উপন্যাস

নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব আট

রাধারমণ-সংগীত

আমার নারীকুলে জন্ম কেন দিলায় দারুণ বিধি রে
নারীকুলে জন্ম দিয়া ঘটাইলায় দুর্গতি রে।
শিশুকালে পিতার অধীন, যৌবনেতে স্বামীর অধীন রে
ওরে বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন আমারে বানাইলায় রে।
যদি আমি পুরুষ হইতাম মোহন বাঁশি বাজাইতাম রে
কত নারীর মন ভুলাইতাম বাজাইয়া মুরলী রে।
ভাইবে রাধারমণ বলে নারীজনম যায় বিফলে রে
না নাগিল সাধের জনম বন্ধুয়ার সেবায় রে।

কমলিকা দুপুরের আগেই মাটির উনুনে রান্না চাপিয়ে আহার প্রস্তুত করল। ফেন গেলে মাটির গামলা খইলসহ ভরিয়ে দিল। তারপর বাঁশের চাটাই চাপিয়ে মাটির আধলা দিয়ে বসিয়ে রাখল। বাড়ির উঠোনে কোনও হাঁড়িখোর কুকুর দেখলেই বাঁশের কঞ্চি হাতে তেড়ে চলে গোপাট অবধি। কুকুরও চেনে কমলিকাকে। মাঝেমধ্যে তার কুকুর-তাড়ানোর দৃশ্য দেখে ননী মুচকি হাসে, আনন্দ লোটে। অনেক সময় পাগল বলে খেপায় তাকে। অনেক সময় ননী ভাবে, কেন এমন করে কমলিকা? তবুও তার সখীর জন্য মায়া ফুরোয় না। দুপুরের আগে ফেন গালে, কারণ দুপুরের পরপরই ঘনশ্যাম বলদ দুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। বলদগুলোর আহারের প্রয়োজন। ফেনের জন্য মানুষের চেয়ে জন্তুর মুখ অধিক হাঁ করে থাকে। আজও সময়মতো ঘনশ্যাম ফিরল। দড়ি খুলে দিতেই বলদ দুটি দিগ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলল ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠোনের সরণি ধরে আহারের সন্ধানে। কালো বলদটি খইলসহ ফেনে মুখ ডুবিয়ে খেতে লাগল, কিন্তু লালটি মুখস্পর্শ করেই থেমে গেল। আর তখনই ঘনশ্যামের দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলল, তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে?

ঘনশ্যাম ঈষৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, না।

কমলিকার বুক ধক্ করে উঠল, তার মুখ পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেল। কোথায় কী-একটা সমস্যা আছে, এই সংশয় হঠাৎ তার মনে জেগে উঠল। সে বলল : তোমার মন খারাপ হলে আমি ঠিকই বুঝতে পারি, সেকথা কি তুমি জানো না, কোনও দিন কি তা লুকিয়ে রাখতে পেরেছ? তাই অনুরোধ করছি, বলো, কী কারণে তোমার মনে এত মেঘ জমে আছে?
দীর্ঘশ্বাসের মতো দক্ষিণ-হাওয়া বইতে লাগল। ঘনশ্যাম একটু নীরব থেকে বলল, লাল বলদটি আজ কিছুই মুখে তোলেনি। একটা ঘাসও স্পর্শ করেনি। মনে হয় খুরের মধ্যে ব্যথা হচ্ছে। বাড়ি-ফেরার পথে লক্ষ করছি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
অতি ধীরে ধীরে লাল গরুটিকে স্পর্শ করল। সে চমকে উঠল। বলল : তাই তো, মুখে ফেনও তুলছে না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে তার বাহুবন্ধন গভীর করে বলল : তবে চিন্তার কোনও কারণ নেই, একবার পশু- বৈদ্যের কাছে গেলেই হবে।

একটা প্রবল হাওয়া উঠলে যেমন অকস্মাৎ ঘন মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়, তেমনই কমলিকার কথায় ঘনশ্যামের দুশ্চিন্তার গ্লানিময় মুখটি পরিষ্কার হয়ে উঠল। কমলিকার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ঘনশ্যাম। কমলিকার স্নিগ্ধগম্ভীর মুখ, তার বিশেষ ধরনের শাড়ি পরা, তার চুল-বাঁধার পরিচিত ভঙ্গি, তার হাতের সাধারণ বালা এবং তারাকাটা দুটি স্বর্ণের চুড়ি দেখামাত্র ঘনশ্যামের বুকের মধ্যে একটা তরঙ্গ যেন একেবারে গলা পর্যন্ত উচ্ছ্বাসিত হল। তাই সে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তার মুখখানি একেবারে ক্ষুদ্র হয়ে গেল। অতঃপর সে ব্যথিতচিত্তে বলল, বিলম্ব করা আর তো উচিত নয়। তাহলে এক্ষুনি যাই, দেখি পশু-বৈদ্য কী বলে!
কমলিকার মনে হল : সাংসারিক কোনও সংকটে ঘনশ্যামের মনের মধ্যে কী যেন একটা ভার চেপে রেখেছে, তার কিছুই কমলিকার জানা হয়নি, হয়তো তাই বলল : ঠিক আছে যেয়ো। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছ থেকে কিছু-একটা লুকোচ্ছ।

কিছু-একটা, মানে?

আত্মসংবরণ করে কমলিকা হেসে বলল : মনে রেখো, আমি তোমাকে ঠিক ঠিক পড়তে পারি। তাই লক্ষ্মী মানুষের মতো বলে ফেলো, তোমার কী হয়েছে?
ঘনশ্যাম কোনও উত্তর না দিয়ে একটুখানি হাসল; তারপর বলল : কী আবার হবে! তাছাড়া তোমাকে বলেও কোনও লাভ নেই। অনর্থক তোমাকে জ্বালাতন করা। তার চেয়ে বরং আমাকে যেতে দাও। পশু-বৈদ্যের কাছে বিলম্ব না করে এখনই যাওয়া প্রয়োজন। কাজটি যত তাড়াতাড়ি করব ততই মঙ্গল হবে।
ঘনশ্যামকে বিরক্তিদৃষ্টিদ্বারা বিদ্ধ করল কমলিকা। বলল, পশু-বৈদ্যের কাছে গেলে হয়তো-বা লাল বলদের অসুখ সেরে যাবে, কিন্তু তোমার মনের যন্ত্রণা কি এতে সারবে?
বিবর্ণ মুখ নত করে দাঁড়িয়ে রইল ঘনশ্যাম। তাকে বেদনার ওপর ব্যথা দিল বলে কমলিকার প্রতি তার মনে ভারি রাগ হল। এক সময় আস্তে আস্তে বলল : তুমি আমাকে এমন করে বোলো না, রসবতী। নিজের কাছে নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হয়। সত্য বলছি, আমার মনে কোনও অসুখ নেই।
কর্তব্যবোধে ভারাক্রান্ত ঘনশ্যাম একটু গম্ভীর স্বভাবের। বিচারশক্তির প্রাবল্যে তার শরীর-মন যেন মন্থর হয়ে গিয়েছে। যেইরূপ আকাশের জ্যোতির্ময় নক্ষত্র চলেফিরেঘুরে বেড়ায়, কিন্তু মানমন্দির নিজের যন্ত্র নিয়ে অত্যন্ত সাবধানে স্তব্ধ হয়ে থাকে—ঘনশ্যামও সেইরূপ এই চলমান জগৎসংসারের মধ্যখানে নিজের সমস্যা নিয়ে যুক্তিতর্কের আয়োজন-ভারে স্তম্ভিত হয়ে আছে। তার দেহে-মনে কেমন যেন একটা চিন্তার ছায়া আবির্ভাব হয়েছে। স্বামীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কমলিকা বলল, তাহলে তো হলই।
ঘনশ্যাম কোনও কথা বলল না। সে ভেবে পায় না, হৃদয়াবেগের পরিণাম কোথায়। তার সাংসারিক বুদ্ধি বর্তমানে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ, কমলিকার কী যেন কী মনে পড়ে গেল, বলল : একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।

অধীর হয়ে ঘনশ্যাম বলল, কী?
নায়েব মহাশয় এসেছিলেন।
মুখ ঈষৎ ম্লান করে ঘনশ্যাম বলল, কিছু বলে গেলেন?
অধিকতর বিরক্ত হয়ে কমলিকা বলল : সরাসরি নয়, কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে বলে গেলেন, এবার অতিরিক্ত খাজনা দিতে হবে।
তোমার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়নি?
না, তিনি আমাকে সরাসরি কিছুই বলেননি, বরং উঠোনে দাঁড়িয়ে এমনভাবে উচ্চবাক্য করলেন যেন পাড়াসুদ্ধ সবাই শুনতে পায় তার কথা।
ঘনশ্যামের শরীর ও মন যেন হাওয়ার ওপর ভাসতে লাগল। অশান্ত হৃদয়ে জিজ্ঞেস করল, কীরকম উচ্চবাক্য?
কমলিকার ওষ্ঠাধর কাঁপতে লাগল। সে উদ্বেল অশ্রুজলের উচ্ছ্বাস অনেক কষ্টে সংবরণ করে কম্পিত কণ্ঠে বলল : সকল উচ্চবাক্যের স্পষ্ট অর্থ বোঝা যায়নি, প্রত্যেক কথা বোঝারও কোনও প্রয়োজন পড়েনি। তবে যা বোঝার তা আমি বুঝে নিয়েছি।
অন্যমনস্কভাবে একটু চুপ করে থেকে, একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘনশ্যাম জানতে চাইল, কী বুঝলে?
কমলিকার মনটা বিকল হয়ে গেল। উৎকণ্ঠিত হয়ে অর্ধস্ফুটস্বরে বলল, রায়বাহাদুর কিছুদিনের মধ্যে ভাটিদেশে ফিরবেন। আসরের আয়োজন করতে হবে। আর তাই খাজনার পরিমাণ একটু বেশিই দিতে হবে।
আরক্ত মুখে ঘনশ্যাম বলল, তা বলবেনই তো। তবে তিনি ভুলে বসে আছেন যে, আমার কাছে চাষের জন্য দেওয়া তার জমিনের পরিমাণ কতটুকু! আমার কাছে তার এইটুকু ভূমি, লাঙলই ঠিকমতো ঘোরে না, তার ওপর আবার অতিরিক্ত খাজনা! ঠিক আছে, সময়মতো পরিশোধ করে দেব। এ নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না।
এই বলে ঘনশ্যাম দ্রুতবেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হল। মুখের ভাব অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। মুখটি আরও গম্ভীর হতে থাকে।

ননী কোনও সাড়াশব্দ ছাড়াই উঠোনের এক পাশে, জলতলায় সাবান ঘষে কাপড় কাচতে ব্যস্ত। কাপড়গুলো তেমন নোংরা হয়নি, তবুও বাইরে থেকে ফিরে আর-কোনও কাজ হাতের কাছে না-পেয়ে, একান্ত তুচ্ছ ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে ওঠে ননী। এরকম দৃষ্টান্ত তার জন্য অবশ্য নতুন নয়, আজকাল এমনই করে সে। কাচতে কাচতে একবার ঘাড় তুলে তাকাল, তারপর দাঁড়িয়ে দুই হাতে পিষে কাপড়গুলোর নোংরা নিষ্কাশন করতে লাগল। লুকোচুরির দৃষ্টিতে আবারও দেখে নিল চারপাশ। তখনই চোখে পড়ল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘনশ্যামকে। সে ননীর কর্মকাণ্ড দেখছিল। ঘনশ্যামের প্রতি চোখ পড়তেই ননী চমকে উঠল। তার মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। গলার ভাঁজে ঘামের মৃদুরেখা। গভীর কালো-ডাগর চোখে অবশ্য ভয়ও বিরাজ করছে। দৃষ্টি যেন রোদ-পোড়া বিষণ্ণতায় মøান। ননী কেমন যেন অপরাধীর মতো এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘনশ্যাম জিজ্ঞেস করল, কী করছিস রে ননী?
বিবর্ণমুখে ননী বলল, কিছু না দাদা। কাপড়ে ধুলোর পাতলা স্তর বসেছিল। তাই ভাবলাম, একটু কেচে নিই।

এই কথার মধ্যে ননীর সান্ত্বনাসুধাপূর্ণ হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করল ঘনশ্যাম। নিজের ব্যথিত অন্তঃকরণের মধ্যেই তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারল। তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বলল, নায়েব মহাশয় যখন এসেছিলেন তখন তুই কি বাড়িতে ছিলি?
ঘনশ্যামের দিকে তাকিয়ে ননী বলল : ছিলাম গো দাদা, ছিলাম। তারপর মুখ নত করে বলল, নায়েম মহাশয় আস্ত একটা মেøচ্ছ। ভগবানের প্রতিও ওর কোনও ভয় নেই। অন্যের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে কিছু আদায় করতে পারলেই হল, যেন এ-ই তার একমাত্র জীবনসাধনা। তারপর মুখের ওপর কাপড় তুলে বলল, আমি ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি গো দাদা।
ননীর পাশে এগিয়ে যেতে ঘনশ্যাম কুণ্ঠিত হল। পশ্চাৎ থেকে কিছুক্ষণের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল। ঘনশ্যামের স্তব্ধমূর্তিটি ননীর মনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী ছবি এঁকে দিল। ননী হঠাৎ স্ফীতচঞ্চল কণ্ঠে বলে উঠল : ওকে স্বচক্ষে দেখেছি, সারা দিন ক্ষেতখামারে ঘুরে বেড়ায়। কোন্ জমিতে বেশি ফলন হয়েছে তার খবর নেয়। যে-জমিনে ফলন বেশি সেই জমির কৃষকের ওপর তার দৃষ্টি চকচক করতে থাকে। এবার তোমার ওপরই তার দৃষ্টি চকচক করছে।
আস্তে আস্তে ননীর কাছে এসে দাঁড়াল ঘনশ্যাম। ঘনশ্যাম বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বলল : কীসব বাজে বকছিস তুই, আমার ওপর কেন তার দৃষ্টি চকচক করবে? না, না, তুই সব ভুল বোকছিস।
ননী তার স্নিগ্ধকরুণ দুই চক্ষু তুলে ঘনশ্যামের মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখল। তার পরে সহসা বিগলিত কণ্ঠে বলল : দেখো গো দাদা, আমার ধারণাই সঠিক হবে।
ঘনশ্যামের দুই কপোল বেয়ে চিন্তা ঝরে পড়তে লাগল। দেখতে দেখতে কলতলে দুইজনের মধ্যে একটি বাক্যবিহীন শান্তি ও সান্ত্বনার খণ্ড সৃজিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ এই সুগভীর মৌনের মধ্যে হৃদয়মন নিমগ্ন রেখে একটি নিশ্বাস ফেলে ঘনশ্যাম বলল, আমি এখন গেলাম রে ননী! তোর বউদিকে দেখে রাখিস।
ঘনশ্যামের এই কথায় ননীর কপোলের কাছে একটুখানি রাঙা হয়ে উঠল। বলল, আমি তো সব সময়ই আমার সখীর প্রতি লক্ষ রাখি।

Series Navigation<< নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *