উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব পাঁচ

গৌরীপুর স্কুলটি প্রতিষ্টা হয়েছে ১৯৩০ সালে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অবিনাশের দাদু জোতির্ময় সেন। তিনি ছিলেন অবিনাশের বাবা অতুল সেনের কাকা। গৌরী মেলার মাঠের পাশে নিজের জমিতে দুজন শিক্ষক নিয়ে শুরু করেছিলেন স্কুলটি। তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি জোতির্ময় সেন ছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা। দেশ বিভাগ নিয়ে ভারত যখন উত্তাল তখন তিনি জেলা শহরে গিয়েছিলেন দেশভাগের বিপক্ষে মিছিল করতে। একই দিনে মুসলিম লীগেরও মিছিল ছিল দেশ ভাগের পক্ষে। এক সময়ে যখন দু’পক্ষের মিছিল মুখোমুখি হয়ে যায়; তখন দুদলের মধ্যে শুরু হয় মারামারি। মুসলিম লীগের লেঠেলদের হাতে মার খেয়ে মাথা ফেটে যায় জোতির্ময় সেনের। মাথার আঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়েন জোর্তিময় সেন। তিনি কোলকতায় যান চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে যায় ভারত ভাগ হবে। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানের জন্য পকিস্তান। চিকিৎসা শেষে জোর্তিময় সেন ফিরে আসে বাড়িতে, পাকিস্তানে। চিকিৎসার সময় জোর্তিময় সেন কোলকাতায় গিয়ে উঠেছিলেন তার এক আত্মীয় কংগ্রেস নেতা প্রবাস সরকারের বাসায়। সে পাশের ধোপাডাঙ্গা গ্রামের মানুষ, মাথা ফাটা বিলের অপর পারে, বিল গৌরীপুর থেকে কয়েক মাইলের পথ। শিক্ষা দীক্ষায় সরকার পরিাবরটি ছিল এ এলাকার একটি অগ্রগামী। ছাত্র জীবন থেকেই এ পরিবারের ছোট ছেলে প্রবাস বসবাস করতেন কোলকাতায়, পড়াশুনা করতেন রিপন কলেজে। ছাত্রাবস্থায় যুক্ত হয়ে পড়েন কংগ্রেসের সাথে। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন তিনি। দেশ ভাগ হবার পর তিনি আর ফেরত আসেন নাই। ভারতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদিন পর তার দাদাও সপরিবারে চলে যান কোলকাতায়।
ভারতে স্থায়ী হলেও তারা মাঝে মাঝে এসে জমি বিক্রি করে আবার চলে যেতেন। কখনও আসতেন দুই ভাই মিলে,  কখনও আসতেন একা। আর এপাড়ে এসে উঠতেন জোর্তিময় সেনের বাড়িতে।

একবার দুই ভাই না এসে শুধু একা আসেন প্রবাস সরকার। জমি বিক্রি করে যেদিন টাকা হাতে পান সেদিন রাতেই ডাকাতি হয় ধোপাড়াঙ্গার পার্শ্ববর্তী গ্রাম কাদিরদীর মশু মিয়ার বাড়িতে। মশু মিয়া প্রবাস সরকারের নামে ডাকাতি মামলা করে। প্রবাসের কাছে ছিল জমি বিক্রির টাকা । পুলিশ এসে জোর্তিময় সেনের বাড়ি হতে জমি বিক্রির টাকাসহ গ্রেফতার করে প্রবাস সরকারকে।ডাকাত আশ্রয় দেবার অপরাধে পুলিশ জোর্তিময় সেনকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। মশু মিয়া সেই টাকাকে ডাকাতির টাকা বলে দাবি করে। পুলিশও সেই টাকাকে ডাকাতির উদ্ধারকৃত টাকা হিসাবে কোর্টে উপস্থাপন করে।

মশু মিয়া এলাকার জমিদার এবং মুসলিম লীগ।  প্রবাস সরকারের সাথে তার ছিল পুরানো শত্রুতা। এ শত্রুতা শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ভারত তখনও ভাগ হয় নাই, বলতে গেলে ভারত ভাগ হয়ে দুটি দেশ হবে এরকম চিন্তা তখনও কারো মাথায় আসে নাই। সে সময়ে মশু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় প্রাপ্ত ছিল পনর ষোল বছরের এক কিশোর। গ্রামের সবাই তাকে শাহ্ পাগলা বলে ডাকে। খুব ছোট বয়সে মশু মিয়া ছেলেটিকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে এবং তখন থেকেই মশু মিয়ার কাছারি ঘরে তার বাস। কাছারি ঘরে থাকলেও তার প্রতি ছিল মশু মিয়ার বাৎসল্য প্রেম। ছেলেটি কোন কাজ কর্ম করেনা, তিন বেলা খায় আর সারাদিন গ্রামে ঘুরাঘরি করে বেড়ায়। কেউ বলে সে পিতৃ মাতৃহীন, মশু মিয়া আশ্রয় দিয়েছে। আবার কেউ বলে ও মশু মিয়ার ছেলে, জন্ম হয়েছে বাদির ঘরে।

সরকার পরিবারটি ছিল গ্রামের সমৃদ্ধশালী পরিবার। বিশাল বাড়ির দক্ষিণে পুকুর। পুকুরের চার পাশ ঘিরে বাগান। দুইপাশে সান বাঁধানো ঘাট। একটি ছেলেদের স্নানের জন্য, আরেকটি মেয়েদের। একদিন দুপুরে প্রবাসের বৌদি এবং বোনেরা স্নান করছিল পুকুরে, হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে শাহ পাগলা পুকুরের অপর পাড়ে গাছের নিচে হাটুর উপরে লুঙ্গি তুলে দাঁড়িয়ে মহিলাদের স্নান করা দেখছে। বৌদি তখন শাহ্ পাগলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে ওখানে কি করছো? শাহ্ পাগলা তখন লুঙ্গি উচু করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি শুরু করে দেয়। প্রবাস তখন গরমের ছুটিতে বাড়িতে ছিল। বৌদি প্রবাসকে ডাক দেয়, প্রবাস এসে সব শুনে দৌড়ে গিয়ে ‌ধরে ফেলে শাহ্ পাগলাকে। তারপর বেদম পিটিয়ে মাজার কটি ভেঙে ফেলে। মশু মিয়া খবর পেয়ে লোক পাঠিয়ে বাঁশের চাঙ্গে করে নিয়ে যায় শাহ্ পাগলাকে।
মশু মিয়া আর শাহ্ পাগলা তক্কে তক্কে ছিল প্রবাসের উপর প্রতিশোধ নেবার। ডাকাতি সেই মোক্ষম সুযোগটি এসেন দেয়। মশু মিয়া প্রবাসকে আসামি করে মামলা করে। মশু মিয়ার বউ ছিল মামলার এক নম্বর সাক্ষী। সে স্বাক্ষ্য দিয়ে বলে, সে প্রবাস সরকারকে বহু আগের থেকে চিনে, ডাকতির সময় লু্ঙ্গী ছিল পড়া আর মাজায় ছিল গামছা বাঁধা। সে আর কাউকে চিনে নাই।

মামলার দুই নম্বর সাক্ষী ছিল শাহ্ পাগলা। সে সাক্ষ্য দেয় ডাকাত ঘর থেকে বের হবার সময় সেও চিনেছিল প্রবাস সরকারকে। সেই সময় সে আরো বলে এই ডাকাত আমাকে এর আগে মেরে মাজার কটি ভেঙ্গে ফেলেছে, যে কারণে সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে এবং হেটে দেখায় জজ সাহেবকে। মামলায় প্রবাস সরকারের সাড়ে সাত বছরের জেল হয়ে যায়। জোর্তিময় সেন বেকসুর খালাস হয়ে যান। ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার হওয়াতে জোর্তিময় সেন অপমানিত বোধ করেন এবং ভবিষ্যতে আরো হয়রানীর আশঙ্কায় মাঠের সব জমি বিক্রি করে পরিবারসহ ভারতে চলে যান। স্কুলের জায়গাটি দান করে দেন স্কুলকে। আর ভিটেটা রেখে দেন অবিক্রিত। বলেছিলেন, ওটা থাক, পূর্বপুরুষের ভিটে। মাঝে এসে দেখে যাব। আর ছেলেমেয়েদের নাড়ি ছেঁড়া করি কিভাবে। ভিটেটা যতদিন থাকবে, নাড়ির টানও থাকবে। তারপর ছেলেরা বড় হয়ে কি করবে সেটা ওরা জানে।

কিছুদিন শুরু হয় পাক ভারত যুদ্ধ। যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, যে সকল হিন্দু যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শত্রু ভারতে অবস্থান করেছে তারা পাকিস্তানের শত্রু। তাদের সব সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হবে। এ সম্পদে তাদের কোন অধিকার নাই, এই সম্পত্তি রাষ্ট্রের। সরকারের ঘোষণায় জোতির্ময় বাবুর ভিটেটা হয়ে যায় শত্রু সম্পত্তি। এখন সেটা পাড়ার ছেলেমেয়েদের দাড়িয়াবাঁধা, হাডুডু, গোল্লাছুট খেলার মাঠ। যুদ্ধ শেষে খবর আসে প্রবাস সরকার জেলের ভিতর হার্ট এটাক করে মারা গেছেন। জোতির্ময় সেন চলে যাবার পর বন্ধ হয়ে হাই স্কুল সেকশনটি বন্ধ যায়। প্রাইমারি সেকশানটি খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে থাকে। ১৯৬৮ সালে অবিনাশের বাবা আর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফ্ফার মন্ডল উদ্যোগ নিয়ে জুনিয়র হাই স্কুলটি আবার চালু করে। ১৯৭২ সালে সরকার প্রাইমারী অংশটি সরকারিকরণ করে। এখন একপাশে প্রাইমারি আর আরেক পাশে হাই স্কুল।

অবিনাশ এবং নিশিকান্ত দুজনই একসাথে স্কুলে গিয়েছিল হাইস্কুলে ছেলেদের ভর্তি করাতে। অতুল আর নিরু দুজনকেই চিনতো হেডমাস্টার। এই প্রাইমারি স্কুল থেকেই পাশ করেছে তারা। প্রাইমারি থেকে কতজন ছাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারে তার একটা হিসাবও হাইস্কুলের শিক্ষকদের মাথায় ছিল। নিরু আদৌ হাইস্কুলে ভর্তি হতে পারবে কি পারবেনা এরকম একটা দোলাচাল ছিল তাদের। নিরঞ্জনকে দেখে সে একটু আশ্চর্য হয়ে যায় হেডমাস্টার। নিরঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে বলে, দাদা আপনার মত বাবা কজন আছে। আপনার নিজেরই চলেনা, কিন্তু ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করছেন হাই স্কুলে। স্কুলের বেতন, সেশন ফি, পরীক্ষার ফি, বই কেনা, সারা বছরের খাতা পত্র; অনেক খরচ। হয়তো আপনার জন্য একটু কষ্টই হয়ে যাবে। তারপরেও চেষ্টা করে দেখেন।

নিশিকান্ত একটু চমকে উঠে। এতদিন যে হেড মাস্টার তাকে নিশে বলে সম্বোধন করতো, আজ সে তাকে বলছে দাদা । নিশে থেকে দাদা! নিশকিান্ত মনে মনে ভাবে, এটাই মনে হয় শিক্ষার গুণ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অকপটে স্বীকার করে, না মাস্টার মশাই, আমার সে সাধ্য নাই। আমি ওকে মাঠের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর ইচ্ছা পড়শুনা করার। নিরু তার যশোদা মা বলতে পাগল, যশোদা মাও নিরু বলতে পাগল। সেই দ্বায়িত্ব নিয়েছে ওর পড়াশুনার। পাশে বসে কথা শুনছিল অবিনাশ। নিশিকান্তের কথা শেষ হতেই হেডমাস্টারকে বলে, নিরুর বেতন ফি নিয়ে চিন্তা করবেন না। অতুলের সাথে ওরটাও পেয়ে যাবেন। অতুল আর নিরু ভর্তি হয়ে যায় হাই স্কুলে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু ।। পর্ব চারউপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব ছয় >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *