মামুর কথা বারবার নাড়ন দিতাছে। তুই ঘুমাস না ক্যা?’
সুফিয়া প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। আজিরনের কথা শেষ না হতেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আজিরনও ঘুমানোর জন্য মেয়ে আদরীকে বুকে নিয়ে চৌকিতে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। এমন সময় বাইরে কে যেন অস্ফুট গলায় ডাক দেয়, ‘খালা চেতন আছেন?’
‘কিডা ডাহে? কিডা?’ আজিরন জানতে চায়।
‘খালা, আমি সাইফুল। দরজাডা একটু খোলো।’
এত রাতে ওয়াহেদ মাস্টারের ছেলে সাইফুল তার বাড়ি কেন? সেটা বুঝতে পারে না আজিরন। সাইফুলের মা জমিলা খাতুন আজিরনের আপন মামাতো বোন। সাইফুল ফাজিল পাস। মাদ্রাসা লাইনে লেখাপড়া করলেও দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি— কোনোটারই ধার ধারে না। সারাদিন বেকার-বখাটেদের মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে আজিরনদের বাড়ি আসে এবং খালার দুঃসময়ে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। তার আবার মতলবও আছে। মোল্লাবাড়ির হেকমত মাস্টারের মেয়ে জবেদাকে ভালোবাসে। খালা আজিরন পিয়ন হিসেবে চিঠি আনা-নেয়া করে। কিন্তু এত রাতে কেন তার আগমন সেটা আজিরন ঠাওর করতে পারে না। তারপরও সে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খুলে দিতেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢোকে সাইফুল। তার এমন করে ঘরে ঢোকায় আজিরন খানিকটা ঘাবড়ে যায়। মাথায় অমঙ্গল শংকার উদ্রেক করে। কিন্তু সাইফুল যখন তাকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে আসার জন্য তখন তার দুশ্চিন্তা দূর হয়। ভাবনা হয় কেবল এত রাতে চিঠি দেয়ার বিষয়ে। কিন্তু সাইফুলের সুমিষ্ট কণ্ঠে অনুরোধমাখা খালা ডাক শুনে জবেদাকে চিঠি দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে আজিরন।
সাইফুলের আগমনে সুফিয়ারও কাঁচা ঘুম ভেঙে যায়। একপর্যায়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে সে।
নীরব-নিস্তব্ধ ঘরে ছোট টুলে বসে আছে সাইফুল। অন্যদিকে গভীর রাতে অতন্দ্রপ্রহরী ঝিঁঝিঁ পোকার মায়াবী সানাইয়ের সুরকেও ম্লান করে দিচ্ছিল হারানের বেসুরা নাকডাকানির সাইরেন। দরজার কোনা দিয়ে ধেয়ে আসা উদাস বাতাসে কেরোসিনের কুপিও নিবু নিবু করছে। ক্ষনেই আনমনা হয়ে উঠছে সাইফুল।
বছিরের বড়ো ছেলে আজিবার গোয়ালঘরে মাচা করে ঘুমায়। সে গরু পাহারা দেয়। ঘরে মস্ত বড়ো একটা চৌকি। এক পাশে হারান, পরান ও আজিরনের দুগ্ধপোষ্য কন্যা আদরী। মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা, চৌকির শেষ প্রান্তে ভরাটযৌবনা সুফিয়া ঘুমের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করছে। সাইফুল খেয়াল করে সুফিয়ার
সারা শরীর কামনায় ছটফট করছে। সাইফুলের ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে। তার ভেতরেও কামনা ছুটে বেড়ায়। তাই শিকারি বাঘের চোখে তাকিয়ে থাকে সুফিয়ার শরীরের দিকে।
উত্তেজনায় ঘামতে থাকে সাইফুল। সুফিয়া দেখতে এত সুন্দর! সে কখনো ভাবতেও পারেনি। এত কাছ থেকে সুফিয়াকে নিরিখ করতে পারবে সেটাও ছিল কল্পনার বাইরে। সুফিয়ার সৌন্দর্য আর নিশ্বাসের সাথে ওঠানামা করা বুকজোড়া তাকে উন্মাদ করে তোলে। তার ওপর সুফিয়ার পরনের শাড়ি হাঁটুর ওপর উঠে আছে। দেখা যাচ্ছে তার ধবধবে সাদা উরু। মৃদু অন্ধকারেও সাইফুল বুঝতে পারে এ নারী শরীর কামনার রসে টইটুম্বুর। শরীরও তার ঈষৎ স্থূলকায়। তাই তাকে কাছে পেতে, মনের ইচ্ছা পূরণ করতে সাইফুল ছটফট করতে থাকে। কিছুতেই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অনিবার্য এক নেশায় মাতাল হয়ে ওঠে তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
একপর্যায়ে সাইফুল আদিমতার কাছে হার মানে। তার মন থেকে সমস্ত ভয় দূর হয়ে সেখানে বাসা বাঁধে কামনার উদগ্র বাসনা। এবার সে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে সুফিয়ার দিকে। সহসাই তার হাত দুটো চলে যায় সুফিয়ার বুকের নরম মাংস পিণ্ডের ওপর, তারপরই ফুঁ দিয়ে কুপি নিভিয়ে দিয়ে জাপটে ধরে সুফিয়াকে।
ঘুমে থাকায় সুফিয়া প্রথমে কিছু বুঝতে পারে না। যখন বোঝে তখন নিজেকে আবিষ্কার করে সাইফুলের বাহুর শক্ত বেষ্টনীতে। তখন আর তার কিছুই করার থাকে না। পাশে যারা ঘুমিয়ে আছে তারা যেন কিছু বুঝতে না পারে তাই সে আওয়াজও করে না। ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্র থাবার নিচে পড়ে থাকা অসহায় হরিণীর মতো শুধু কাতরকণ্ঠে বলে, ‘সাইফুল ভাই এইডা কী করলেন?’
সাইফুল কোনো উত্তর না দিয়ে সুফিয়াকে বাহুডোরে বেঁধে রাখে নিজের শরীরের সাথে। চরিতার্থ করতে থাকে তার লিবিড রসনা। কেবল গাঢ় অন্ধকারে একজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ দেখতে থাকে কী করে একটা জংলি ভোমরা তার সতীত্ব নামক গোলাপের পাপড়িগুলো দুমড়ে-মুচড়ে একটা একটা করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। একসময় সুফিয়ার জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে যমুনার ঘোলা জল ঢেলে দরজা খোলা রেখেই নীরবে চলে যায় সাইফুল।
অসহায় সুফিয়া বাইরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে ঘুমের ভান করে কাঁদতে থাকে। মনে মনে মামি আজিরনকে দোষারোপ করে। এভাবে সাইফুলকে ঘরে রেখে কেনো গেল। নাহয় সাইফুল এসব করতে পারত না। সুফিয়া ভাবে, এটা কী হয়ে গেল? কেন এমন হলো? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
ততক্ষণে ফিরে আসে আজিরন। দেখে ঘর অন্ধকার। দিয়াশলাইয়ের বাক্স খুঁজতে থাকে। সাইফুল নাই। ভাবে হয়তো তার অপেক্ষা করে চলে গেছে। তাই আর বাতি ধরায় না। দরজা বন্ধ করে মেয়ে আদরীকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সুফিয়ার চোখে ঘুম নেই। ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা তাকে আঁকড়ে ধরে। অস্থির করে তোলে। বাঘ একবার রক্তের ঘ্রাণ পেলে যেমন বারবার হানা দেয়, সাইফুলও যদি তাই করে, তখন কী হবে উপায়?
