উপন্যাস

উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব তিন

তিনের দুই

পশ্চিমকান্দি মসজিদের বড়ো হুজুরের খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি সপ্তাহ শেষে সুগন্ধি নিজ বাড়ি গেছেন। মতির কথা মনে আসে কিন্তু একে সে বয়সে ছেমড়া তদুপরি শত্রুপুত্র, তো রজবই শেষ ভরসা। এদিকে বহু বছর হওয়া সত্ত্বেও মমতাজের সাথে বাড়ির মুনিষের বিয়ে মেনে নেয়নি ছেলেরা, তারা এখনও বোনকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাপের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে প্রস্তুত, আরে গাঙ হুগাইলেও রেখ্ থাহে, বাবায় এইডা করল কী! ছেলেরা ছোটকাজির সাথে মামলা মোকদ্দমা এক সাথে চালানো ছাড়া যার যার মতে আলাদা, তো এই বিপদে ভরসা বদর, জামাই বরাবর মুনিষ। জামাই হয়েও মুনিষের চরিত্রটি না বদলালে কী, বিয়ের এক বছরের মধ্যে বউ বাচ্চা প্রসব করলে গভীর মনোযোগ দিয়ে বাচ্চার নাকচোখমুখ দ্যাখে। নিজেকে হন্যে হয়ে খোঁজার দৃশ্য মমতাজ দেখেও কোন বিকার দেখায় না বরং সুযোগ পেলে রসিকতা করতে ছাড়ে না, এত আদর করো ক্যা, পোলা তোমারনি? বদর বিষণœ হয়ে তাকালে মমতাজ আরো নিষ্ঠুর হয়ে বলে, বাড়ির কামলার পোলারেনি আমি বুকের দুধ খাওয়াইতাম! আর বছর ঘুরে আরেকটা ছেলে হলে চন্দ্রকাকিকে দ্বিতীয়টা দেয়ার প্রস্তাবও দেয় নিজে। কিন্তু স্বামীর বাধার মুখে তার সে ইচ্ছা সফল হয় না। বদরকে পাঠায় মিয়াবাড়ির জায়গির রজব আলীকে ডেকে পাঠাতে। রাস্তায় বেরিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারে না। জায়গির ছেলেটাকে তার পছন্দ, চেহারা যেমন নূরানি তেমনি স্বভাবও বড় মধুর। কিন্তু এ মুহূর্তে সে তার প্রতি সদয় হতে না পেরে গিয়ে ঢোকে দক্ষিণধারের ছিপটিলতায় ঘেরা পায়খানায়। বহুক্ষণ মশার আক্রমণ সহ্য করলেও সাবিহার স্বামীর প্রতি অন্যায় অবিচার করে রজবকে ডেকে আনতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। আরো কিছুক্ষণ পায়খানায় কাটিয়ে বাড়ি এসে শোনায় — রজবের জ্বর আইছে, ঘুমায়। বড়ো কাজি হুংকার দেয়, বাড়িত একটা মানুষ নাই একটা মানুষ ডাইক্যা আনতে পারে! ভাদুবিবি ভয়ে কাঁপলেও ছেলেরা আর পাত্তা দেয় না। বদর যথারীতি ছোটে আবার। আশ্চর্য ঘটনা, রজব সত্যি সত্যি জ্বর গায়ে সাবিহার মাথায় দীর্ঘ দীর্ঘ সূরা পড়ে ফুঁ দেয়, পানি পড়ে দেয় খাওয়ার জন্য। সাবিহার ক্রমাগত বলতে থাকা ‘হায় আল্লাহ তোর জামাই নাই, তোর জামাইরে খবর দে’ এক সময় ঠোঁটের জড়তায় হয়ে যায়Ñ জামাইরে দে, জামাইরে দে। তখন কী যে অবস্থা দাঁড়ায় পুরো পরিবারের! তারপর সূরা অন্তে ফুঁ পড়ে মাথায় আর শাস্তি নেমে আসে টিমটিম আলো জ্বলা অন্ধকার ঘরে। পানিপড়া খেতে দিলে শিশুর মত না বিড়ালের মত চুকচুক শব্দ করে খেয়ে এলিয়ে পড়ে প্রবল ঘুমের কোলে। আর তখনই ভাদুবিবি এগিয়ে গিয়ে বলতে চায় নারিকেলগাছের ডেগো ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু বলা লাগে না। রজব মুখ তুলে বলে, আর কোন ডর নাই, নাইকেল গাছের ডাউগ্যা আর ভাঙত না, সূরা পইড়া দিয়া গেলাম। রজবকে পৌঁছে দেয়ার দরকার ছিল না কিন্তু বড়ো কাজি জোর করে সঙ্গে দেয় বদরকে। এসব কাজ করার পর একলা চলা বিপজ্জনক। বদরের কি হয়, মনে হয় সাবিহার না, তারই ভূত ছাড়ানো হয়েছে, তারই বুকের ভিতরে হাত দিয়ে কলজেটা ছিঁড়ে ফালাফালা করা হয়েছে। হায় আল্লাহ গুমটি দেয়া গরমে পথে পথে কত সাপখোপ ওঁত পেতে থাকে, তার কোনটা কি রজবকে এখন দংশন করতে পারে না! অন্তত তার নিজেকে! যদি সাবিহার ভূতটা রাতে চলে গিয়ে না থাকে তাহলে কি রজব আবার এ বাড়িতে আসবে, এসে আবার সাবিহার মাথায় ফুঁ দিবে, সাবিহা চোখ খুলে দেখবে এক সুন্দর যুবা তার মুখের উপর উপুর হয়ে সুস্থ করার অছিলায় তাকে দেখছে! এত কিছু ঘটনার অনেক কিছুই মতির জানা নাই, শুধু শুনেছে রজব ঝাড়ফুক করেছে আর ডেগো ভেঙে না পড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

মতিকে দেখে রজবের মালিক জিজ্ঞাসা করে —  কিরে মতি, খবর কী, কার খোঁজে? — এই তো কাকা, একটু রজবদাদার খোঁজে, জিগাইতে আইলাম কাইলকানি যাইবো মাদ্রাসায়! হারুন মিয়া অবাক চোখে তাকায়, কাইল না রইববার, রইববারেও নি মাদ্রাসা খোলা থাহে তোগো!
মতির থতমত খাওয়া চোখে পড়ার আগেই হারুন মিয়া অন্দরের দিকে চলে যেতে যেতে বলে, ভিত্রে আয়, ডাইক্যা দেই।
আকাশে মেঘ ডাকে গুড়গুড়, ঠান্ডা বাতাসটা আগের মত নাই। কেমন ভ্যাপসা গরম।
মতি ইতস্তত করতে করতে ঢোকে বৈঠকখানায়। পঁয়ত্রিশের বন্দ বৈঠকখানাটা এতটাই বড়ো যে একপাশে বেড়ার আড়াল করে রজবের অনায়াস বসবাস দেয়া হয়েছে। মাগরেবের নামাজ শেষ করে বেরিয়ে এসে রজব দেখে মতি অপরাধী মুখ করে বসে আছে।
–কী খবর মতি মিয়া? নামাজ পড়বা!
— পড়–ম।
হঠাৎ বৃষ্টি এলে দু’জনই ঘটনার আকস্মিকতায় কোন রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অথচ দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল সবার মতো তাদেরও। টিনের চালের শব্দে কথা বন্ধ আর মাটি কেটে পানি বেরিয়ে যায় দক্ষিণধার ধরে। কিন্তু মাটি বেশী কেটে নিতে পারে না। যেমন হুড়মুড় করে এসেছিল চলেও গেলে তেমনি।

 — বাড়ি যাও মতি।
— ডাকছিলা কেন, কইলা না তো!
— যাও যাও, বাড়ি যাও।
— এহন কও!
— মঙ্গলবার যাইবা না ?
— যামু।
— হে দিন কমুনে।
হারুন মিয়া একটা কাসার বাটিতে দুইটা মিষ্টিআলু এনে সামনে রাখলে পরিবেশ পাল্টায় দ্রুত।
— খা, তোগো বাড়ি গেলে তোর মায় বড়ো ইজ্জত করে, আছেনি ভালা?
— ভালাই…
হারুন মিয়া খড়ম পায় ভেজা উঠানে নেমে গেলে রজব উঠে দাঁড়ায়, মোলায়াম স্বরে বলে, বাড়ি যাও মতি, আমি এশার নামাজ পইড়া ভাত খাইয়াই ঘুমামু, বাতি নিভ্যা যাইব, ত্যাল শেষ।

মতির উঠার ভাব নাই। ভ্যাপসা গরম ঘরের ভিতর, যেন রজবের তেলচিটে বিছানা দিয়েও সে গরম বেরুচ্ছে, সামান্য বৃষ্টির কুকীর্তি! কিছুক্ষণ এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে কী যেন খোঁজে তারপর ভাবে, আসলে কী? আপনে সাবিহারে সারাইছেন? নাইকেল গাছের ডাউগ্যা ভাঙ্গা থামাইছেন? আসলেই সাবিহারে ভূতে ধরছে? নাকি … নাকি সবডাই ছলাকলা…নাকি আলো অন্ধকারের খেলা…নাকি আপনে সাবিহারে দেখা দিতে গেছেন, নাকি আপনের জন্য সে দেওয়ানা হইছে, নাকি আপনে তারে অন্য কোন কথা বলতে গেছিলেন…

 মতি মাথা নত করে বসে থাকে যেন আর কোন কথাই বলে বা জিজ্ঞাসা করে লাভ নাই। যা হওয়ার তা হয়েই গেছে।
— বাড়ি যাও মতি, আমার অনেক কাম পইড়া রইছে!
রজব দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আর কী করে মতি, তাকে এবার যেতেই হবে। খোলা দরোজায় হঠাৎ শীতল একটা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগলে পশম খাড়া হয়ে ওঠে।
উঠান পেরুতে পেরুতে শোনে রজবের বড়ো ম্রিয়মান গলা, বেশী ডড়াইলে ফিরা আইসো, কাইল এক লগে জাল বাইতে যামু।

তারপর দরজার খিল ঢুকানো শব্দ, সুনসান নিরব অন্ধকার। অল্প বৃষ্টিতে যা হয়, কাদা পিছল, টিপে টিপে হাঁটতে গিয়েও কয়েকবার পড়তে পড়তে সামলে নেয়। তারপর একটা ভয় কি আতঙ্ক কুন্ডলী পাকাতে থাকে পেটের র্ভিতর। দক্ষিণধারের জামগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে বাড়ি যেতে কতটা সময় লাগবে, এত পিছল রাস্তা, সবটাই মাটির। মিয়াবাড়ি ছাড়ালে ওমর সরকারের সীমানা, তারপর মাস্টারবাড়ি, বড়ো কাজিবাড়ি ছাড়িয়ে ছাড়াবাড়ি তারপর খালের উপর নড়বড়ে পচাধ্বসা বাঁশের সাঁকো। সাঁকোর কথা মনে হতে এক অজানা আশংকা তাকে এতটুকু করে ফেলে। রাত তো তেমন নিশুতি না তবে এমন ভয় কেন লাগছে সেটাও সে ভেবে পায় না। রজব এখন আজান দিবে নাকি আজান না দিয়ে নামাজ পড়বে, তারপর খাবে তারপর কি সে ঘুমিয়ে গিয়ে সাবিহাকে দেখতে থাকবে! নাকি সাবিহাকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাবে! এক পশলা বৃষ্টি, ব্যাঙেদের ফুর্তি, কীটপতঙ্গের একটানা সুর আর তিরতির কাঁপতে থাকা জামের পাতা আর ঝরতে থাকা বান্দর লাঠিগাছের দু‘একটা হলুদ পাপড়ি ঝুরঝুর করে গায়ে পড়ে পানিসহ। একটা কুচকুচে কালো বিড়াল হঠাৎ সামনে সে পড়ে, কয়েক মুহূর্ত তারপর হাওয়া হয়ে যায় দ্রুত। ভয়টা গিলে নেয়, বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠলেও সামলে নেয়, সামান্য বিড়ালই তো। কিন্তু সরকারবাড়ির বাংলাঘরের পিড়ায় নাদুসনুদুস কুকুরটা, আক্রমণাত্মক আর সতর্ক চাহনি মতির শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা প্রবাহ নামিয়ে নিয়ে যায় ভয়ের শেষ প্রান্তে। আর একটা জোনাকি পোকা তখনই কিনা ভোগলামি করতে করতে এসে গোত্তা খায় কপালে!

 — ডেউয়া ধরছে! ডেউয়া ধরছে তোরে!

ঝিমঝিমে একটা মাথা নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আসলে কোথায় এখন দাঁড়িয়ে, তাকে কি ডেউয়া ধরছে! এত কম আলোয় আর কখনও চলতে হয়নি জীবনে। চাঁদের দেখা নাই, থাকলে একটা বিহিত করা যেত। আর একটা সাদা গরু একেবারে সামনে এসে পথ রুখে দাঁড়ালে সে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে হাত বাড়ায়। আর ভাবে সরকাররা কি মীর কাদিমের গরু কিনে আনল! মীর কাদিমের গরু সাদা তো! কত নামডাক, সাদা ছাড়া কি! নাকি এটা সেই গরুটা, যে কয়েকদিন আগে সাবিহার লাউয়ের মাচা সাবাড় করেছিল, তাও মাঝরাতে। কে দেখেছিল? সাবিহা নিজেই। পেসাব করতে যাচ্ছিল রসিঘরের পিছনের বেড়ায়, হায় আল্লাহ চেগ দিয়া খাড়ায়ছিল, এক ঠ্যাং ছাড়াবাড়ির বাঁশঝাড়ে আরেক ঠ্যাং সরকারগো বারমাসি তালগাছের মাথায়, পরক্ষণেই দেহি নাইম্যা আইয়া মুখ দিছে লাউয়ের মাচায়, মুহূর্তে মাচা সাবাড়!

 সাদা গরুটা ক্রমশ বদলাতে থাকে, বদলে বদলে হয় একটা বাঘ, যাকে দেখে কেঁপে মরার কথা থাকলেও এবার সে উল্টো পথে হাঁটার কথা ভাবে এবং হাঁটার জন্য প্রস্তুতিও নেয়। দোয়াদরূদের গুণ জানা আছে, সূরা নাস পড়বে সে তার আগে পড়তে হবে সূরা ফাতিহা একবার, ইখলাস তিনবার তারপর সূরা নাস। নাস সব দূর করে। ফাতিহা পড়ার জন্য ঠোঁট খুলতে গিয়ে দ্যাখে ঠোঁটে বল নাই আর অদূরে বিলের ছিপছিপে পানির চারপুরুষ সমান উঁচু দিয়ে গ্রামের সমান্তরাল পালতোলা নৌকা যায় সাঁই সাঁই…। আর কিছুই দেখে না মতি মিয়া, বস্তুতঃ তার দেখার ক্ষমতা লুপ্ত হয়।

ফজরের নামাজের আজান দিতে দরজা খুললে রজবকেই প্রথম মতিকে আবিষ্কার করতে হয়। চোখেমুখে পানির ছিটা দিলে মতি বলে ওঠে, রজবদাদা নৌকা!
— নৌকা দিয়া কী করবি, আইজ না রইববার! একবারে মঙ্গলবারে যামুনে রসুলপুর।

কাহিনীর কত হাতপা গজায়! মতির কিছুই বলা লাগে না প্রায়। তারাই মতির হয়ে গল্প সরবরাহ করে, মতি হতবিহবল হয়ে দেয় সূত্র। ব্যাঘ্র সিংহ সর্প সমেত পুরো গ্রাম ভাগে ভাগে আসে ছোটকাজিবাড়ির উঠানে। ছাড়াবাড়ির গাবগাছেরডি নাইকেল গাছের ডাউগ্যা ভাঙ্গা থুইয়া এহন মতিরে ধরার চেষ্টা করতাছে গো! কিন্তু বুজে নাই পোলার প্যাডে যে আল্লার কালাম ভর্তি! পোলায় কি আমগো লাহান নাদাননি? পোলায় তো আরেকটু বড়ো হইলে মোরাকাবায়ও বইব!

চন্দ্রভানু পক্ষে তো সাঁকো পার হয়ে ছোটকাজির বাড়ি যাওয়া সম্ভব না, বস্তুত সে যাবেও না। জনে জনে ধরে এমকি বৃত্তান্তও জানতে পারবে না, এটা তার চরিত্র নয় যে! আর স্বজনপ্রতিবেশীদের সঙ্গে সে সম্পর্ক গড়েও ওঠে নাই। কিন্তু বিষয়টা আদ্যোপান্ত শোনার বড়ো আগ্রহ। তাই বিকাল নাগাদ একবার মতিকেই প্রথম আসতে হয় স্বমুখে বয়ান দেয়ার জন্য।

— গেছিলাম রজবদাদার লগে দেহা করতে, ফিরার পথে ঝামেলা …
— কী ঝামেলা?
— ঐ আর কি, কী কী সব আইতে লাগলো, সবডি দেহার সুযোগ পাই নাই! পইড়া গেছি!  

কুদ্দুস কাছে এসে বলে, কারা আইছে? ধরতে পারলা না!
চন্দ্রভানু চোখের ঈশারায় মতিকে প্রস্থানের আদেশ দেয়। মতি কি করে, বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রভানুর মুখের দিকে। চন্দ্রভানু কুদ্দুসকে বলে, রজবরে একটু আসতে কন, সে আসলে বুজা যাইব ব্যাপারটা।

Series Navigation<< উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব তিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *