উপন্যাস

উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব তিন

ওমর সরকারের বাইরের ঘরের সামনের উঠানে বিশাল নারকেল গাছটার নীচে এসে দাঁড়ায় রজব আলী। গতকাল যে ঘটনা ঘটেছে তাতেই যে আজকে তাকে ডেকে এনে ব্যাখ্যা চাইবে তা সে কল্পনা করে নাই। হাবা এসে একবার মাত্র দাঁড়াতে বলে কোথায় যে পালালো, ভাবতে ভাবতে কালিনীর দেখা মেলে। কালিনীই অন্দরে খবর দেয়। পূবকান্দির ছোটকাজীর ছেলে মতির সঙ্গে রজবের কী যে হয়েছিল গতকাল, আর কুদ্দুস যে কী বলে রজব সম্পর্কে ─ রজবে জিন চালান দিছে, মটি মিয়ারে জিনে উলায় নিয়া বিলে গাইলা ফালাইতে চাইছে…।

বুঝতে না পেরে চন্দ্র রজবকেই ডেকে পাঠায় উঠানে। গোঁফ উঠবো উঠবো করা রজবের চেহারায় এমন একটা নিষ্পাপ ভাব যে উঠানে একটা সমত্ত ছেলে, এ কথা কারো মনেই আসে না। এই মুহূর্তে আমেনাবিবি বাড়ি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। থাকলে নির্ঘাত তার উপস্থিতি বোঝা যেত। হয়ত চন্দ্রভানুও এ সাহস করত না এ সবের।
চন্দ্রভানু ঘোমটার আড়াল থেকে প্রশ্ন করে─কী হইছিল কাইলকা?
রজব ইতিউতি চায়, ওর চোখের মনির সঙ্গে বোকা কুদ্দুসের মনিও ঘোরে। চন্দ্রভানু কাছে ডেকে কুদ্দুসকে কী যেন বোঝায়, এবার কুদ্দুস প্রশ্ন করে ─ কাইল সারা রাইট মটি মিয়া অজ্ঞান আছিল্, কী কারণ?
রজব উত্তর দেয় না। চন্দ্রভানু এবার ঘোমটা খানেকটা সরায় ─ মতি মিয়ারে আর ডর দেখাইবা না, বুজঝো রজব! সে নাবালগ ছেমড়া, তোমার কেরামতি দেখার সাহস তার হয় নাই।
রজব ঘাড় কাত করে সায় দিলে বিনিময়ে দুটো বড় বড় ঝালের নাড়– পায়। কাবান্নির দেয়া নাড়– দুটো হাতে নিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে সদর দরজার কাছে উঠানের শেষ মাথায়।
নাড়– দুটো দিয়ে সে কী করবে ভেবে পায় না। যতদূর সে জানে ছোটকাজীদের সাথে সরকারদের কোন আত্মীয়তা নাই। তো এ সব খবর দিয়ে চন্দ্রমামি কী করবে! কিন্তু লাভ হয়েছে রজবের, বহুদিনের একটা আবছা বাসনা, নাকি ইচ্ছা ছিল সরকারদের বাড়ির ভিতরটা দেখার, ফুলের বাগান আছে বাইরের ঘরের সামনে উঠানের চারধারে। নানা রকম গোলাপ বেলি কামিনী শিউলি আর বেড়া ঘেঁষে মোরগফুল সারাটা
বছর। রজব এই কয়টার নামই জানে কিন্তু গাছ চেনে না সব কয়টার, বস্তুত গোলাপ জবা ছাড়া আর কিছুই চেনে না। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবনা তার বেশী দূর আগায় না হাবার উপস্থিতিতে।

যা হোক, কাল ঘটনা যা ঘটেছিল, তার বয়ান সে কী দিবে? সে তো কেবল মতি মিয়ার ভুল ভাঙতে চেয়েছিল। প্রতিদিনের মত নৌকায় কাল যেতে যেতে মতি জিজ্ঞাসা করেছিল, নাকি কটাক্ষ করেছিল ─ রজবদাদা, সাবিহা বুবুগো নাইকের গাছের ডাউগ্যা ভাঙ্গা কেমনে বন্দ করলা? রজব উদাস হয়ে বলে, আছে, দোয়া আছে।
মতি অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে বলে, কী দোয়া দিলা? ফটকাবাজি?
নৌকায় ওদের ছাড়া মানুষ ছিল তিনজন, প্রথমজন চানমিয়া মোক্তার; কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ততা তার নৌকায়ও, এদিকে তার মন নাই।
দ্বিতীয়জন রজবের গৃহকর্তার দশ বছরের ছেলে; কয়েকদিন হয় সেও ওদের সঙ্গে মাদ্রাসায় যায়।
শেষ ব্যক্তি রজবের চেয়ে বছর দুই বড়, টাইপে বিশাল ফেঁচকা, বকবকে অদ্বিতীয়, মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে কবে কেউ জানে না। সপ্তাহে মাসে দু’চারদিন যায় আর গ্রামবাসীর কাছে নিজেকে বিশাল আলেম বলে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আর তার এই মাঝে মাঝে আড়াই তিন ঘন্টার রসুলপুর যাত্রার রাস্তায় সে গ্রামের তাবৎ সুন্দর অসুন্দর নারীর খবরাখবর পরিবেশন করে, সঙ্গী যাত্রীরা এসব শুনতে চাক না চাক সেদিকে তার ভ্রক্ষেপ নাই। ফেচকার নারী গবেষণায় বেশী থাকে নারীর বুক আর পাছা, এই দুটো ভারী ওজনদার না হলে আর কিসের নারী, সে তো মনু মিয়া, মানে হিজড়া।

ফেচকা মতির কথা শুনে অবিশ্বাস নিয়ে তাকায় রজবের দিকে ─ নাইকেল গাছের ডাউগ্যা ভাংগে কে? ফেচকার প্রশ্নের উত্তর না দেয় মতি, না দেয় রজব। আর ফেচকার আগ্রহ এ সুযোগে যায় আরো বেড়ে। আরো খানেক পীড়াপীড়ি করেও যখন উত্তর পায় না তখন বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে বলে ─ থাহেন তো মাইনষের বাড়ি জায়গির, দেইখ্যেন কামেলি মারাইতে গিয়া ধরা খাইয়েন না, দিনকাল কলাম ভাল্ না!
পানির ছলাৎছল শব্দ আর ফেচকার কথার তুবড়ি চলে সারা নৌপথ। মোক্তার দু’একবার ধমক দিয়ে
থামিয়ে দিলেও পরক্ষণে যেই, সেই। ফেরার পথে মতি আগ বাড়িয়ে রজবের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলেও ফেচকার বিরক্ত করা অব্যাহত থাকে।

চৈত্র মাসে সন্ধ্যায় খাল পাড়ে গা ধুতে আসে বউঝি অনেকেই। আর সান্ধ্য এই গা ধোয়া দেখতে ফেচকা একেবারে বাঁশে সাঁকোর নিচে গিয়ে নামবে। নেমে দু’তিন বার যাওয়া আসা করা তার নিত্যকর্ম। বাঁশের সাঁকো জায়গায় জায়গায় পচে গিয়ে মড়মড় করে কিন্তু ফেচকার ধীর গতির যাওয়া আসায় কোন রকম সমস্যা হয় না। একটা কাঠের পুল হবো হবো করেও ঠিক হয়ে উঠছে না অর্থাভাবে। ওমর সরকার সব কাজে এগিয়ে আসলেও পুলের কাজে এক কথাই বলে মাস্টারকে ─ আপনেরা আগে জোগাড়যন্ত্র করেন তারপর আমি দিমু যেদ্দুর দেয়া যোয়। নৌকা খালে ঢোকার আগে টেকের গাঙেই নেমে পড়ে রজব আর কি জানি কেন, মতিও নামে পিছে কিন্তু রজব কথা বলে না অনেকক্ষণ, শেষে বলে বাড়ি যা, সন্ধ্যায় বাড়ি আইছ মতি!

যা হোক, ভরা সন্ধ্যায় সাঁকোর উপরে মতি দেখা পায় ফেচকার। কই যাও কী বৃত্তান্ত, নানা প্রশ্ন এড়িয়ে মতি সন্তর্পণে পুল পেরিয়ে এসে ছাড়াবাড়ি পার হয়ে বড়োকাজী বাড়ি, মাস্টার বাড়ি এবং সব শেষে সরকারদের বাড়ি পার হয়ে এসে দাঁড়ায় মিয়াদের দক্ষিণধারে।
সারাদিন প্রবল গরম গেলেও এখন একটু ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, সারাদিন পর গাছগুলোও যেন গরম
ছেড়ে জিরিয়ে নিচ্ছে ঠান্ডা বাতাসে।

রজবের প্রতি তার আস্থা ছিল ঠিকই তাই বলে হঠাৎ করে কেরামতি দেখানো, বিশেষ করে সাবিহার ব্যাপারেই! রজব চমক দেবে আর মতি মিয়া চুপচাপ শুনে যাবে তা তো হয় না, তাই সংশয় প্রকাশ করেছে মাত্র কিন্তু রজব যে বিষয়টা এভাবে নিবে, একেবারে সারা রাস্তা নিশ্চুপ!
খোলসা করে বলে দিলেই তো বুঝত আসলে সে সাবিহার কী উপকারে এসেছিল! একবার ভেবেছিল যাবে না রজবের কাছে, সে যা ভাবে ভাবুক কিন্তু তার আশংকাটাই যদি সত্যি হয়ে যায়! যদি রজব নারিকেলের ডেগো ভাঙার উছিলায় ক্রমাগতই কাজিবাড়ি যাওয়া শুরু করে আর স্বামীর অনুপস্থিতিতে সাবিহা রজবের

সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, ভাই হিসাবে তারও তো কিছু কর্তব্য আছে! হোক না দুই পরিবারের মুখ দেখাদেখি বন্ধ আর মামলা মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রিতা। দুই কাজীবাড়ির মাঝখানে একটা খাল, খালের উপর বাঁশের পুল। আর যখন বাঁশের পুলটাও হয়নি, দুই ভাইয়ের তুমুল রেষারেষি শুরু হয়নি, এমনকি দুই ভাইয়ের পুত্রকন্যার বিয়ের যাবতীয় কথাবার্তা পর্যন্ত পাকা হয়ে গিয়েছে তখন কি প্রতিদিন মতি সেই বাড়িতে পরম আত্মীয়ের মতো দিনের পর দিন থাকেনি? আর মামলা হওয়ার পর দুইভাই বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাল বলেই তো তারা পালিয়ে গেল ডিঙি নিয়ে খোদ মেঘনায়।

সম্মিলিত কাজী পরিবার সারা দিন খুঁজে খুঁজে চলচ্চিত্রের মতো সেই নৌকা ধাওয়া করে আনল ধরে। সেই রাতেই শাস্তিসরূপ মমতাজের বিয়ে দেয় বাড়ির মুনিষের সাথে আর মনের দুঃখে বিবাগী হয় জোনাব কাজি। তখন কি সে মন খারাপ করেনি ভাইয়ের সঙ্গে মমতাজবুবুর জন্যও!
আজ দশ বছর অতিক্রান্ত হলেও জোনাব কাজির খবর জানে না কেউ। মেঘনায় গলায় কলস নিয়েছে না

ঢাকায় গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সঠিক কেউ বলতে পারে না। তবে বিষয়টা নিয়ে তারা যে খুব ভাবিত তা মনে করার কোন কারণ নাই। এখন অবশ্য মতি সেই বাড়ির মেয়ে, যে কিনা বিবাহিত এবং ধরতে গেলে শত্রুপক্ষ, তারই জন্য এমন ছটফট করছে! সাবিহার বিয়ে হয়েছে দু’বছর আগে আর স্বামীকে বিয়ের তিন মাস পর বিদায় দেয়া হয়েছে এই কথা বলে, সে যেন দু’বছরের আগে শিমুলচরে পা না রাখে, রাখলে ঠেং ভেঙে গাঙে ভাসায় দিবে। সেই যে জামাই খেপুপাড়া ভাইয়ের সাথে চালের ব্যবসা করতে গেল এর মধ্যে

না খবর না চিঠিপত্র। সে কি অভিমান, না গুরুজনের কথামান্যি বোঝার উপায় নাই। তবে বিয়ের পর থেকে সাবিহার ভূতে ধরা এমনকি স্বামী চলে গেলেও অব্যাহত থাকা গ্রামের কারো চোখ এড়ায় না। প্রথমবার ভূতে ধরেছে বিয়ের পরদিন তারপর স্বামী এলেই ভূতে ধরতো ফলতঃ বুড়ি দাদিই ঘোষক, এখন সাবিহার স্বামীর সঙ্গে থাকা চলবো না, নাতি ডাঙ্গর হইলে আমরাই খবর দিমু, বুজজো! ছেলেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে ─ ছেমরি এহনো বড়ো অয় নাই, জামাইর লগে থাকব কেমনে? আর একটা বছর সবুর করতে পারলি না অবাইগ্যার পুত! মতি যখন পায়ে পায়ে মিয়াবাড়ির দক্ষিণধারে এসে দাঁড়ায় তখন কেবল অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে জামগাছ আর বিছুটিলতার নিচে।

বয়সে রজবের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট, পড়ালেখায়ও এক ক্লাস নিচে, তা সত্ত্বেও কিছুটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছিল নানা কারণে। কারণ মতি আর দশটা ছেলের চেয়ে মেধাবী এবং রসপ্রবণ। কোরআনের আয়াতগুলো দ্রুত মুখস্ত করে মাদ্রাসার মৌলভীকে অবাক করে দিয়ে সে মজা পায় আর মজা পায় রজবের সাথে তর্ক করে। জায়গির থাকা রজব খুব কম সময়ই মতির সঙ্গে পারে বা পারতে চায়। বয়সে ছোট হলেও মতিকে সে সমীহ করে। সমীহ তার এক প্রকার বিনয়।

ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে মতি তাকিয়ে থাকে ছায়াচ্ছন্ন বিলের দিকে। খুবই গরম ছিল সারা দিন, এখন ঝিরঝির হাওয়া দিতে দৃষ্টি যায় আকাশে। নির্মেঘ ফকফকা আকাশ চোখে পড়ে।

কিন্তু মতির চোখ এড়িয়ে দু’এক খণ্ড মেঘ ঘোরাঘুরি করে আকাশে আর মতি যদি সোজা পূবদিকে পাঁচ মিনিট হাঁটতো, মানে সরকার বাড়ি, মাস্টার বাড়ি পেরিয়ে এসে দাঁড়াতো তবে দেখতে পেত সাবিহা খাল পাড়

থেকে দক্ষিণধারে উঠছে। দেখতো সাবিহার সাথের বউঝিরা কেউ কেউ গা ধুলেও সাবিহা ধোয় নাই। সাবিহার মাথার চুলে জবজবে তেল, কাকই করা চুলে হেসে হেসে কলকল করতে করতে বাড়ি ঢুকছে। দেখে কে বলবে কাল সন্ধ্যায় ছাড়াবাড়ির নিকষ অন্ধকার গাবগাছ থেকে এসে ভর করেছিল কেউ, আর ─ ওরে তোর জামাই নাই, ওরে তোর জামাই নাই, বলে প্রলাপ বকছিল।

আর রাত যত গভীরই হোক বহু লোকই উঠানে এসে দাঁড়ায় সাবিহার খবর নিতে। মাঝরাতে তেল ফুরিয়ে যাবার আগে মামলায় সর্বশ্রান্ত বড়োকাজির প্রয়োজন পড়ে একজন মাওলানার যিনি বড়ো বড়ো সূরা কালাম পড়ে সাবিহার মাথায় ফুঁ দিয়ে শয়তান দূর করবে গভীর মনোনিবেশে। কিন্তু কোথায় মাওলানা এত রাতে!

Series Navigation<< উপন্যাস─ চন্দ্রভানুর পিনিস। নাসিমা আনিস ─পর্ব দুই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *