উপন্যাস

নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ

জোয়ার—লাগা—ভরা—গাঙের মতো কমলিকা স্নান সেরে ভিজে শাড়িতে উঠোনে পা রাখে। রোদে কাপড় শুকানোর বাঁশে জল—নিংড়ানো কাপড় নেড়ে দিচ্ছে। শংকর দাওয়ায় বসে, মন—গলানো জল—হাওয়ার মতো কমলিকাকে দেখতে থাকে। অন্য রকম কামনায় তার হৃদয় কেঁপে ওঠে। বাস্তবতা যেন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। হাস্নাহেনার সৌগন্ধ্য আর কৃষ্ণচূড়ার মিষ্টি সৌরভের মতো কমলিকার শাড়িভেজা গন্ধ তার দেহে শিহরণ জাগাচ্ছে। কমলিকার জলভেজা চুল যেন দুলে ওঠে লবঙ্গলতার মতো। সঙ্গে সঙ্গে শংকরের অন্তরে ফুটে ওঠে সম্ভোগের অকুণ্ঠ সংস্কৃতি। কমলিকাকে রুইমাছের মতো ভোগ করার নির্লজ্জ বাসনা তার অন্তরাত্মাকে করে আপ্লুত। কোনও অপরাধ না—রাখার কৌমপ্রাচীন শুদ্ধকাম যেন শংকরকে পূর্ণমাত্রায় মানুষ হতে দিতে চাইছে না। শংকর নিজমনে কথা বলতে থাকে : নারীজাত নষ্ট করার যৌনাভিলাষ আমার মনে জেগে উঠেছে। এরকম উদ্ধতমদির নারীকে স্পর্শ করে কলুষিত করার অবাধ্য কামনা আমার দেহকে আলোড়িত করছে। তবে ভেবে পাচ্ছি না, এই উঠোনের মধ্যে কী করে তার ওপর জোর খাটাব। আমার স্থির বিশ্বাস, ওর ওপর জোর খাটাতে পারলে, সে কোনও বাধা দেবে না। আমি তার শরীরে মিশে গিয়ে একজন কাম্য কামিনী নির্মাণ করতে চাই। তাকে স্পর্শ করে, চোখ বন্ধ অবস্থায়, আমি তার দেহকে মন্থন করতে চাই। কিন্তু এসব কথা সে প্রকাশ করতে পারল না, বরং প্রকাশ করল : আমার মনটা আজ ভরে গেছে।
কমলিকার চোখ দুটি নিষ্পলকে শংকরকে দেখছে। শংকরও কমলিকাকে দেখছে, তাই শংকরের চোখ দুটি বিস্ফারিত। এই চোখের দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলল, কেন ঠাকুরপো? মেয়েমানুষের সঙ্গে রং—তামশা করে বুঝি!
শংকর মনে মনে বলল : বুকের মধ্যে মেয়েমানুষের সঙ্গে রং—তামশা করে বাঁচাকে কি বাঁচা বলে? তারপর প্রকাশ্যে বলল : কী—যে বলো না বউদি! তুমিই আমার পূর্ণিমার অপরিপূর্ণতার পরিপূর্ণতা।
শংকরের মনের মধ্যে জাগ্রত পরস্ত্রীকে ভোগ করার সামগ্রী। কমলিকাই সেই নারী, সেই দেহ। এই দেহকে ঘিরেই তার মনে জাগ্রত কামনার নিবৃত্তি ঘটাতে চায়। এই অশেষ বাসনার উৎস দেহটিকে দেখতে দেখতে তার চিন্তাচেতনায় কৃষ্ণলীলালোভ জেগে উঠল, তাই সে চায় বীজরোপণ করে তৃষ্ণার চরম তৃপ্তি পেতে।
কান খাড়া করে শংকরের কথাগুলো যেন শুনল। তারপর কমলিকা বলল : তুমি কী—যে বলো না, ঠাকুরপো! মনে হচ্ছে তুমি আবার নতুন কৃষ্ণলীলায় মেতে উঠেছ।
যা—কিছুই বিপজ্জনক, তার প্রতিই প্রত্যেকের এক অদম্য আকর্ষণ ও কৌতূহল থাকে, এমনকি ছোট ছেলেদেরও—একথা ভাবতে ভাবতেই শংকর বলল : নতুন নয়, বউদি।
শংকরের কাছে কমলিকার দেহটা শুধু দেহ নয়, মনও বটে। তার ভরাট কল্যাণময়ী বক্ষ, পূর্ণিমার পুষ্পিত দেহ শংকরের দিকে কেমন যেন তাকিয়ে আছে।
শংকর বলল, প্রেমে কি তোমার ঘেন্না?
না, তা নয়। নর—নারীর প্রেম তো থাকবেই, চিরদিনই থাকবে। তা বলছি না, তবে প্রেম বলতে তুমি যা বোঝো আমি তার চেয়ে অনেক গভীরতর কিছু বুঝি। মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম।
তোমার কথা শুনলেই আমি বোবা হয়ে যাই, বধির হয়ে যাই। যাই হোক, একটা কথা বলো তো বউদি!
কী?
আমি যদি অন্য কোনও নারীতে আসক্ত হই, তাহলে তুমি কি কষ্ট পাও না?
আমার বয়ে গেছে।
মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে শংকর বলল : মুখে যা—ই বলো, বুকে কিন্তু তোমার অন্য কথা; জ্বলন্ত আগুন। তোমার মনে পুষে রাখা অগ্নিতে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, সেকথা কি তুমি অস্বীকার করতে পার!
কমলিকা কিছুই বলে না, বরং পালানোর উপক্রম করছে, পালাই পালাই করছে, কিন্তু কীভাবে পালানো যায় তা সে ভেবে না পেয়ে বারান্দার বাঁশখুঁটিতে হেলান দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। এই তাকানোর ভঙ্গি দেখে শংকরের মুখ দিয়ে ‘রা’—শব্দটি পর্যন্ত বেরুতে দ্বিধাবোধ করছে। কমলিকার পানে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থাকে শংকর; তার দৃষ্টি যেন শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। কমলিকার নীরব থাকার মধ্যে হঠাৎ শংকর যেন এক রকম তৃতীয় শক্তির সন্ধান পায়। এই শক্তির শিকড়টা যেন কমলিকার অন্তরেই রোপিত। সেই শক্তি শাখা—প্রশাখা মেলে এই পরিবারটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শংকরের জীবনটাকেও যেন জড়িয়ে ধরেছে, সরলভাবে। এতে কোনও ক্রোধ নেই, দ্বেষও নেই। তারপর হঠাৎ শংকর বলে উঠল : তুমি কী তা তুমিই জানো না!
কমলিকা হাসল। বলল : তাই নাকি! একথা বলেই কমলিকা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। একটি শাড়ি কোনও রকম পেঁচিয়ে আবার সন্তর্পণে বারান্দায় ফিরে এল। কমলিকার শাড়ি—পরনের কলাকৌশল শংকরের নির্নিমেষ চোখে ধরা পড়ে, শিংমাছের পিঠের মতো। তার দৃষ্টি বিচিত্র রকমের রহস্যময়। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই শংকর বলল : আজ্ঞে, তা—ই বটে।
কমলিকা বলল : ঠাকুরপো, তোমার কথা যেন নপুংসক শ্রেণির অকুণ্ঠিত অসংকুচিত অপ্রতিহত অবিরত আম্রচোষণ। এতে আমি উদ্দীপ্ত হতে পারি না।
শংকর বলল : আম্রচোষণই বলো আর আমড়াচোষণই বলো, আমি জানি অন্য কারও সঙ্গে কৃষ্ণলীলায় লিপ্ত হলে তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে। তোমার চরম হিংসে হবে।
নৈর্ব্যক্তিক গলায় কমলিকা বলল, হয়তো—বা না।
শংকর চারদিক দেখে নিয়ে গর্বিত গলায় বলল : হয়তো—বা, ঠিক তাই।
শংকরের কথায় দৃঢ়তা ছিল না, দৃঢ়তা যে ছিল না তা কমলিকা বুঝল না। ওকে উদাসীন দেখেই বলল : তোমার মতো পুরুষমানুষ হচ্ছে জিয়ালা গাছের স্বচ্ছ ছায়া। এই ছায়ার সবচেয়ে বড় ভণ্ডামিই হচ্ছে কৃষ্ণলীলা। আত্মবিকাশই হচ্ছে তার একমাত্র সম্বল।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল শংকর, কী যেন ভাবতে লাগল, কোনও কথা বলল না। তারপর বলল, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না, বউদি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কমলিকা, মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখের ভাব বদলে গেল। তারপর বলল : শেষপর্যন্ত তাহলে স্বীকার করলে, তুমি আমার কথা বোঝো না। আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে। এখন সেকথা বোঝার দায়িত্ব তোমার, আমার নয়।
শংকর বিড়বিড় করে বলল, তুমি আসলেই বুদ্ধিমতী!
শংকরের বিড়বিড় করে বলা কথার উত্তর দিল কমলিকা, তোমার মতো বোকা মানুষও মাঝেমধ্যে একটু চালাক হতে পারে তা তোমাকে না জানলে বিশ্বাস করতাম না।
চাপা হাসি হাসল শংকর; তারপর বলল : আমি চালাকই হই আর বোকাই হই, তবুও একথা সত্য যে, তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসি না।
কমলিকা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শংকর তার আঁচল চঞ্চল—মুঠোয় লুফে নেয়। তারপর ভীষণ অভিমান—উদাস গলায় শংকর বলল, তুমি আমাকে অবহেলা করো কেন?
শংকরের খ্যাঁক—শিয়ালের মুঠোটি কমলিকা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। তারপর ব্যর্থতার গ্লানি মুখে মেখে খুব উত্তেজিত হতে লাগল। অতঃপর বলল, তুমি এটা কী করছ!
শংকর বলল, অযথা উত্তেজিত হচ্ছ কেন? এটার কি কোনও কারণ আছে! ঠান্ডা মাথায় আমার কাছে এসে বসো।
ধুতি—পাঞ্জাবি—পরা শংকরের মুখের একটা পাশ সূর্যের আলোয় চক্চক্ করে উঠল। হঠাৎ সে অপরিচিত হয়ে উঠল কমলিকার চোখে। গম্ভীর হয়ে কমলিকা বলল : না, না, ঠাকুরপো। এটা ঠান্ডা মাথার ব্যাপার নয়। আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, আমার পক্ষে কৃষ্ণলীলায় মেতে ওঠা মানায় না। এটাকে প্রশ্রয় দিলে আমার সংসার শিকেয় উঠতে কতক্ষণ! ঠাকুর… ঠাকুর… ঠাকুর… আমাকে ক্ষমা করো।
কমলিকা দৌড়ে ঘরে চলে গেল।

Series Navigation<< নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *