নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুই
রাধারমণ-সংগীত
জলের ঘাটে দেখিয়া আইলাম কী সুন্দরও শ্যামরাই
নিতি নিতি ফুল বাগানে ভোমর এসে মধু খায়
মুখে হাসি হাতে বাঁশি বাজায় বাঁশি বন্ধুয়া।
চাঁদ বদনে প্রেমের রেখা কী বা শোভা দেখা যায়
ভাইবে রাধারমণ বলে পাইলাম না-রে হায়-রে হায়-রে
পাইতাম যদি প্রাণবন্ধুরে রাখতাম হৃদয় পিঞ্জিরায়।
ননী ও কমলিকা যাত্রাপালা করার চেষ্টা করছে। কমলিকার চোখে-মুখে এক রকম লাবণ্যময়ী লজ্জা ফুটে উঠেছে। এই লজ্জায় কামমোহের আঠালো ভাব রয়েছে। ভারী আঁশ। মিষ্ট দেহাঙ্গের দোলন। তার হাত দুটি বিভিন্ন মুদ্রা তৈরি করে আপন মনে খেলা করে চলেছে। হঠাৎ একটি হাত প্রসারিত হতেই শংকর খপ করে চেপে ধরে। কমলিকা সেই হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
কমলিকা ভাবতেই পারেনি এই অসময়ে শংকর এখানে এসে উপস্থিত হতে পারে! তবুও তো সে এসে উপস্থিত। শংকর যুবাপুরুষ। বেশ শৌখিন, মাথার চুল টেরিকাটা, হলুদ রঙের সিল্কের বেনিয়ান ও কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি পরা, কাঁধে একটি উত্তরীয়। ধুতির কোঁচা সামলে সে এগিয়ে এল উঠোনের দিকে, তাঁর পায়ে চামড়ার সুদৃশ্য চটি, তা কিছুটা ধুলোমাখা।
কমলিকার শরীরটি কেমন যেন দমে যায়। সবকিছু যেন বদলে গেল চোখের পলকে। বিদ্যুৎগতিতে, নিরেট গম্ভীর গাঢ় লজ্জায় কাতর হয়ে যাচ্ছে তার অন্তর্গত যন্ত্রণার দৃষ্টি। ভয়াবহ ভাব ফুটে উঠেছে তার ভঙ্গিতে। সুস্পষ্ট বিষণ্ণও বটে। এই লজ্জাকাতর দৃশ্যটি নিঃশব্দে অবশ্যই ননীর দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।
ননীর কাছে এই দৃশ্যটি কিছুক্ষণ স্থির স্তব্ধ হয়ে মিলিয়ে যায়, কিন্তু থেকে গেল অসহ্য বিস্ময়কর কাতরানি, তাই হয়তো তার কাছে নিমিষে এই উঠোন হয়ে ওঠে বন্দিশালার মতো। মাথায় জল ঢালার মতো অবিরল, স্বচ্ছন্দ শীতল সে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে, তারপর সে একটু একটু করে ক্লেদ আকাঙ্ক্ষণীয় শংকর-বিষে মরতে শুরু করে। এই বিষকারক, দ্রাবক, বিষ। তার অস্তিত্ব যেমন বাস্তব, ঠিক তেমনই বড্ড বেশি বাস্তব এই শংকর-বিষ। এখন কী করে নিজেকে সামাল দেবে? তার যন্ত্রণা কি সহ্য করা সম্ভব! সে যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। শংকর-বিষ-যন্ত্রণাই যেন তার দেহে স্থায়ী বাসা বেঁধে আছে। চোখ দুটি যেন মৃত্যুর সঙ্গেই খেলায় মেতে উঠেছে। তবুও সে তার দৃষ্টি কমলিকার চোখ থেকে সরিয়ে শংকরের মুখে স্থাপন করে। স্থির। তখনই দেখতে পায় শংকরের মুখোচ্ছল নিঃসহায় দাঁতগুলো নিভৃতে ঝিলিক মারছে। আর তার গাঢ় জুলফির নিচে নিষ্ফল কামনা মাথাকুটে সুতীব্রভাবে জেগে উঠেছে। অদৃশ্য সহজ পাথরের আদি-উৎকৃষ্ট কামরহস্যের মতোই যেন সে কণ্ঠরুদ্ধ। অবশ্যই তা লুপ্ত-ভুবন-স্বপ্নের মতো যেকোনও নারীর হৃদয়কে করে বায়ুবিষাক্তাপ্লুত। টানে অর্থহীনভাবে কাছে। শংকরের মুখ থেকে যখন দৃষ্টি তার চোখে উঠে আসে তখন সে দেখতে পায়, অভিশপ্তাতঙ্ক। শিউরে ওঠে সে। সমস্ত ঘটনার অপ্রত্যাশিত পীড়নে, নিজেকে সামাল দিতে না পেরে এক পলকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার, তাই হয়তো পালিয়ে যায়। ননীর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করল শংকর। রক্ষা পেল যেন সে। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল বিজয়ী মানুষের চাপা সূক্ষ্ম সুখের চাঞ্চল্য; তাই দূষণগম্ভীর কণ্ঠে শংকর বলল : কী ব্যাপার বউদি! কী হচ্ছে এখানে?
শংকরের কথা শুনে চমকে ওঠে কমলিকা, বিকম্পিত হয়ে তীব্র গলা-ধরা কণ্ঠে বলল : যাত্রা করছি গো ঠাকুরপো, যাত্রা করছি।
অনুনয়ের ভাষায়—বর্ণে, সুরে, বিভঙ্গে—শংকর বলল : এতদিনে তাহলে কাজের কাজ একটা করছ। এই বয়সে যাত্রা করার শখ কেন তোমার উথলে উঠল বউদি, শুধাও শুনি? বলো দেখি, তোমার মধ্যে আর কী কী গুণ লুকিয়ে আছে? দেখাও-না একবার কেমন যাত্রাপালা করছিলে তুমি!
অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে শংকরের এক পাশে দৃষ্টিক্ষেপ করে কমলিকা বলল : ধ্যাৎ, যা করছিলাম, তা কি তোমাকে দেখানোর জন্য! তবে…
শংকর দৃঢ়তার সঙ্গে জানতে চাইল, তবে আবার কী!
কমলিকা সহজ-সরলভাবে বলল, তবে যাত্রাপালাটি যদি ঠিকমতো গুছিয়ে নিতে পারি, তখন না-হয় বিবেচনা করে দেখা যাবে। এখন তুমি ঘরে গেলেই রক্ষে। আমি স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলে বাঁচতে পারি।
মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে এবং হাত দিয়ে চিবুক ঘষতে ঘষতে শংকর বলল, কেন যাব? যাত্রা তো অন্যকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই করা হয়।
চক্ষু সংকুচিত করে, শংকরের মুখের কেন্দ্রবিন্দুটি দেখে নিয়ে কমলিকা বলল : বালাই ষাট! আমি হচ্ছি একজন মূর্খ মানুষ, অন্যের সামনে কোন্ দুঃখে যাত্রাপালা করতে যাব ঠাকুরপো?
একথা শুনেই দপ করে জ্বলে উঠল শংকর, বলল : আমার সামনে যাত্রাপালা না-করাটাই হচ্ছে তোমার এক রকম বাহানা। এতে লজ্জার কী আছে! আছে কি?
কমলিকা সঙ্গে সঙ্গেই বিনয়ের অবতার হয়ে গিয়ে বলল : আছে গো ঠাকুরপো, আছে। শত্রæর মতো কথা বোলো-না তুমি! তুমি ভালো করেই জানো, এটি শুধু ননী ও আমার অবসর সময় কাটানোর জন্য করছি। অন্য কারও জন্য অবশ্যই নয়।
বিস্মিতভাবে শংকর বলল : এই দ্যাখো, তুমি কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ছ। উত্তেজনা তোমার শোভা পায় না। তাই বলছি, তুমি প্রফুল্লচিত্তে ও প্রসন্নকণ্ঠে যাত্রাপালা করে আমার মনে একটু আনন্দ দাও!
কমলিকা মাথা নেড়ে, বিষণ্ণভাবে বলল, কেন?
শুকনো গলায় শংকর বলল, এমনি। এখন বলো দেখি, কোন্ পালাটি করছিলে?
হাসতে হাসতে কমলিকা বলল, মহুয়া সুন্দরী গো ঠাকুরপো, মহুয়া সুন্দরী। আমি মহুয়া সুন্দরী আর ননী নদের চাঁদ।
সঙ্গে সঙ্গেই টনক নড়ে গেল শংকরের, বলল : ননী দেখছি শেষপর্যন্ত নায়কের পাঠটাই নিল!
প্রথমে চুপসে গেল কমলিকা, তারপর জিজ্ঞেস করল, কে কী নিল?
শংকর অতি ধুরন্ধর মানুষ। সে কথায় হার মানে না কারও কাছে। বলল : না, বলছিলাম, আমার বুকে খুব ইচ্ছে জাগছে মহুয়া সুন্দরী কেমন পাঠ করছ তা দেখার জন্য। তোমার ভাষার প্রচ্ছন্নতা, তোমার আবেগের উদ্বেগ, তোমার অভিনয়ে উৎসাহ—এসব দেখা আর কি!
কারুর কাছ থেকে সহানুভূতি কুড়োনো যেমন কমলিকার স্বভাব নয়, তেমনই ব্যক্তিগত আবেগও কারুর কাছে প্রকাশ করতে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে কমলিকা বলল : তোমার শব্দের চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে, আমার মনে হয়, তোমাকে হারাতে পারব না। তাই ভাবছি…
গালে হাত রেখে ক্লিষ্ট কণ্ঠে শংকর বলল, কী ভাবছ বউদি!
কমলিকা দীর্ঘ দুই বাহু প্রসারিত করে আর্তকণ্ঠে বলল : ভাবছি, আমাকে এখান থেকে পালানোই উত্তম। যাই গো ঠাকুরপো। গেলাম।
কমলিকার কথা শুনে খুবই শ্লাঘা বোধ করে শংকর। তাই বলতে লাগল : দাঁড়াও বউদি, এক দণ্ড দাঁড়াও। পালাচ্ছ কেন?
কমলিকার গমনপথের দিকে তাকিয়ে শংকর বলতে লাগল, তোমার পালানোর গতিই তো আমার হৃদয়কে মাতাল করে দেয়। এই অনুশোচনার আগুন আমাকে বিধ্বস্ত করছে।
কমলিকার চলনের গতিকে ধারণ করে শংকর একটি পুঁটুলি নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে। পুঁটুলিটিকে পাশে রেখে আশ্চর্য হতবাক হয়ে খাটের ওপর বসে সে ভাবতে লাগল। বউদির চলে-যাওয়া বিস্ময়গতি তার বিমূঢ় মনে ক্ষীণ আলোর মতোই ভেসে বেড়াচ্ছে। এ-যেন এক সুস্পষ্ট চলচ্চিত্র। আরও গভীরভাবে এই গতির স্পন্দন অনুভব করার জন্য হয়তো-বা সে তার হৃদয়ে গুঁজে নিতে চাইছে বউদির চলে-যাওয়া দৃশ্যটি; আর এই দৃশ্যকেই সে তার রেশমি কালো নয়নতারায় আটকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তখনই ননী ঘরে প্রবেশ করে তাকাল শংকরের চোখে। একটু আগে যে-চোখে অভিশপ্তাতঙ্ক ছিল সেই চোখে এখন যেন তা বিলীন হয়ে গেছে। সেই অভিশপ্তাতঙ্ক পটচিত্র বিলীন হলেও তার স্থান দখল করে নিয়েছে এক নিঃসঙ্গ-গাঢ়-বিষণ্ণ-বিষাদ; সত্যিই বেদনার্দ্র, তৃষ্ণার্ত, না পাওয়ার ব্যথা-বিষণ্ণ-ক্ষীণ আলোই যেন ফুটে উঠেছে, যা বেদনাকে করে নিবিড়-ঘন-স্থির, তবে তীব্র আর যন্ত্রণা-ঘন-শূন্যতা। ননীর চোখে শূন্যতাই যেন শংকরকে উদাসীন দেখাচ্ছে, যেন প্রাঞ্জল কষ্টের ভেতরই সহবাস করছে বিচ্ছিন্নতার ভয়, স্থির সন্দিগ্ধ মায়া, কিন্তু ননীর সামনে বসা থাকা শংকরকে, এই মানুষটিকে, একবার স্পর্শ করতে তার সাধ জাগল; স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে তার হাত দুটি প্রসারিত করেও হঠাৎ থমকে গেল, বরং ভাবল : স্পর্শ করে কী লাভ! সে তো তার অপেক্ষায় নেই। সময় হলে সে ননীর কাছে ধরা দেবেই। ননী থেমে গেল ঠিকই, কিন্তু তার অন্তরের কামনার্তধ্বনি কি কিছুতে থামতে চায়! না, চায় না। থামতেও চাইছে না, বরং ক্রমাগত মনের প্রাচীরে ব্যাকুলভাবে আঘাত করছে। বুকের ভেতর কেমন যেন ছটফট করছে। কেবলই মনে হচ্ছে : এই কামনার্তধ্বনির প্রতিটি আঘাতই বাস্তব, সত্য, দৃষ্টিময়; কিন্তু শংকরের অন্তরের ছবি তো কমলিকা। সেই চিত্রপটের কাছে সে যতই চেষ্টা করে না কেন, কোনও ভাবেই পৌঁছতে পারবে না। তাহলে শংকরের কামনার্ত ধ্বনিটি কী! ননী স্পষ্টই উপলব্ধি করছে, একদিন কমলিকার ঠাকুরপো হয়তো-বা তাকে বর্জ্যপদার্থের মতো কোথাও ফেলে দেবে। মানুষ কি মানুষের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে পারে? এ কি তার প্রতি ওর করুণা, নাকি ভালোবাসা! কমলিকার প্রতি শংকরের টান কেমন তা জানতেই হয়তো ননী জিজ্ঞেস করল : বউদি কেন ওভাবে পালিয়ে গেল?
সঙ্গে সঙ্গেই শংকর উত্তর দিল, আমি কী জানি! সেই খবর রাখার সময় ও ধৈর্য কোনওটাই আমার নেই!
শংকরের মুখে এমন কথা শুনে বুক-বেঁধে-থাকা ননী চমকে ওঠে। অসম্ভবভাবে চুপ হয়ে যায়, কিন্তু সে ঠিকই অনুভব করতে পারছে, শংকরের নিজের বলে কিছুই নেই। তার চোখে-মুখে কেমন যেন এক মøান বারিধারা লুকোচুরি খেলা করছে, কিন্তু একথা ননী প্রকাশ করতে পারছে না, তাই হয়তো অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বলল : না, নেই।
একথা বলে প্রবল সাহস সঞ্চয় করে খাট পর্যন্ত এগিয়ে গেল ননী। এই অবধি পৌঁছানোর পর, সে আর অগ্রসর হতে পারল না, মনের সমস্ত উৎসাহ যেন সহসা থেমে গেল। সে স্থির করল, কমলিকা সম্বন্ধে আর কোনও কথা বলবে না, এই পৃথিবীর কাউকেই এসব কথা জানাবে না, বরং অন্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করবে, তাই হয়তো সে দম ধরে দাঁড়িয়ে, দৃষ্টিতে শংকরকে অনুসরণ করতে লাগল, আর তখনই পুঁটুলিটি তার দৃষ্টি কাড়ে, সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল : আপনার পাশে রাখা পুঁটুলিতে কী আছে?
শংকর জানাল, হাতে নিয়ে দেখলেই হয়!
কথাটি শুনে অপমানিত বোধ করে ননী। ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়ে। নির্মম শীত যেন ফিরে এসেছে তার মুখমণ্ডলে। মুখ শুকিয়ে ওঠে। ভীষণ অপমান-জড়ানো শংকরের চাউনিও। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে ননী এগিয়ে আসে পুঁটুলিটির দিকে। দুর্মর আত্মসম্মানের চিক্কণ সুতো মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই হাতে তুলে নেয় পুঁটুলিটি। তারপর খুলে, ভেতরের জিনিসটি হাতে নিয়ে মুগ্ধবিমোহিত কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল : এর কী প্রয়োজন ছিল?
এই সময়ে শংকরের পক্ষে ঝাঁঝিয়ে ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সে মিষ্টি করেই বলল, পছন্দ হয়নি বুঝি?
ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে ননী বলল, না, না। পছন্দ হবে না কেন? খুব হয়েছে। তবে?
এবার শংকর খুবই ক্রুদ্ধ হয়। ঝাঁঝালো স্বরে বলল : তবে আবার কী?
কিছু-একটা সন্দেহ হল ননীর। মেঘের প্রাবল্যে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যেমন অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ, তেমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখে, বোকার মতন তাকিয়ে থেকে, মিনমিন করে বলতে লাগল ননী : হঠাৎ এর কীইবা প্রয়োজন ছিল!
ননীর থেকে আলাদা বাচনভঙ্গিতে শংকর বলল, হঠাৎ করেই রায়বাহাদুর আমাদের অঞ্চলে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। তার জন্যই প্রস্তুত থাকা চাই, এজন্যই এটি কিনে আনা।
ননী সভয়ে বলল, খুবই সুন্দর হয়েছে। আমাকে বেশ মানাবে! এটি যেন আমার কাছে অমূল্য রতন।
শংকরের মুখটি খানিকটা রক্তিম হয়ে উঠল, বলল : রতনকে তো রতনই মানায়!
সবেগে দুই দিকে মাথা নেড়ে, খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে ধরা-গলায় ননী বলল, তবুও কথা থেকে যায়।
অতৃপ্তির সঙ্গে, গম্ভীরভাবে, শংকর বলল : কথা থেকে যায়… মানে?
ননী বিনীতভাবে বলল, অনর্থক অনেক কড়ি নষ্ট হল আর কি!
একটু ভেবে এবং ঈষৎ অনুতপ্ত স্বরে শংকর বলল, কড়ি নষ্ট হয়নি। রায়বাহাদুরের জলসায় নেচে এর মূল্য পরিশোধ করে দিবি।
হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে ননীর সমগ্র শরীরে। মুখটিও বাকি নেই। ঠিক যেন অগ্নিপরীক্ষায় সীতা, কিন্তু বাস্তবে আগুনের কোনও দয়া নেই। এই দয়াহীন কণ্ঠেই ননী বলল : তা-ই বলুন, আপনি স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না।
শংকর ভুরু কুঁচকে বিষম কণ্ঠে বলতে লাগল : শোন্, স্বার্থপর হই-বা-না-ই-হই, তোর জন্য যা এনেছি তা অমূল্য রতনই বটে। সেকথা কি তুই অস্বীকার করতে পারিস?
উৎকর্ণ ও বিস্মিত হয়ে ননী বলল : অস্বীকার করার মতো আমার সাহস নেই, শক্তিও নেই, তাই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি যে, আপনি অমূল্য রতনই এনেছেন; কারণ, আপনি তো আর সব সময় আমার জন্য উপহার আনেন না, তাই এটি আমার জন্য অমূল্য রতনই বটে, তবে…
খাটের এক কোণে পাথরের মূর্তির মতন বসে ছিল শংকর, কিন্তু ননীর কথায় এই মূর্তিটি ভেঙে গেল, কোনও রকমে থেমে থেমে বলতে লাগল : তবে আ-বা-র?
শংকরের কাছে দাঁড়িয়ে ননী বিহ্বল গলায় বলল, তবে এটি আরও অমূল্য হতো যদি সোহাগ মিশানো থাকত।
ফরসা মুখখানি রক্তবর্ণ হয়ে গেল। শংকর অস্ফুটভাবে বলল, তাই বুঝি!
একথা বলে শংকর তাকিয়ে রইল ননীর দিকে। আর কিছুই বলল না। ননীর কণ্ঠেও একটু শব্দ নেই, কেবল তার দুই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আবেগ।
শূন্যকোলে কমলিকা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কীসের এক তীব্রতা অন্তরকে ধাক্কা দিয়ে কাঁপিয়ে তুলছে। শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তার দৃষ্টি প্রসারিত, বিকশিতও; কিন্তু এই কাঁপুনি সেই অবধি পৌঁছতে পারছে না। জীবনের গতি তাহলে কোন্ পথে ঘুরে যাচ্ছে? মনের ওপর সুশাসন করার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে, কিন্তু যে-মন পুরুষের ওপর আধিপত্য সৃষ্টির জন্য জন্মেছে, তার চরিত্র সম্বন্ধে তো সন্দেহ থেকেই যায়। এই মন কি হাটে-বাজারে বিক্রি করার এক অমূল্য সত্তা! কে আজ তার চিন্তার স্রোতে আঘাত হেনে মনের দরজায় কড়া নেড়ে দিল? সুন্দর কারুকার্যখচিত মনটি কি এক নিমিষে সস্তা বাজারের থলে হয়ে গেল! অর্থহীন উক্তিতে সে স্তম্ভিত এখন। এতদিনের অভিজ্ঞতা, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, রূপযৌবন সবই কি এক মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল, যেন স্বর্ণপ্রসূ স্বপ্নজাল! একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার বুকে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে, নীরবতা ভেঙে, কথা-পাড়ার জন্য সে বলে উঠল : ঠাকুরপো, ওগো ঠাকুরপো, এদিকে একবার এসো তো!
শংকর বউদির আহ্বানে মরিয়া হয়ে উঠল। মনে যেন জেগে উঠেছে রাতের অন্ধকারের লণ্ঠন-জ্বালানো ঘুমন্ত নেশা। ঝনঝন করে উঠছে অন্তরের লোহালক্কড়ও। বহির্মুখী উন্মত্ততার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে যেন তার দেহ। আচমকা জেগে উঠছে অপরিসীম কৌত‚হলও। উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় : মনোমুকুর আবছান্ধকারের সিঁড়ি ভেঙে মুখ বাড়াচ্ছে, অকারণেই; কিন্তু ধৈর্যের সীমা কোন্ অসীমানায় বিরাজমান! তার গলায় ঝোলানো কবজটিও ঝংকারহীন, উত্তাপহীনভাবে কাঁপছে।
পালঙ্কের ওপর বসে সুপুরি কুচোচ্ছে কমলিকা। সুপুরি কুচোনো বন্ধ করে জলপাত্র থেকে একটু জল বিড়ালের মতো পান করে কমলিকা আবারও ডাকল : কী হল ঠাকুরপো! এখনও এলে না যে!
শংকরের ধৈর্যের কাঁটা অনড়, কেনই-বা নড়বে? শংকর মনে মনে বলতে লাগল : বউদির মন যেন শস্যহীন, যা আছে তা মনে হচ্ছে যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে দেনাই বেশি, আগাছাও বেশি। বন্যার জলে প্লাবিত-বিধ্বস্ত এই মন। তাই হয়তো-বা হৃদয়গহ্বরে কোনও আশার আলোর চিহ্ন নেই। সত্যি সত্যিই নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই শংকর বলল : আসছি বউদি। এক্ষুনি আসছি।
শংকরের মুখে কেমন যেন একটি ভাটিদেশের মরা ভাব ফুটে উঠেছে, যেন শস্যশূন্য। একটি দিন কথা না হলেই শংকরের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তবে কমলিকার মনের অবস্থা বোঝাই শংকরের কাছে জটিল ব্যাপার। যে-পথের সন্ধানে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় সে-পথের সন্ধান তার জানা নেই। অভিমানী মন স্বাভাবিকভাবেই অসহায়-ক্ষীণ সরুপ্রেম-ঝরা মধুতে ব্যথা-বেদনায় আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। তবুও শংকরের শীর্ণ জুলফিতে অসংযত দৌর্বল্য ঝুলিয়ে, চলার গতিতে মাহাত্ম্য ফুটিয়ে, ক্ষুধার্ত মনে ছুটে এল কমলিকার কাছে। সে একটু এগিয়ে এসে নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করল : কী হয়েছে বউদি, ডাকছ কেন?
একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করে একটু অন্যমনস্কভাবে কমলিকা বলল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
সাধারণ বাড়ির তুলনায় এই নির্জন বাড়িটির নৈঃশব্দ্য অনেক বেশি। এখান থেকে বাইরের অস্তিত্বও টের পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে যেন শোনা যায় বিগত কালের ফিসফিসানি। শংকর সেদিকেই কান পেতে বলল : বলো। শুনছি। তুমি তো জানোই, তোমার কথা শোনার জন্য আমার মন সর্বক্ষণ অস্থির থাকে। তোমার আজ্ঞাই আমার শিরোধার্য।
কমলিকা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে, ঈষৎ পাশ ফিরে অভিমানের বাষ্প-জড়ানো কণ্ঠে বলল : রাখো তোমার রসিকতা! আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শোনো।
শংকর তাড়াতাড়ি বলে উঠল : রসিকতা করলাম কোথায়! শুধু বললাম, তোমার আজ্ঞাই আমার শিরোধার্য।
শংকরের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে—মাঝেমধ্যেই তার চিত্ত ভীষণ উতলা হয়ে—কমলিকা বলল : আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা ভুলে গিয়েছি। তোমার রসিকতাই এর জন্য দায়ী।
পাতলাভাবে হেসে কণ্ঠস্বর নরম করে ও পরিষ্কার গলায় শংকর বলল : বা-রে, তুমি হচ্ছ আমার বউদি, তাই একটু আধটুকু রসিকতা তো করতেই হয়।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল কমলিকা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধকণ্ঠে বলল, তোমার বউদি ডাকটাই আমার জন্য কাল হয়ে উঠেছে।
হাস্যমুখে কাঁচুমাচুভাবে, মৃদু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে শংকর বলল : তাহলে বলো, কী নামে ডাকলে তোমার প্রাণ জুড়বে, আমি না-হয় সেই নামেই ডাকব! তোমার পছন্দমতোই একটা নাম খুঁজে নেব।
সচকিত ও বিস্মিত হয়ে দুই দিকে মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে কমলিকা বলল : হায়-রে আমার পোড়া কপাল! আমি বলি কী, আর আমার সারেন্দা বাজায় কী!