উপন্যাস

উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব ছয়

ছয়

বছির বউ-বাচ্চাসহ শ্বশুরবাড়ি পৌঁছার পর তার শ্বশুর আফাজ মণ্ডল বড়ো ছেলেকে বলে, ‘গেদা, অনেক দিন পর জামাই-মেয়ে-নাতি আমার একসাথে আইছে, তোর মামুকে খবর দে। সে যেন তার ক্যাসেটটা নিয়া আয়। হোন গেদা, আসার সময় মনে কইরা নজর সরকারের জারি, লিলি মিন্টুর ফিতা, ওয়াহেদ সালেকার ফিতা, সবুর তালুকদারের কেচ্ছার ফিতা আনতে ভুলিস না। সাথে পাইল্যা যাত্রাও।’
রাতে খানাপিনা শেষ করেই বাইর বাড়িতে টেপ রেকোর্ডারে নজর সরকারের কিচ্ছাগান শোনার ধুম পড়ে যায়। বছির কিছুক্ষণ শোনার পর উঠে ঘরে যায়। ভাবতে থাকে কী করে ক্যাসেট কেনা যায়। ক্যাসেট শোনার পর প্রিয় রেডিওটাও তার আর ভালো লাগে না। রেডিওটা কেমন যেন তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। ভাবে এবার সিলেট কাবার থেকে ফিরে ধান বিক্রির টাকায় ক্যাসেট কিনবে।
ক্যাসেট ছাড়াও গ্রামে বিভিন্ন ধরনের গানবাজনা হয় শীতকালে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলে ও প্রাথমিক শিক্ষকরা মিলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আছে যাত্রা, নাটক, গান, কবিগান, বাউলগান, নসিমন সুন্দরীর পালা, বেহুলার বাসরঘরের জারি। মহুয়া সুন্দরী ও নইদার চাঁদের পুঁথিপাঠ এবং মরমি বাউল হাসান নবীরের পাইল্যা যাত্রার কি যে বুদ্বুদ। যাত্রা নাটকে ছেলেরা মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করে। তা নিয়ে যে কত হাসি-ঠাট্টা!

একবার এক নাটকে মহারানি ও সেনাপতি উভয়ের অভিনয়ের সময় সেনাপতির চরিত্রে অভিনয় করে সাজঘরে গিয়ে পোশাক পাল্টিয়ে রানির পোশাক পরে ভুলে গোঁফ না খুলেই রাজার সামনে হাজির, অমনি সবাই চারদিক থেকে হো হো করে হাসতে শুরু করে দেয়। রাজা তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি সামলাতে অট্টহাসি দিয়ে বলে, ‘হা হা হা-হু হা হা একি রানি, তোমার মুখে কেন গোঁফরেখা? জলদি অন্তঃপুরে যাও, তোমার গোঁফ খুলে এসো।’
রানি মুখে হাত দিয়েই ভোঁ দৌড় অন্তঃপুরের দিকে; গোঁফ খোলার জন্য। এভাবে দর্শকদের বোকা বানিয়ে যাত্রা নাটক শেষ হয়।
বছির ছোটবেলা থেকেই এসব যাত্রা নাটক দেখে। বছিরের বড়ো ছেলে আজিবার লেখাপড়া করে না। মেজ ছেলে হারান দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়ায় সে বেশ ভালো। ছোট ছেলেটির বয়স সবে তিন বছর। সব মিলিয়ে হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনায় কেঁটে যেতে থাকে তাদের সংসার জীবন।

’ধলা দাদী কাইলা দাদী পানি দে লো
লঙ্কারই ক্ষ্যাত খোলা পুইড়া গেল ও’

চৈত্র মাস। চারদিকে কাঠফাঁটা রোদ্দুর। ভ্যাপসা গরম। আগুনে আবহাওয়া। সিলেটের হাওর অঞ্চলে গেরমান ব্যাপারির কাবারে এসেছে বছির উদ্দিন। হাওরে ব্যাপারিরা চুক্তিতে ধান কাটার জন্য নৌকাভর্তি লোক নিয়ে কামলা খাটায়। কামলা বাবদ প্রতি একশ’ আঁটিতে বিশ আঁটি ধান। এখানে অলখের পাথার বাহিয়া যত দূর চোখ যায় সোনারং ধানে ধন্য। বাড়িঘরে বিশুদ্ধ পানি নাই বললেই চলে। পিপাসার্তরা হাওরের ময়লাযুক্ত পানি খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডায়রিয়ায় কয়েকজন মারা গেছে। সেবার কোনো প্রকার দুর্যোগ না হওয়ায় প্রচুর ধান পায় বছির উদ্দিন। বাড়ি এসে দ্যাখে পূর্ণিমার চাঁদের মতো মেয়ে হইছে তার। আদর করে মেয়ের নাম রাখে আদরী। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মা বলে ডাকে।
বছিরের চার বোনের মধ্যে তিন বোনের অন্যত্র বিয়ে হওয়ায় শুধু বড়ো বোনটা কাছাকাছি ছিল। সে বোনটিও সাপের কামড়ে মারা যায়। বোনের স্মৃতি হিসেবে রেখে গেছে একমাত্র মেয়ে সুফিয়াকে। সেই সুফিয়ার দুই মাস আগে বিয়ে হয় গ্রামের আরেক সর্বস্বহারা এতিম মানিকের সাথে।

মানিককে খুব ভালোবাসে বছির। মানিকও বছিরকে আগে থেকেই মামা বলে ডাকে এবং মামাকে না জানিয়ে কিছু করে না। এই সখ্যের মধ্য দিয়েই সুফিয়ার সাথে বিয়ে হয় মানিকের। মানিকের বাবা গণি মিয়া। তাকে সবাই গণি ডিমওয়ালা বলে ডাকত। পাড়া-মহল্লা ঘুরে ডিম কিনে সরিষাবাড়ী মোকামে বিক্রি করত। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অগ্নিঝরা ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/জয় বাংলা’ বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে গোপনে ডিম কেনার ছলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। অবশেষে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এই অপরাধে তার স্ত্রী হাজেরা বেগমকে ঘাতক দালালরা হানাদার ক্যাম্পে দিয়ে আসে। কোলের সন্তান মানিককে ছুঁড়ে ফেলে খড়ের গাদায়। নির্যাতন করে মেরে ফেলে হাজেরা বেগমকে। মানিক হয়ে পড়ে এতিম।

অসহায় মানিকের এ অবস্থায় গ্রামের ওয়াহেদ মাস্টারের বউ খড় থেকে তুলে নিয়ে খাবারদাবার দিয়ে কাজের ছেলের মতো বড়ো করতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বাঙালি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধা ডিমওয়ালা গণি ফিরে আসে না। কেউ জানে না তার কী হয়েছে। কখন, কোথায় সে শহিদ হয়েছে তার হদিস মেলে না। জীবিত আছে কি না তাও কেউ বলতে পারে না।
মানিকের বয়স যখন পনেরো তখন ওয়াহেদ মাস্টার একটি দোচালা টিনের ঘর ও আধা বিঘা জমিসহ আলাদা করে দেয়। তারপর থেকেই মানিক বছিরের সাথে কামলা-কিষাণ দেয়া থেকে শুরু করে খিয়ারে বিদেশ করা, সিলেট কাবারে যাওয়া—মোটকথা বছিরের সাথেই কাজে যায়। মানিক যখন কোথাও কাজ করতে যায় তখন সে তার যুবতী বউকে রেখে যায় মামি আজিরনের কাছে। তার যে আর কেউ নেই। একমাত্র বছিরের পরিবারই তার আপনজন। আজিরনের কাছে সুফিয়াকে রেখে গেলে সে নিশ্চিন্ত হয়।

প্রতিবারের মতো এবারও খিয়ারে ধান কাটতে যাবার সময় সুফিয়াকে মামির কাছে রেখে যায় মানিক। সুফিয়া আঠারো বছরের পূর্ণ যৌবনা রূপবতী। মানিকের ভয় এখানেই। এমন যুবতী বউয়ের ওপর যখন-তখন যার-তার শকুন চোখ পড়তেই পারে। সে চোখ যে এখানেই আছে সে কথা  ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। এ ঘরেও যে যুবকদের বাস তা তার অজানা নয়, কিন্তু মনের ভেতর কখনো সে কথা জেগে ওঠেনি। তার না জাগলেও যার জাগার ঠিকই জেগে ওঠে সুফিয়ার ভরা যৌবন দেখলে। তাই তো মা আজিরন বেগম ঘুমিয়ে গেলে আজিবার চুপিসারে উঠে কুপি জ্বালিয়ে সুফিয়ার ভরাযৌবনা উদ্দাম শরীরের দিকে রুদ্ধশ্বাস তাকিয়ে থাকে। সুফিয়ার নিশ্বাসের সাথে ওঠানামা করে স্তন। কামনা তখন আজিবরকে তাড়া করে পাগলা ঘোড়ার মতো। তার ইচ্ছে করে সুফিয়ার ওঠানামা বুকে হাত দিতে। ছুঁয়ে দেখতে, কতটা আগুন সেখানে ওম যোগাতে পারে। কিন্তু অজানা ভয় এসে ভর করে তার সে শিহরণে। মা যদি টের পায়!

কিন্তু যার সর্বনাশ হওয়ার সে কি পারে তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে? ঘটনাচক্রে সুফিয়াও যে ডুব দেয় কামনার সে জলে। চরিত্র আর চিত্রপট কেবল ভিন্ন।

Series Navigation<< উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব পাঁচ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *