উপন্যাস

উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব তিন

তিন

বর্ষা যায় বর্ষা আসে। কালপরিক্রমায় ঘুরে আসে ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যা। তরতর করে বাড়তে থাকে যমুনার জল। বাড়তে বাড়তে বন্যার পানি যমুনার পাড় অতিক্রম করে বসতভিটার ওপর উঠতে থাকে। বন্যার প্রবল স্রোতে রাস্তাঘাট ডুবে ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। যমুনার চরে বন্যা মোকাবিলায় অনভিজ্ঞ মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোনোমতে মাচা বেঁধে ঘরের চালে উঁচু জায়গায় অবস্থান নিলেও গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে তারা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ভাঙতে থাকে যমুনার দু’কূল। বিলিন হয়ে যায় ফসলের খেত। বাড়িঘর। যমুনা যেন রাক্ষসী হয়ে উঠেছে। সব গিলে খাবে। বন্যার পানির কারণে পাড় দেখা না গেলেও যখন কোনো বাড়িঘর, গাছ বা বাঁশের ঝাড় নদীগর্ভে বিলীন হয় তখন মানুষের গগনবিদারি আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়। এভাবে কত বাড়ি, কত মানুষ যে যমুনার প্লাবনে ভেসে গেছে তার হিসাব মিলানো কঠিন। একে তো বন্যা তার ওপর নদীভাঙন, সেই সাথে সাপের উপদ্রবে মানুষ দিশেহারা। রাক্ষুসী যমুনার করালগ্রাসী ভাঙনের কবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ বাড়ির অর্ধেক ঘর ও আসবাবপত্র ভাড়া বাবদ নৌকাওয়ালাদের দিয়েও স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা নিয়ে নিরাপদ স্থানে যায়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে এবং ব্যক্তিমালিকানায় বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। স্কুল মাঠ ও হাটে-বাজারে রুটি বানিয়ে বিতরণ করা হয়।   

কেউ কেউ যমুনার চর ছেড়ে শেরপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পাড়ি জমায়। কিন্তু আজিরন স্বামীর ভিটা ছেড়ে যেতে পারে না। জন্মস্থানের মায়া তাকে অন্যত্র যেতে বাঁধা দেয়। আটকে রাখে মায়ার শিকল পরিয়ে। এরই মধ্যে তার ঘরে এসেছে আরও দুই ছেলে সন্তান। সংসারে তারা এখন পাঁচ জন। আয়ের লোক বাড়েনি। আগের মতোই বছিরের দু’হাতের আয়। তেমন কোনো উন্নতি বছির উদ্দিন করতে পারেনি। কোনোমতে সংসারের অন্ন জোগাড় করতেই দিন পার হয়ে সন্ধ্যা নামে। তার জীবনে আলো ফোটে না। একটু একটু অন্ধকারে ডোবে। বিড়ি টানে আর বছির ভাবে কী করবে? বন্যার পানিতে সব তলিয়ে যাওয়া তার কাজকাম বন্ধ। খাবার জোটে না। প্রতিদিন লঙ্গরখানায় যায় শুকনা রুটির আশায়। বাড়িতে তিন ছেলে আর স্ত্রী বসে থাকে তার ফেরার অপেক্ষায়। বছির রুটি নিয়ে ফিরলে সে কী আনন্দ ঘরে। তিন ছেলে ছুটে আসে। জড়িয়ে ধরে বাবাকে। আজিরন দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের কোণে। দেখে ছেলেদের আনন্দ। আবার কষ্টে বুক ভাসে তার। কবে এইবান থেকে মুক্তি মিলবে। যমুনার জল হারিয়ে যাবে। তারা ফিরতে পারবে সেই জীবনে। এরপর তিন ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে রুটি খেতে বসে আজিরন।

একসময় শেষ হয় যমুনার তাণ্ডব। কমতে শুরু করে পানি। ডুবে যাওয়া চর, বাড়িঘর মাথা তুলে দাঁড়ায়। যারা চর ছেড়ে দূরে আশ্রয় নিয়েছিল বাড়ি ফিরতে শুরু করছে তারা। সব হারানো মানুষের চোখে নতুন স্বপ্ন। আবার সংসার সাজাবে। ফসল ফলাবে। বন্যার পানি নামতেই দেখা দেয় নানা রোগ। যা মহামারির রূপ ধারণ করে। জ্বর, আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, কলেরাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয় চরের মানুষ। বন্যা কেবল বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়ে যায় তা নয়, রেখে যায় নানা জীবাণু, পরবর্তীতে যা মানুষের দেহে প্রবেশ করে নানা রোগের বিস্তার ঘটায়। যমুনার চরাঞ্চলের মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে দিশেহারা। একে তো যমুনা তাদের সব ভাসিয়ে নিয়েছে। কারো কারো বাড়িঘর জমি-জিরাত গিলে খেয়েছে। গরিবদের আরও বেশি গরিব করে দিয়ে গেছে। তার ওপর এমন রোগ-জীবাণুর বিস্তারে তারা একেবারেই কাবু হয়ে পড়ে। কোথায় যাবে চিকিৎসার জন্য। কোথায় পাবে টাকা। এ যেন মরার ওপর খাড়ার গা।

চার বছরে তিন সন্তান জন্ম দিয়েছে আজিরন। দীর্ঘদিন বন্যার জলে আটকে থাকা জীবনে অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ায় তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিয়েছে। অন্যদিকে তিন সন্তানের ভরণপোষণ ও পরিবারের খরচ যোগাতে দিনে কামলা খাটার পরেও রাতে বাড়তি রোজগারের জন্য চেয়ারম্যান বাড়িতে রিলিফের গমের বস্তা নামায় বছির। অভাব তাদের জীবন এতটাই গ্রাস করেছে যে এসব করে দূর করতে পারে না। স্বামীকে সাহায্য করার জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে অন্যের বাড়িতে ঢেঁকিতে ধান ভানে আজিরন। সেখান থেকে কিছু চাউল পায়। ছেলেদের সামনে খাবার দেয়। বছির নিষেধ করে এসব করতে। শোনে না আজিরন। জোর দিয়ে বলতেও পারে না বছির। কী করবে সে তো পারে না ছেলেদের আর স্ত্রী খাবার জোটাতে।

আজিরনের শরীরের অবস্থা দেখে হাফিজা বেগমের চোখে জল এসে যায়। এই শরীর নিয়ে ঢেকিতে পাড় দেয়। শ্বাস টেনে তুলতে পারে না আজিরন। মাঝেমধ্যে দু-এক সের চাল দিয়ে সাহায্য করেন  তিনি। তারও যে খুব বেশি আছে এমন না। তবু আজিরনের জন্য কষ্ট হয়। একদিন আজিরনকে ডেকে বললেন, ‘হোন আজিরন, তোর সংসারে যা অবস্থা তাতে ঢেঁকিতে কয়দিন ধান ভাঙবি! তাছাড়া তোর শরীলডা ভালা না। এভাবে খাইটতে থাইকলে মইরা যাইবি। তাই বলি কী, দাম ধইরা একডা গরু আন। হেইডা পাল। দেখবি তোর সংসারের অভাব থাকবে না, চালানও অইবে। বাড়ির আলান-পালানও নাই যে কয়কৃষি হরবি।’

হাফিজা বেগম জহর মণ্ডলের স্ত্রী। বছিরের দূর সম্পর্কের খালা। জহর মণ্ডল চরে কোমকে নিহত হয়। এ অঞ্চলে নতুন চর উঠলেই আরেক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক আদিম নেশায় মেতে ওঠে চরের মানুষ। দখলদার ক্ষমতাপিপাসু অত্যাচারী মোড়লরা জমি দখল নিয়ে শুরু করে লাঠালাঠি, মারামারি (যাকে স্থানীয় ভাষায় কোমক বলে)। রাতভর বাঁশের লাঠি বানানো, হলংগা, ফলা, জুইতা, ট্যাঁটা, রামদা সংগ্রহ নিয়ে ছেলেরা ব্যস্ত থাকে। মেয়েরা মরিচের গুঁড়া বানায়। নির্দিষ্ট দিনে দুই পক্ষের সামনাসামনি উপস্থিতিতে শুরু হয় কোমক। বড়ো এবং মাঝারি বয়সীরা লাঠি, হলংগা, ফালা নেয় আর ছোটরা নেয় চেংগা। মেয়েরা বাতাসের উজান থেকে মরিচের গুঁড়া ছিটানোর জন্য সুবিধাজনক স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। সরদার বা উভয় পক্ষের মোড়লদের মুখে ধ্বনি বোল আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কোমক। যারা জয়ী হয় তারা সাময়িক মিছিল করে। সেই কোমকের অভিশপ্ত থাবায় কেউ কেউ মারা যায়; কেউ পঙ্গু হয়ে অভিশপ্ত জীবনযাপন করে। কেউ প্রতিপক্ষের মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়।

হিজলডাঙ্গা চরের সব সম্পত্তি জহর মণ্ডলের হওয়া সত্ত্বেও চর দখল নিয়ে মন্টু মাতব্বরের সাথে কোমক হয়। সেই কোমকে জহর মণ্ডল মারা যায়। মণ্ডলের একমাত্র ছেলে হারুন মন্টুর ছোট ভাই শিহাবকে ফলাবিদ্ধ করে বাড়িতে নিয়ে আসে। সবার সেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে মন্টু মাতব্বরের কাছে হস্তান্তর করে। মন্টু মাতব্বর মোকদ্দমায় জেতার জন্য আপন ভাইয়ের ক্ষতস্থানের সেলাই কেটে মেরে ফেলে। সেই মামলায় হাফিজা বেগমের একমাত্র ছেলে হারুনের যাবজ্জীবন জেল হয়। সেই থেকে হাফিজা বেগম ছেলের প্রতীক্ষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও পরোপকার করে নিজের অন্তরের ক্ষত ভুলে থাকেন। জমিজমা বর্গা দিয়ে যা পান তা দিয়েই সংসার চলে যায়।

হাফিজা বেগমের দেয়া প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবতে থাকে আজিরন। খালা ঠিকই বলছে। আজিবার এখন বড়ো হইছে। গরু পালক আনলে আজিবার ঘাস কেটে খাওয়াতে পারবে। তাদের অভাব আস্তে আস্তে দূর হইবে। শান্তি আসবে সংসারে। ক্ষুধা  ঘর ছেড়ে পালাবে। ভাত খাবে পেট ভরে। বিষয়টা ভাবতে ভাবতে সে মনস্থির করে রাতে ঘুমাবার আগে আজিবারের বাপকে জানাবে। এমন হলে খারাপ হয় না। আজিরন সেদিনের মতো কাজ সেরে বাড়ির পথ ধরে। নিস্তব্ধ রাত। ছেলেরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজিরন বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে স্বামীর পাশে শোয়। কোনোরকম ভণিতা না করে গরু পালক আনার বিষয়টি স্বামী বছিরকে জানায়। একথাও বলে একদিন তাদেরও একটা গরু হইবে। ছেলেরা বড়ো হইছে। পালতে পারবে।

 আজিরনের কথা শুনে বছির চমকে উঠে বলে, ‘কথাডা মন্দ কও নাই তুমি। তয় আমরা তো গরিব মানু, চাষবাস করবার জমিজমা নাই, খড় নাই, গরু পালক আইনলে তো ঘাস-খড় খাইবার দিতে অইবো। ক্যামনে কী করুম?’ কী খাওয়াবা? নিজেদের খাবারই তো জোটাইতে পারি না।
কিছুকক্ষণ চুপ থাকে আজিরন। তারপর বলে, ‘হোনেন আজিবারের বাপ, দরকার অইলে আমি ঘাস তুলুম। আপনার চিন্তা করতে হইবে না। হ্যারপরও গরু পালক আনমু। এতে যা-ই হউক। গরু আনমুই একটা। আমাগো অভাব থাকবে না।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বছির। ‘এমনিই তোমার শরীলডা ভালা না; হ্যারপর মাইনসের ধান ভাঙো, কেঁথা সিলাই করো, জুতমতো দুই বেলা খাইবার পাও না, পোলাডারে দুধ খাওয়াতে অয়। গরু পাইলবা ক্যামনে? আমার তো মাথায় কিছু আসে না। বুঝতাছি না তুমি কেমনে কী করবা!’

এরপর আজিরন কোনো কথার উত্তর দেয় না। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করে কী করবে। এক সময় মনে হয় যত কষ্টই হোক সে গরু আনবে। বাড়তি আয়ের আর যে কোনো পথ নাই। এভাবে চললে কোনো দিনও সংসারে একটু আলো পড়বে না। দুটো পয়সার মুখ দেখতে পারবে না। গরু পালক আনলে কোনো একদিন তাদেরও একটা গরু হবে। বাড়তে থাকবে গরু। তিনটা গরু হলে তিন ছেলেকে দেবে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আজিরন। রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই বছির পাচুন-কাস্তে নিয়ে কামলা দিতে যায়। ছেলেদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করে  আজিবারকে নিয়ে মন্টু মাতব্বরের বাড়ি যায় আজিরন। গরু পালক নেয়ার কথা বলে। মণ্টু মাতব্বরও রাজি হন। আজিরনকে গরু পালক দেবেন। খুশিমনে গরু পালক নিয়ে আসে আজিরন। অভাব দূর করার একটা রাস্তা আবিষ্কার হওয়ার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চরজুড়ে। আজিবর গরুর দড়ি নিয়ে সামনে হাঁটছে। পেছনে আজিরন। পথে পথে কয়েকজনে জিজ্ঞেস করল, গরু কই পাইছে?

আজিরন বলল, পালক আনছে।

বাড়ি ফিরে ঘরের পাশে আমগাছের সাথে গরু বাঁধে। আজিবর খাবার এনে দেয়। গরুকে আদর করে। কিছুক্ষণ পরে আজিরন গেল ঘাস কাটতে। ঘাস এনে দিল গরুর সামনে।  সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বছির উদ্দিন দেখতে পায় একটি বাছুর। বুঝতে পারে পালক আনছে আজিরন। কিছুটা খুশি হয়। যাক, আনছে যখন ভালোই হয়েছে। সবাই মিলে পালবে। আজিরনের স্বপ্ন পূরণ হবে। একদিন তাদের যাদি একটা গরু হয়। প্রতিদিনই কামলা দিতে যাবার সময় পাচুন-কাস্তের সাথে একটা বস্তা নিয়ে যায় বছির। রাতে বস্তাভর্তি নিড়ানি দেয়া ঘাস নিয়ে আসে। অন্যদিকে আজিরনও সন্তান লালনের পাশাপাশি ঘাস কাটে বাছুরটির জন্য। খৈল, ভুষি, পানতা ভাত খাইয়ে সন্তান স্নেহে পালক নেয়া গরুটিকে বড়ো করে তুলতে থাকে।

Series Navigation<< উপন্যাস─ আজিরন বেওয়া। রাশেদ রেহমান ─ পর্ব দুই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *