উপন্যাস

কিশোর উপন্যাস।। রহস্যময় লোকটা।। সারওয়ার-উল-ইসলাম।। পর্ব চার

জানালায় টুকটুক শব্দ শুনেই বুঝতে পারি আবু ডাকছে। ভোর হয়ে গেছে। প্রতিদিন ভোরে আবু আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। তারপর দু’জন চলে যাই আমাদের বাড়ির পেছনের দিকে। যেখানে রয়েছে একটা বড় পাকা মতো জায়গা। এক কোণায় খুপড়ি মতো ষ্টোর রুম। সেই রুমে থাকে আমাদের ব্যায়াম করার সরঞ্জাম। সিমেন্ট বালু দিয়ে আমরা নিজেরাই বানিয়েছি ডামবেল। বড় আমগাছটায় দুটো রশি ঝোলানো রয়েছে– ওখানে আমরা ঝুল খাই। পাকা জায়গাটাতে বুক ডন দেই।
রোজকার মতো আজও প্রথমে আমরা দু’জন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জগিং করি। মিনিট দশেক মতো ওরকম করার পর রশি ধরে ঝুল খাই।
আবু আমাকে হঠাৎ বলল, ছোট মামা, খালাম্মায় বলে রাইতে ভূত দেখছিল?
ঝুল খেতে খেতে বলি, হ্যাঁ।
কেমন দেখতে কইছে?
হ্যাঁ।
আবু আমার সামনে এসে যখন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন দেখতে? আমি তখন ঝুল সামলাতে না পেরে আবুর গায়ে পড়ে যাই– আবু হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে যায়। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গা থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে আবু আমার সামনে আসে। বলে, কেমন দেখতে?
তুই ব্যথা পেয়েছিস না?
না, বেশি পাই নাই।
বুঝলাম আবুর ভেতর ভূত দেখার সীমাহীন আগ্রহ থাকার কারণে পড়ে যাবার ব্যথাটা ভুলে গেছে। মিথ্যে বললাম– ইয়া লম্বা দাঁত, ঠ্যাং দুটো ছোট ছোট। গায়ের রঙ কালো কুচকুচে। মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া। নাকটা লম্বায় এক ফিট।
ছোট মামা আপনে না কইছেন ভূতটূত নাই?
আবুর প্রশ্ন শুনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। আমিই ওকে ভ‚ত নেই বলেছিলাম, আজ থেকে ওকে বোঝাবো একটা মাত্র ভূত আছে। আর বাকিরা মরে গেছে।
বললাম– বুঝলি আবু, আমিও জানতাম ভূত নেই। তবে একটা নাকি ভূত এখনো আছে। আর বাকিরা মরে গেছে।
আবুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আমার একেবারে কাছে এসে গা ঘেঁষে বলল, আমার মনে হয় ছোট মামা ওই দুইজনরে ওই ভূতটায় ধইয়া নিছে। আপনে কি কন?
আমার দুষ্টু বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে তাই ভরসা পেয়ে এগিয়ে যাই– বলি, হ্যারে আবু আমারও তাই মনে হয়। তবে তুই এই কথাটা কাউকে বলিস না- তোর মাকেও না। তাহলে কিন্তু তোকে সবাই বোকা বলবে বুঝেছিস?
আইচ্ছা কমু না, আবুর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
বুক ডন দিবি না আজকে। আবুকে জিজ্ঞেস করি।
ছোট মামা আইজকা আর না। আপনে দোলনায় বহেন আমি আপনেরে ঠেলা দেই।
চল তাহলে, তুই যেহেতু চাচ্ছিস না তবে দোলনায় চড়ি।
আমি দোলনায় চড়ি। আবু ধাক্কা দিতে দিতে বলে ছোট মামা, খালারে ভয় দেখাইছে ভ‚তটায়, না?
হ্যাঁ দেখিয়েছে। দোল খেতে খেতে বলি।
তাইলে তো আমারেও দেখাইতে পারে। আমি বলে আইজকা থেইকা একলা থাকুম। মায় বলে খালার ঘরে থাকবো।
শোন তুই তো খুব সাহসী ছেলে, তাই না?
হ।
তোকে ভয় দেখালেও তুই ভয় পাবি না। কারণ এখন যেই ভূতটা আছে সে খুবই বয়স্ক ভূত। বেশিদিন বাঁচবে না। শরীরে তেমন শক্তি নেই। তুই যদি সাহস করে মুখ বরাবর একটা ঘুষি মারতে পারিস তা হলে দেখবি ওর সবগুলো দাঁত খসে পড়বে।
ছোট মামা নাম জানি কি লেখছিল ভূতটার?
আবুর এমন দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশ্ন করা দেখে আমার হাসি পায়। হাসিটা চেপে রেখে বলি, ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী।
নামটা এত বড় কেন ছোট মামা?
মনে হয় ওর বাপ দাদা অনেক বড় লোক ছিল।
ও আইচ্ছা-আবুর অস্ফুট উত্তর।
তুই কি ভয়-টয় পাবি যদি তোর কাছে আসে?
না।
হ্যাঁ পাবি না। তুই তো খুব সাহসী।
আইচ্ছা ছোট মামা ভ‚তটায় থাকে কই জানেন?
এখন ওই বটগাছটায় থাকে।
কি খায় ?
যারা বেশি ভিতু তাদের পায়ের হাঁড় দিয়ে নেহারি বানিয়ে খায়।
ওরা কি আমাগো মতো ব্যাম করে?
করে। তবে এই ইরকিটি কিরকিটি ভূতং চৌধুরী তো বুড়ো হয়ে গেছে এ বোধহয় ব্যায়াম করে না।
ও আইচ্ছা। ছোট মামা আমি মনে অয় একদিন ওই ভূতটারে দেখছিলাম।
তাই নাকি? দোল খেতে খেতে আশ্চর্য হয়ে বলি।
হ। দেখি কি জানেন?
কি দেখলি?
বটগাছের মাথায় খাড়াইয়া আছে।
আবু এমনিতেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার ওস্তাদ। আমি ওর গল্পের একমাত্র নিষ্ঠাবান শ্রোতা। প্রায় সময় সে আমাকে নিজের মনের মতো গল্প বানিয়ে বলে। যেমন একদিন বলল, রাস্তায় একটা লোক ওকে বলেছে, আবু তোকে টেলিভিশনে নিয়ে যাব। তোকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুজিয়ে পিচ্চি নায়ক বানিয়ে দেব। তখন তোদের আর মানুষের বাড়িতে কাজ করে খেতে হবে না। নায়ক হয়ে অনেক টাকা কামাবি।
আমিও আবুর এ গল্পটা শুনে একদম অবাক হয়ে বলেছিলাম, তাই নাকি? তাহলে তো খুব মজা হবে। আরেক দিন আবু বলেছিল ওদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের একটা গরু সারাদিন দুধ দেয়। যে যার মতো দুধ পাত্রে করে নিয়ে যায়।
আজকের পর থেকে আবু আরেকটা বানিয়ে গল্প বলার বিষয় পেল– ভূতের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল এই বিষয়ক। আমি আবুকে বললাম, আবু ভূতটা বটগাছের ওপর দাঁড়িয়ে কি করল?
কোনো কথা বলে নাই। আবুর স্পষ্ট জবাব।
আবু, তুই পাগলটাকে চিনিসতো, ওই যে বটগাছের নিচে বসে থাকে?
হ পাগলডায় একেবারে আস্ত পাগল। কোনো কথা কয় না।
তুই পাগলটার সঙ্গে কথা বলবিতো, তোর সঙ্গে কোনো কথা বলে কি না দেখিস।
হ ছোট মামা ওই পাগলডায় আমারে একদিন দেইখ্যা দৌড়াইয়া আইছিল। হায়রে দৌড়। আমি দৌড়াই,পাগলও দৌড়ায়। দৌড়তো থামে না।
তারপর কি করলি? বানিয়ে গল্প বানাতে সহায়তা করি।
আমি একটা টেম্পুতে উইঠ্যা পড়লাম। পাগলডায় খাড়াইয়া গেল।
তাই নাকি?
হ।
চল, বেলা অনেক হয়ে গেছে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করি।
চলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *