উপন্যাস

নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়

রাধারমণ-সংগীত

মান ভাঙ রাই কমলিলী, চাও গো নয়নও তুলইয়া
কিঞ্চিৎ দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া
এক দিবসে রঙে ঢঙে গেছিলাম রাধার কুঞ্জে
সেই কথাটি হাসি হাসি কইলাম তোমার পুঞ্জে
আরেক দিবস গিয়া খাইলাম চিড়া পানের বিড়া
আর না যাইব চন্দ্রার কুঞ্জে, দিলাম গো মাথার কিরা
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আইজ অবধি কৃষ্ণ নাম দিলাম গো ছাড়িয়া।

একজন পরিচিত বাইজিকে নিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছে ননী। বাইজি মানুষটি ভীষণ অদ্ভুত। গ্রামে এসেই ননীর সন্ধানে চলে এল শংকরদের বাড়িতে। তার একটা নাম ছিল, কিন্তু তা হারিয়ে গেল বাইজি নামেই। এক সময় সেসব হারিয়ে আরও উদাস হয়ে চলে গেল লখনৌ। সেই থেকে সে একা। একেবারে একা।
হ্যাঁ, কয়েকদিন আগেই সে গ্রামে ফিরেছে। আজ ননীকে নিয়ে নৌকাবিলাসে বেরিয়েছে। এই সময় ভাটিদেশ যেন সিংহসমুদ্র। হাজারো সিংহ এক সঙ্গে গজরাচ্ছে। বাইজিরও তাই মনে হয়। সিংহই বটে। তবে গর্জন যখন থাকে না, শুধু ঢেউ ভাঙে, তখন মনে হয় সফেন সমুদ্র, তখন সিংহ নয়, কেশর-ফোলানো শ্বেত পক্সিখরাজ। যদিও নোনাজল নেই, তবুও সমুদ্রের মতোই সারা রাত্রি কেঁদে চলপ। বাইজি নৌকায় বসে চারদিকে ঘাড় ঘুরোয়। রাতভর যে সমুদ্র কান্না শোনায়, এই মুর্হূতে সে নীল জলধি। যদিও দৃষ্টি যত দূর যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, জল যেন খেয়ে ফেলেছে সকল ধানি জমি আর ঘাসের মাঠ। কোথাও কোনও গাছ-গাছালির ছায়াও নেই। হয়তো-বা দূরে, কোথাও, দ্বীপের মতো ভেসে থাকে ঘরবাড়ির আশেপাশে কোনও গাছগাছালির ছায়া থাকলেও থাকতে পারে, যেমন আছে ননী-শংকরদের বাড়িতে।

এখন বিকেল, রোদ পড়ে গেছে। আর-একটা দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাইজি দেখছে তাকে ঘিরে ছায়া নামার আয়োজন। বাইজির কৌতূহলী মুখ ননীর চোখে ধরা পড়ে। তার হৃদয়ের ডানাগুলো যেন শরবিদ্ধ হয়ে ঝাপটে ওঠে। সে তার আহত দৃষ্টিতে আর-এক পলক বাইজির মুখটি দেখে নেয়। তার মুখচ্ছবি এক মুর্হূতে গাঢ় যন্ত্রণায় ভেঙে কুঁচকে ছোট আর কালো হয়ে আসছে যেন। এক সময় ননী বলে উঠল, ভাটিদেশে কি আগে রায়বাহাদুরের পা পড়েনি?
বাইজি সারকথা বলল, অবশ্যই পড়েছে। ঐ-যে দেখেছিস রায়কুটির, সেখানেই রায়বাহাদুর আসেন। আসর জমান। রাতভর চলে ঘুঙুরের নিক্বণধ্বনি। ঘাটে নোঙর ফেলা নৌকায় ভিড় জমায় বাইজি ও ঘেটুপুত্ররা।
বাইজির কথা শুনে হাঁ করে চেয়ে থাকে ননী। চোখ-মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই। কেমন ফুটফুটে ভাব। মুখে একটি হাসির উদয় হল। হাসিটি অস্ত যেতেই ননী জিজ্ঞেস করল, তাহলে এবারও তেমনটিই ঘটবে?
বাইজি যুবতি, গায়ের রং ফরসা, চোখ-মুখে শ্রী আছে। যৌবন ফুলেফেঁপে উঠেছে। একপই বলে যৌবনরে দীপ্তি। এই দীপ্তি নিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে বাইজি।দাঁতে আঁচলের খুঁট চেপে ধরে বলল, এমনটাই ঘটার কথা। সেজন্যই আমি এখানে এসেছি। রায়বাহাদুরের আগমনে বাইজির ভাগ্য ফেরে। একটি আসরের বিনিময়ে এক যুগ সুখে কাটানো যায়।
কী যেন ভেবে নিয়ে ননী জিজ্ঞেস করল, এত জায়গা থাকতে এই ভাটিদেশে রায়বাহাদুরের আসার কী প্রয়োজন?

ঘুরেফিরে সেই এক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কখনও মনে হয়, প্রশ্নটা তারই অস্তিত্বের ভেতরে অনেককাল ধরে ছিল। ধীরে ধীরে এটা বড় হয়েছে, এখন যেন চারদিক থেকে ফেটে পড়তে চায়। বাইজি ভেবে পায় না প্রশ্নটির শুরু কবে থপকে? প্রশ্নটা যেন কার মুখে প্রথম শুনেছে সে!সে মনে মনে হাতড়ায়, কিন্তু উত্তর পায় না। অবশেষে সে বলল, এটি যে তার জন্মস্থান। তাছাড়া ভাটির জলেই তো বাইজি জন্মায়, ঘেটুপুত্র জন্মায়। এই মৃত্যুঞ্জয়ী সুধা পান করতে রায়বাহাদুরকে তো এখানে আসতেই হয়। তাছাড়া যে আর কোনও উপায়ও নেই, বুঝলি?
ননী চমকে উঠল। সে বিড়বিড় করল : তুমি কি জানো, কবে থেকে এই প্রথা চালু হয়েছিল?
বাইজি বলল, লোকমুখে শোনা কথা, তা অবশ্যই ভাটিদেশের জন্য এক বেদনাদায়ক ইতিহাস।
সারা মনে বিষাদ নিয়ে ননী বলল, বেদনাদায়ক ইতিহাস?
মিহি কণ্ঠস্বরে বাইজি বলল : শোন্ তাহলে, সেই কবেকার এক প্রভাতে, বণিক-নৌকাগুলো নোঙর ফেলেছিল এই অঞ্চলে। বউ-ঝিরা উঁকি দিয়ে দেখেছিল, সেই সুবিশাল কিস্তিগুলোকে। শুনছেি, পণ্ডিতমশায় নাকি কঞ্চিকলম ফেলে ছুটে এসেছিলেন কিস্তিগুলোর গায়ের লেখা পড়তে। লাঙল ফেলে দৌড় তুলেছিল কৃষক মাস্তুলের গর্জনে।
ননী ইতস্তত করল দুই মুর্হূত, আর ঠিক এই সময়ের মধ্যে অচতেনভাবে লগি টানার কারণে তার আঘাতে জল দানবপর মতো ডেকে উঠল। জলের দিকে তাকিয়েই ননী বলল, এটি কি দানব ছিল?
বাইজি মনে মনে বলল : এটি এক নিদারুণ প্রশ্ন। কেবলই ঘুরেফিরে আসছে। একাকী থাকলওে মনে হয় কে যেন পাশ থেকে বলে ওঠে। আর প্রকাশ্যে বলল : লোকে বলে, লৌহদানব। তরঙ্গের-পর-তরঙ্গ তুলে ধেয়ে এসছিল সেই কিস্তিগুলো, আমাদের চিরপরিচিত ভাটিপথ ধরে।
তারপর?
তারপর, যা হওয়ার তাই হল। আমাদের চেনা ঘাট থেকে আর নোঙর তুলল না ভিনদেশি বণিকরা। অন্যদিকে, ভাটিদেশের মানুষেরা ভাবল, বণিকরা কয়েক দিনের অতিথিই মাত্র! তাই এই লৌহদানবকে ঘিরে জমে উঠল আসর, চলতে লাগল রাতভর সংগীতের লহরি আর নৃত্যের ঝংকার।
এই মুর্হূতে বাইজির মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিবোধ করল ননী। বাইজির চোখের ভেতর ভারি করুণ বিষাদ। কেমন যেন জড়িয়ে ধরতে চায় এই বিষাদময় দৃষ্টি। এই দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই যেন ননী বলে উঠল, তুমি খুব সুন্দর নাচতে পার। এক-একবার মনে হয় আমি যদি তোমার মতো নাচতে পারতাম!

বাইজির হাসি পায় ননীর কথা শুনে। অস্পষ্ট হাসওে। অস্পষ্ট হাসি ঠােঁটরে কোণে মলিয়িে গেলেই সে বলল : ননী, ভুলেও এমন কথা বলিস না। বাইজির নাচের অপমান সহ্য করতে পারবি না। চোখের জলে কিনার খুঁজে পাবি না।
একথা বলতে বলতেই বাইজির মনে ঘনীভূত হতে থাকে এক বিহ্বল ব্যাকুলতা। ক্রমশ শঙ্কিত হয় তার তাবৎ অনুভূতি জুড়ে। তাই নদীর জলে দৃষ্টি ছুড়তে সে বাধ্য হয়। সেই দৃষ্টির আঘাতেই যেন ভাটিজলে মৃদু কাঁপন সৃষ্টি হয়। নৌকাও যেন তলিয়ে যাচ্ছে এই কাঁপনের সমারোহে। তারপর, এক সময়, সে ননীর কথায় বাস্তবে ফিরে আসে, ননী বলল : ঠিক আছে, লৌহদানবকে ঘিরে জমে ওঠা আসরের কথাই বলে যাও।
সংগীতের লহরি আর নৃত্যের ঝংকারকে কেন্দ্র করে ভিড় জমে উঠল পণ্ডিত আর চণ্ডালের। চলল মোহ আর সোহাগের বিনিময়। তারপর…
ননী ধাক্কা খায় মনে মনে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল : বলে যাও, আমি শুনছি।
এক সময় এই ভাটিতল্লাট দখল করে নিয়েছিল ভিনদেশি বণিকরা।
চেতনাকে রুদ্ধ করে, যেন মুর্হূতের জন্য স্তম্ভিত হয়ে, ননী বলল : তাহলে লোকজন ঠিকই বলে, এ হচ্ছে বেদনাদায়ক এক ইতিহাস।
বাইজির বুকের মধ্যে কেমন যেন ছটফট শুরু হয়। কেমন ভয়-ভয় লাগছে তার। শহিরিত হওয়ার বেদনা আমার কাছে সত্যি সত্যিই অতিচেনা। এই অতিচেনা বেদনা হৃদয়ে পোষণ করে বাইজি আবার কথা বলতে লাগল, দখল করেই বণিকরা থেমে থাকেনি, বরং ঠিকাদার বানাল স্বদেশি লোকদের।
ননী নিশ্চুপ হয়ে গেল আচমকা। যখন নৈঃশব্দ্য ভাঙল তখন সে জিজ্ঞেস করল, মানে?

নির্গমনের পথ পেলেই বাষ্পের বেগ প্রবলতর হয়ে ওঠে, এটিই বাষ্পযন্ত্রের মূল কথা। বাইজির অন্তরের পুঞ্জীভূত বিষবাষ্পও ননীর কথার দ্বারা বহিরাগমনের সামান্য পথ বেয়ে প্রবলতর বেগ ধারণ করল। আসলে বাইজির সবচেয়ে ব্যথার জায়গায়ই ঘা দিয়েছে ননী। বাইজি বলতে লাগল, রায়বাহাদুরের মতো প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীকে ভিনদেশি বণিকরা বানাল স্বদেশীয় ঠিকাদার। অর্থের লোভে ভাটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে তারা একেবারেই উদাসীন হয়ে পড়ে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পোড়ামাটির সন্ধান করতে লাগল স্বদেশীয় ঠিকাদাররা। আমাদের বাড়ির আকাশছােঁয়া বৃক্ষরাজি মাটিতে শুয়ে পড়ল। গাছগাছালি পরষ্কিার করা হল। খাঁ-খাঁ করতে লাগল সব। আমার পিতৃপুরুষের রক্ত আর ঘামে গড়ে উঠল অট্টালিকা। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল রায়কুটরি।
রাগে দুঃখে অভিমানে দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে বাইজির। তা ননীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। তাই হয়তো প্রসঙ্গ পালটাতে সে বলে উঠল, কিন্তু একটা কথা কোনও মতেই মাথায় ঢুকছে না।
কোন্টা?
আমাদের মতো বাইজি ও ঘেটুপুত্রদের অন্য মানুষের মতো কেন কোনও সম্মান নেই?
খিলখিল করে হেসে ওঠে বাইজি, তারপর নিজেকে স্থির করে বলল : এর উত্তর আমার জানা নেই, ননী। তবে রায়কুটিরের সঙ্গে এর সর্ম্পক সংযুক্ত, এই সর্ম্পক র্দীঘকালের।
প্রায় মুর্হূতখানেক স্তব্ধ হয়ে রইল ননী। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। অন্ধকারও হয়ে উঠল বলা যায়। তারপর চাপা অভিমানে বলল, আমরা তাহলে নর্তকী। অন্ধকূপের অধিবাসী। ঝমঝম নাচি। ঝলক তুলি মুর্হূতে। বণিক ও রায়বাহাদুর গোষ্ঠী নিজস্ব স্বাদে আঁকড়ে ধরে আমাদের।
সঙ্গে সঙ্গেই বাইজির মুখখানি ম্লান হল। মাথা হেঁট করে ডান পাশের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বাঁ-পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে ঘষতে ঘষতে বলল, সত্যিই বলেছিস ননী। এ হচ্ছে নিভূত কান্না। ঘেটুপুত্র আর বাইজির ঘুঙুরের নিক্বণধ্বনির চাপা কান্না। তা ক্ষণিকের জন্য হলেও জলের মূলকে করে ব্যথিত।
জলের মূলেই তাহলে ঘেটুপুত্র জন্মায়!
বাইজি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বলল, ভাটিদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঘেটুপুত্রদের জন্মসূত্র। ভাটিদেশেরে ইতিহাস হচ্ছে ঘেটুপুত্রদের বেদনার উপাখ্যান।
ঈষৎ একটু ভুরু কুঞ্চিত করে ননী বলল, আমি কোনও বেদনার উপাখ্যান হতে চাই না। চাই মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করতে।
একটি সংক্ষিপ্ত র্দীঘশ্বাস ফেলে নৌকা এগিয়ে নিতে লাগল ননী। বাদল-বরিষনের র্বাতা নিয়ে এল হাওয়া। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। ননীর চোখ দুটিও ঝলসে উঠল।

Series Navigationনাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত >>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *