নির্বাচিতছোটগল্প

ছোটগল্প।। উত্তরসূরি।। মোজাম্মেল হক নিয়োগী

এখানে রাতের ট্রেন দিনে আর দিনের ট্রেন রাতে আসে। সময়সূচিটা বদলিয়ে দিলে মানুষের জন্য মঙ্গল হতো, তা করা হয়নি, তবে ট্রেন-যাত্রীদের সমস্যা হয় না, সময় হিসেব করেই স্টেশনে আসে।
সকালবেলার সেভেনআপ ট্রেনটি বিকেলে যখন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফরমে এসে ভিড়ে তখন ডেগুকে দেখা যায় ইঞ্জিনের সামনে বীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওর এলোমেলো রুক্ষ ও ধূলিতে পরিপূর্ণ চুলগুলো বাতাসে এখনও তিরতির করে কাঁপছে। বিড়ির শেষ অংশটি তিন আঙুলের মাঝখানে চেপে ধরে শুকনো ঠোঁটের মাঝখানে রেখে সজোরে শেষ টানটি দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে আস্তে আস্তে ইঞ্জিন থেকে সিঁড়ি বেয়ে এমন ভাব নিয়ে নামল সে, মনে হলো ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার। নাভির অনেকটা নিচে ময়লাযুক্ত ছেঁড়া লুঙ্গিটির গিঁট, কয়েকটা জায়গায় ছেঁড়া, সেটি উল্টিয়ে ভাঁজ করে হাঁটুর উপরে উঠানো। লুঙ্গির রং উদ্ধার করা অসম্ভব। উচ্চতা চার ফুট দশ ইঞ্চি বা তার চেয়ে কিঞ্চিৎ কমও হতে পারে। পিঠ কুজো। কবুতরের বুকের কাঠামোর মতো অস্থি পিঞ্জরের সন্ধিস্থল কাপড়ের গিঁটের মতো উঁচু। ঘাড় তুলনামূলক খাটো। বুক থেকে লম্বালম্বি পেটের মাঝখানটা বোয়াল মাছের পেটের মতো ঝুলানো। মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর জিনের প্রভাব নাকের নিচে গোঁফের বাড়াবাড়ি নেই। উপরের ঠোঁটের দুই প্রান্তে কয়েকটা হালকা গোঁফ। দাঁতগুলো পোকায় খাওয়া, পান খাওয়ার ফল হিসেবে খয়েরি রং ধারণ করেছে। গায়ের রং কালো তো বটেই একেবারে পাতিলের তলা। অবশ্য এমন হওয়ার কারণ হলো তাকে কেউ গোসল করতে দেখেনি কোনোদিন। ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে দড়ি দিয়ে ফিতা বানিয়ে এক-তৃতীয়াংশ খয়ে যাওয়া দুপাটি স্পঞ্জ পায়ে। ডান পায়ের তলায় দুটি শালগড়া থাকাতে সে স্পঞ্জ ছাড়া চলতে পারে না সামান্য পথ।
একটি ধোঁয়ার কু-লি খালাস করে ইঞ্জিনটি ডুকরে হর্ন বাজিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল ট্রেনটি। ডেগু আস্তে আস্তে প্ল্যাটফরমের উত্তর পাশে গিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে দাঁড়ায় যদি দুয়েক টাকা জুটে তাহলে বিড়ি কিনে খাওয়া যাবে। ট্রেনের টিকিটবিহীন যাত্রীরা টিকিট চেকারকে ফাঁকি দিতে উত্তর দিক দিয়েই নীরবে পালিয়ে যায়।
ক্ষীণকায় এক হতদরিদ্র লোক দূরের গঞ্জে কোথাও মজুরি খেটে বাড়ি ফিরছিল, পালিয়ে যাওয়ার সময় ডেগু ডাক দিয়ে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, টিহেট আছে?
লোকটি শুধু গরিবই নয়, বুদ্ধিরও ঘাটতি আছে। কে টিকেট চেকার আর কে স্টেশনের কুলি এই পার্থক্যটুকু সে করতে পারে না। যুব বয়সেই ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া শিড়দাঁড়া, আর কটা কটা চোখ, করুণভাবে বলল, স্যার টিহেট নাই।
ডেগু জানে এ ধরনের লোকদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়। সে বলল, চল, থানায় চল।
লোকটি করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, স্যার আমি গরিব মানুষ। মাফ কইর‌্যা দেন। কামলা দিতে গেছলাম।
বাপের টেরেন ফাইছো? মাফ নাই। থানায় চল।
স্যার মাফ কইর‌্যা দেন। আর জীবনে টিহেট ছাড়া গাড়িত উটতাম না।
বেআইনি কামের লাইগ্যা আমার কিছু করার নাই। থানায় চল।
স্যার একটা ট্যাহা নেন। ছাইড়্যা দেন।
এক ট্যাহা? না, দুই ট্যাহা দে।
স্যার, আমি গরিব মানুষ। কামলা দেয়া খাই। একটা ট্যাহা নেন।
আচ্ছা দে দেহি।
হতদরিদ্র লোকটি কোমরের কোচর থেকে একটি টাকা দিয়ে দ্রুত প্ল্যাটফরম ত্যাগ করে দূরে গিয়ে টিকিট ছাড়া এতো দূর থেকে এক টাকা দিয়ে মুক্তি পাওয়াতে মনের আনন্দ প্রকাশ করে, অনুচ্চারে হাসতে হাসতে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়।
প্ল্যাটফরমের দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন এ দৃশ্য দেখে পিটপিট করে হাসল। ডেগু টিকিট চেকার! এ অভাবিত, অগ্রহণযোগ্য তবুও হয়। ডেগুর পায়ের নিচে মাটি আছে। তাকে কেউ কিছু বলে পার পেয়ে যাবে এমনটি আশা করা যায় না। স্টেশনের সবারই প্রয়োজন ডেগুকে। তাই সে মাঝে মাঝে এমন টিকিট চেকারের কাজ করে। তবে এই কাজ করার সময় সে ভালো করে দেখে নেয় তার চেয়ে দুর্বল এবং হতদরিদ্র কিনা। সবার কাছে টিকিট চাওয়ার মতো সাহস ওর নেই। এভাবে দুয়েক টাকা আয় করে পান-বিড়ি কিনে খায়। মজা করার জন্যই এমন করে।
শীতের রাত। নিকষ অন্ধকার আর জমাট কুয়াশার আবরণে জনমানবহীন চারপাশে ভরাট নৈঃশব্দ্য, উত্তুরে হিম বাতাসের সঙ্গে ঝেঁকে আসা হাড় কাঁপানো শীত। স্টেশনমাস্টার হ্যারিকেন জ্বালিয়ে একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে টেবিলের উপরে শুয়ে আছেন। তীব্র শীতের দাপটে মাঝে মাঝে ঠক ঠক করে কাঁপছেন। বারান্দায় গুটি মেরে শুয়ে থাকা কুকুরটি শীতে কুঁ কুঁ করে আর মাথাটা চার পায়ের ভাঁজে গুঁজে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। এমন শীতের রাতে ডেগুও বারান্দায় একটি ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কান খাড়া করে। মাস্টার সাহেব ডাক দিলেই তাকে উঠতে হবে। পাশের জঙ্গলে কয়েকটা শিয়াল ডাকছে। ডাক শুনে এমনই মনে হয়। স্টেশনের পাশের দুটি চা-স্টলে এখন আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটি ট্রেন এখনো আসেনি। দুপুরে ট্রেনটি আসার কথা। এখনো সময় হয়নি আসার।
কুয়াশা মুড়ানো অন্ধকারের সুরঙ্গে রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে নিজ গতিতে। একসময় টেলিফোন বেজে ওঠে। মাস্টার সাহেব বিছানা ছেড়ে ফোন ধরেন, প্রলম্বিত ধীর তাল-লয়ে বলতে শুরু করেন, নান্দাইল… নান্দাইল… নান্দাইল… হ্যালো… হ্যালো… নান্দাইল… নান্দাইল… টোয়েনটি ডাউন… হ্যালো নান্দাইল…।
টেলিফোনের বিশাল স্টিলের বক্সের সামনের হ্যান্ডেলটি সজোরে টান দিয়ে খটাস খটাস করে লাইন ক্লিয়ারেন্সের ধাতব চাকতিটি বের করেন। ডেগু পাশে এসে দাঁড়ালে মাস্টার সাহেব ওর হাতে তুলে দিলেন চাকতিটি, প্রায় অনুচ্চারিত শব্দে বললেন, নেয়।
লাইনসম্যান লোহা লক্কড়ের হাতল টেনে সিগন্যাল আপ করে আবার শুয়ে পড়ে।
রেলওয়ের বাতিটি নিয়ে আউটার সিগন্যালের দিকে এগিয়ে যায় ডেগু। এই গাড়িটি পার করলেই রাতটি ঝামেলামুক্ত। তারপর নিñিদ্র ঘুমে ডুব দিয়ে রাত পার।
এই এক্সপ্রেস ট্রেনটির এই স্টেশনে স্টপেজ নেই, প্যাসেঞ্জারও নেই।
পশ্চিম পাশের লাইনে কয়েকটি মালগাড়ির ওয়াগন নিথর দাঁড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে, তার ওপাড়ে কাঁটাঝোপ, শেয়াকুল, নিসিন্দা তারপর ঘুমন্ত ধানের মাঠ, অভেদ্য সাদা কুয়াশা মুড়ানো ঝিমধরা অন্ধকার গলিয়ে দূরের গ্রামগুলো দৃষ্টির গোচরে আনা দুঃসাধ্য, নিঃশব্দ শূন্যতায় কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি। মালগাড়ির ওয়াগনগুলো অনেক দিন ধরেই এখানে, হয়তো কোনো একসময় পাট বোঝাই হবে, অতঃপর কোনো একদিন নারায়ণগঞ্জ কিংবা তদুদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। এগুলো স্টেশনের শোভা কিংবা রেলের প্রতীক, না-হয় মফস্বলের এই রেল স্টেশনটির খুঁজে পাওয়াই হয়তো দুষ্কর হতো।
ওয়াগনগুলো পাড় হয়ে কচ্ছপের গতিতে উত্তর পাশের আউটার সিগন্যালের দিকে এগিয়ে যায় ডেগু। রেলপাতের পাশে উপচে পড়া পাথর মাটির সংকীর্ণ পথ এবড়ো-খেবড়ো, বিধ্বস্ত। কোনো পাথর মাটিতে আংশিক ডুবে মুখিয়ে আছে, কোনোটা মাটি ছাড়া আবার কোনোটা গর্তে লুকানো। ডেগু সিগন্যালের পাশে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন ঘুম জড়ানো দৃষ্টি রাখে। সাদা অন্ধকারে নির্বিষ বোড়া সাপের মতো পড়ে আছে কালো শীতল রেলপাত। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে ইঞ্জিনের হেড লাইটের আলো ছড়িয়ে পড়ে সাদা অন্ধকার প্রাচীরে। ফেনিল কুয়াশা সেঁদিয়ে আলোর ফোকাস অনতিক্রম্য, বালির চরে যেমন সমুদ্রের স্রোত অবরুদ্ধ তেমনি হেড লাইটের তীব্র আলো সেঁটে গেল সাদা কুয়াশার অভেদ্য স্তরে। ইঞ্জিনের পেট খোলাশা করে হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে আসে বারো কামড়ার এক্সপ্রেস ট্রেনটি।
হাড়চিবানো হিম বাতাসে ডেগু কাঁপছে থরথর করে। স্টেশন মাস্টারের দেওয়া গায়ে একটি ছেঁড়া কম্বল জড়ানো, তার নিচে রয়েছে অতিশয় পুরনো ছেঁড়া, ময়লা, জরাজীর্ণ কালো রঙের একটি কোট। রাত-বিরেতে সে এভাবে নিয়ম-ভাঙা ডিউটি করে স্টেশন মাস্টার আর অন্যান্য কর্মচারির সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে, এই কাজের কোনো মজুরি নেই। আর রেলের কর্মচারিদের সঙ্গে খাতির থাকার জন্যই ‘ডেগু নামে’ গৌরীপুর থেকে ভৈরব বাজার স্টেশনের অনেকেই চেনে… এতেই তার শান্তি। মজুরির প্রয়োজন সেও বোধ করে না। তিন বেলা কোনোভাবে খাওয়া হলেই ওর খুশির শেষ নেই। মাঝে মাঝে বিড়ি কুড়িয়ে খায় কিংবা বিনা টিকিটের যাত্রী পেলে এক টাকা দুই টাকা আদায় করতে পারলেই দিন চলে যায়। খায়-দায় ঘুমায়, রেলের ইঞ্জিনে চড়ে ভৈরব যায়… গৌরীপুর যায়… এতেই ওর মনে থাকে প্রশান্তির আত্মশ্লাঘা। একজন দিনমজুর হিসেবে অভাব-অনটনের শেষ নেই, বুকের ভেতরে হয়তো হাহাকার রয়েছে যা অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায় না। কোনো দিন সে আকাশের গভীর নীলে চোখ ডুবিয়ে কোনো নারীর মুখ কিংবা কাব্যকলার অনুপ্রাস খুঁজে বেড়ায় নি, স্বপ্ন দেখেনি কোনো প্রাসাদের, এই বিশ্বচরাচরে সে দেখে শুধু বেঁচে থাকার অন্নজল এর বেশি কিছুই তার চাওয়ার নয়, পাওয়ারও নয়।
ট্রেনটি এক ঝাপটা ঠান্ডা বাতাস তিমির ও কুয়াশার পাহাড় কাঁপিয়ে, মজ্জায় ছুরি বিঁধিয়ে ডেগুর হাতের লাইন ক্লিয়ারেন্সের চাকতিটি নিয়ে আরেকটি চাকতি মাটিতে ফেলে অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। ট্রেনটি অদৃশ হলে আপাদমস্তক আবৃত ডেগু লাইন ক্লিয়ারেন্সের চাকতিটি কুড়িয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়। পায়ের শালগড়া মুখিয়ে উঠেছে, ঠান্ডায় বেড়ে গেছে ব্যথার ইতরামি স্টেশনে পৌঁছুতে সামান্য পথটুকুই ডেগুর কাছে মনে হয়েছে যোজন যোজন দূর, দীর্ঘ সময়ের পথ।
ধীরে ধীরে হাঁটে ডেগু।
ওয়াগনগুলোর কাছাকাছি আসতেই একটি শব্দ বাতাসে উথলে ওঠে। কিসের শব্দ কিংবা এই শব্দের অর্থ কী হতে পারে তা নিয়ে ডেগু একটু ভাবে নি। শব্দটি শুধু ওর কান পর্যন্ত এলো এই যা। কোনো শব্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো ব্যক্তিও ডেগু নয়। সে অতি সাবধানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে যায়। শীতফাটা পায়ের গোড়ালির জোর ক্রমে হ্রাস পায়, শ্লথ হয় আসে গতি, কিছুটা টনটন ব্যথা শীতের না পায়ের তা দুর্জ্ঞেয়। একমাত্র ভরসা ছেঁড়া স্যান্ডেল দুটি যা ভারী হয়ে উঠছে কুয়াশার সঙ্গে মিশে মৃত ঘাসকাদায়। নিস্তরঙ্গ কুয়াশার স্তর আকাশ পর্যন্ত ঠেকেছে, যেন এক নীল বরফের হিমশীতল নিস্তব্ধ ছমছমে নির্জনতা, এমনকি প্রাণীহীন এক সুরঙ্গপথ দিয়ে ডেগু এগিয়ে যায়ে যেন বরফ-মেরুর এক নিরুদ্দিষ্ট অভিযাত্রীর মতো। মাঝে মাঝে ছুরি বিঁধানো উত্তরা দমকা বাতাস। নিঃশ্বাস বাষ্পরুদ্ধ। রেল লাইনের আশপাশে ধানক্ষেতের আলে কখনো হঠাৎ শেয়ালের ডাক। দু-একটা পেঁচার ডাক শোনা গেলেও এখন তাও আর নেই। পথের ওপর মুখিয়ে থাকা পাথর দেখে দেখে খালি সমতল জায়গায় পা রেখে আরও একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে।
শীর্ণবস্ত্রে আকর্ণ মুড়ানো দ্বিতীয়বার ডেগুর কানে শব্দটি এসে টোকা দিলে সে একটু দাঁড়িয়ে চোখ বিস্ফারিত করে, কান খাড়া করে শব্দের উৎসটি নির্ণয়ের জন্য কিঞ্চিৎ ব্যাকুল হয়। কীসের শব্দ? সে ভাবে কিছুক্ষণ। এই শব্দের যথার্থতা বোঝার জন্য আবার অনুচ্চারে বলল, ক্যার শব্দ? কোনো কিছুর সুরাহা করতে না পেরে সে আরও একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
শব্দটি আবার ডেগুর কানে ভেসে আসে।
এবার সে পরিষ্কার বুঝতে পারে একটি শিশুর শব্দ। কিন্তু এই কঠিন হিংস্র শীতের রাতে এখানে শিশুর শব্দ কেন? ডেগু বিস্ময়াবিভূত হয়ে কয়েক পল চিন্তা করে শব্দটির উৎপত্তিস্থলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওয়াগনের পাশে সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি শিশু পড়ে আছে। কিছুটা অবাক হয়েই সে কাচঘেরা রেলের বাতিটি নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখে শিশুটির গায়ে এখনো টাটকা তাজা রক্ত লেগে আছে। চোখ দুটি বকুল কুঁড়ির মতো বুজানো, নির্জীব, শান্ত, হাত-পা কুঁকড়ানো। ডেগু বুঝতে পারে না শিশুটি জীবিত না মৃত। পা দুটি ঘুমন্ত কাঁকড়ার মতো একটু একটু নড়ছে। হয়তো জীবিত। কিন্তু কতক্ষণ বাঁচবে? সে চোখের আয়তন বড় করে শিশুটিকে দেখে কিছুক্ষণ। তবে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটি ডেগুর বুকের ভেতরে কোনো মায়ার সঞ্চার করতে পারেনি। সে কিছু না ভেবে কিংবা শিশুটির জন্য কোনো কিছু করার চিন্তা না করেই স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়।
এক পা এগিয়ে যেতেই শিশুটি ক্যাঁ করে শব্দ করে। মুহূর্তের মধ্যে ডেগুর শরীরে একটি মায়াবী শিহরণ জাগে। সে ঘুরে দাঁড়ায়। তার অন্তরাত্মা একটু কেঁপে ওঠে। ডেগু মনে মনে বলল, ‘আবুডা (শিশুটি) কী কইল?’ ওর বুকের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা কোনো একটি স্থান থেকে উত্তর এলো, ‘ডেগু এই শিশুটিকে ফেলে চলে যাচ্ছিস কেন? তোর জন্মের দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখ।’ ডেগুর সমস্ত চিন্তা ঝিম ধরে যায়। মনে হয় ওর সামনে একটি অলৌকিক মানুষ দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি করেছে। চল্লিশ বছরে সে যা ভাবেনি আজকে এমন একটা ভাবনার অন্তরাল থেকে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এত দিন নিজের মধ্যে সে যা খোঁজেনি আজ তাকে তাই খুঁজতে বলছে কেন?
ডেগুর অন্তরালোক থেকে বের হয়ে আসে আরেক মানুষ। তাই তো, আমার জন্ম কোথায়? না, আমি জানি না আমার বাবা কে? আমি জানি না আমার মা কে? শুনেছি ছোটবেলায় নীলগঞ্জের এক হাটের পাশে আমাকে একটা ডেকচির মধ্যে রেখে কে বা কারা ফেলে গিয়েছিল। সেখান থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল আলামত কুলি। ডেকচির মধ্যে আমাকে পেয়েছে বলে আমার নাম রাখা হয়েছে ‘ডেগু’। সেই আলামত কুলি একদিন পেটের দায়ে নীলগঞ্জ ছেড়ে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে মুটের কাজ করতে গেল। আলামতের স্ত্রীই আমাকে বড় করেছে। তার বুকের দুধ খাইয়েছে। তারপর আমিও আমার বাবার সঙ্গে অর্থাৎ আলামত কুলির সঙ্গে রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন স্টেশনে এলাম। সেই স্টেশনে বাবার কাছে কাছে থাকতাম। দেখতাম বাবা কীভাবে কাজ করে। আমি কিছুটা বড় হলাম। একদিন এক লোক বাবাকে একটা চড় মারলে আমি লোকটাকে ইটের টুকরা দিয়ে মাথায় ঢিল দিলাম। লোকটার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। আমি ভয়ে পালিয়ে চলে গেলাম আমার পালক মায়ের কাছে। রাতে আমাকে বেদম মারা হলো। আমি কেন এমন দস্যুতা করলামÑএই আমার অপরাধ। পরদিন সকালবেলা রাগে-ভয়ে-দুঃখে অন্য একটি ট্রেন ধরে এই নান্দাইল রোডে স্টেশনে চলে এলাম। তখন থেকে আমি এখানেই আছি।
থাক এসব। এসব শুনে তোর কী লাভ?
ডেগু আবার হাঁটতে শুরু করে। এই শিশুকে নিয়ে সে কী করবে? আলামত কুলির না হয় বউ ছিল, সংসার ছিল… ডেগুর তো বউ নেই, সংসার নেই। সে কার কাছে দেবে এই শিশুকে? এমন ভাবনার যন্ত্রণায় মর্মে মর্মে রক্তাক্ত হয়ে ডেগু পা বাড়ায় স্টেশনের দিকে। যারা জন্ম দিল তারা যদি তোকে বাঁচাতে না চায়, তাহলে আমি ডেগু তোর জন্য কী করব? যে অন্ধকারে তোর জন্ম হলো সেই অন্ধকারেই তোর মৃত্যু হোক। আমার জীবনেই আমি কী পেয়েছি? এই পৃথিবীর মানুষ আমাকে কোনো দিন শান্তি দিতে পারেনি। অযাচিত মানুষের ঠাঁই এই পৃথিবীতে নেই, এমন অশান্তির জীবনের চেয়ে মৃত্যুই অনেক ভালো। তুই এখানেই থাক।
উত্তরের বাতাস বেগবান হয়, শোঁ শোঁ করে এক ঝটকা হিমছুরি মজ্জায় ঢুকিয়ে আবার শান্ত হয়। বুকে একটু উম নেওয়ার আকাক্সক্ষায় সে বাম হাতটা বুকের ওপর বিছিয়ে দিল আড়াআড়ি করে। অন্য হাতে বাতিটি। কিছুদূর অগ্রসর হলে শিশুটি আবার শব্দ করল, ক্যাঁ? এই শব্দ শুনে ডেগুর গলা ভারি হয়ে ওঠে। সে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘কিরে তুই এমুন করতাছোস ক্যারে? আমি তোরে কই লইয়্যা যাইবাম? তোরে আমি কেমনে পালুম, ক দেহি?’ ডেগুর চোখ দুটি নেভা আগুনে জ্বলে ওঠে। সে পেছন ফিরে তাকায়। শিশুটি আবার শব্দ করে, ক্যাঁ।
ডেগু চাপা স্বরে বলল, তারপরে কী হলো? তারপর আর কী? আমার জীবন শুরু হলো এই স্টেশনেই। খড়ের ছাওয়া একটি চায়ের স্টলের সামনে পড়ে থাকতাম। লোকেরা একটা-আধটা বিস্কুট দিলে সেটি দিয়েই দিন পার। টিউবওয়েলের পানি তো ছিলই। একদিন এক হাটের দিন চায়ের স্টলের মালিক একটা কেরোসিনের খালি টিন দিয়ে বলল, যা ঢোল মাইর‌্যা আয় ডেগু, মিশ্রিপুর খাঁ বাড়ির পুকুরে মঙ্গলবারে ভাড়ায় বড়শি বাওয়া অইব। আমি সারা বিকেল বাজারে ঢোল পিটালাম। এরপর থেকে প্রতি বাজারেই আমি ঢোল পেটাই, মানুষের নানা খবর দিই হাটের মানুষের কাছে। আর এই জন্য পেতাম আট আনা করে। আমার খাওয়া চলত। রাতে স্টেশনের প্ল্যাটফরমÑআমার ঘুমের ঠিকানা। ইট-বালিশ আর ছালার চট-আমার বিছানা। মশামাছিরা আমার প্রিয়তম ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
ডেগুর চিন্তা-চেতনায় এক ভয়াল স্থবিরতা আসে। জীবনের ভেতরের সব জটিল গ্রন্থিগুলো আস্তে আস্তে খুলতে খুলতে চোখের সামনে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতাশার বলয়টি ধীরে ধীরে অবারিত হতে থাকে। পেছনের জীবন নিয়ে কখনই সে ভাবেনি, আজকে কেন তবে এমনভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অতীতকে খুঁজে বের করতে হচ্ছে। কী প্রয়োজন? কেনই বা এতো ভাবনা? সে যখন আবার নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় তখনই নবজাতকটি আবার বলে, ক্যাঁ।
ডেগু আবার ফিরে দাঁড়ায়। তার মনে হয়, তার ভেতর থেকেই সেই মানুষটি আবার বের হয়ে প্রশ্ন করছে, তারপর কী? ডেগুও অতীতের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে বলল, তারপর কী? তারপর একদিন স্টেশন মাস্টার আমাকে বলল, তার বাসার পায়খানা পরিষ্কার করতে। এই কাজ করতে প্রথমে রাজি হইনি। শুনেই ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করতে লাগল। তখন আমাকে টাকার লোভ দেখাল, পায়খানা পরিষ্কার না করলে স্টেশনে থাকতে দেবে নাÑএ রকম কত কথা। জীবনে বেঁচে থাকাই প্রথম কথা, কী কাজ করলাম সেটা বড় কথা নয়। আমি রাজি হলাম। আজব পায়খানা। সাহেবরা বাসায় বসে মল ত্যাগ করে আর সে মল নিচে একটা মাটির খাদায় জমা হয়। সেই খাদা বালতি দিয়ে পরিষ্কার করতে হলো-তাই করলাম। এই বাজারের মেথরটা মরার পরেই আমার এই কাজ করতে হয়েছিল। এভাবে একদিন-দুইদিন করে আমার অভ্যাস হয়ে গেল। শুরু হলো মেথরের জীবন। আমার কিছু রোজগারের একটা বিহিত হলো। কিছুদিন চলল এভাবেই।
ডেগু স্টেশনের দিকে আরও একটু এগিয়ে যায়। আর তখনই সেই শিশুটি আবার ক্যাঁ করে ওঠে।
ডেগু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এখানে মেথরের কাজ করি মাত্র দুটি বাসায়। এ দিয়ে আমার খাওয়া চলে না। মাসে দুইবার দুই দিন কাজ। পেট চলে? বল দেখি? আমি তখন কাজের সন্ধানে পাটের গুদামে কুলির কাজ নিই। আমি ছোট মানুষ। বয়স বারো তেরো হবে। মাথায় বোঝা নিতে পারি না। দেখিস না আমার ঘাড়টা কেমন বাঁকা। তাই আমি বোঝা নিতাম ঘাড়ে। অন্য কুলিরা দুই মণ বোঝা নিত। আমার তো সেই শক্তি নেই, এত বড় বোঝা নিতে পারি না। কষ্টে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে যেত। একদিন কয়ালে আমাকে লাথি মেরে বলল, ফোজা লিতে ফার না মাগার কুলিগিরি করতা আইছ। বেজন্মা বলে গালি দিল। লাথি খেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লাম। তারপর একসময় দুই মণ পাটের গাঁটই নিতে হতো আমাকে। আমার মনে হতো আমার জিহ্বা বের হয়ে যাচ্ছে, জান বের হচ্ছে। তবুও আমাকে এই কাজ করতে হতো। একদিন আমারও অভ্যাস হয়ে গেল। আমার বোঝা আমি আরও বাড়িয়ে দিলাম। আড়াই মণ। আড়াই মণ বোঝা টানে ঘোড়ায়। তাই মানুষেরা আমার নাম দিল ‘ঘোড়া ডেগু’। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা আমাকে বোঝা নেওয়ার জন্য নিয়ে যেত তখন। বিশেষ করে বিয়েবাড়িতে বড় বোঝা হলে আমাকে নিয়ে যেত। এভাবে চলতে লাগল জীবন কোনো সময় গুদামের কুলি, কোনো সময় মেথর, কোনো সময় ঝাড়–দার, কোনো সময় বাজারের ইজারা তোলা, কোনো সময় ঢোল পিটানো… কত কাজ! মনে হয় এই রায়ত আমারই। কাজের কোনো শেষ নেই। সবাই আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। খাওয়ায়। কিন্তু টাকা দেয় না। আমিও টাকা নিই না। খাওয়া হলেই চলে। আমি টাকা নিয়ে কী করব বল দেখি? টাকার লোভ হলো বড়লোকের। আমার তো টাকার লোভ নাই। আমার খাওয়া আর কাপড় হলেই চলে।
এখানে আমি রেলের কাজ করি কীভাবে? এইহানে মাস্টার সাবের সঙ্গে ভাব হলো, আরও লোকজনের সঙ্গে ভাব হলো, কেউ আমারে নিয়ে মজা করে, কেউ তামাশা করে, কেউ কাজ করায় … এই তো। স্টেশনে থাকতে থাকতে এই-সেই কাজ করি। সাহেবরা ঘুমায়, আমি তাদের কাজ করে দিই যেগুলো আমি পারি। থাক, এই সব শুনে তোর কী হবে? তুই শিশু মানুষ। যেখান থেকে এলি সেখানেই চলে যা। গরিব মানুষের জন্য এই পৃথিবী কোনো উপযুক্ত স্থান নয়। দেখ আমিও তো হতে পারতাম কোনো উর্বরা জমির কৃষক, ফলাতে পারতাম শাওনে-আগুনে সোনালি ধান। কিংবা হতে পারতাম কোনো গঞ্জের বেপারি। দেশবিদেশে ব্যবসা করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন করে গড়ে তুলতে পারতাম একটি সংসার কিন্তু আমি কিছুই পারিনি। আমি কি হতে পারতাম না কোনো আমলা কিংবা কোনো রাজনীতিক। আমি কি পারতাম না কোনো মেরুন রঙের গাড়ির মালিক হতে। পারিনি কিছুই হতে। আমার না আছে কোনো পরিচয়, না আছে জাত কিংবা ধর্ম-বর্ণ। আমি পূজা-অর্চনা করতে পারি না, প্রার্থনা করতে পারি না, পারি না নামাজ-রোজা করতে। আমার সৃষ্টিকর্তা কী ভগবান, না আল্লাহ না ঈশ্বর আমি কিছুই জানি না। আমি কাকে প্রার্থনা করব? আমার না আছে ইহকাল, না আছে পরকাল। তাদের যৌনসুখ সঞ্জাত আমার জন্মের জন্য আমার অপরাধ কী? অপরাধ তো হওয়ার কথা সেই জরাযুর যেখানে আমার জন্ম হয়েছিল? দোষ তো হওয়ার কথা সেই শুক্রাণু ধারণ ও বিতরণকারীর। বল, তুই-ই বল, আমি মিথ্যে বলেছি কিনা? আমি কি কখনো জন্মের আগে জানতাম আমি ডেগু হয়ে এই স্টেশনে পড়ে থাকব? আমার জন্মদাতা-দাত্রীকে আমি চিনি না। যে জন্মের পর ঝড়ে উপড়ানো বৃক্ষের মতো আকস্মিক বেঁচে থাকে তার জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব বড় দুর্বিষহ। এমন নি-উর্বরা পৃথিবীতে তোরও বেঁচে থেকে লাভ নেই। আমি তোকে বাঁচাতে চাই না। যে অন্ধকার গর্ভে তোর জন্ম ভোরের আলোর মুখ দেখার আগেই সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায়। বিলীন হয়ে যা পৃথিবীর মাটির সঙ্গে।
একসময় এক প্রকার মাদকতা ভর করে ডেগুর শরীরে। শরীর টেনে তুলতে পারছে না ডেগু। তার পা যেন মিশে গেছে রেলের পাতের মতো মাটিতে।
ডেগু আবার হাঁটতে শুরু করে। হিম বাতাসে শরীর যেন বরফে পরিণত হয়েছে। একটু এগিয়ে আসতেই শিশুটি আবার শব্দ করে, ক্যাঁ। এই সময় এক অলৌকিক ও বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের দুর্বোধ্য আলেখ্য পাঠ করে কিছুক্ষণ আগে ক্ষান্ত হলেও আবার তার মধ্যে অযাচিত তাড়নার সৃষ্টি হয়। সে পেছনে ফিরে গেল শিশুটির কাছে, শিশুটির মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। চারদিকের স্তব্ধতা ভেদ করে ওর কান্না দূরে কোথাও প্রতিধ্বনিত হয়নি। নিশ্চলা পৃথিবীর আর কোনো মানুষ ওর কান্না শুনতে পায়নি। হয়তো ধানক্ষেতে অপেক্ষারত শিয়ালটি শুনতে পেয়েছে। এই সময় শিয়ালের ডাকও শুনতে পায় সে। চোখ মুছে ভালো করে দেখল শিশুটিকে। ফুটফুটে সুন্দর। ক্ষোভ ও যন্ত্রণার এক মিশ্র ভাষায় বলল ডেগু, তরে আমি কই লইয়্যা যাই? আমার তো কেউ নাই রে? তুই-ই ক দেহি? আমার তো কেউ নাই? আমার কোনো ঘর নাই, বাড়ি নাই, চুলা নাই, কুলা নাই, পুলা নাই, তরে কই লইয়া যাই? এই মুহূর্তে পাশের ধানক্ষেতের কাছাকাছি কোথাও থেকে একটা শিয়াল আবার ডেকে ওঠে। মনে হলো শিয়ালটি খুব কাছাকাছি কোথাও ওঁৎ পেতে আছে। ডেগুর মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিশুটিকে এখানে ফেলে গেলে শিয়ালের পেটে যাবে। ছিঁড়েবিড়ে খাবলে খাবলে খাবে এই অবোধ ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুটিকে। ওর মনে শুরু হয় অভূতপূর্ব অস্থির আলোড়ন একে এভাবে ফেলে যাব কেন? না, শিশুটিকে বাঁচাতে হবে, এক হৃদয়বান ও আত্মবিশ্বাসী মানুষে পরিণত হয় শিশুটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। বাতিটি দূরে রেখে শিশুটিকে টেনে বুকের ওপর নেওয়ার সময় অনুভব করে কোথাও যেন কী একটা লতিয়ে থাকা জিনিস বাধা দিচ্ছে। হাত দিয়ে অনুমান করল নাভির নিচে লতানো নাড়িটি কাটা হয়নি। কেই বা কাটবে? নাড়িটা নেড়ে-চেড়ে দেখল ডেগু। কীভাবে কাটা যায়? এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। না, কাটার কোনো উপায় নেই। তারপর নাড়িটি রেলের পাতে রেখে পাথর দিয়ে আঘাত করে কেটে নেয়। গায়ের ছেঁড়া কম্বলটি দিয়ে প্যাঁচিয়ে শিশুটিকে জড়িয়ে নিল একখ- মাংসপি-ের মতো এবং বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সে দৌড়াতে শুরু করে স্টেশনের পুব পাশে এক কুঁড়েঘরের দিকে। মাঝে মাঝে পাথরের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে মনে হচ্ছে তার পায়ের ফাটা দিয়ে রক্ত ঝরছে। তবুও তার গতি থামেনি। এক মুহূর্ত বিলম্ব হলে হয়তো শিশুটি মারা যাবে এমন চৈতন্যে মগ্ন হয়ে সে দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে।
প্ল্যাটফরমের পুব পাশেই একটা কুঁড়েঘরে থাকে এক ভিখারিনী সাদাবুড়ি। বুড়ির চুল ও চোখের ভ্রু পর্যন্ত সাদা বলে মানুষে সাদাবুড়ি ডাকে। ডেগু বুড়ির ঘরে গিয়ে হামলে পড়ে ডাকে, ‘ও নানি। ওডো। দেহো। দেহো। দেহো কারে আনছি।’
বুড়ি ঘুম জড়ানো চোখে বলল, কেলা?
আমি ডেগু। ওডো। তাড়াতাড়ি ওডো।
কারে লইয়্যা আইছোস?
আগে উইট্যা দেহো। তাড়াতাড়ি ওডো।
এই শীতের রাইতে কের লাইগ্যা রান্দা করছোস? কী অইছে ক।
আরে ওডো না আগে।
বুড়ি ঘুমলাগা চোখ নিয়ে উঠে বসে বাতি জ্বালায়। ঝাঁপ খুলে দিলে ডেগু ভেতরে ঢুকে বলল, এই আবুডারে ফাইছি। নেও একটু দুধ খাওয়াও। আবুডারে বাছাও।
আবু ফাইছোস? কার আবু? কই ফাইছোস?
আরে ফ্যাছাল রাইক্যা আগে দুধ খাওয়াও। একটা গরম কাপড় দেও। না অইলে মইর‌্যা যাইব। ফরে ফ্যাচাল ফাইরো। মাইয়্যা মানুষ আছেই ফ্যাছালের লাইগ্যা। ডেগুর কথায় ধমকের কিংবা অনুশাসনের সুর, দৃঢ়তা, সংশয়হীনতা ফুটে ওঠে যা আগে কখনই দেখা যায় নি।
বুড়ি বিস্ময়াহত হয়ে চেয়ে থাকে ডেগুর দিকে। ভাবে, ডেগু কী বলছে এসব? বুড়ি হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে যতটুকু সম্ভব ততটুকু কাঁথা দিয়ে তাকে জড়িয়ে বুকের উম ছড়িয়ে দেয় নবজাতকের বুকে। বুড়ি বলল, ‘আবুডা তো খুব সুন্দর! তরে বাপ ডাকব নে রে ডেগু।’ বুড়ির নীরদ মাড়িতে পিছলে পড়ে দুষ্ট হাসি।
বুড়ির কথা শুনে ডেগুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে হতবিহ্বল হয়ে বলল, ‘আমারে বাপ ডাকবো?’
বুড়ি বলল, ‘হ। তরে বাপ ডাকবো।’
ডেগু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মুহূর্তের মধ্যে। তার সারা মুখে লেপ্টে থাকা অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে ঈদের চাঁদের মতো একফালি আনন্দের চাঁদ ফুটে ওঠে, মনে হলো চাঁদখসা জোছনায় উদ্ভাসিত হলো দুচোখে। সে আবার বলল, ‘তাড়াতাড়ি দুধ খাওয়াও নানি। না অইলে মইর‌্যা যাইব।’ এই শিশুর প্রতি দরদ উথলে উঠতে দেখে বুড়ির মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়ে। কুঁড়েঘরের অন্ধকার ওদের হাসিতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল যখন ঠিক তখনই বুড়ির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে কোথা থেকে দুধ খাওয়াবে? কী করে বাঁচাবে এই নবজাতককে? হতাশারা সুরে সাদাবুড়ি বলল, ‘আমি দুধ কই ফাইয়াম রে ডেগু?’
ক্যান্? তোমার বুনি দেও।
ডেগুও তো অবোধ, ওর কথা শুনে বুড়ির হাসি পায়। কুঁচকানো ঠোঁটে হেসে হেসে বলল, এই গোলাম, হুননা বুনিত দুধ আছেনি? তর তো আক্কল-বাক্কল কিছুই নাই দেখতাছি। যা দুধের বেবুস্থা কর।
বুড়ির কথায় ডেগু আশাহত হয়, বিদীর্ণ হয় বুক। চিন্তাক্লিষ্ট ডেগু কী বলবে বুঝতে পারে না। এ বিষয়ে ওর জ্ঞান থাকার কথা নয়। সে তো কোনো নারীর সংস্পর্শে আসেনি কোনো দিন। এক কুলির প্ররোচনায় একদিন কিশোরগঞ্জ বত্রিশের প্রামাণিকের দীঘিরপাড়ের পতিতালয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডেগু কুৎসিত ও নোংরা বলে কোনো পতিতা তাকে ঘরে তোলেনি। সেই বয়সে শরীর মাঝে মাঝে উছলে উঠত। এখন আর তেমন কিছু সে বোঝে না। ঝিমিয়ে পড়েছে জীবনের স্নায়ু, গ্রন্থি কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়েছে গোনাল্ড গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হরমোন। এসব ভেবে কী হবে? জীবনের তীব্র বাসনা হলো প্রজনন এবং বংশ বিস্তার কিন্তু ডেগুর সে বাসনা লুপ্ত হয়েছে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার জাতাকলের চাপে। জীবনবঞ্চিত কিছুটা দুর্ভাবনায় পতিত হলেও সে ভাবনা থেকে সহসাই নিজেকে মুক্ত করে। কারণ শিশুর দুধের চিন্তায় মাথার স্নায়ু যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে কী করবে? হঠাৎ মনে হলো স্টেশনের দক্ষিণ পাশের চায়ের স্টলের কথা। ক্ষণকাল বিলম্ব না করেই সে জ্ঞানহারার মতো দৌড়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশে আবছা গোচরের মধ্যে আসা চায়ের স্টলের দিকে এগিয়ে যায়। মাথায় অন্য কোনো চিন্তা নেই, কেবলই এক ফোঁটা দুধ। এই স্টলে তেমন মালামাল না থাকায় শক্ত করে ঝাঁপ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করে না স্টলের মালিক। চারদিক স্তব্ধতার অবাধ সুযোগে আকাশ আরও থমথমে হয়ে ওঠেছে। কুয়াশার দানা আর অন্ধকারের পুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ডেগু ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে গুহানিবির স্টলের ভেতরে।
ঝাঁপ খোলার শব্দ পেয়েই স্টলের মালিক জেগে ওঠে। ডেগুকে ধরে শক্ত করে। চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করল স্টলের মালিক। তার ডাকে কেউ এল না, মালিক নিজেই দড়ি দিয়ে ডেগুকে শক্ত করে বাঁধল। চোরের বিচার হবে সকালে।
সকালে যখন রোদ ওঠে তখন দেখা যায় ডেগুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে স্টলের সামনে। ট্রেনের যাত্রীরা দুই-একজন আসতে শুরু করেছে। চোর দেখলেই মানুষের মারতে ইচ্ছে করে। পথচারী কিংবা স্টেশনের যাত্রীদের মধ্যে দুই-একজন এসে ডেগুকে কয়েকটা লাথি মারল এলোপাতাড়িভাবে। একজনের লাথিতে ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হলো। কিন্তু ডেগু নির্বিকার। সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে রইল কাদার মূর্তির মতো।
স্টেশনমাস্টার এবং আশপাশের অনেক লোক এসে জড়ো হলো কিছুক্ষণ পরে। এমন অভাবনীয় কাজ ডেগু করতে পারে তা কেউ বিশ্বাস না করলেও হাতেনাতে যেহেতু ধরা পড়েছে সেহেতু বিশ্বাস না করে উপায় নেই। সে নিশ্চয়ই চোর। এমন ধারণার শেকড় তাদের বিশ্বাসের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইত্যবসরে চোর বলে কিছু কিছু অত্যুৎসাহী লোক তাকে আরও কয়েকটা লাথি মারে। স্টেশনমাস্টরসহ অন্যরা বাকহীন। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে শুরু করেছে। নান্নু মিস্ত্রির ছেলে একটা লাথি দিয়ে বলল, ‘এরে হাতে মারলে শরীর নাপাক অইয়্যা যাইব। সারা শইলে গুমুতে ভরা।’ লাথি খেয়েও ডেগু কিছু বলল না। একসময় গণপিটুনির হাতে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় স্টেশনমাস্টার বললেন, ‘আর কেউ মারবেন না। আগে ওর বিচার হবে তারপর।’
কিছুক্ষণ পর বাজারের আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এলেন ডেগুর বিচার করার জন্য। কেউ কেউ বললেন, ‘ডেগু তো চুরি করতে পারে না। সে তো খুব সৎ। তার সামনে টাকা ফেলে পরীক্ষা করা হয়েছে অনেকবার কিন্তু সে কোনো দিন চুরি করে নাই।’ চালের এক মহাজন বলল, ‘আরে ভাই রাখেন। এগুলো ভিজে বেড়াল। অভাবে স্বভাব নষ্ট। ছোট লোকদের কোনোভাবেই বিশ্বাস নেই।’
তারা জেরা শুরু করে। ডেগুকে অনেক কথাই জিগ্যেস করা হয় কিন্তু ডেগু কোনো কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তার এই চুপ থাকাতে সবার মনের সন্দেহ দানা বাঁধে। সে হয়তো প্রকৃতপক্ষেই চোর। না-হয় কথা বলে না কেন? এরপর আরেকবার তাকে ধোলাই দেওয়া হয়। কয়েকজন এমন কি সে যাদের সঙ্গে চলাফেরা করত তারাও তাকে মারল। ডেগু তবুও নিরুত্তর, পাথরের মতো শব্দহীন। শুধু তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, এর বেশি কিছু নয়।
আরও কিছুক্ষণ পর ডেগু ফিরছে না এমন একটা বিষয় এবং আশপাশে সর্বত্র প্রচার হলো ডেগু চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে, এই কথা শুনে বুড়ি শিশুটিকে কোলে নিয়ে বিচার মজলিসের সামনে এসে দাঁড়ায়। রক্তাক্ত অবস্থায় ডেগুকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে সাদাবুড়ির চোখ থেকে দরদরিয়ে পানি পড়ে। চোখ মুখে বুড়ি বলল, ‘সাবেরা ও চুরি করত আইছিন ঠিহই। এই আবুডারে (কোলে রাখা শিশুটিকে দেখায়) একটু দুধ খাওয়ানোর লাইগ্যা ইস্টলে হাঞ্জাইছিন। ট্যাহা ফয়সার লাইগ্যা না। এ্যারে ক্ষেমা দেন। ডেগুরে মাফ দেন।’ কথাটি শেষ করে বুড়ি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
স্টেশনমাস্টার সাদাবুড়ির নিকট থেকে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তিনি ডেগুর কাছে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এই কথাটা ?

‘এই কথাটা আগে কইতে ফারিস নাই, বেয়াকুফ?’ এই শীতে এমনিতে ওর শরীর ফেটে আছে। তার ওপর অনেকের চড় থাপ্পড় লাথিতে শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরছে। মাস্টার সাহেবের বুকের ভেতরটা এক প্রকার দরদি কান্নায় ভরে যায়। কষ্টে বুকের ভেতরটা হু হু করতে থাকে। তিনি আবার বললেন, ‘ডেগুর বান্ধন ছাড়ো মিয়ারা। এই মুহূর্তেই ছাড়ো।’
কেউ লজ্জিত হয়ে, কেউ দুঃখিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে এবং মুহূর্তেই জায়গাটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। সবাই চলে গেলেও ডেগু বসে ছিল নির্বাক নিথর হয়ে দীর্ঘক্ষণ। হতবাক সাদাবুড়ি যখন বলল, ‘আবুডারে দেখবি না? আয়।’ কান্নাজড়িত গলায় সাদাবুড়ি বলল, ‘তরে বাপ ডাকবো, আয় আমার লগে।’ সাদাবুড়ির দু’চোখ আঁচলে ঢাকা। তখন ডেগু মাথা তুলে দাঁড়ায়, আস্তে আস্তে সে বুড়ির সঙ্গে ঘরে গিয়ে শিশুটির মুখের ওপর ঝুঁকে হাউমাউ করে কাঁদে কিছুক্ষণ।
কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। অতঃপর কান্না ও আবেগ থিতিয়ে এলে বুড়ি বলল, ‘আবুডারে একটা নাম দে রে ডেগু।’
ডেগু বলল, ‘আমার মাথায় তো কুলায় না গো নানি। তুমি একটা নাম দেও।’ এই বলেই ফোকলা দাঁতে হাসে ডেগু।
বুড়ি বলল, ‘তোর পোলা তুই-ই নাম দে। বড় অইয়্যা তরে বাপ ডাকবো দেহিস।’ বুড়ি হাসল।
ডেগু বিক্ষিপ্ত চিন্তায় এলোমেলো হয়ে যায়। কপাল থেকে ঘাম বের হয়। কী নাম দেওয়া যায়? এমন চিন্তার জটিলতায় সে কোনো দিন আটকায়নি। সে অস্ফুটভাবে বলল, ‘এমুন বিপদে আর ফরি নাই গো নানি। নাম দেওয়া কডিন কাম।’ আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করে ডেগু বলল, ‘আচ্ছা নানি ঠান্ডু রাখলে কেমুন অয়? ঠান্ডার মধ্যি যহন ফাইলাম।’
বুড়ি বলল, ‘ভালাই অয়। সোন্দর নাম অইছে।’
ডেগুর মুখে হাসি ছলকে উঠল। এক মোহাবিষ্ট স্বপ্নের ছায়ায় ওর মুখ ঢেকে যায় মুহূর্তের মধ্যে। এই স্বপ্নের উজ্জ্বলতা ঘরটিকে ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত করে তুলল। বুকভরা সুখ আর আনন্দের তরঙ্গ যেন কোনো দূর সাগরের গভীর গর্জনের সঙ্গে মিশে টগবগ করতে থাকে। সারা দিন ওর পেটে অন্নজল পড়েনি, তবুও ক্ষুধার যন্ত্রণা নেই, ক্ষুধার হিংস্রতা নেই। ওর হাসিতে স্বর্গীয় দ্যুতি, এই দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে, সারা আঙিনায়।
ঠান্ডু কাঁথার উম পেয়ে ঘুমে বিভোর। চোখ খোলার কোনো কারণই নেই। ঠান্ডুর ঘুমন্ত চোখের দিকে ডেগু চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। মনে মনে ভাবল যদি একবার ঠান্ডু হাসত। তাও কি হয়? একদিনের শিশু কি হাসে? আকণ্ঠ সুখে ডুবে থাকা ডেগু একসময় সন্ধ্যার প্রাক্কালে কুঁড়েঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়, দূর দিগন্তে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে আকাশের গভীর নীলে ডুব দিয়ে যেন বিলের পানিতে পানকৌড়ির মতো হারিয়ে যায়। এই সময় চায়ের স্টলের মালিকের ছেলে নীলাভ একটি গ্লাসভর্তি দুধ নিয়ে ডেগুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাজান তোমার ছেরারে দুধ দিছে।’
সকালের কষ্টের দাগ কিছুটা থাকলেও এই এক গ্লাস দুধ নয় যেন স্বর্গের দুষ্প্রাপ্য অমৃত তাও ডেগুর ছেলের জন্য… ভাবতে ভাবতে সে ভুলে যায় শরীরের সকল যন্ত্রণা। গ্লাসটি হাতে নেয় পরম দরদে। বুড়িকে ডেকে বলল, ‘নানি, আবুর দুধ, নেও।’ সুখ-আহ্লাদে আটখানা ডেগু আর কিছুই বলতে পারে নি। শুধু ওর চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে এল।
স্টলের মালিকের ছেলেটি চলে যাওয়ার সময় বলল, ‘বাজান কইছে তোমার ছেরারে ছয় মাস দুধ দিবো। তোমারে চিন্তা করতে না করছে।’
ছেলেটির কথা শুনে ডেগুর বুক আনন্দে ভরে যায়। ওর চোখে পানি এসে যায়। সে স্টলের মালিকের ছেলের দিকে বেভোলা তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। মনে মনে স্টলের মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
প্রতিদিনই ডেগুর বুকে স্বপ্নের বীজ বুনে বুড়ি। ‘তোরে বাপ ডাকবো, দেহিস।’ বুড়ির কথা শুনে ডেগু হাসে। শিশুটির জন্য ডেগু বাড়তি পরিশ্রম করে। এভাবে কেটে যায় দুই-তিন মাস। ডেগু দুপুরে ঠান্ডুকে দেখতে আসে মাঝে মাঝে। ঠান্ডু একটু একটু হাসতে পারে। যখন ঠান্ডু হাসে তখন সাদাবুড়িকে ডেগু ডেকে দেখায়, ‘ও নানি, দেহো ঠান্ডু আসতাছে (হাসতাছে)। আরে নানি আইয়ো।’ সাদাবুড়ি তখন ঠান্ডুর পাশে এসে বসে। ডেগুর হাসি দেখে সাদাবুড়িও হাসতে হাসতে বলে, ‘কী সোন্দর আসে (হাসে)। খুব আক্কল অইব দেহিস।’ বুড়ির কথায় ডেগুর বুকের ভেতর সুখ-আনন্দ ফেনিয়ে ওঠে।
ঠান্ডুর যাতে কষ্ট না হয় তাই ডেগু বুড়িকেও একদিন বলল, ‘নানি তুমি আর ছইলে বাইর অইবা না। আমি তোমার খাওনের ব্যবস্থা করবাম। তুমি বাইরে গেলে ঠান্ডু কানব।’
বুড়ি হেসে বলল, ‘আচ্ছা, যাইতাম না। তুইন আমার খাওনের বেবুস্থা করিস।’
নিঃসঙ্গ সাদাবুড়ি, নিঃসঙ্গ ডেগু ওরা ঠান্ডুর সেতুবন্ধনে এক হয়। এখন ডেগু বুড়ির চুলোর রান্নাই খায়। বুড়িকে বাজার করে দেয়। বাড়তি পরিশ্রম করে। ভৈরব থেকে গৌরীপুর অহেতুক ট্রেনে ঘুরে বেড়ায় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই ঠান্ডুকে দেখতে আসে। বুকের ওপর নিয়ে খেলে। ডেগুর বুকের ওপর খেলতে খেলতে যখন ঠান্ডু খিলখিল করে হেসে ওঠে তখন মনে হয় পৃথিবীর তাবৎ সুখের নাচনে এই কুঁড়েঘরটি শূন্যে ভাসতে থাকে।
ডেগু রাতে স্টেশনের প্ল্যাটফরমে ঘুমায়। ঠান্ডু ওর বুকের মাটিতে বুনে দিয়েছে সবুজ ধানের চারা, সেই ধানের চারা বাতাসে দোল খায়। একদিন চারাগাছগুলো সোনালি ধানে ছেয়ে যাবে, এমন স্বপ্নে আচ্ছন্ন থাকে ডেগু। প্ল্যাটফরমে শুয়ে শুয়ে আপন মনে গান গায় অনাবিল আনন্দে। মাস্টার সাব মাঝে মাঝে ডাক দিলে সে হাসতে হাসতে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এত দিনের ভারক্লিষ্ট ও গম্ভীর চেহারায় ভাটা পড়ে সুখ আর হাসির জোয়ার উঠেছে ডেগুর চোখে-মুখে।

আরেক শীতের রাত। এক বছর পর ঠান্ডু একটু একটু কথা বলতে পারে এবং একটু একটু হাঁটতে পারে। একদিন অনেকটা বেলা হয়ে গেল, ডেগুর ঘুম ভাঙে না। স্টেশনের অন্য এক কুলি ডেগুকে ডাকল, এই ডেউগ্যা, ওঠ। দখ্যা কত্ত বেইল অইছে।
ডেগু ঘুম থেকে ওঠে না। এই ঘুম থেকে কেউ জাগে না। ডেগুও জাগল না। স্টেশন মাস্টারসহ অনেকেই এসে দেখল ডেগুর মুখে মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে।

ডেগু কোনো দিন ‘বাপ’ ডাক শুনতে পারেনি।

বুড়ি যখন ভিক্ষা করতে বের হয় তখন ঠান্ডু মাঝে মাঝে বুড়ির হাত ধরে স্টেশনে আসে। রেলগাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর চোখে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দে সে খিলখিল করে হেসে ওঠে। কিংবা কোনো দিন ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শুনে বুড়ির কুঁড়েঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসে। যাত্রীদের দিকে যখন চেয়ে থাকে নিষ্পলক তখন মনে হয় বিস্ময়ের ঘোর লাগে অবুঝ মনে। সে কী ভাবে সে-ই জানে। ট্রেন চলে যায় প্রশন্তির ধূলিবায়ুধোঁয়ার তরঙ্গ রেখে, কোলাহল ছিনিয়ে নিয়ে দিয়ে যায় অসাড় নীরবতা। তখন ঠান্ডু দূরের নীলিমার দিকে চেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। স্টেশনের চারপাশের শব্দ, ধূলি, পাথর, ইস্পাত এসব এবং এসব প্রতিঅণু-অনুবল তার মজ্জায় অনুপ্রবেশ করে যার মধ্য দিয়েই আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে ঠান্ডু। একদিন বুড়িও মারা যাবে। উন্মুক্ত হবে তার চারপাশ, দিগন্ত থেকে দিগন্তে, ভৈরব থেকে গৌরীপুর সেদিন হয়তো ঠান্ডু দখল করবে ডেগুর রেখে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটুকু। অচলায়াতন এই পৃথিবীতে ঠান্ডু এর চেয়ে আর কি-ই-বা বেশি পেতে পারে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *