ঈদসংখ্যার গল্প।। পাহারাদার।। ইকবাল খন্দকার
আমি কিন্তু এক বাপের এক পোলা- সাতাশ বছরের জীবনে এটি আবু তালেবের সবচেয়ে বেশিবার বলা কথা। কারো সঙ্গে বাতচিৎ করতে গিয়ে পাঁচ-দশটা বাক্য খরচ করেছে আর সেই পাঁচ-দশ বাক্যের মধ্যে এই বাক্যটা ছিল না, এমন ঘটনা বিরল। আবু তালেব জানে বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ার পেছনে তার নিজের কোনো কৃতিত্ব বা অবদান নেই, এটা নিতান্তই উপরওয়ালার ইচ্ছে অথবা তার বাবা-মার ইচ্ছে; তবু কথাটা বলার সময় সে শার্টের কলার এমনভাবে নাড়ায়, যেন তার ভয়েই তার বাবা-মা আর কোনো সন্তান নেননি।
এক বাবার এক ছেলে হতে পারার ব্যাপারটা যে বেশ ইজ্জতের, প্রথমজীবনে আবু তালেব এটা জানত না। জেনেছিল প্রাইমারি পাস করে হাইস্কুলে যাওয়ার পর। আর জানিয়েছিল সেই স্কুলের দপ্তরি সুলতান মিয়া। সুলতান নিজে বাবা-মার একমাত্র সন্তান ছিল। এই
কারণে বাবা-মাসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সে যে কত গুরুত্ব পাচ্ছে, এই গল্প প্রায়ই শোনাত আবু তালেবকে। শুনে শুনে একদিন আবু তালেবের মনে হলো— আরে, যে যোগ্যতার বলে সুলতান মিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে, সে যোগ্যতা তো আমারও আছে। তাহলে আমি
কেন ভাব নিচ্ছি না?
ছাত্রে ছাত্রে বন্ধুত্ব হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ছাত্র-শিক্ষকেও হয়। কিন্তু ছাত্রে-দপ্তরিতে বন্ধুত্ব— এমন ঘটনা তালেবদের স্কুলে আগে কখনোও ঘটেনি, ঘটেনি
আশপাশের স্কুলগুলোতেও। সুলতান আর তালেব দুজনই বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় যে ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ, তালেব ছাড়াও স্কুলে অনেক ছাত্রই ছিল, যাদের ভাই-বোন কোনোটাই নেই। তারা কেউ সুলতান মিয়াকে
বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করল না, করল কেবল আবু তালেব- রহস্যটা কী? এই রহস্যের একটা আপত্তিকর ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন আবু তালেবের চাচা শুক্কুর আলী- যার নজর ছোট, সে-ই দোস্তি পাতায় ছোটলোকগোর লগে।
চাচার কথা কানে তোলেনি আবু তালেব। কারণ, এই আত্মবিশ্বাসটা তার মধ্যে ছিল- তার নজর ছোট না। দপ্তরির চাকরি করা সুলতান মিয়ার সঙ্গে সময় কাটালেও তার নজর আর্মির চাকরির দিকে। কোনোমতে হাইস্কুলের গ-িটা পার হতে পারলে কে আর তাকে ঠেকায়? কদিন পরপরই তো লোক নেয় সেনাবাহিনীতে। স্টেডিয়ামে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত প্রার্থীর মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নেওয়ার দৃশ্য আবু তালেব যতবার দেখেছে ততবারই ভেবেছে— মেট্রিক পাস হতে হবে, এই আইনটা কে করেছে? এই আইন না থাকলে তো কবেই সে পুরোদস্তুর মিলিটারি হয়ে যেতে পারত।
আবু তালেব তখন ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠি উঠি করছে। আর বছর দুই পরে সে সেনাসদস্য হয়ে যাচ্ছে- এই সুখচিন্তায় রাতে তার কমই ঘুম হয়। ছেলের পাগলামিতে বাবা শতভাগ অসন্তুষ্ট না হলেও শতভাগ সন্তুষ্টও না। তিনি বহুবার বলেছেন— মেট্রিক পাস
কইরা মিলিটারিতে গেলে সারাজীবন নরমাল সৈনিক হইয়াই থাকতে হইবো। যদি বিএ, এমএ কইরা যাস, তাইলে এক ঠেলায় অফিসার অইয়া যাবি গা। অফিসার হইতে পারলে কত সুযোগ সুবিধা জানস? তোর কথায় হাজার হাজার সৈন্য বসবো উঠবো। তোরে স্যার স্যার ডাকবো। তোরে দেখামাত্র বুট দিয়া মাটিতে লাইত্থি মাইরা স্যালুট দিবো। বাবার কথা কানে না তুলে সাধারণ সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই যখন আবু তালেব সামনে এগোচ্ছিল, তখনই তার জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। কুরবানীর ঈদের ঠিক আগের হাটে গরু বিক্রি করে বাবার সঙ্গে নসিমনে করে বাড়ি ফিরছিল আবু তালেব।
মাঝরাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট। নসিমন রাস্তার পাশের খাদে উল্টে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাবা। গুরুতর আহত আবু তালেবকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে ভর্তির তৃতীয় দিনে তার জ্ঞান ফেরে। একসময় সে সুস্থও হয়। সুস্থ হয়নি কেবল তার ডান পা-টা। হাড় গুঁড়িয়ে যাওয়ার কারণে চিরতরে সে হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিকভাবে হাঁটার ক্ষমতা।
অভিভাবকহীন পরিবারের অভাবের তাড়না আর বিকল পায়ের কারণে সেনাবাহিনীতে যোগদানের স্বপ্নভঙ্গ- এই দুই নেতিবাচক বিষয়কে বিবেচনায় রেখে শুরু হয় আবু তালেবের খড়-কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এ সংগ্রামে জিততে হলে তাকে
কিছু একটা করতেই হবে। কী করবে? নাইন পাস একটা ছেলেকে কে দেবে কাজ?
সার্টিফিকেটধারী কত ছেলে বছরের পর বছর ঘুরেও কাজ পায় না! একদিন আবু তালেবের মা আবু তালেবকে নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যান। অনুরোধ করেন বাপমরা ছেলেটাকে শহরের কোনো গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।
চেয়ারম্যান বলেন- তোমার ছেলেরে চাকরি দেওয়ার মতো বহু লোক আল্লাহর রহমতে আমার হাতে আছে। পাঠাইতে দেরি, চাকরি দিতে দেরি করবো না। কিন্তু চাকরি দিয়াই কি সব হয়? সহায় বইলাও তো একটা জিনিস আছে। ঠিক কিনা? যার সহায় নাই, সে কিন্তু
অসহায়। চেয়ারম্যানের কথার মর্মার্থ বুঝতে না পেরে একবার চেয়ারম্যানের দিকে, একবার আবু তালেবের দিকে তাকান মা। চেয়ারম্যান বলেন— আবু তালেব শহরে চইলা গেলে তুমি অসহায় হইয়া পড়বা। ক্যান? কারণ তোমার পাশে কেউ থাকবো না। এইদিকে
তোমার টাকা-পয়সাও দরকার। পোলা শহরে না গেলে টাকা-পয়সা ইনকাম করবো কেডা?
মা এবার চেয়ারম্যানের কথার মর্মার্থ আঁচ করতে পারেন। আর বলেন— আপনে আমার সহায় নিয়া চিন্তা কইরেন না ভাই সাহেব। পোলাটায় যদি একটা কাজ-কাম পায়, এইটাই আমার বড় সহায়। চেয়ারম্যান কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে একটা সুপারির টুকরো বের করে চিবাতে চিবাতে বলেন- তোমার পোলা কামও পাইবো, আবার তোমার সহায়ও হইবো। ক্যামনে? ইউনিয়ন পরিষদের বিল্ডিংয়ের পাশে যে বড় কবরস্থানটা আছে, এইটাতে একজন পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া হইবো। মোটা বেতন। তুমি যদি চাও তোমার পোলারে চাকরিটা আমি দিতে পারি। অতি সহজ চাকরি। ভোর থেইকা দুপুর পর্যন্ত ঘুমাইবো, দুপুর থেইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির কাজ-কাম করবো, তারপর খাওয়া-দাওয়া কইরা চইলা আইবো ডিউটিতে।
চেয়ারম্যানের প্রস্তাবে মার চোখে-মুখে সন্তুষ্টির পরিবর্তে অসন্তুষ্টি দেখা গেলে তিনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন— তোমার পোলা কিন্তু আর্মিতে যাইতে চাইছিল।
আর্মিতে যারা যায় তারা কী করে? নিজের জীবন বাজি রাইখা দেশের মানুষের জানমাল হেফাজত করে। সে যদি কবরস্থানের পাহারাদার হয়, তাইলে মোডামুডি সেই ধরনের কাজ করারই সুযোগ পাইবো। গোরস্থানে আজকাইল নানান ঘটনা ঘটতাছে। এই জন্যই আমরা
পাহারাদার নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিছি। তোমার পোলার সাহস আছে, মানুষের জানমালের হেফাজতে কাজ করার নিয়ত আছে, এইদিকে মোটা বেতনেরও ব্যবস্থা আছে,
তাইলে সমস্যা কোথায়?
চেয়ারম্যান যেমন কোথাও সমস্যা দেখেন না, সমস্যা দেখে না আবু তালেবও। তাই মার মৃদু আপত্তিকে উপেক্ষা করেই যোগদান করে ফেলে চাকরিতে। শুরুর দিকে আবু তালেব কবরস্থানে চলে যাওয়ার পর মা ঘুমাতে পারতেন না ভয়ে। তার কেবল মনে হতো বুকের
মানিকটা বুঝি ভূত-পেত্নীর আক্রমণের শিকার হলো। তাই কাকুতি-মিনতি করে চাচা শুক্কুর আলীকে পাঠাতেন তার পেছন পেছন। শুক্কুর আলী আবু তালেবকে দেখা না দিয়ে দূর থেকে অনুসরণ করতেন। আর প্রস্তুত থাকতেন, কোনো প্রকার বিপদের আলামত
দেখলেই ভাতিজার সামনে ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভুত হওয়ার জন্য।
দুদিন যেতে না যেতেই শুক্কুর আলীর বিস্ময় প্রকাশ- কারে পাহারা দেওয়ার লাইগা কারে পাঠাইতাছেন ভাবিছাব? আপনের পোলার কলিজা তো ধাড়ি। তার কলিজার কাছে আমার কলিজা কিছুই না। বিশ্বাস করবেন না, যেইসব জায়গায় দিনের বেলা যাইতেও আমারঠ্যাং কাঁপে, কুচকুইচ্যা আন্ধার রাইতেও সেইসব জায়গা তার লাইগা দুধ-ভাত। ভূত-পেত্নীও আপনের পোলারে দেইখা ডরে বুকে ছেপ দিবো। পোলা একখান বানাইছেনভাবিছাব। তার মাথা থেইকা পাও পর্যন্ত পুরাডাই কলিজা। বাবারে বাবা! শুক্কুর আলীর
কথায় মার সমস্ত শঙ্কা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। স্বাভাবিক হয় তার রাতের ঘুম।
সেই কিশোর আবু তালেব এখন আর কিশোর নেই। সুঠাম দেহের তাগড়া যুবক। টর্চ আর বল্লম হাতে নিয়ে সে যখন রাতদুপুরে কবরস্থানের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তখন তার মনে হয়, একযোগে বিশজনও যদি তাকে আক্রমণ করতে আসে, এক ঘায়ে বিশজনকেই সে
গেঁথে ফেলতে পারবে বল্লমে। তার কাছে বিশজন কেন, বিশ দুগুণে চল্লিশজনের জীবনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কর্তব্য। অ্যাক্সিডেন্টের কারণে ডান পা-টা হয়তো তাকে সহায়তা করে না, তবে মনোবলে চুল পরিমাণ ঘাটতি নেই। ভাঙা পায়ের সুবাদে ‘খোঁড়া’হলেও মনোবলের সুবাদে সে ‘পালোয়ান’। মহাবীর।
চাকরির বয়স যখন প্রায় একবছর, তখনও আবু তালেব ভাবত তাকে খামোখাই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কারণ, চেয়ারম্যান যে চক্রের হাত থেকে লাশ নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে পাহারাদার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই চক্রের কেউই তার সামনে পড়েনি। চক্র যেখানে নিষ্ক্রিয়, সেখানে কী দরকার পাহারাদারের? মনের ভেতর এই প্রশ্ন ঘোরাতে
ঘোরাতে আবু তালেব যখন ঠিক করল রোজ রাতে পাহারা না দিয়ে মাঝেমধ্যে আয়েশ করে ঘুমাবে, তখনই ঘটে ভয়ঙ্কর ঘটনা। অস্ত্রধারী চোরেরা করম আলীর বউয়ের কবর খুঁড়ে লাশটা প্রায় তুলেই ফেলেছিল। আবু তালেব সময়মতো হাঁক না ছাড়লে সর্বনাশ হয়ে যেত।
এই ঘটনার পর থেকে আজ অবধি সারারাত একবারের জন্যও চোখের পাতা এক করার চিন্তা করেনি আবু তালেব। যদিও সে জেনে গেছে পুরনো লাশের প্রতি চোরদের কোনো আকর্ষণ নেই। আকর্ষণ কেবল তরতাজা লাশের প্রতি। তার মানে একটা লাশ সমাহিত
করার পর তিনদিন কড়া পাহারা দিলেই হলো। কিন্তু আবু তালেবের কাছে তিনদিন বলে কিছু নেই। তার দৃষ্টিতে মাসের ত্রিশদিনই সমান। সে এই বিষয়টাকে মূল্যায়ন করে এভাবে— আমারে বেতন দেয় মাস হিসাবে। তাইলে তিনদিন আর চাইরদিন কী? খালি রাইত ক্যান, দিনেরবেলাও যদি কোনো লাশের ক্ষয়ক্ষতি হয়, দায়দায়িত্ব আমার। রাত তিনটা। কবরস্থানের পাশের কাঁঠালতলায় বানানো মাচায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবছে আবু তালেব। চারপাশে ঝিঁঝির ডাক আর শেয়ালের হুক্কাহুয়া ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
অবশ্য কিছুক্ষণ পরপর ডানা ঝাপটানোর একটা শব্দও কানে আসছে। শব্দটা বাদুড় করে থাকতে পারে। আবার পেঁচাকেও সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। কারণ, এদিকটায় প্রচুর পেঁচা। কিন্তু শব্দ করে ডানা ঝাপটানোর ক্ষমতা পেঁচার আছে কি না, আবু তালেবের জানা নেই। জানার দরকারই বা কী! যে যেদিক দিয়ে পারে শব্দ করুক। লাশ চুরির ফন্দি না করলেই হলো। এমনিতেই খুব চাপে আছে সে। কারণ, গত তিনদিনে দুটো লাশ ঢুকেছে
গোরস্থানে।
: আবু তালেব!
কারো মোলায়েম ডাকে ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায় আবু তালেবের। বাম হাতের বল্লমটা ডানহাতে নিয়ে পেছনে ঘাড় ঘোরায় সে। কাঁঠালপাতার ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় চেনা যাচ্ছে মানুষটাকে। তবু টর্চে টিপ দেয় আবু তালেব। মুখ বরাবর আলো ফেলে নিশ্চিত হতে চায় সত্যিই এটা সুলতান মিয়া। কিন্তু সুলতান মিয়া এতরাতে এখানে কেন আসবে? সে যদি স্কুলের দপ্তরি না হয়ে নাইটগার্ড হতো, তাহলে ধরে নেওয়া যেতো হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে। যেহেতু স্কুলটা কাছেই। ভাবতে ভাবতে ‘অন’ টর্চ ‘অফ’ করতে ভুলে যায় আবু
তালেব।
: আরে কী হইল! আমি চোর-ডাকাইত তো না। বন্ধ করো লাইটটা। একটু কথা কইয়া চইলা
যাই।
: এত রাইতে কিসের কথা?
: সারাদিন আমি থাকি ইশকুলে, তুমি নাক ডাকায়া ঘুমাও। কথা কওয়ার সুযোগ কই? বলতে বলতে আবু তালেবের কাছে চলে আসে সুলতান মিয়া।
: তাই বইলা এত রাইতে? বসেন।
: তুমি মিয়া রাইতজাগা লোক। তোমার কাছে এত রাইত আর তত রাইত কী!
স্যান্ডেল খুলে মাচায় পা তুলে বসতে বসতে বলে সুলতান মিয়া। আবু তালেব তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে বিশেষ কিছু শোনার জন্য। সুলতান মিয়া তাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় রাখে না। একটা সিগারেট ধরিয়েই শুরু করে কথা- তোমারে তো মিয়া আমি
ছোটবেলা থেকেই চিনি। বুদ্ধিমান ছেলে তুমি। আসলে এক বাপের এক পোলারা বুদ্ধিমানই হয়। কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলে হইয়া যদি বোকার মতো কাজ করো, তাইলে সেইটা শুধু তোমার জন্য অপমানের না, যেহেতু আমিও এক বাপের এক পোলা, এই কারণে আমার জন্যও
অপমানের।
: কিসের কথা কইতাছেন আপনে?
: এতদিন ধইরা তুমি গোরস্থান পাহারা দেও, এখনও তুমি জানোই না চোররা কিসের জন্য
আসে!
: দেহেন, আপনে কী জন্য আইছেন, সেইটা বইলা চইলা যান। চোররা কী জন্য আসে, সেইটা আপনের কাছ থেইকা জানতে হইবো না। এইগুলা আমার জানা আছে। আমি কিন্তু এক বাপের এক পোলা।
: তুমি তো মিয়া হাচা হাচাই আইনের লোক হইয়া গেছো। হুনছি পুলিশ যখন ডিউটিতে থাকে, তখন নাকি বন্ধু-বান্ধবের সাথেও চড়া গলায় কথা কয়। কিন্তু ডিউটি ছাড়া অন্য সময় নরমাল। তোমার ডিউটির সময় আমার আসাটাই ভুল হইছে। ক্যামনে কথা কইতাছো, রস নাই, কষ নাই! ঠিক আছে, গেলাম তাইলে। তবে এইটা জাইনা রাইখো, চোররা লাশ চুরি
করতে আসে না। তাদের উদ্দেশ্য অইন্য। সুলতান মিয়া মাচা থেকে নেমে স্যান্ডেল পরা শুরু করলে আবু তালেব তার হাত ধরে এবং টেনে বসায় আগের জায়গায়- অইন্য কী উদ্দেশ্য? সুলতান মিয়া আবু তালেবের এমন
আগ্রহ আর প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিল। তাই সে সোজা উত্তরে চলে যায়- অনেক সময় শোনা যায় মরা মানুষের চোখ, কিডনি, হাত, পা এইগুলার লোভে নাকি চোরেরা লাশ চুরি করে। হাচা-মিছা জানি না। করতে পারে। তবে এই গোরস্থানে যারা আসে, তাগো এই লোভ নাই। তারা লাশের চোখও চায় না, কিডনিও চায় না, হাত-পাও না। তারা চায় খালি লাশের গায়ের কাফনের কাপড়টা।
: কাফনের কাপড়! আবু তালেবের গলা ভয়ার্ত শোনায়।
: হ। নতুন লাশের কাফনের কাপড় দিয়া একজন কবিরাজে একটা ওষুধ বানায়। কাপড়টা কাঁচি দিয়া ছোট ছোট টুকরা কইরা কাটে। একেকটা টুকরা একেকটা তাবিজের ভিতরে ভরে।
এই তাবিজ রোগীর গলায় ঝোলাইলে যেকোনো রোগ ভালো হইয়া যায়। যেকোনো রোগ। যেই রোগ বড় ডাক্তারেও ভালো করতে পারে না, সেই রোগও।
: কবিরাজটা কেডা?
: ক্যান? চেয়ারম্যানের কাছে কইয়া কবিরাজের বিচার করাইবা? শোনো, এত মাথা গরম ভালো না। লাশ থাকে কবরের ভিতরে। তার গায়ে কাপড় থাকলেই কী, না থাকলেই কী।
এছাড়া কয়দিন পরে কাপড়টা তো এমনিতেই মাটির লগে মিশ্যা যাইত। যাইত না?
: আপনে কবিরাজের নামটা কন।
: নাম কওয়া যাইবো না। তবে তোমারে একটা সুখবর দিতে পারি। এই যে অ্যাক্সিডেন্টে তোমার পাওটা ভাংলো, তুমি সারাজীবনের জন্য ল্যাংড়া হইলা, এই সমস্যাটা কিন্তু থাকবো না। কবিরাজের তাবিজটা গলায় ঝোলানির লগে লগে দেখবা পাও ভালা।
: আপনের কাছে আমি সুখবর শুনতে চাই নাই। কবিরাজের নাম শুনতে চাইছি।
সুলতান মিয়া আবু তালেবের চাওয়া পূরণ করে না। চলে যায় দ্রুত। আবু তালেব চাইলে তাকে আটকাতে পারত। কিন্তু আটকায় না। আটকাতে ইচ্ছে করে না। পরদিন টিফিন পিরিয়ডে স্কুলে গিয়ে হাজির হয় আবু তালেব। সুলতান মিয়া তাকে দেখে চমকে উঠলেও মুহূর্তেই সামলে নেয় নিজেকে। টুল এগিয়ে দিয়ে বলে— বসো মিয়া, বসো। তা এই সময়ে এইখানে? এই সময়ে না তুমি ঘুমাও? ঘুম বাদ দিয়া আমার লগে গল্প-গুজব করলে রাইতে ডিউটি করবা ক্যামনে? ডিউটির সময় যদি ঘুমাও, তাইলে কিন্তু চাকরি থাকবো না। আর যদি কোনো লাশের কাপড় চুরি হয়…
সুলতান মিয়াকে বাক্য শেষ করতে দেয় না আবু তালেব। তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বলে-
আপনে অবশ্যই আমারে কবিরাজের নামটা কইবেন। যদি না কন, তাইলে এখনই আমি চিয়ারম্যানরে লইয়া থানায় যামু। আর একবার যদি থানায় যাই, তাইলে আপনের কী দশাডা হইবো, চিন্তা করেন। আবু তালেব ভেবেছিল হুমকিতে সুলতান মিয়া ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু না, সেও উল্টো হুমকি দেয়- কবিরাজের পিছনে লাগার চেষ্টা কইরো না। কবিরাজের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়াই নাই। তুমি যদি তার কথামতো কাজ করো, তাইলে তোমার ল্যাংড়া পাওটা ভালো হওয়া ওয়ান-টুর ব্যাপার।
: যদি না করি?
: না করলে তোমার ভালো পাওটা ল্যাংড়া হওয়া ওয়ান-টুর ব্যাপার। এইবার চিন্তা কইরা দেখো, ল্যাংড়া পাওটা ভালো করবা নাকি ভালো পাওটাও ল্যাংড়া কইরা আজীবনের লাইগা বিছানায় পড়বা।
আবু তালেব কথা বাড়ায় না। স্কুল থেকে সরাসরি চলে আসে চেয়ারম্যানবাড়ি। কিন্তু চেয়ারম্যানকে পায় না। জানতে পারে চেয়ারম্যান প্রচ- অসুস্থ, তাকে ঢাকার বড় একটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর একদিন দুদিন করে টানা দু মাস সে অপেক্ষা করে চেয়ারম্যানের জন্য। তিনি ফিরলেই আবু তালেব তাকে সুলতান মিয়ার কথা বলবে এবং অমানুষ কবিরাজটা যে কে, সেটা খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার অনুরোধ করবে।
লাশকে বে-আব্রু করে কাফন চুরি করে কবিরাজগিরি? এই জঘন্য কবিরাজগিরির বারোটা না বাজিয়ে শান্তি নেই আবু তালেবের।
আড়াই মাস পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয় চেয়ারম্যানকে। কারণ, ডাক্তার কোনো রোগ ধরতে পারছে না। তাই বলে দিয়েছে এই অসুখ আরোগ্যের অনুপযোগী। অতএব বাড়ি নিয়ে রোগীর পছন্দের খাবার খাওয়ানো আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয়।
চেয়ারম্যানের ফেরার কথা শুনে তাকে দেখার জন্য ছুটে যায় আবু তালেব। কিন্তু চেয়ারম্যানবাড়ির সীমানায় পা দিতেই চমকে ওঠে সে। কারণ, সুলতান মিয়া বের হচ্ছে
বাড়ির ভেতর থেকে। সঙ্গে আলখাল্লা পরিহিত অপরিচিত একজন।
একবছর পর।
চেয়ারম্যান এখন পুরোপুরি সুস্থ।
আর আবু তালেব বিছানায় পড়া। তার দু পা-ই এখন ল্যাংড়া, অচল।