উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব পাঁচ
- রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। পর্ব এগারো
- রহস্য উপন্যাস।। রহস্যময় বারান্দা।। মালেক মাহমুদ।। শেষ পর্ব
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব দুই
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব তিন
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব চার
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব ছয়
পাঁচ
গ্রামে খুব একটা কাজকাম নাই। কয়েক দিন শুয়ে বসে কাটিয়েছে বছির। এভাবে বসে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। তবু কী করবে ভেবে পায় না। দুপুরে খাবার সময় বলে, ‘আজিবারের মাও, এভাবে কামকাইজ ছাড়া কয়দিন খাওন যায়! কোনো প্রকার কামলা-পাইট চলে না। সিলেট কাবারও তিন মাস দেরি আছে। তাছাড়া ঘরে পাঁচ মুখের আহার যোগাতে অয়। হের মধ্যে আরও একজন আইতাছে। তাই বলি কী, খিয়ারে গিয়া কিছুদিন ইরি ধান কাটার কাজ কইরা আহি। মানিক সাথে যাইব কইছে।’
মানিকের সাথে যাবার কথা শুনে আজিরন রাজি হয়। তারপরও ভয় হয়। কারণ, খিয়ারে যেতে মোটরগাড়িতে উঠতে হয়। যদি দুর্ঘটনা ঘটে! সংসারের অভাবের কথা ভেবে শেষে রাজি হয় আজিরন। এ ছাড়া কোনো গতি যে নেই!
বছির কাজের জন্য অন্যত্র চলে গেছে বেশকিছু দিন আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া খাবার শেষ হয়ে গেছে। তিন ছেলে নিয়ে কী খাবে আজিরন। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা ধার করে সংসার চালায়। অন্যদিকে বাবার অনুপস্থিতিতে গরুর ঘাস কাটা তো দূরের কথা, দিন-রাত খেলাধুলায় মেতে থাকে আজিবার। হা-ডু-ডু, কাবাডি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, চিকচিক, ভদন—এ ছাড়া রাতে চাঁদের জোছনায় খই খই খেলে। সকালে নড়িগুটি বা গুটিবাড়ি খেলে। প্রথমে দুজন খেলা শুরু করে। একজন বাঁশের কঞ্চি বা বাঁশের শুকনো ডাল ঝাড় বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপরজন নড়ি গুটি নিয়ে প্রথমে ডান হাতে তুলে বাড়ি দেয়। দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষ ঝাড় দিয়ে গুটি শূন্যের ওপর ছুঁয়ে দিতে পারলে ডান হাত মরা। এরপর বাম হাত দিয়ে খেলতে হয়। খেলার একক হিসেবে মোনা, দোনা, তেনা, চারা, বাছা, ছই, গই—এইসব শব্দ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কয়রা, চিলা, গুড্ডি ওড়াতেই দিন চলে যায় আজিবারের। দুষ্টু ছেলেদের সাথে দুপুরে গাছের ছায়ায় মার্বেল, দিয়াশলাইয়ের পরিত্যক্ত খোল দিয়ে নই নই খেলে। আজিবার ঘাস কাটতে গেলেও ঘাস কিংবা পাচুন ছুড়ে নই নই খেলে ফতুর হয়ে বাড়িতে আসে। ছেলেকে গালিগালাজ করে, ভর্ৎসনা দেয় আজিরন। কিন্তু আজিবার খেলা ছাড়তে পারে না। তার মতোই চলে।
ছেলের বেয়াড়াপনা আর দীর্ঘ সময় স্বামী বিবাগে আজিরন শরীরিক ও মানসিকভাবে অস্থিরতায় দিন যাপন করতে থাকে। তবু বসে থাকে না। অন্যের আবাদি জমিতে আগাছা পরিষ্কার করে ঘাস আনে। ফসলের মধ্যে ধান, পাট, কাউন, গম, খেরাচি, মরিচ, আখ, প্যারা, খেসারির ডাল, মাসের ডাল, কাতি কালাই, মসুর, বুট, বাদাম, মিষ্টি আলু, বেগুন, লাউ, কুমড়াসহ আরও আছে। আজিরন ঘাস কাটার সময় অন্যের মরিচের খেত থেকে ঝরে পড়া বা ইঁদুরে কাটা মরিচ, বথুয়ার শাক, সরিষা পাতা তুলে এনে ভর্তা করে তাই খেয়ে ছেলেদেরকে নিয়ে দিনাতিপাত করে। অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মরিচের টাল থেকে দু-একটা বেগুন, কাঁচা মরিচ, শোলকপাতা তোলে আজিরন। কারণ একটানা সরিষার পাতা ভাজা ও বথুয়ার শাক খেতে ভালো লাগে না। ছেলেরাও খেতে চায় না। মরিচ খেতের মালিক জমিওয়ালা দেখলে তো রক্ষাই নাই। মরিচ, বেগুন, শাক ও ঘাসসহ সব কেড়ে নেয় এবং গালিগালাজও করে। এসবের জন্য কতবার যে অপমানিত হয়েছে, কতবার যে লজ্জায়-অপমানে সে না খেয়ে ঘুমিয়েছে তার হিসাব মেলানো ভার।
বাড়ির উঠোনের মাঝখানে দুটো বড়ো আম গাছ কেরাম ব্যাপারির। ঝড়ের সময় আম পড়লেও কুড়াতে পারে না তারা। আজিবার দরজা খুলে যেতে চাইলে বাধা দেয় আজিরন। বলে, ‘দেখ, কেরাম ব্যাপারির বউ সোলার বেড়া ফাইট কইরা হেরকেন ধইরা আছে।’
কিন্তু আম কুড়াবার জন্য আজিবার ছটফট করে। ঝড় থেমে গেলে ব্যাপারির বউ আম কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ঘর থেকে বের হয় আজিরন। মেঘের গর্জন, প্রবল বর্ষণের মধ্যে বিদ্যুতের আলোক ঝলকানিকে সঙ্গী করে ছুটে যায় চেয়ারম্যানের আমবাগানে। ছেলেদের জন্য আম কুড়িয়ে আনে।
মেজ ছেলে হারান প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বার্ষিক পরীক্ষা তার। মাকে বলে, ‘মা, কাইল কিন্তু আমার পরীক্ষা। শেষ রাতে আমাকে ঘুম থাইকা জাগাইয়া দিও কইলাম। উইঠা পড়মু।’
ছেলের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে মায়ের মন ভরে যায়। আজিরনের অসময়ের সম্বল ডিম বিক্রি করা টাকায় পরীক্ষার ফি দেয়। ছেলেকে লাউ শাক ভর্তা দিয়ে ভাত দিবে তাই রাতেই হাফিজা বেগমের বাড়ি থেকে লাউ শাক চেয়ে নিয়ে আসে ভর্তা বানানোর জন্য। নানি-দাদির কাছে শুনেছে আলু, ডিম, ডাল এসব খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে নাকি পরীক্ষা খারাপ হয়। তাই সে পরীক্ষার সময় এসব খাবার খেতে দেয় না ছেলেকে।
হারানের পরীক্ষা শেষ হবার পর হঠাৎ বাড়ির উঠোনের আমগাছে কুটুম পাখি ডেকে ওঠে। ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করা অবস্থায় হাফিজা খালা বলেন, ‘আইজক্যা বুঝি তোর সোয়ামী আইসবো। ওই দ্যাখ কুটুম পাখি ডাকতাছে। নইলে কুটুম পাখি ডাকতাছে ক্যান?’
হাফিজা খালার কথাই সত্য হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। খিয়ার থেকে তখন বছির বাড়ি আসে। আসার সময় আজিরনের জন্য শেরপুর থেকে লাল পাইড়ওয়ালা শাড়ি আনে এবং ছেলেদের জন্য জামা-জুতা।
নতুন শাড়িতে নববধূর মতো সাজে আজিরন। মনের ভেতরে দোল খায়; কতরকমের কামনা-বাসনা। নিমিষেই মন হারিয়ে যায় প্রকৃতির অপরূপ শোভাবর্ধিত কাশফুলের গভীর অরণ্যে। মন পায়রা পাখনা মেলে উড়ে যেতে চায় তেপান্তরে। যমুনার মৃদু ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ভাঙা নদীর ক্ষতবিক্ষত কূলে। তবুও সাবধান হতে হয় আজিরনকে। সে যে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাকে তো অনেক কিছু বেছে চলতেই হবে।
অনেক দিন বাড়ির বাইরে থাকায় পরিবারের জন্য বছিরের মনটাও কেমন কেমন হয়ে ছিল। তাই বাড়ি ফেরার আগে সে মনস্থির করে রাখে এবার বাড়ি গেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়িয়ে আসবে। সে রাতেই আজিরনকে জানায় সেকথা। আজিরনও বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে খুশি হয়। অনেক দিন যাওয়া হয় নাই।
সকাল হতেই বছির গোসল সেরে নতুন জামা-কাপড় পরে তৈলাক্ত মাথায় বাঁকা সিঁথি কেটে প্রিয় রেডিওটা বগলতলায় নিয়ে বউ-বাচ্চাসহ শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়।
