নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদচৌধুরী।। পর্ব দশ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এক
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তোরো
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব আট
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব নয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তিন
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুই
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এগারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। শেষ পর্ব
রাধারমণ-সংগীত
কৃষ্ণ আমার আঙিনাতে আইতে মানা করি
মান ছাড় কিশোরী।
যাও যাও রসরাজ এইখানে নাহি কাজ
যাওগি তোমার চন্দ্রাবলির বাড়ি।
চন্দ্রাবলির বাসরেতে সারা রাইত পোহাইলায় রঙ্গে
এখন বুঝি আইছ আমার মন রাখিবারে।
ভাইবে রাধারমণ বলে দয়া নি করিবায় মোরে
কেওড় খোলো রাধিকা সুন্দরী।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল কমলিকা। কুকুরটা ভুক্ভুক্ শব্দ করে ডেকে উঠল। নৃত্যরত বাতাস তাকে বকুলতলার দিকে যেন আহ্বান করছে। সে সেদিকেই ছুটে গেল। সোজা বকুলতলায় এসে দাঁড়াল। তখন প্রভাত।
এমন সময় ননী প্রভাতের আলো-অন্ধকারের ভেতর তাকে এসে ধরল। কমলিকা তার মুখ দেখতে পেল। ননী কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কথা বলল না কোনও। একদৃষ্টে কমলিকার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভয়ে নীল। তার কি কোনও সাহস আছে কমলিকাকে কিছু বলার?
ননীর মুখের দিকে তাকিয়েই কমলিকার কাছে মনে হল স্বগৃহে ফিরে যাওয়া নির্বিঘœ নয়। তার সামাজিক মর্যাদা সেখানে কী হবে? তাকে কোনও সম্মান দেবে কি তার স্বামী বা আত্মীয়রা? তাছাড়া সে তো অপমানে শুকিয়ে যাচ্ছে। ওকে সমাজ কী ভাববে, কোন্ পরিচয় নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে সে? যদিও সমাজটা মনেরই প্রতিফলন। বাইরে যুদ্ধ বাঁধার পূর্বে ব্যক্তির অন্তরেই রণক্ষেত্র রচিত হয়। অন্তরে সন্ধি স্থাপিত হলে, বাইরের যুদ্ধের অবসানে বিলম্ব হয় না। তবুও সমাজের প্রচলিত প্রথা ভাঙার জোর আর কমলিকার বুকে শক্তি নেই। অনেক বছরের জীবনের সাধারণত্ব তাকে অতিসাধারণ করে তুলেছে। না! কমলিকার প্রথাভাঙার সাহস নেই। কমলিকা মনে মনে বলতে লাগল : আমাকে এই ভাটিদেশ ছেড়ে চলে যেতেই হবে। এটিই আমার জন্য উপযুক্ত।
কমলিকার ভয়ংকর রূপ দেখে আঁতকে উঠল ননী। বলল : বউদি, তুমি কোনও ভুল করোনি। একথা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।
ননীর দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলল : মানুষ এক আশ্চর্য জীব, সে ক্রমাগত নতুন সত্য সৃষ্টি করে চলে।
কথা থেমে গেল। উভয়ই মৌন। দূরে আলো-অন্ধকারের ভেতর বর্ষার জল বয়ে চলেছে। ওপরে নিস্তব্ধ প্রভাতের আকাশ তার মহিমা নিয়ে ভাটিদেশের জলের ওপর চিত্রার্পিত হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে ননী বলল : এতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এখন চলো বাড়ি ফিরে যাই।
কমলিকা হাঁটতে শুরু করল। পিছু পিছু ননীও। কমলিকা পথ দেখছে না, দেখছে দূরের আকাশ। এই যে আকাশ, তা যতই বিশাল, যতই ব্যাপক হোক না কেন; তা তো স্থূল ইন্দ্রিয়গোচর। এই আকাশ পেরিয়েও আরও আকাশ রয়েছে, সেসব পেরিয়েই সমস্ত জড়জগতের আদি উৎস, আর বিশ্বজগতের যাবতীয় শক্তি; কেবল উত্তাপ, বিকিরণ, তেজস্ক্রিয়তা, অভিকর্ষের মতো বহির্জাগতিক শক্তিই নয়, অন্তরের চিন্তা করার অন্তর্জাগতিক শক্তিও বটে। সেখান থেকেই তো সকল প্রাণের আদি প্রাণশক্তি উৎসারিত হয়েছে। সেখানেই অতীন্দ্রিয় প্রাণশক্তির লীলা চলছে। লীলাচঞ্চল প্রাণ কম্পিত হচ্ছে। এই কম্পনের ফলে সমস্ত সম্ভাবনা ও সম্ভাবিত চিন্তা উঠছে, পড়ছে। প্রাণের স্পন্দনের প্রকাশ ঘটছে। চিরচঞ্চল প্রাণ নৃত্য করছে। এই নৃত্যের ছন্দে কমলিকারও চিন্তাভাবনা বেরিয়ে আসছে। মহাজাগতিক বৃহৎ ঘটনাগুলোর পাশে এই ভাটিদেশের কমলিকার তুচ্ছাতিতুচ্ছ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাটি বেরিয়ে আসছে। প্রেম-বিষাদ-বিরহ বেরিয়ে আসছে। তার জীবনের এই ঘটনাটিও আদি প্রাণশক্তির অভিব্যক্তি। যখন খেলা ফুরোবে, এক মুহূর্তের জন্য কমলিকার বুক শান্ত হবে, তখন এই ভাটিদেশ ও তার যাবতীয় কর্মক্রিয়া নিশীথের অসার স্বপ্নের মতো মিলিয়ে যাবে।
কমলিকা এক মনে বলতে লাগল : কমলিকা! ব্যাধি-জরা-মরণ-সংকুল এই মানবজীবনের নিখিল দুঃখের আত্যন্তিক নিবারণ খুঁজতে পথে বেরিয়েছ, এই উদ্দেশ্যেই দেশান্তর হতে হবে। এখন তোমার সমীপে ননী আছে, আগামীকাল হয়তো তোমার স্বামী আসবে, জনসাধারণের ভিড় জমাবে—এমতাবস্থায় তোমার জীবনের ব্যাঘাত ঘটবে—তা তো তুমি হতে দিতে পার না।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কমলিকা নিজেকে বলতে লাগল : আমি চাই নির্জনবাস—জীবনের কঠিন সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবার জন্য নির্জনবাসই একান্ত আবশ্যক। একথা ভেবে আমার এই ভাটিদেশ পরিত্যাগ করা উচিত, আশেপাশের কোনও অরণ্যে চলে যাওয়াই উচিত। তাছাড়া এও আমার মনে হচ্ছে : আমার পূর্বে সমাজচ্যুত অন্য নারীরা এই জীবনসমস্যা নিয়ে কী প্রকারে চিন্তা করেছে—সেকথা আমার জানা প্রয়োজন। শুনেছি, অরণ্যে নারীসাধক অবস্থান করে। আমার মনোবেদনা যদি আমি তাদের কাছে জ্ঞাপন করি, তাহলে নিশ্চয়ই তারা এই বিষয়ে যা জানে তা আমাকে বলবে। কিন্তু তাদের সন্ধান আমি কীভাবে পাব? অরণ্য জটিল, বহু শাখাপ্রশাখাসমন্বিত; দিবাভাগেও এত অন্ধকার থাকে যে, পায়ে চলার পথ অন্বেষণ করা মাঝেমধ্যে দুর্ঘট হয়ে পড়ে। এসব স্থানে ভিক্ষা মেলে না; বনের ফল আর নদীর জল ক্ষুধাতৃষ্ণানিবৃত্তির একমাত্র উপায়। রাত্রিকালে এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে প্রথম প্রথম কোনও বৃহৎ বনস্পতির ডালে উত্তরীয়বস্ত্র দ্বারা নিজদেহ বন্ধন করে নিদ্রা যেতে হয়।
তখনই যেন কমলিকা বিবেকের নির্দেশ পায়। সে মনে মনে বলতে লাগল : আমি দেশান্তরী হব; কেন আমার এই ভয়? বৃক্ষতলে বনস্পতিমূলে মাথা রেখে বিশ্রাম করতে পারি, মনে হল, এতে যদি আমাকে কোনও বনের পশু আহার করে যায়; সে-ও ভালো। অন্তত, আমি সেই ক্ষুধার্ত পশুর বুভুক্ষা মেটাতে তার উদরবিবরে প্রবেশ করব, অকৃতার্থ জীবনের পরিসমাপ্তি হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ননীকে কমলিকা বলল : না, কাজ নেই। এখন আর তোর দাদার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনও মুখ রইল না। না, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না।
ননীর চোখে এবারে ভয়ানক বিপদ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে কমলিকার বিপদের কথা ভেবে নিজের কথাই ভুলে গেল। ও বলল : কী বলছ তুমি! এমন কথা বলতে নেই। বাকি জীবন আমার সঙ্গেই থাকবে। ফের যদি তুমি এমন কথা বলো তাহলে আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলব না।
ননীর দৃঢ় চোয়ালের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কমলিকা কোনও কথা বলার সাহস করল না। ননীর চোয়াল যখন শীতল হয়ে এল তখন কমলিকা মাথা নিচু করে বলল : না-রে ননী। রাত্রি গেল, দিবস এল, শুধু রয়ে গেল অস্তে যাওয়া চাঁদের ছায়ার বিষণ্ণতা। সে সম্ভোগ করল। নিজেকে মনে হল, আমি যেন কারও খাদ্য। না, না, আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। ভাটিদেশ দুঃখময়, ননী! এখানে থাকতে চাইলে কারও-না-কারও দাসত্ব করতে হয়। আমি আর কারও দাসত্ব করব না। এই জীবন, এই প্রাণ আমি অরণ্যেই অর্পণ করব।
ননী একটু দ্বিধা করে বলল, রাখো তো তোমার এমন কথা! চলো বলছি! চলো!
অস্তমান চাঁদ আর দেখা যাচ্ছে না। সূর্য উদীয়মান এখন। বিভিন্ন পাখির ডাক। প্রকৃতিকে কেমন যেন নেশা-নেশা লাগছে। কমলিকা দ্রুত হাঁটতে লাগল। রহস্যময় ভবিষ্যতের দিকেই হাঁটতে লাগল। আর তার মাথার ওপর সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত অথচ কোথাও ধরা-না-পড়া আকাশ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই অধরা আকাশকে একটিবারের জন্য স্পর্শ করার আকাক্সক্ষায় এই ভাটিদেশের বন্যার জল নিতান্ত অসহায়ের মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে। জলের দিকে তাকিয়েই ননী শুধোল, কী হল? এত দ্রুত হাঁটছ কেন?
কিছুক্ষণ থেমে স্বগতোক্তির মতো কমলিকা বলল, কোনও কোনও নারী জীবনে এমন এক পুরুষের সন্ধান পায়, যাকে কিছুতেই সে অতিক্রম করতে পারে না। অফুরন্ত সেই পুরুষ।
ননীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। বলল : বউদি, তোমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আমি তোমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছি না। তুমি একটু দাঁড়াও।
ননীর দিকে তাকিয়ে কমলিকা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বলল, অরণ্যকে আমি খুব ভয় পাই। অরণ্য আমার অন্তরে ভয় বাঁধিয়ে দেয়। মাছ কোটার ভয়, কামনার ভয়, মাতৃত্বের ভয়—এক কথায় না-পাওয়ার ভয়, হারানোর ভয়। এমনকি রাত্রিতে যখন পিদিম হাতে বাঁশবনের পথ মাড়াতে গিয়ে উত্তরের বাতাসে প্রদীপশিখা নিভে যেত, তখন মনে হতো আমি আর বাঁচব না, বাঁচতে পারব না। কিন্তু এখন, অরণ্যকেই আমার আপন মনে হচ্ছে, তাকে আপন করে পেতে চাই।
কমলিকাকে ক্রন্দন, আদর, প্রবোধ কোনও উপায়েই ননী বোঝাতে পারল না। সে অবস্থা বেগতিক দেখে বলল : বউদি, বউদি, তুমি কোথায় যাচ্ছ? এটা তো বাড়ি ফেরার পথ নয়।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কমলিকা বলল : মনে রাখিস ননী, উন্মুক্ত ভোগবাদ আর নির্লজ্জ দারিদ্র্য—দুটিই ক্ষয়, সুন্দরের ক্ষয়। জীবনকেই করে জীবনবিমুখী। তার মধ্যে বিরাজ করে চরম পরাজয়। এখন অস্তে যাওয়া সূর্যের অরণ্যের বিষণ্ণতায়ই আমার আশ্রয়। এ-ই সত্য, এ-ই স্বচ্ছ বাস্তবতা।
ননী বলল : বউদি, কথা বলছ না কেন? তুমি কোথায়? তোমাকে একটুও দেখতে পাচ্ছি না।
আতঙ্কপাণ্ডুর ননী কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় দৌড়াতে লাগল।