উপন্যাস

নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদচৌধুরী।। পর্ব দশ

বিকেলে মেঘ জমেছে, ঘরে গুমোট, ননী ভাবল, নদীতীর থেকে ঘুরে আসবে। গ্রামের বেষ্টনীর বাইরে নদীতীরে এসে স্নিগ্ধ বাতাসে তার শরীর ও মন যেন শান্তি পেল। ঘাটের ওপর বসে আছে, কে এক ব্যক্তি স্নান সারছে। স্নানান্তে শাদা বস্ত্র ধারণ করে ওই ব্যক্তি যখন উঠে এল, লোকটিকে দেখে ননী নীরবে বিস্মিত হয়ে গেল। এই-যে লোক, তার মুখের সঙ্গে কায়ার মুখের মিল হয়েছে অনেক। ননী চমকে উঠল, কিন্তু কোনও কথা বলতে পারল না। লোকটিও তার সম্মুখে হাত নেড়ে নেড়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে চলে গেল|
ননী জলের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। জলের ওপর তরঙ্গের দোলা দেখতে দেখতে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন এক মায়াতুর পীড়নে ছলছল করতে থাকল। তখনই তার মনে পড়ে গেল : এক খণ্ড শাদা পাতলা কাপড়ে মুড়িয়ে একদিন তাকে খাটিয়া করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। কী নির্মম! তার মন শূন্যতায় হাহাকার করে উঠল, বলতে লাগল : জীবনের কীইবা ভণিতা! জীবনটা কি ভুলের অর্ঘ্যাঞ্জলি? মিথ্যে প্রতিমা-পুজো!

ননীর কথায় কায়া যেন হেসে উঠল। কথাটি রহস্যপূর্ণ। হয়তো তাই কায়া বলে উঠল : তুমি কি জানো, খাটিয়া করে মানুষ কোথায় যায়?
ননী ঘাড় নেড়ে বলল, শ্মশানে।
ননীর ভাবভঙ্গি দেখে কায়া এবার শিশুর মতো হেসে উঠল, তারপর জিজ্ঞেস করল, কেন?
ননীর মুখভাব মøান হয়ে গেল, বলল, পোড়ানো হবে বলে।
কায়া সাগ্রহে ননীকে জিজ্ঞেস করল : বলো তো, চিরকাল কি কেউ বেঁচে থাকে?
অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা না করেই ননী বলল, কেন? তুমি তো চিরকাল বিরাজমান।
নদীর উত্তাল বাতাসের ভিড়ে, জলের মধ্য থেকে আপন মনে বিড়বিড় করে কায়া বলতে লাগল, না। একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে।
ননী স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে বলল, তোমার তো কোথাও যাওয়ার নেই।
সহস্রলোচনে, ত্রিলোচনে, দুই চক্ষুযুক্ত দৃষ্টিতে এক বিন্দু অপ্রতিভ না-হয়ে কায়া জানতে চাইল, কে বলল?
চরণদ্বয়ের সামান্য পরিবর্তন করে ননী প্রশ্ন করল, তাহলে কোথায় যাবে?
ঈষৎ বিরক্ত হয়ে কায়া বলল, তুমি জানো না! মৃত্যুর পর সবাইকে যেখানে যেতে হয় সেইখানে, অর্থাৎ বৈকুণ্ঠধামে।
ননী উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল, সেটা আবার কী?

কায়া গম্ভীরভাবে বলল, এক পরম শান্তিময় স্থান।
ননীর মনে তখন কায়ার প্রতি অত্যন্ত ক্ষোভ সঞ্চারিত হল। সে ক্রোধে ফুঁসছে। এই যখন মনের অবস্থা, তখন সে বলতে লাগল : তাহলে এখনই যাচ্ছ না কেন?
এই প্রশ্ন শুনে কায়া দুঃখিত স্বরে বলল, সৎকার না হলে সেখানে যাওয়া যায় না। সৎকারের পরেই বৈকুণ্ঠধামে যাওয়া যায়।
রোমঞ্চিত কলেবরে কায়ার কথা শুনছিল ননী। একটু ভেবে জিজ্ঞেস করল, সৎকার আবার কী?
কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থেকে পরিশেষে কায়া বলল, মরা দেহকে পোড়ানো।
ননী স-উৎসাহে জিজ্ঞেস করল, দেহ পুড়ে গেলে মানুষ কী করে বৈকুণ্ঠধামে যাবে?
অন্ধকে চক্ষুষ্মান করার উদ্দেশ্যে কায়া বলল : দেহ হচ্ছে আত্মার পোশাক, সৎকারে দেহ পোড়ে কিন্তু আত্মা নয়।
তারপরই কী একটি প্রশ্ন, কী একটি জিজ্ঞাসা ননীর মানসসরসীর তলদেশ থেকে উঠি-উঠি করে ফুটে উঠতে চাইল। প্রথমে সেই জিজ্ঞাসার আকার ননী দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু ক্ষণপরেই তার মনে পড়ল। মনে পড়ামাত্র উদ্গ্রীব হয়ে সে কায়াকে প্রশ্ন করল, কেন?

যুক্তকরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ননী তাকিয়ে রইল। কায়া বলল : কারণ, আত্মার ক্ষয় নেই, বিনাশও নেই, এমনকি অপচয়ও হয় না। দেহ ছেড়ে প্রাণ চলে গেলে আত্মাও বেরিয়ে যায়। মনে করো, প্রাণটাই আত্মা, প্রাণ শুধু জীবিত দেহটাকে সতেজ রাখে।
ননী বিস্ময়ে শিহরিত হয়ে উঠল। এটি সে কী শুনছে! তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ত্বরিতে জিজ্ঞেস করল, প্রাণ আর আত্মা কি তাহলে ভিন্ন জিনিস?
কায়ার মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে উঠল। বিষণ্ণ হেসে বলল : কেউ বলে প্রাণই আসল, আত্মা বলে কিছুই নেই, প্রাণ আর দেহ নিয়েই মানুষ। আবার কেউ বলে, না, আত্মা একটি আলাদা বস্তু, সে আলোর মতো প্রাণকে আগলে রাখে দেহের মধ্যে, আত্মা হচ্ছে অধীশ্বরের অংশ, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা পরমেশ্বরের কাছে ফিরে গিয়ে তার সঙ্গে মিশে যায়।
কায়ার কথা ননীর ভালো লাগল। মন্দ বলেনি। কত কিছুই অজানা রয়ে গিয়েছে, কত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে হয়তো সে বাস করছে! কায়ার কথা শুনতে শুনতে ননীর মনে হতে লাগল, সে যেন রহস্যাবৃত অন্ধকার এক গুহাকক্ষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার রহস্য তাকে গভীরভাবে নিকটে আকর্ষণ করছে। সামান্য বিরক্ত হয়েই ননী বলল, তুমি তাহলে মিশে গেলে না কেন?
লালিত মাধুর্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা দিল জলে। কায়ার নীল চক্ষু, আরক্তিম গণ্ডদেশ, সুললিত হস্ত-পদ। দুই করতল দিয়ে মুখ ঢেকে কায়া বলল : বললাম যে, সৎকার হয়নি।
অত্যন্ত আগ্রহে অধীর হয়ে ননী প্রশ্ন করল : তুমি কি কেবলই কল্পনা, শুধুই উড়ে বেড়াও মানুষের মনে?
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে রহস্যপূর্ণভাবে কায়া বলল : ঐ দ্যাখো, দূরে… কারা যেন একজনকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে রায়কুটিরের দিকে।

Series Navigationনাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত >>নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *