নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদচৌধুরী।। পর্ব দশ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এক
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তোরো
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব আট
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব নয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তিন
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুই
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এগারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। শেষ পর্ব
জোয়ার—লাগা—ভরা—গাঙের মতো কমলিকা স্নান সেরে ভিজে শাড়িতে উঠোনে পা রাখে। রোদে কাপড় শুকানোর বাঁশে জল—নিংড়ানো কাপড় নেড়ে দিচ্ছে। শংকর দাওয়ায় বসে, মন—গলানো জল—হাওয়ার মতো কমলিকাকে দেখতে থাকে। অন্য রকম কামনায় তার হৃদয় কেঁপে ওঠে। বাস্তবতা যেন ভেঙে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। হাস্নাহেনার সৌগন্ধ্য আর কৃষ্ণচূড়ার মিষ্টি সৌরভের মতো কমলিকার শাড়িভেজা গন্ধ তার দেহে শিহরণ জাগাচ্ছে। কমলিকার জলভেজা চুল যেন দুলে ওঠে লবঙ্গলতার মতো। সঙ্গে সঙ্গে শংকরের অন্তরে ফুটে ওঠে সম্ভোগের অকুণ্ঠ সংস্কৃতি। কমলিকাকে রুইমাছের মতো ভোগ করার নির্লজ্জ বাসনা তার অন্তরাত্মাকে করে আপ্লুত। কোনও অপরাধ না—রাখার কৌমপ্রাচীন শুদ্ধকাম যেন শংকরকে পূর্ণমাত্রায় মানুষ হতে দিতে চাইছে না। শংকর নিজমনে কথা বলতে থাকে : নারীজাত নষ্ট করার যৌনাভিলাষ আমার মনে জেগে উঠেছে। এরকম উদ্ধতমদির নারীকে স্পর্শ করে কলুষিত করার অবাধ্য কামনা আমার দেহকে আলোড়িত করছে। তবে ভেবে পাচ্ছি না, এই উঠোনের মধ্যে কী করে তার ওপর জোর খাটাব। আমার স্থির বিশ্বাস, ওর ওপর জোর খাটাতে পারলে, সে কোনও বাধা দেবে না। আমি তার শরীরে মিশে গিয়ে একজন কাম্য কামিনী নির্মাণ করতে চাই। তাকে স্পর্শ করে, চোখ বন্ধ অবস্থায়, আমি তার দেহকে মন্থন করতে চাই। কিন্তু এসব কথা সে প্রকাশ করতে পারল না, বরং প্রকাশ করল : আমার মনটা আজ ভরে গেছে।
কমলিকার চোখ দুটি নিষ্পলকে শংকরকে দেখছে। শংকরও কমলিকাকে দেখছে, তাই শংকরের চোখ দুটি বিস্ফারিত। এই চোখের দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলল, কেন ঠাকুরপো? মেয়েমানুষের সঙ্গে রং—তামশা করে বুঝি!
শংকর মনে মনে বলল : বুকের মধ্যে মেয়েমানুষের সঙ্গে রং—তামশা করে বাঁচাকে কি বাঁচা বলে? তারপর প্রকাশ্যে বলল : কী—যে বলো না বউদি! তুমিই আমার পূর্ণিমার অপরিপূর্ণতার পরিপূর্ণতা।
শংকরের মনের মধ্যে জাগ্রত পরস্ত্রীকে ভোগ করার সামগ্রী। কমলিকাই সেই নারী, সেই দেহ। এই দেহকে ঘিরেই তার মনে জাগ্রত কামনার নিবৃত্তি ঘটাতে চায়। এই অশেষ বাসনার উৎস দেহটিকে দেখতে দেখতে তার চিন্তাচেতনায় কৃষ্ণলীলালোভ জেগে উঠল, তাই সে চায় বীজরোপণ করে তৃষ্ণার চরম তৃপ্তি পেতে।
কান খাড়া করে শংকরের কথাগুলো যেন শুনল। তারপর কমলিকা বলল : তুমি কী—যে বলো না, ঠাকুরপো! মনে হচ্ছে তুমি আবার নতুন কৃষ্ণলীলায় মেতে উঠেছ।
যা—কিছুই বিপজ্জনক, তার প্রতিই প্রত্যেকের এক অদম্য আকর্ষণ ও কৌতূহল থাকে, এমনকি ছোট ছেলেদেরও—একথা ভাবতে ভাবতেই শংকর বলল : নতুন নয়, বউদি।
শংকরের কাছে কমলিকার দেহটা শুধু দেহ নয়, মনও বটে। তার ভরাট কল্যাণময়ী বক্ষ, পূর্ণিমার পুষ্পিত দেহ শংকরের দিকে কেমন যেন তাকিয়ে আছে।
শংকর বলল, প্রেমে কি তোমার ঘেন্না?
না, তা নয়। নর—নারীর প্রেম তো থাকবেই, চিরদিনই থাকবে। তা বলছি না, তবে প্রেম বলতে তুমি যা বোঝো আমি তার চেয়ে অনেক গভীরতর কিছু বুঝি। মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম।
তোমার কথা শুনলেই আমি বোবা হয়ে যাই, বধির হয়ে যাই। যাই হোক, একটা কথা বলো তো বউদি!
কী?
আমি যদি অন্য কোনও নারীতে আসক্ত হই, তাহলে তুমি কি কষ্ট পাও না?
আমার বয়ে গেছে।
মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে শংকর বলল : মুখে যা—ই বলো, বুকে কিন্তু তোমার অন্য কথা; জ্বলন্ত আগুন। তোমার মনে পুষে রাখা অগ্নিতে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, সেকথা কি তুমি অস্বীকার করতে পার!
কমলিকা কিছুই বলে না, বরং পালানোর উপক্রম করছে, পালাই পালাই করছে, কিন্তু কীভাবে পালানো যায় তা সে ভেবে না পেয়ে বারান্দার বাঁশখুঁটিতে হেলান দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। এই তাকানোর ভঙ্গি দেখে শংকরের মুখ দিয়ে ‘রা’—শব্দটি পর্যন্ত বেরুতে দ্বিধাবোধ করছে। কমলিকার পানে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চেয়ে থাকে শংকর; তার দৃষ্টি যেন শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। কমলিকার নীরব থাকার মধ্যে হঠাৎ শংকর যেন এক রকম তৃতীয় শক্তির সন্ধান পায়। এই শক্তির শিকড়টা যেন কমলিকার অন্তরেই রোপিত। সেই শক্তি শাখা—প্রশাখা মেলে এই পরিবারটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শংকরের জীবনটাকেও যেন জড়িয়ে ধরেছে, সরলভাবে। এতে কোনও ক্রোধ নেই, দ্বেষও নেই। তারপর হঠাৎ শংকর বলে উঠল : তুমি কী তা তুমিই জানো না!
কমলিকা হাসল। বলল : তাই নাকি! একথা বলেই কমলিকা ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। একটি শাড়ি কোনও রকম পেঁচিয়ে আবার সন্তর্পণে বারান্দায় ফিরে এল। কমলিকার শাড়ি—পরনের কলাকৌশল শংকরের নির্নিমেষ চোখে ধরা পড়ে, শিংমাছের পিঠের মতো। তার দৃষ্টি বিচিত্র রকমের রহস্যময়। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই শংকর বলল : আজ্ঞে, তা—ই বটে।
কমলিকা বলল : ঠাকুরপো, তোমার কথা যেন নপুংসক শ্রেণির অকুণ্ঠিত অসংকুচিত অপ্রতিহত অবিরত আম্রচোষণ। এতে আমি উদ্দীপ্ত হতে পারি না।
শংকর বলল : আম্রচোষণই বলো আর আমড়াচোষণই বলো, আমি জানি অন্য কারও সঙ্গে কৃষ্ণলীলায় লিপ্ত হলে তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে। তোমার চরম হিংসে হবে।
নৈর্ব্যক্তিক গলায় কমলিকা বলল, হয়তো—বা না।
শংকর চারদিক দেখে নিয়ে গর্বিত গলায় বলল : হয়তো—বা, ঠিক তাই।
শংকরের কথায় দৃঢ়তা ছিল না, দৃঢ়তা যে ছিল না তা কমলিকা বুঝল না। ওকে উদাসীন দেখেই বলল : তোমার মতো পুরুষমানুষ হচ্ছে জিয়ালা গাছের স্বচ্ছ ছায়া। এই ছায়ার সবচেয়ে বড় ভণ্ডামিই হচ্ছে কৃষ্ণলীলা। আত্মবিকাশই হচ্ছে তার একমাত্র সম্বল।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল শংকর, কী যেন ভাবতে লাগল, কোনও কথা বলল না। তারপর বলল, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না, বউদি।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শংকরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কমলিকা, মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখের ভাব বদলে গেল। তারপর বলল : শেষপর্যন্ত তাহলে স্বীকার করলে, তুমি আমার কথা বোঝো না। আমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে। এখন সেকথা বোঝার দায়িত্ব তোমার, আমার নয়।
শংকর বিড়বিড় করে বলল, তুমি আসলেই বুদ্ধিমতী!
শংকরের বিড়বিড় করে বলা কথার উত্তর দিল কমলিকা, তোমার মতো বোকা মানুষও মাঝেমধ্যে একটু চালাক হতে পারে তা তোমাকে না জানলে বিশ্বাস করতাম না।
চাপা হাসি হাসল শংকর; তারপর বলল : আমি চালাকই হই আর বোকাই হই, তবুও একথা সত্য যে, তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসি না।
কমলিকা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে শংকর তার আঁচল চঞ্চল—মুঠোয় লুফে নেয়। তারপর ভীষণ অভিমান—উদাস গলায় শংকর বলল, তুমি আমাকে অবহেলা করো কেন?
শংকরের খ্যাঁক—শিয়ালের মুঠোটি কমলিকা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। তারপর ব্যর্থতার গ্লানি মুখে মেখে খুব উত্তেজিত হতে লাগল। অতঃপর বলল, তুমি এটা কী করছ!
শংকর বলল, অযথা উত্তেজিত হচ্ছ কেন? এটার কি কোনও কারণ আছে! ঠান্ডা মাথায় আমার কাছে এসে বসো।
ধুতি—পাঞ্জাবি—পরা শংকরের মুখের একটা পাশ সূর্যের আলোয় চক্চক্ করে উঠল। হঠাৎ সে অপরিচিত হয়ে উঠল কমলিকার চোখে। গম্ভীর হয়ে কমলিকা বলল : না, না, ঠাকুরপো। এটা ঠান্ডা মাথার ব্যাপার নয়। আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, আমার পক্ষে কৃষ্ণলীলায় মেতে ওঠা মানায় না। এটাকে প্রশ্রয় দিলে আমার সংসার শিকেয় উঠতে কতক্ষণ! ঠাকুর… ঠাকুর… ঠাকুর… আমাকে ক্ষমা করো।
কমলিকা দৌড়ে ঘরে চলে গেল।
রাধারমণ—সংগীত
যদি আমি হইতাম পাখি উড়িয়া গিয়া শ্যামরূপ দেখি
দারুণ বিধিয়ে বুঝি পাখা আমায় নাহি দিল গো।
ভাইবে রাধারমণ বলে রূপ হেরিলাম তরুমূলে গো
এবার আমার মনের দুঃখ মনেতে রহিল গো।
বৃহৎ সংসারটি কমলিকা সামাল দিলেও মাঝেমধ্যে ননীর সাহায্য নেয়। সবকিছু কমলিকার নখদর্পণে, তাই হয়তো পুঁইশাকে কুমড়োর সঙ্গে বড়ি দিয়ে রান্না হবে কি—না, সেই ব্যাপারে তার অনুমতি নিতে চায় ননী : বউদি তুমি একবার এসে পুঁইশাকে কুমড়োর সঙ্গে কী বড়ি দেব দেখে যাও। তাড়াতাড়ি এসো, আমি রান্না চাপিয়ে দিয়েছি।
রান্না শেষ করে কমলিকা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গান্ধার স্বরের ক্রোধশ্রুতিতে যেন তার চোখের ভাষা, অশ্রুর দোলনে মেঘাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। কত দিন কতবার এরকম হয়েছে, সেকথা কি মনে আছে! কিন্তু এই অবোধ অশ্রুচ্ছায়া তার ভুরু দুটিকে ক্ষীণম্লান রেখায় ফুটিয়ে তুলেছে। শংকরের ব্যবহারই এই ক্রোধের মূল কারণ। আর চোখ দুটি মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার পেছনে কমলিকার অভিমানী মনটাই দায়ী। তারপর, তার ঘরে ঘরে প্রবেশ করে, দম ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কী মনে করে বিছানার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই দেখতে পেল তার স্বামী শান্তস্তব্ধ অবস্থায় অতীব সূক্ষ্ম নকশি কাঁথার ওপর শুয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কমলিকার কাছে ধ্রম্নব হয়ে ধরা দেয় শংকরের তির্যক মন্তব্যগুলো : এসব যেন বাজারের বিকিকিনি বালিখেলা। স্বামীপ্রেমের স্পর্শসুখের আকর্ষণে এগিয়ে আসে সে বিছানার পাশে। তার মাথায় হাত দিতেই চমকে উঠল। বলল : তোমার কী হল? এমন করে শুয়ে আছ কেন? কমলিকার দিকে তাকিয়ে ঘনশ্যাম নিশ্চুপ। কমলিকা বলে চলল, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি নিশ্চুপ থাকলে আমার মনের নীলিমা লেহন করে নেয় এক জ্বলন্ত আগুন। তাবৎ হৃদয়ে প্রসারিত হয় নির্ঘাত অস্ফুট আর্তশব্দ। আমার বুক কেঁপে ওঠে।
কমলিকার গতর একটু ভারী হলেও অসাধারণ রূপ তার, ঠিক যেন রাজেন্দ্রাণী। রং যেন ফেটে পড়ছে! তার দিকে দৃষ্টি রেখেই ঘনশ্যাম বলল, আমার কিচ্ছু হয়নি। শুধু তোমাকে দেখছি। ভিজে রক্তে নোনা স্বাদ নিচ্ছি। স্ত্রী যে কত আনন্দ দেয় তা তোমাকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
একথা শোনার পর কমলিকার অন্তঃচোখে জল ভরে উঠেছে। অশ্রুবন্যার কারণ কী তা ঘনশ্যাম অনুভব করেনি। তার দুই চোখে ধ্রুব মায়া স্ফুট। তাকে একান্তভাবে দেখতে থাকে কমলিকা; ভ্রুকুঞ্চনে, ঈষৎ কটাক্ষে আর স্মিতহাস্যে। স্মিতহাস্যে কমলিকা বলল : আমি কোনও কালেই প্রশংসা শুনতে চাইনি, চেয়েছি শুধু তোমার উষ্ণ হৃদয়ের ছোঁয়া। আর তাই তো সকাল—সন্ধ্যা তোমাকে ভালোবাসার জন্য উন্মাদ হয়ে থাকি। কী আবার দেখাচ্ছ এমন করে?
একটা অস্পষ্ট সহানুভূতিতে ঘনশ্যামের মন আর্দ্র হয়ে উঠল। মনে এই আর্দ্রতা নিয়েই ঘনশ্যাম বলল, প্রাণভরে তোমাকে দেখছি। তোমাকে ঝরনার উৎসারিত জলধারার মতো বিস্ময়স্নিগ্ধ, খুবই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বন্ধকি—জমি যেন, চোখ সরানো দায়।
হঠাৎ সচেতন হয়ে কমলিকা লক্ষ করে, ঘরে বিরাজ করছে অখণ্ড নীরবতা। ভুরু উঁচিয়ে সে নির্বাক ঘনশ্যামের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে, ঘনশ্যাম নিষ্পলক দৃষ্টিতেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। অবশেষে এদিক—ওদিক তাকিয়ে ঘনশ্যামকে জিজ্ঞেস করল, এত দেখার কী আছে?
এমন প্রশ্নের উত্তর ঝট্ করে আসে না। ঘনশ্যাম কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। নিদ্রাহীন রাত্রি বিচরণের ছাপ নিশ্চয় তার চোখে—মুখে স্পষ্টভাবে লেখা। তার আচরণ কি কমলিকার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে? না, ঠেকে না। সে বুঝতে পারে ঘনশ্যাম উত্তরের অনুসন্ধান করছে। একটু পর ঘনশ্যাম বলল : ভাটির মাটি যেমন চৈত্রের লাঙলের ফালিতে, সূর্যের কিরণে, ফসল ফলানোর খেলায় মেতে ওঠে আর বর্ষায় ভেঙে পড়ে প্লাবন বন্যায়, তুমিও ঠিক তেমনই আমার কাছে। তুমি আমার শোকে হও কাতর, আবার আমার সুখে তুমি হও সুখী। কী অপূর্ব আনন্দই না দাও তুমি! এসবই দেখছি।
কথাগুলো এমন অসাধারণ শোনায় যে, এগুলো কমলিকার মনে তৎক্ষণাৎ কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। তারপর হঠাৎ ঘনশ্যামের কথামালার মর্মোদ্ধার করার আগেই যেন একটা দুর্বোধ্য স্রোত প্রবলবেগে এসে তাকে স্থানচ্যুত করে। তার মনে বাস্তবতার স্বাভাবিক রূপ সৃষ্টি হয়। তার প্রতি ঘনশ্যামের প্রেমপ্রকাশে কমলিকার মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে, সে—ও ঘনশ্যামের সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে বলল : তুমিই আমার প্রাণ, মনোরঙ্গ জীবন। মনে আছে, একদিন যখন আমার হাতে বাবলার কাঁটা বিঁধেছিল, সেই দিন তুমি আমাকে কত ভালোবেসে দাঁত দিয়ে কাঁটাটি তুলে দিয়েছিলে।
ঘনশ্যামের মনে একটা বিচিত্র নেশার সৃষ্টি হয়। কাঁটা তোলার ঘটনাটি ক্ষণকালের জন্য তার হৃদয়ে কম্পন সৃজন করে। কেমন একটা উত্তেজনা যেন। কিছুক্ষণের জন্য বাস্তব জগৎ থেকে তার সমস্ত সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চোখের পলকেই সে বাস্তব জগতের সীমানা অতিক্রম করে নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে লাগল : তুমি আমার লাস্যময়ী উষা, স্বর্গের অপ্সরী। তুমি আমার রাজেন্দ্রাণী। তাই তো খুব সহজেই কাঁটাটি তুলে দিতে পেরেছিলাম, যেমন করে লাঙলের ফলা দিয়ে আমি মাটিকে করি বিভক্ত ঠিক তেমনই। কিংবা যেমন বলদের ঘাড়ে জোয়াল বেঁধে অনায়াসে মাটি ভেঙে করি ফসলের উপযোগী তেমনই। তোমার সৌন্দর্যে আমি হই বিভোর, শরীরে ধরে নেশা, অন্তরে সৃষ্টি হয় দুরন্ত আলোড়ন, ভাটিভূমি চেরার আদি বাসনা যেন। তাই তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। জেনে রেখো, তুমি ছাড়া আমার পৃথিবীটাই অচল, মরচে—ধরা লাঙলের ফলা যেন।
ঘনশ্যামের কথা সবটা বুঝতে না—পারলেও এগুলোকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কমলিকার নেই। সত্যাসত্য, সাধারণ—অসাধারণ, উচিত—অনুচিত বিচার করাও যেন তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। ঘনশ্যামের কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করার চেষ্টায় শুধু শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার, শরীরে গোপন কাঁপনও ধরেছে। এই কাঁপন থামার পরই কমলিকা বলল : তুমি এমন করে বোলো না, লক্ষ্মীটি। আমি তোমাকে প্রচুর ভালোবাসি, যার ভাষা শ্রেষ্ঠ চেতনায় ভরপুর। তোমাকে ভালোবাসার মধ্য—দিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই।
শঙ্কাভীতিশূন্য দৃষ্টিতে কমলিকার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ঘনশ্যাম বলল, আমাদের মতো সুখী দুটি প্রাণী এই জগতে হয়তো—বা আর নেই।
সময় দীর্ঘ ঢেউয়ের মতো ধীরেআস্তে বয়ে চলে, কমলিকার দুই চোখ আরও নিবিড় কালো হয়। সে অনুচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগল, অবশ্যই নেই। আমিও তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসি।
কমলিকার ভাষা শ্রেষ্ঠ চেতনায় ভরপুর। ঘনশ্যামকে তার ভালোবাসার মধ্যেই খুঁজে পায়। সে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে ঘনশ্যামের নগ্নবক্ষের দিকে। কামনা যেন স্ব—ইচ্ছায় জাগ্রত। ভাটিদেশের শস্যের গন্ধ দুটি দেহকে করছে আপ্লুত। ধানের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিক। ঘনশ্যাম তার হাত দুটি প্রসারিত করে কমলিকাকে তার বুকে গেঁথে নেয়। আর কমলিকার চোখ—মুখ এক মুহূর্তে গলে দলে যায়।