ঈদসংখ্যার গল্প।। ক্ষরণ।। নিতু ইসলাম
মাঝ রাত্তিরে পোষা ডাইকের শব্দে ঘুম ভাঙে আরজ আলির। এমনিতেই তার ঘুম কম। তার উপর এই কোয়াক কোয়াক ডাকাডাকি। ওর রক্তে ঝিঁঝি করে। আজ বেশ কিছু পাখি না ধরে ঘরে ফিরবে না। বাড়িতে বাজার বাড়ন্ত। আয়না বিবি কাল মুখ ঝামটা দিয়েছে। বেচুইন তো গোস্ত আর বাড়িতে ভাত খাইন চুনাপুঁটি দিয়া।
আজ বেশ কয়েকদিন পাখি ধরায় ভাটা পড়েছে। সরকার নাকি নিষেধ করেছে। আরে বাপুরে যার যার কাম তাক করি খাতি দাও দিনি। হামরা কি কইতে গেছি। তোমরা পোলাউ গোসত, রোস্ট খাও কা? সেগলি কী পশু পাখি না মাইরে খাওয়া যায়?
যাক গিয়ে, আজ একটা বড় দাও না মেরে সে ঘরে ফিরবে না। প্রতিজ্ঞা করে সে বাইরে নামে। প্রায় ভোর হয়ে আসছে। নিজের পাখিটা নিচে বেঁধে রেখে, তার সামনে খাবার দেয় আরজ আলি। পাখিটা প্রাণপণে ডাকে – কোয়াক, কোয়াক। পাশে পেতে রাখা জালের উপর ওরা বসে। তারপর আরজ আলির হাতের কাজ। দ্রুত ওদের জাল থেকে ছাড়িয়ে বড় খলউইয়ে রাখে। এভাবে তিন চারবার করতে করতেই পাখিরা সতর্ক হয়ে যায়।
সূর্য ওঠে, কাঁসার থালার মতো রোদ ঝলমলিয়ে। আরজ আলি হাটের দিকে রওনা হয়। তার আগে কিছু মরিচ পানতা খেয়ে নিতে ভোলে না। ছেলে জামালের স্কুলে যাওয়ার সময় এটা।
নবাব পুত্তুরের ঘুম আর ভাংতি চায় না।
তারপরেও সে – ও বাজান, ও বাজান, ইস্কুলত না যাও? উডো উডো। বলে হাঁক ছাড়ে।
আয়না বিবি চুলা লেপছে। প্রতিদিন কী এমন গোস পোলাউ রান্না হয় যে, সে চউলা না লেপে থাকতে পারে না? বিড়িতে কষে একটা টান লাগিয়ে খাঁচাটা সে হাতে ঝুলায়। আজ হাটে প্রচুর লোক। সবাই যেন খুব ব্যস্ত। চারদিকে সবার ভীষণ তাড়াহুড়া। এক কোণায় বসে আরজ আলি। থানার ছোট দারোগা আজও এসেছে। সপ্তাহে দুইদিন হাট। প্রতি হাটেই তার আসা চাই। এদিকে এক গ্রাহক নেবে দশটা হরিয়াল। বট ফল খেয়ে পাখিগুলো খুব নাদুসনুদুস হয়েছে। সবগুলো সে নিজে জবেহ করে গ্রাহকের হাতে দেয়। এক হাতে পাখি ধরে আর এক হাতে গলায় পোঁচ দিলে ফিনকি দিয়ে রক্ত আসে। হাতে লাগে গরম রক্ত। পাখিটা ছটফট করতে করতে মরে যায়। আহা এই গরম রক্ত হাতে নেয়ার সুখই আলাদা।
‘কীরে আরইজ্জা? তোরে না কইছি, পাখি দেশের সম্পদ। পাখি ধরে বিক্রি করা পুরা নিষেধ। তারপরও তুই পাখি মারস।’ ছোট দারোগার রুলারের গুতা খেয়ে, আচমকা হুশ ফেরে আরজ আলির। আর ধরমু না পাখি আল্লাহর কিরা। দৌড়ে আলাতে চায় আরজ আলি। তার আগেই আরো দুইটা বাড়ি পড়ে পিঠে।
‘বাকি পাখিগুলো ছেড়ে দেয়, ছোট দারোগা। আহহারে দেশের লাইজ্ঞা তার কী দরদ! যেন উথলিয়া উটছে।’ খলুই পিঠে নিয়ে দৌড় দেয় সে। খাঁচাটা পায়ে গুড়িয়ে দেয় ছোট দারোগা। হাট থেকে বাজার না নিয়ে আসার কারণে আয়না বিবি চিৎকার করে৷ ছোট দারোগাকে অভিশাপ দেয়। আরজ আলির বাপ মাও সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় না। অবশেষে নিজের কপালই চাপড়াতে থাকে। আজকাল পাখি ধরা একদম নিষেধ। বিলের চারপাশে গ্রাম পাহারাদার সারারাত চৌকি দেয়।
ডাইকের ডাক শুনলেই দৌড়ে আসে। একদিন সে হাতেনাতে ধরে ফেলে আরজ আলিকে। অন্য শাস্তি না দিয়ে, তার এতো সাধের ডাইক কুবাকে ছেড়ে দেয়। কুবা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, তার মুক্ত জীবনকে। তারপর একসময় আকাশে উড়াল দেয়। কুবার উড়ে যাওয়া দেখে, ওর বুকটা হুহু করে ওঠে। বর্ষা মাসে এক ঝোঁপের মাঝে খুঁজে পেয়েছিল কুবাকে।
একদম ন্যাদা বাচ্চা। তাই বিক্রি না করে পুষেছিল। পরে কাজে লাগবে বলে। আইজ প্রায় পাঁচ সন তার সাথে সাথে ছিল পাখিটা। চুপচাপ ঘরে ফেরে সে। আয়না বিবির শত প্রশ্ন আর অভিযোগের সে উত্তর দেয় না। ছেলে জামাল অবধারিতভাবে ঘরে নেই। ছেলেটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে। সামনের মাসে নৌকা বাইচ। সে আবদার ধরেছে নয়া শার্টের। বাইচের নৌকায় সবাই সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দেয়। নয়া শার্ট ক্যান লাগিবে কে জানে? ইদানীং নাকি বিড়িও ফোঁকে। আয়না বিবি কবে যেন গুনগুন করে বলছিল। আইজ ঘরে আসুক হারামজাদা। স্বগতোক্তি করে আরজ আলি।
ধার দেনা করে, পানি, পান্তা, শালুক খেয়ে কিছুদিন চললো। পেটে খিঁচ মেরে আর কতো ঘরে থাকা যায়? আয়না বিবির ঝগড়ায় কাক চিল আসে না আশেপাশে। একদিন বাইচের নৌকা থেকে পা পিছলে হাঁটু কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছিল জামালের দোস্তের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফেরে সে। আরজ আলি শুয়ে ছিল বারান্দায়। ছেলের পা বেয়ে রক্ত পড়ছে। দুই চোখের আশ মিটিয়ে দেখছিল সে । আহ রক্তডা মনে লয় গরমই আছে। পিপাসার্ত শার্দূলের মতো চেয়ে চেয়ে দেখে। কোত্থেকে আয়না বিবি চিলের মতো দৌড়ে আসে। ছেলেকে লতাপাতা দিয়ে পা বেঁধে নিয়ে কবিরাজের কাছে দৌড়ায়। যাওয়ার সময় গজগজ করে আয়না। মনে হয় নিজের পুত না পাখির গলাকাটা রক্ত দেখতাছে।
আয়না যতই গজগজ করুক, আরজ আলি অবাক হয়ে যায়, আসলেই সে তখন এই কথাটাই ভাবছিল। পূব পাড়ার নইমের প্রস্তাবটা সে আজ আর ফেরাবে না। নইম কসাইয়ের কাজ করে। আরজ আলিকে সে সঙ্গী হিসেবে চায়। গরু কাটলে পাঁচশো আর খাশি কাটলে দুইশো টাকা চুক্তি। আসলে সে গরু খাশি কাটতে চায় না যত জবাই করতে চায় আরো বেশি। এই কাজ তার ভালো লাগে। রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়। গরম রক্ত হাত দিয়ে ধরার শান্তিই আলাদা (! )
আজ প্রায় দুই বছর সে কসাইয়ের কাজে আছে। দিনে তিন / চার / পাঁচ কাটাকাটি, কোন বিরক্তি নাই। বাড়ি আসতেও আজকাল ভালো লাগে না। ছেলেটা প্রায়ই বাড়ি ফেরে না। নষ্ট হয়ে গেছে। ইয়ার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। বিড়ি ফোঁকে। বর্ডারে নাকি এপার / ওপার করার কাজও করে। মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা যায় । মাথায় উলটা ক্যাপ পরে বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে বসে আছে।
আজ ভাত খেয়ে কাজে বেড়োনোর সময় বৌ বলে – ছেলে তিন দিন বাড়ি ফেরেনি। সে যেন একটু খোঁজ নেয়। সে নাকি রাতে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। মেয়ে মানুষের বাকোয়াস, তবুহাটের চায়ের দোকানে খোঁজ নেবে। মনে মনে ভেবে রাখে। সিনেমার পুরাতন একটা গান – হয় যদি বদনাম, হোক আরো, আমি তো এখন আর নই কারো গানটা গুনগুন করতে করতে হাটে আরজ আলি।
বাড়ির হালট পার হয়ে মাঠে নামতেই। বাঁ পাশের পাকুড় গাছের পাশ থেকে দুজন মানুষ বেরহয়ে আসে।
আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম ভাইজান। আইজ একটা বিশেষ কাম যে কইরা দিতে অয়!
কী কাম? অবাক চোখে শুধায় সে।
এই কাটাকাটির কাম।
অনুষ্ঠান আছে বুঝি? তা আমার কাছে তো মাল সামা নাই ভাই!
ঐসব আমগো চিন্তা। আপনে চলেন তো!
দুইটা গ্রাম পার হতেই সন্ধ্যা ঘনায়। আর কতদূর?
আইসা পড়ছি।
বাড়ির কান্দায় কোন ছাগল, গরু না দেখে অবাক হয়। আচ্ছা, পরে বুঝি আনবে। ভেবে নিজেকেই শান্তনা দেয় সে। প্রায় অন্ধকার একটা ঘরের সামনে একটা লোক। তাকে ডাকে। এই ঘরে আসেন। একটা মাল আছে। কাইট্টা ছোট্ট ছোট্ট টুকরা করেন। সে ঘরে ঢুকে অবাক হয়। মেঝেতে শোয়ানো আছে একটা লাশ। এই লাশ তাকে কাটতে হবে! বিস্ময়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। কতক্ষণ সময় গেছে জানে না। বাইরে থেকে তাগাদা আসে। কেউ একজন তাকে দুইটি চাপাতি দিয়ে যায়। কোন দিক থেকে শুরু করবে দিশে পায় না। ঘরের ভেতর একটা হারিকেন শুধু। স্বল্প আলোয় সে আবার তাকায়। পুরো পা’টাই উদোম হয়ে আছে এবার। হারিকেনটা উস্কে দিয়ে সে চাপাতি উপরে তোলে। ও আল্লাহ বলে একটা চিৎকার আসে তার গলা দিয়ে। ছেলেটার হাঁটুর কাছে একটা দাগ। হ্যাঁ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শামুকে কাটা দাগ। এটা তো আর কেউ না, তার ছেলে জামালের লাশ। ত্রস্ত হাতে সে লাশের মাথার কাপড় সরায়। ভয়ে থরথর করে কাঁপে আরজ আলি। কিন্তু উপায় তো নেই। আহারে মানিক চাঁন আমার! গলা দিয়ে একটা আর্তচিৎকার করে সে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়। তার বুক, তার মন থরথর করে কাঁপে। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসে। সে দৌড়াতে থাকে। মনকে বোঝায় সে কিচ্ছু দেখেনি। লোক দুজন তার পিছু নেয়। দৌড়াতে দৌড়াতে সে দেখে তার ছেলে জামাল আসছে। ঐতো জামাল। জামাল বলে সে ডাকতে চায়। গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। জামাল আরজ আলির হাত ধরে – আব্বা আসেন। সে নিশ্চিন্তে ছেলের হাত ধরে। তারপর তারা পালায়, বিল,পুকুর, বন জঙ্গল ডিঙিয়ে তারা পালাতে থাকে। হোঁচট খায়। আবার ওঠে, কাঁদে আরজ আলি। তার দুই বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করে। বারবার পড়ে যাওয়ার দরুন হাঁটু ছিলে যায়। পায়ে, গায়ে নানান জায়গা দিয়ে রক্ত বের হয়। একসময় সে নিজের রক্তের গন্ধ পায়। সেই পাগল করা গন্ধ। কিন্তু আজ সে ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত। তারপর একসময় আড়মোড়া ভেঙে চাঁদ ওঠে। ফিনিক ফোঁটা জোৎস্নায় ভেসে যায় চারদিক। এই জায়গা সে চেনে। এই জঙ্গল, এই বিল তার পরিচিত। এখান থেকে সে শতশত পাখি ধরে এনেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে একসময় নিজের উঠানে আসে। জামাল বলে – আব্বা, হাত ছাড়েন। আরজ আলি তাকায়। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আশ্চর্য হলেও সত্যি। জামালের শরীরের এখান দিয়ে সেখান দিয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু জামালের চোখ বন্ধ। আহারে তার পোলা, একমাত্র পোলা সুরুত জামাল আসলে মৃত ! সে হাত বাড়িয়ে ছেলের রক্ত মুছে দিতে চায় পারে না। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলতে – এই মরার রক্ত পড়া বন্ধ হউক। আর পারি না। আজ বহু বছর পরে রক্ত দেখে আরজ আলির ভয় করে। সে জ্ঞান হারায় ।