নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তোরো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদচৌধুরী।। পর্ব দশ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এক
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তোরো
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব আট
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব নয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তিন
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুই
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এগারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। শেষ পর্ব
রাধারমণ–সংগীত
জলে গিয়াছিলাম সই
কালা কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই।
সোনার ও পিঞ্জরা সই গো, রুপার ও টানগুনি
আবের চান্দুয়া দিয়া পিঞ্জরা ঢাকুনি।
পালিতে পালিসলাম পাখি দুধ কলা দিয়া
এগো যাইবার কালে বেঈমান পাখি না চাইল ফিরিয়া।
ভাইবে রাধারমণ বলে পাখি রইলো কই
এগো আইনা দে মোর প্রাণ পাখি পিঞ্জরাতে থুই।
উত্তেজিত হয়ে শংকর বলল, এক রাত্রির জন্য বাড়ির বাইরে ছিলাম। এখন বাড়ি ফিরে দেখছি ননীর কোনও খোঁজখবর নেই। আর পারছি না! ননী, তুই কোথায় গেলি? বউদি, ওগো বউদি, তোমারও দেখছি কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাড়িসুদ্ধ সবাই কি উধাও হয়ে গেল নাকি!
নৈঃশব্দ্য ভেঙে ঘনশ্যাম প্রশ্ন করল,এই অবেলায় ঝামেলা পাকাচ্ছিস কেন? ওরা আবার কোথায় যাবে? দ্যাখ্, আশেপাশে কোথাও আছে।
ঘনশ্যামের দিকে তাকিয়ে শংকর বলল, সাধে কি আর ঝামেলা পাকাচ্ছি? ওদের কোনও পাত্তা পাচ্ছি না যে!
কিঞ্চিৎ গম্ভীর স্বরে ঘনশ্যাম বলল,একটা কথা বলি শংকর?
একটু চিন্তা করে শংকর বলল,বলো। শুনছি।
তীক্ষ্ণভাবে ঘনশ্যাম বলল : আমাদের মানসম্মান এবার বুঝি চলে গেল, শংকর।
ঘনশ্যামের কথা শুনে শংকর শিউরে উঠল। অসহায়ভাবে বলল, কেমন করে?
ব্যর্থ পুরুষের মতো জেদ করে ঘনশ্যাম বলল, তোর বউদি এখন পরপুরুষের স্বাদ নিতে আত্মহারা।
প্রথমে কোনও উত্তর দিল না শংকর, শুধু একটু হাসল; তারপর বলল : তোমার আসলেই সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। তোমাকে বলে দিচ্ছি, বউদি সম্বন্ধে আজেবাজে কথা তুমি বলবে না।
শংকরের কথা বোঝার চেষ্টা করছে ঘনশ্যাম। তার মনে হল, শংকর সত্যই অতিশয় গম্ভীর কথা বলেছে। এই জগতে এই ব্যাকুলতার তুলনা কোথায়? পরক্ষণে নিঃশব্দে বসে থেকে ঘনশ্যাম ধীরে ধীরে বলল,তোকে বলে অবশ্য কোনও লাভ নেই। তুই আমার মনের কথা বুঝবি না। আমার অন্তর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, শংকর।
শংকর শান্ত স্বরে বলল, কোন্ কারণে তোমার অন্তর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তা খুলে বললেই বুঝে নেব।
ঘনশ্যাম মনে মনে বলতে লাগল : স্ত্রীর প্রণয় এক প্রকার সজীব বিষয়। স্ত্রীর হৃদয়, বস্তুত, যেকোনও স্বামীকে সত্যের ইঙ্গিত দেয়। তা পুথির পাতার মতো নিষ্প্রাণ নয়। স্ত্রীর হৃদয়ে রোমাঞ্চ আছে? ব্যাকুলতা আছে? কোনও স্ত্রীর হৃদয়কে আবিষ্কার করে স্বামী অধিকার করে নিতে পারে, কিংবা এই হৃদয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার মধ্যে স্বামীর যে-আনন্দ হয়, তা পুথির পাতায় পাওয়া যায় না। যখন সামান্য স্ত্রী অসামান্য হয়ে ওঠে, তখন অসামান্য স্ত্রীর প্রতি প্রেম থাকলেও আনন্দ হারিয়ে সমুদয় বেদনাই হৃদয়ে উদিত হয়। এসব ভেবেই ঘনশ্যাম বলল, থাক্ সেসব কথা। এখন বল্, কেন ননীকে খুঁজছিলি?
শংকর বিস্ময়াহত হয়ে বলল :আমি খাবার খেতে চেয়েছিলাম, তাই। সন্ধ্যায় ঘেটুনাচের আসর বসবে, অনেক কাজ পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি বেরুনোর প্রয়োজন। তুমি সন্ধ্যার আগেই তৈরি হয়ে থেকো, আমার সঙ্গে রায়কুটিরে যেতে হবে তোমাকেও। দুই ভাই মিলে ঘেটুনাচ উপভোগ করব।
ঘনশ্যাম সচকিত হয়ে একবার শংকরকে দেখে নিল। সত্যই, একই কথা সে গতকালের ঘটনাটির পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ভেবেছিল, কিন্তু রায়কুটির থেকে ফেরার পর তার হৃদয় শুকিয়ে গিয়েছে! সেখানে কমলিকার রাত্রিবাস কেমন করে যেন তার মনোজগতে সংশয় ধরিয়ে দিয়েছে! কমলিকাকে তার আর আপন মনে হচ্ছে না। এক মুহূর্তে যেন কত কালের সঙ্গিনী পর হয়ে গেল। কমলিকাকে তার মন সপ্রেমে আর আকর্ষণ করছে না। তার প্রতি তার সকল আস্থা কেমন যেন হারিয়ে ফেলেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘনশ্যাম বলল : না, আমার কোথাও যাওয়া হবে না।
চক্ষু ঘনশ্যামের ওপর স্থির রেখে ঈষৎ আত্মগত স্বরে শংকর বলল,কেন?
ঘনশ্যাম যত ভাবছে, ততই বিষম যন্ত্রণা এসে তার হৃদয়কে অধিকার করে নিচ্ছে। সে এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন! কী করে তা থেকে যে উদ্ধার পাবে, সে জানে না! এরকম অবস্থায় সে বলল, শরীরটা ভালো নেই।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ঘনশ্যামকে দেখতে লাগল শংকর। তার ওষ্ঠাধরের কোথায় যেন বিদ্রুপবঙ্কিম ক্ষুরধার বেদনা আত্মগোপন করে আছে। ঘনশ্যামকে দেখতে দেখতে শংকরের হৃদয় কী এক অজানা ভয়ে কম্পিত হতে লাগল। মৃদুস্বরে শংকর বলল, তা-ই-তো! তোমার চোখ-মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে!
এই মুহূর্তেই এক ঘনশ্যামের অন্তরে অভ্যন্তরে দুইজন ঘনশ্যাম কথা বলছে। মস্তিষ্কের ভেতরও যেন মল্লযুদ্ধ চলছে। বাস্তবতার বিরুদ্ধে ভাবের। হঠাৎ ঘনশ্যাম বলল, রাত্রিতে ভালো ঘুম হয়নি।
এইক্ষণে সমস্যা হচ্ছে এই যে, বাস্তবতার বহু ধারণার সম্মুখে ভাবের যুক্তি আর দাঁড়াতে পারছে না। নিজে ভাবের পক্ষে থাকলেও বাস্তবতার কাছে ভাব প্রবলভাবে পরাজিত হতে থাকে। ঘনশ্যামকে অসহায়ের মতো দেখে শংকর বলল, বউদির সঙ্গে বুঝি আবার ঝগড়া হল?
ঘনশ্যামের অন্তরে, একদিকে, যুক্তিনিষ্ঠ মনোভাব, আর অন্যদিকে, কী যেন সন্দেহ রাজত্ব করছে। তার মুখাবয়বে ভীষণ পরাজয়ের ভাব দেখা দিল। কমলিকার সম্পর্কে সে যেন কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। অন্যদিকে, ‘আমি ন্যায় বা ন্যায়মতের অনুসারী’—এই রকম মিথ্যে বাক্য বলতে গিয়ে ঘনশ্যাম মরমে আহত হচ্ছে। তাছাড়া শংকরের কাছে সত্য প্রকাশ করাও সম্ভব নয়, করলে বরং আরও আহত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘনশ্যাম বলল, মাথার ভেতর কী যেন তোলপাড় করছে। বালতিটা একটু এগিয়ে দে তো! আর ঘরে গিয়ে চৌকির ওপর থেকে আমার গামছাটা নিয়ে আয়। মাথায় জল ঢেলে দেখি, মনকে শান্ত করা যায় কিনা!
লম্বা-লম্বা পা ফেলে, শরীরকে মাথার দোলনে দুমড়ে, চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে, গলা তুলে বিড়বিড় করে কী যেন জপতে জপতে, বকতে বকতে, শংকর এগিয়ে গেল কমলিকার ঘরের দিকে। তারপর উচ্চ স্বরে বলতে লাগল : বউদি, ও-গো বউদি, দাদার গামছাটা দাও তো!
কমলিকার কোনও সাড়াশব্দ নেই। এক নিষ্ঠুর দৃশ্যের ভেতর, শংকর আপনা-আপনিই চমকে উঠল। এক প্রকার বিমূঢ় হয়ে গেল। কমলিকা কি আজ সকল সম্বন্ধই চুকিয়ে ফেলতে চায়! শংকর হতবিহ্বল হয়ে ভাবছে, কমলিকা ছাড়া তার এই জগতে আপন বলতে অন্য কেউই নেই। তারপর আবার ডাকল : বউদি, ও-গো বউদি, গামছাটা নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি করো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কমলিকার তবুও কোনও সাড়াশব্দ নেই। শংকর বারান্দার খাঁজে পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের ভেতর ঝুঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সে দেখল, ঘরে কেউ নেই। শংকরের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। চিৎকার করতে চায়। ঘরের চারপাশে আর-একবার দৃষ্টিপাত করল, তবুও কমলিকার সন্ধান পেল না। চৌকির ওপর থেকে গামছাটা হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, কী হল? কীব্যাপার! বউদির কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন?
সে ঘনশ্যামের দিকে গামছা হাতে ছুটে আসে। জগৎ-সংসার-পথ-ঘাট কোনও কিছুই স্পষ্টভাবে দেখার অবকাশ নেই তার। তার মন মৃদু ডুকরে উঠতে গিয়েও নিশ্চুপ হয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে, বাতাসের-সঙ্গে-যুদ্ধ করার মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যামের মাথায় জল ঢালতে থাকে। আর তখনই ননী ছুটে এসে সামনে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলতে থাকে : সর্বনাশ হয়ে গেছে, বউদিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
চিন্তিত স্বরে ঘনশ্যাম বলল, কী বললি তুই? ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। আর মনে মনে বলতে লাগল : প্রকৃতপক্ষে, তুমি ছাড়া আমার অন্য কিছুই নেই! একথা একবার তুমি বুঝতে পারলে, বুঝতে আমি তোমাকে পরিত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু তুমি আমাকে বজ্রাহত করার জন্যই নিজে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলে। তা তো হতে পারে না।