উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস─ পর্ব চার
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব দুই
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব তিন
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব তিন
- উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস─ পর্ব চার
৪
মতি মিয়ার ঘটনার পর রজবকে ঘন ঘন খবর দেয় চন্দ্রভানু, কি-না, অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে কাল রাতে, অনেক সাপ, অনেক পদের সাপ, সবচেয়ে বিষহীন সাপটার সাথে তাকে সই পাতাতে হইছে, এই সই কি সে রাখবে, নাকি বাদ দিবে! আর নদীর পানি সাদা, দুধের নাহাল। রজব বসে থাকে উঠানে আর চন্দ্রভানু বারান্দার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে। কচি কচি আম বাতাসে দোলে, সকালবেলার বাতাস বড়ো আকুল করা বাতাস। এই বাতাসে বিলের পানি বাড়ে, নদী উপচে পানি ছোঁয় উঠান আর নামার ধঞ্চে গাছ পানির নিচে তলিয়ে যেতে যেতে মাথা আগলে রাখতে চায়।
রজবের মাথার টুপি খুলে পড়ে, ফুঁ দিয়ে টুপি পড়তে পড়তে কতগুলি ঘটনা ঘটতে দেখে সে অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ায়, মাথা নিচু করে বলে, বিষুদবার গজারিয়া গেলে একটা খোয়াবনামা আইনা দিমু।
অল্পক্ষণেই একটা আধলি এসে পড়ে রজবের পায়ের কাছে তখন আবার কতগুলো ঘটনা একে একে ঘটতে দেখে রজব আগেরটার সাথে এটাকে জোড়া দিয়ে একটা কাহিনী দাঁড় করায়, চমকে উঠে ভাবে এসব কি সে কারো কাছে আগে শুনেছে! নাকি নতুন! উঠান ছাড়তে ছাড়তে সে কি মনে করে আরেকবার চন্দ্রভানুর দিকে ফিরে তাকায়। চন্দ্রভানু মামির পরনে লাল মসলিনের শাড়ি, ক্রমশ শাড়িহীন নগ্নতা ওর চোখকে অন্ধ করে দেয় আর কাছেই কুদ্দুস কি বলে যেন বিলাপ করছে, কানে আসে — ওলে আমাল চন্দ্ররে আইনা দে… চন্দ্র কই গেলো লে… চন্দ্ররে ছাড়া আমি বাঁচুম না …
ওমর সরকারের তখন নতুন সরকারি, জমজমাট। দলবল নিয় খাজনা তোলে, জমিদারের কোষাগারে জমা পড়ে কিছু, কিছু সরকারের শোয়ার ঘরের মেঝের নিচে পিতলের কলসে, সপ্তাহে অন্তত একরাত সরকারের বউ আমেনা আর সরকারের বোন হাওয়া, যে কি-না মাস্টারের স্ত্রী, তেঁতুল আর নারিকেলের ছোবা নিয়ে মাজতে বসে টাকা, সারারাত মাজে, মোছে, শুকায়। তারপর আবার কলস ভরে মাটির নিচে গেড়ে রাখে। পুরো কাজটা করার সময় সরকার দোনলা একটা বন্দুক হাতে বসে থাকে কাচারি ঘরে।
সেই সময়, কুদ্দুসের বিয়ের বছর পাঁচেক পর, এখন থেকে আড়াই বছর পূর্বে। প্রতি বছরের মত ভরা বর্ষায় দক্ষিণধারের ঘাটে ভিড়ে সদ্য রঙ কর ঝকঝকে পিনিস।
আড়ালে কথা তো হয়ই — ঢেবনায় কাম না করলে কি ফুর্তির বেলায় হোলয়ানা!
তারপর পিনিসে ওঠে বাক্সপেটরা খাবারদাবার রাধুনি, চালডালনুনতেল, লাকড়ি আর পাহাড়াদার হিসাবে হাবা।
আর বাধাটা দেবে কে, চন্দ্রভানুর উত্তল অচঞ্চল চোখজোড়াই এমন যে চোখের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ি পর্যন্ত থেমে যায়। শুধু চোখই বা কেন, শ্যামলা গায়ের রঙ বটে কিন্তু আশ্চর্য উজ্জ্বল; কোমল আর কঠোরে মেশানো লাবন্য নিয়ে এমন এক মাধুরী যে সমীহ না করে পারা যায় না।
পাছা পর্যন্ত সর্পবৎ বেনুনি দুলিয়ে হাঁটার সময় মাথার তেলের মদির ঘ্রাণ বেভুলা করলেও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে কার সাহস! কি নাক, ঠোঁট চিবুক, ভরাট বক্ষ আর পাছা। রসিক বৃদ্ধও বুঝি এক ঝলক দেখেই বলে ফেলবে আহ্রে, কি ঢক্! কুদ্দুসে বউডা পাইছে বাক্কা! তারপর পিনিস এসে ভীরে সদরঘাটে। প্রতিদিন গ্রাম্য পাচকের হাতে একেই স্বাদের খাবার খেয়ে যখন বিরক্ত তখন মনে আসে সীতারাম মিষ্টান্ন ভান্ডার কি বৈকুন্ঠের দৈ কিংবা মালাইর কথা। আর রূপমহলে হান্টারওয়ালিকা বেটির পর বোস কেবিনে চিংড়ি মাছের কাটলেট, গাঢ় বাদামি কাটলেটের উপর দু’ফোঁটা লেবুর রস! আর শনিবারটা সামনে নিয়েই আসে, বিবিকে পিনিসে রেখে ছোটে রমনার ঘোড়া দৌড়ের পান্টার হতে। ঘোড়দৌড়ের খবরাখবর দেয় সদরঘাটের কুলি সর্দার রকমত। আর সব জুয়াড়িদের মত কুদ্দুসকেও রেসের আগে নিয়ে যায় রমনার কালীবাড়ির ‘মা আনন্দময়ী’র কাছে। কুদ্দুসের হয়ে রকমতই ভক্তি ভরে বলবে, হেই মা কালী, জোড়া পাঠা বলি দিমু মা, এই বার যদি জিতায় দাও। গড় হয়ে কি করে প্রণাম করতে হয় তাও শেখায় রকমত।
আর ল্যাবড়া হেবলা কি ঢেমনা যাই বলুক রকমত কুদ্দুসকে, টিকেট কিন্তু কখনো সর্দারের হাতে ছাড়ত না। সর্দারের কাজ রেসের ঘোড়াটা পছন্দ করা আর রেস শুরু হলে প্রতি ফার্লং পর পর তার ঘোড়ার অবস্থান সম্ভবনার কথা বলে উত্তেজিত করা।
আর একদিন, পর পর ৬/৭ দান খেলে ফতুর হওয়ার পর খড়খড়ি তোলা ঘোড়ার গাড়িতে নিয়ে যায় কুমোরটোলা। সেই একবারই, বেচারা কুদ্দুসকে উত্তেজিত করে করেও যখন দ্যাখে লিঙ্গ তার কাঁচামরিচের অবয়ব তখন হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায় রুপনারীর। অপমানের একশেষ, ধার্য টাকাটা দিয়ে কোন রকম পালিয়ে আসা। কী লোভ দেখিয়েছিল রকমত, তা কি ভুলে গেছে! — গেলেই হালায় বুঝবেন, আপনের জিনিস কৈথন গর্জায় বাইরায় আইবো, হালায় মালুমই করতে পারবেন না!
আর তার দুদিন পরেই ঘটে ঘটনা। রূপমহলে রাজকাপুরের সিনেমা দেখতে গিয়েছিল চন্দ্রভানুকে নিয়ে। সন্ধ্যার শো ভাঙতে ভাঙতে রাত একটু হয়। আর ভাড়া করা ঘোড়ার গাড়িও দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্যই। কিন্তু তার আগেই চন্দ্রভানুকে তুলে নিয়ে টমটম দ্রুতগতিতে ছুটে যায়। চন্দ্রভানু চিৎকার দিয়ার সুযোগ পেয়েছিল কিনা জানে না কুদ্দুস। কিন্তু গ্রামবাসী যতটা না এ ঘটনায় বিনোদিত হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশী আহাম্মক হয়ে গিয়েছির কুদ্দুসের ‘আমাল বউ আইনা দাও, আমাল বউ ছাড়া আমি বাঁচুম না’ আর্তচিৎকারে। আহার নিদ্রা ছেড়ে দেয়া ছেলের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় ওমর সরকার। নিজে আসে সদরঘাট কুলি সর্দারের কাছে, বিশদ বুঝিয়ে বললে সাতদিন পর ফিরিয়ে দিয়ে যায় পিনিসে। দৃশ্যমান ক্ষতির মধ্যে মাথার চুল বব। আর যে দু’একজন নিকট আত্মীয় চন্দ্রভানুকে দেখার সুযোগ পেয়েছিল তারা আবিষ্কার করে চুল কাটা চন্দ্রর চেহারা আরো জৌলুসপূর্ণ আরো ডক্ বাক্কা হইছে। আর যারা বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢোকার অনুমতি পায় না, পায় না বলে পাওয়ার অধিকার নাই বলে মনে করে না, তারা দক্ষিণধারে এসে উঁকিঝুকি মারে, মেরে দেখতে না পেয়ে, কি আর এমন দেখার আছে ভাব নিয়ে চলে যায়। অথচ পরদিন দেখার ষোলয়ানা ভরসা। আর গল্প বানায় অদ্ভুত। গল্পের অলংকার দিতে যাকে পায় তাকেই ধরে, হুনছোছনি কতাডা…। ধোপার বউ কাপড়ের গাট্টি ঘাড়ে ফেলে কেবল ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্য দুপুর। গোসল ঘাটে বসে বসে পা মাজার অফুরান সময় হাতে — কি গো, কাগো কাফড়? জানা প্রশ্নের উত্তর তবুও প্রশ্ন। কোন অজানা অচেনা ডিঙ্গি পেলে এখনি হাঁটুর উপরে শাড়ি তুলে লাফিয়ে উঠতো, তোর কাপড়ের খ্যাতা পুড়ি বলে। কিন্তু বাহন নাই, ভাঙ্গাচুড়া বাঁশের সাঁকোই এ গাঁয়ের মানুষের উপর ধোপিনীর রাগের কারণ। গত মাসে গঁট্টি ঘাড়ে সাঁকোর ভাঙায় পা দিয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। কাপড় কার জানা সত্ত্বেও তাকে আগলে ধরে কাজিদের বা মিয়াদের বউঝিরা— কী গো কাফড় কাগো?
— সরকার গো।
— খবর কী হেগো?
ধোপাবউ সবই জানে, তবু না জানার ভান করে সব শুনে নিতে চায়, কিয়ের কথা কও?
— কী গো , কিছুই হনো নাই! তাইলে থাক বাড়ি গিয়া কাফড় ধোও!
— মিছা কমু না, হুনছি ভাসা ভাসা, ভিত্রের খবর পামু কই!
— আগো, হেয় না আরাইয়া গেছিল্ ঢাহায় গিয়া, হাইয়েরা না লইয়া গেছিল্।
পায়ের ফাটা ঘষা ধুন্দুলের ছোবা ফেলে উঠে আসে ছাড়াবাড়ির মল্লম মাঝির মেয়ে— আগো ভাউরা কুদ্দুসের কান্দনে তো বাড়িত থাহা দায় অইছিল!
ধোপার বউ কাপড়ের গাট্টি কাঁধ বদল করে; পানের দলা এ গাল থেকে অন্য গাল। সূর্য তখন বড়ো বেশী নির্দয়। ছাড়াবাড়ির বাটুলগাছের যে ঝোপড়া ডালটা নুয়ে পড়েছে ঘাটের দিকে, এরা কথা বলতে বলতে অজান্তেই রোদ ছেড়ে এসে দাঁড়ায় তার তলে।
— চন্দ্র বেগমরে কেমন দেকলা? চুল বলে কাইট্যা বেল কইরা দিছে!
ধোপিনী পান চিবায় আয়েশ করে, একটু আগের তাড়াহুড়া আর নাই। পানের রস ঠোঁটের দুই পাশের ফাঁকে খানেক ঢোকে খানেক গড়ায়।
— পান দিলো কে গো?
— ক্যা আমার পান আমি খাই!
— কও না ক্যামন দেখলা!
— সোন্দর, হেয় তো হগল সময়ই সোন্দর, তোমগো গ্রামে এমন নাই একজনও।
— আগো এহন ক্যামন দেখলা!
— ভালা কাফড় পিন্দা উডানে নামলো গুয়ামুড়ি রইদ দিতে।
— নিজে রইদ দিলো?
— না, কাবান্নিই রইদ দিলো, হেয় খাড়াইয়া দেখলো কেমনে রইদ দেয়।
— আর কী দেকলা?
ধোপানী এবার হাঁপিয়ে ওঠে। ক্ষুধাই হবে হয়তো, হঠাৎ মেজাজ খারাপ করে চিৎকার করে বলে ওঠে — কী দেহার কতা কও? হের কাফড় তুইল্যা দেখতাম কয়ডা বাল ছিড়া নিলো হের হাইয়েরা?
ভালই তো চলছিল হঠাৎ কী হলো এমন বুঝতে না পেরে সবাই বোকার মত চেয়ে থাকলেও মাস্টারবাড়ির কাজের লোক হতি, বাড়ি যার পূবকান্দি, ধোপানীর বাড়ির কাছে, সে এসেছিল কাইলমোশলে ছেঁচা কাঁচামরিচ ধুয়ে বিচি বের করে দিতে। এখনি ধুতে পারছে না পানিতে মরিচের ঝাঁঝ লেগে গেল ওদের গোসল করতে কষ্ট হবে বলে। এবার সে ঝাঁঝুরি ফেলে উঠে আসে কাছে, মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, তোমার মোখটা তো দেহি পাশ করা! আর একটা কতাও না কইয়া এহনি হাঁতরাইয়া খাল পাড় হইবা!
ধোপানী বেঁকে বসে — তোর কতানি লো মাগি! খালডা কী তোর বাহে লেইখ্যা নিছে জমিদারের কাছ থেইক্যা!
— তুমি এনো খাড়াইয়া যাতা কইয়া যাইবা আর ভদ্রলোকের ঝিয়েরা খাড়াইয়া হুইন্যা যাইবো, ক্যামনে ভাবলা?
তারপর ঝড়ের বেগে চলে খিস্তিখেউর — আগো শুয়ারনি, আগো লউ খাওয়াইন্যা, আগো হতিনের গরে হতিন, নডির গরে নডি, বাইশুকি গরে বাইশুকি, হাঙ্গালনি মাগি…
তারপর ঝাঁঝাঁ রোদ আর চুলাচুলি, আপাততঃ চন্দ্রভানুর খোঁজের খ্যাতাপুড়ি, গোসলে নেমে কারো মুখে কথা নাই, চুপচাপ ডুব দেয়।
বিকালে যথারীতি কত কথা হয়, কথা তো হয়ই, সঙ্গে কেঁপে কেঁপে শিউড়ে ওঠা বলাৎকারের কামাতুর কল্পনার পুরু প্রলেপ। পিনিসে বসে রং আলতায় রাঙানো মুখ, ফিনফিনে মসলিনে, সাতনরিহার কঙ্কণ বাজু মাকড়ি বিছায় দেখনেওয়ালা এক যুবতী যাচ্ছে বায়োস্কোপ দেখতে। আর চলনে কী যে ছিনালী! উপসংহার ঐ একই, ওরে ধরবো না তো কি ধোপানী গুইলডারে ধরবো! আর বড়োলোকের কারবারই আলাদা, দু’একজন আবার বলেই বসে, ‘বড়োর বড়ো গুণ, হুইয়া ঘাস খাইতে পারে’। আর পেটে বাচ্চা এসে গেলে কিভাবে সামলাবে সে প্রশ্নও করতে করতে আর আব্রুর লেশমাত্র থাকে না।
সন্তান হওয়ানোর ব্যাপারি হাডিলার মাওলানা অবশ্য বিয়ের দু’বছর পর বলে গেছেন চন্দ্রভানুর সন্তান হতে বছর পাঁচেক সময় নিবে। যদিও নেংটা ফকির দক্ষিণধার দিয়ে যেতে যেতে বলে যায় আরে বাচ্চা দিয়া তুই কি করবি, তার চাইতে তুই কুদ্দুস পোলাডারে একটু মানুষ কর। জবরদস্তি ধরে এনেছিল বলার জন্য, বলেছে নেংটা একদম মনেরই কথা! বাংলাঘরে নিয়ে লেংটাকে চেয়ারে বসানোর জন্য ওমর সরকারের লোক ধ্বস্তাধস্তি করেও বসাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলে লেংটা ব্যাঙের মত লাফ মেরে মেঝেতে এসে উবু হয়ে বসে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে, যেন সে কিছুই জানে না!
— বিষয় কী? লেংটার চোখে বিস্ময়।
ঘরের মানুষ সব প্রস্থান করলে আমেনাবিবি চন্দ্রভানু আর কুদ্দুসকে নিয়ে ঢোকে। ঘোমটার আড়াল থেকে আমেনার প্রার্থনা, এগো একটু দোয়া পইড়া দিয়া যান, যেন সংসারে পোলাপাইন আইয়ে।
এবার উবু হয়ে বসা লেংটা এক লাফে গিয়ে উঠানে পড়ে, বিস্ময় নিয়ে হাতের কব্জিটা বাতাসে ফাৎফাৎ করে ঘুরায় তারপর দক্ষিণধার ধরে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপরও উপায় চাইতে আমেনাবিবি লোক পাঠালে জানিয়ে দিয়েছে — এসব হওয়া না হওয়া আল্লাহর ইচ্ছা, খোদার উপর খোদকারী গুণাহ্, তবে হওয়ার কোন গন্ধ পাই না গো মিয়া! এ সবই সদরঘাটের কাহিনীর আগে।
সদরঘাট থেকে ফেরার পর গ্রামবাসীর ফিসফাস বন্ধ হয় না যুগের পর যুগ কিন্তু কমে আসতে সময় নেয় মাত্র মাস খানেক। আর তখন থেকে শুরু হয় আমেনাবিবির গভীর উৎকন্ঠা। সে এখন নানা ছুতায় চন্দ্রভানুর স্নানঘরে উঁকি দেয়। ঘরে ঢোকা পছন্দ করে না বলে বারান্দায় দাঁড়ায়, বারান্দা সংলগ্ন চন্দ্রভানুর স্নানঘরের পাশে একান্ত নিজস্ব খুঁপড়িঘরেই মূলত চোখ রাখে; প্রতিমাসে ৬/৭দিন এখানেই ঝোলে মাসিকের কাপড়। আমেনাবিবির পর্যবেক্ষণ চলে সকলের অগোচরে এমন কি কাবান্নিরও। উৎকন্ঠায় সে রাতবিরাতে টাকা মাজা ছেড়ে দেয় আর দেড় মাসের মধ্যেও যখন উদ্দিষ্ট বস্তুটি খুঁজে পেল না তখন নিজের খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে সারাদিন পান চিবায়। মনের দুঃখে একা ঘরে কপাল চাপড়ায়, আল্লামাবুদের দরবারে ফরিয়াদ জানায়। নিজের মতো এমন ভাগ্যহীন সে আর কাউকে মনে করে না। সকালে দুপুরে সন্ধ্যায় কতবার যে সে উদ্দিষ্ট বস্তুটার খোঁজ করে! পাকানো দড়ির উপর ঝুলতে থাকা সামান্য লালসালু কাপড়ের ন্যাকড়ার এত মূল্য হয় কখনও তা কে জানতো! ক্রমে আমেনাবিবি মাথা খারাপের মতো কাজকারবার শুরু করলে বাড়ির লোক ঘাবড়ে যায়। সারা রাতদিন জায়নামাজে পড়ে থাকে আর কখনো কখনো কী যেন বিড়বিড় ক’রে এ মটকা ও মটকা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলে, একটা চিজ হারাইয়া লাইছি, খুঁজি। রাতে ঘুম আসে না বলে রসিঘরে বসে যাতিতে মুগডাল ভাঙে। এতগুলো কাজের লোকের ঘরে কেন সে একা এ কাজ করে কেউ জানতে চাইলে নিশ্চুপ থাকে আর এভাবে সে তিন মন সোনামুগ ভেজে ভাঙিয়ে কলস ভরে সাজিয়ে রাখে। যে চন্দ্রভানুর প্রতি ছিল সমীহ এখন তাকে দেখলে অবিমিশ্র বমি অনুভব করে আর বিড়বিড় করে, হায় আল্লা এহন আমার কী করা উচিত!
অপেক্ষা চলে আরো সাতদিন, মানে আমেনাবিবি আরো সাতদিন হাবিয়া দোজখে জীবন চালায় আর চন্দ্রভানুর বিকারহীন জীবনযাপন বিশেষতঃ পোয়াতিদের মত এটা ওটা চিবাতে দেখে সে কেবল নিজের মৃত্যু কামনা করে।
বহু বছরের বিশ্বস্ত ভৃত্য হাবা আর কাবান্নিকে ভরসা করে পাঠায় গৌড়িপুরা। হামদু কবিরাজের হাতে বানানো বড়ো বোতলে এক প্রকার ভেষজ আসে ওদের হাতে। অব্যর্থ এই ঔষধের ফলাফল ক্রমাগত রক্তপাত। ‘সামান্য ভাইটামিন খাও, গায়ে বল হইবো’ এই কথায় সে ঔষধ সেবন করে, ওসুধে যে এমন হবে তা কে জানতো! শরীর এমন কিছু খারাপ ছিল না। একটু গা বমি বমি করলে কাবান্নির তেঁতুল আর পান খাওয়া পরামর্শে সে তো ভালই ছিল। চন্দ্রর অসুস্থতা যখন চরম তখনি খবর আসে চন্দ্রভানুর পিতার সর্পদংশনে মৃত্যুর। চন্দ্রভানু বুঝতে পারে না সংসারে এসব কী হচ্ছে! মৃত পিতার মুখটুকুও দেখতে না পারাকে আমেনাবিবি অবশ্য মনে মনে পাপমোচন বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে, সর্পদংশনে মৃত্যু হলেও আসলে তো তার মৃত্যু হয়নি, গুণী কোন ওঝা দিয়ে ঝাঁড়ফুঁক করতে পারলে সে এখনও বেঁচে যেতে পারে। আর চন্দ্রভানুর কি বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী জানা নাই! নারী যদি সতী হয় তো সর্পদংশন করলেও স্ত্রীর সতীত্ত্বের গুণে স্বামী বেঁচে যায়। আর সর্প বিষয়টা যে সত্যি খুব সাংঘাতিক শাশুড়ি তা নানাভাবে বর্ণনা করতে থাকলে মনে মনে ঠিক করে সুস্থ হলে পূবকান্দির যে লোকটা বহুবছর সর্পবিষয়ে দীক্ষা নিয়ে এসেছে একদিন তাকে বাড়িতে ডাকাবে।
কিন্তু অল্পদিনেই কাবান্নির মারফত চন্দ্রভানু শাশুড়ির ষড়যন্ত্র সব জেনে ফেললে প্রথমে জাগে ক্রোধ তারপর জাগে দ্রোহ আর তারও পর পাপবোধ বিদূরিত হয়ে এতকাল বঞ্চিত থাকার বেদনা ক্রমশঃ দুই শিংওয়ালা দৈত্যের মত কব্জা করে ফ্যালে ভূত-ভবিষ্যত। ঘৃণা ক্রমশঃ আমেনাবিবিকে কেন্দ্র করে কুদ্দুসের জন্যও ছড়িয়ে পড়ে। আর চন্দ্রভানুকে অবাক করার জন্য তার ভাসুর এমনকি ঢাকাই শাড়ির সঙ্গে আনে পালা মৌ ভ্রমন কাহিনী, আবদুল্লাহ, সোনালী ফসল নামক গ্রন্থ কিংবা শুকরছানার বেলুনে চরে বেড়ানো কাহিনী। আর কুদ্দুস, বরাবরের মত চন্দ্রভানুর অসাধারণ স্বাধীনতার অংশ হিসাবে পাশিং শো সিগারেটের প্যাকেটগুলি দেখিয়ে বলে, এইগুলি সিগ্রেট, শহলের মানুষ খায়, আপনেও খাইতে পালেন!
সেই যাত্রায় মাসব্যাপি তীব্র রক্তপাত আর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সে যে পরিমান সিগারেট আসক্ত হয় তারচেয়ে অনেক অনেক বেশী আসক্ত হয় আফিমের নেশায়।
তো রজব এখন গজারিয়া কি রসুলপুর থেকে বই এনে দিতে গিয়ে দ্যাখে সেখানে সাপ বিষয়ক অজস্র খোয়াব, কোন স্বপ্নটার কথা চন্দ্রমামী বলেছে তা মনে করতে পারে না। ওমর সরকারের উঠানে পা রেখে দ্যাখে উঠানে তুরফুলা খোঁজে কাবান্নির সাত বছর বয়সী ছেলে মধু আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। পায়খানার বদনা দিয়ে দক্ষিণধার থেকে বদনা বদনা পানি আনে আর গর্তে ঢালে। তারপর বেরিয়ে আসে পুষ্ট নধর তুরফুলা। তারপর সেটা নিয়ে ছোটে সোজা পশ্চিমে।
