ছোটগল্প ।। গল্পটা ঘৃণার কিংবা ভালোবাসার ।। অনামিকা ভট্টাচার্য ।।
লাল রঙের একতলা বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ। কল্যাণপুরের এদিকটায় এলে অন্যরকম একটা প্রশান্তি পাওয়া যায়। ব্যস্ত নগরী থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় কেমন একটা গ্রামীণ গ্রামীণ ভাব আছে চারপাশে। সবুজের সাথে ওর বন্ধু নাহিদও আছে। দুই বন্ধু মিলে ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়েছে। ঠিক ঘুরাও বলা চলে না। ছুটির দিনে ঘুরা বলতে তো নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় যাওয়া বুঝায়। বলা যায় উদ্দেশ্যহীনভাবে এলোমেলো পথ চলা।
সবুজ মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করে! এই ভর দুপুরে কেউ এভাবে পথে পথে ঘুরে! নাহিদকে ওর মেস থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। নাহিদের আসার ইচ্ছে ছিল না খুব একটা। কিন্তু সবুজ যখন বললো কিছুক্ষণ ঘুরার পর চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ট্রিট দেবে তখন আর লোভ সামলাতে পারলো না। অগত্যা আসতেই হলো।
- কি-রে, এই বিল্ডিং এর সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চরণ কি আর চলছে না? আগেই বলেছিলাম একটা রিকশা ডেকে নেই। আমার কথা তো শুনলি না। আরে বস, সবাই হিমু হতে পারে না।
- তুই কোনও গন্ধ পাচ্ছিস না?
- কিসের গন্ধ?
- কেউ শুটকি ভর্তা বানিয়েছে। এই ঘ্রাণ উপেক্ষা করা অসম্ভব! চল, এই বাসায় ঢুকি।
- কি বলছিস? চেনা নেই, জানা নেই কারো বাসায় হুট করে ঢুকে যাবি। গিয়ে কি করবি?
- বলবো আমাকে এক প্লেট ভাত দিন। শুধু শুটকি ভর্তা হলেই হবে। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আমি এক ক্লান্ত পথিক। আপনার শুটকি ভর্তার এই ঘ্রাণ আমার ক্ষুধার সৃষ্টি করেছে। এখন আমাকে না খাওয়ালে আপনাদের পেট ব্যথা করবে।
বলেই গেটে হাত রাখলো সবুজ। নাহিদ বললো, আর ইয্যু সিরিয়াস? - ইয়েস। অবভিয়াসলি! আই অ্যাম নট জোকিং।
নাহিদের হা করা মুখের সামনে জবাব দিলো সবুজ। গেটে ঢুকতে ঢুকতে সবুজ বললও, তুই মুখ বন্ধ কর। মুখে মাছি ঢুকে গেলে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবি কিভাবে? তুই নিশ্চিন্ত থাক। তোকে রেস্টুরেন্টেই লাঞ্চ করাবো।
কলিংবেলে চেপে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ।
একটু পর দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রমহিলা। পরনে বেগুনী রঙের সুতির শাড়ী। শাড়ীতে হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রান্নাঘর থেকে এসে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজা খোলার কারণে মহিলার শাড়ির আঁচলে তেল-মসলার দাগ লেগে আছে। বয়স সাতাশ/আটাশ হলেও সংসার জীবনের ক্লান্তিকর ছাপ পড়েছে চেহারায়। দেখে মনে হচ্ছে বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। সবুজ যতোটা অবাক হয়েছে, তার থেকেও বেশি অবাক হয়েছেন বোধহয় মহিলা নিজে! তাই উনার মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হচ্ছে না।
সবুজ নিজে থেকেই বললও, আমরা এসেছি পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে। কিছু ইনফরমেশন দিতে হবে। ভেতরে আসবো?
- হ্যাঁ,আসুন।
সোফায় বসতে বসতে পকেট থেকে প্যাড আর কলম বের করলো সবুজ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললও, আপনার নাম, পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা, বয়স্ক ও শিশুদের তালিকা করতে চাই।
সব তথ্য ঠিকঠাক ভাবেই দিল নাবিলা। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে নাবিলার সংসার। ওর স্বামী ফারহান বিজনেসের কাজে বাইরে আছে। তাই দেখা হলো না। কাজ শেষে বের হয়ে যাবার সময় নাবিলা বললো, আপনারা একটু বসুন। আমি আসছি।
নাহিদ ফিসফিস করে বললও, এই গরমে চা-টা খেতে ইচ্ছে করছে না। তবে তুই কিন্তু দারুণ বুদ্ধির খেল দেখালি। হাহাহা……পরিসংখ্যান ব্যুরো।
একটু পর নাবিলা ফিরে এলো। দুই প্লেট ধোঁয়া উঠা গরম ভাত। একপাশে শুটকি ভর্তা। দুই বাটি ডাল। একটা প্লেটে দুই পিস রুই মাছ ভাজি। মাছ ভাজির সাথে পেঁয়াজ বেরেস্তা আর দুইটা শুকনো মরিচ ভাজা। কাঁচের গ্লাসে করে দুই গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেওয়া হয়েছে। হাত ধোঁয়ার জন্য একটা ছোট জগে করে পানি আর একটা গামলাও নিয়ে এসেছে নাবিলা। - এই ভর দুপুরবেলা না খেয়ে যাবেন না।
মুখের উপর হালকা হাসি ভাসিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাহিদ প্রশ্ন করলো, আপনি কি ভর দুপুরবেলা বাসায় আসা যে কোন আগন্তুককেই খাইয়ে দেন?
আমতা আমতা করে নাবিলা বললও, আসলে আপনাদের দেখে অনেক টায়ার্ড লাগছিলো।
সবুজ অবশ্য কোনও কথা না বলেই গোগ্রাসে গিলছে। সবুজ ছোটবেলা থেকেই ভোজন রসিক ছিল। শুটকি ভর্তা, চালতার আচার, ইলিশ মাছ ভাজি, কষা মাংস সবটার গন্ধই ওর নাকে পৌঁছে যেত।
নাবিলা মাঝে মাঝে বলতো, তোমার নাকটাকে বাঁধিয়ে রাখা দরকার সবুজ ভাই। সবসময় শুধু এর ওর বাসায় খাবারের গন্ধ খোঁজে বেড়ায়!
আবার নাবিলা নিজেই কদবেলের আচার কিংবা খেজুর গুড়ের পায়েস অথবা কাঁচা আমের ভর্তা টিফিন বক্সে করে এনে সবুজকে দিত। সেই সময়ে নাবিলা দুই বেণী বেঁধে স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে যেত। তারপর কলেজ। আর সবুজ ভাই সাইকেলে করে প্রায়ই ওর পিছু নিত। একই গ্রামের বাসিন্দা ছিল দু’জনেই। শৈশব, কৈশোর সবই একসাথে কেটেছে। বয়সের ব্যবধান চার/পাঁচ বছর হবে।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর সবুজ বিদেশে পাড়ি জমায়।
যাবার আগে গ্রামের বুড়ো বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলেছিলও, কয়েক বছর পর এসেই বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবো। তোর হাতের মজার মজার খাবার খাওয়ার পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করবো। মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। মনে রাখিস, অন্য কোথাও বিয়ে আটকানোর এটাই একমাত্র হাতিয়ার। সেই কথার শক্তি এত বেশি ছিল যে নাবিলা দিন-রাত এক করে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে যায়।সবার অমতে নাবিলার আব্বু ঠিকই মেয়েকে দূর শহরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। তারপর একদিন খবর পাওয়া গেল কোনও এক বড়লোকের ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে নাবিলা। রাজধানী শহরে বড় হওয়া সেই ছেলেটি নাকি রাজনীতির সাথেও জড়িত। একুশ বছর বয়সী মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। কারই বা কি করার আছে! শুধু একজন পিতার স্বপ্নের মৃত্যু হলো। সবুজ বিদেশে বসে সেই খবর শুনে বুঝে গিয়েছিল মেয়ে মাত্রই লোভী। তারপর থেকে নাবিলার সরল মুখখানি যতবার মনে পড়েছে, ততবারই ঘৃণায় মন ঘুরিয়ে নিয়েছে সে। আজ এত বছর পর আবার ঐমুখটাকে দেখতে পাবে, তাও এমন কাকতালীয় ভাবে সেটা ভাবতেই পারেনি সবুজ। খাওয়া শেষে বেসিনে মুখ ধুয়ে আসার সময় মুখোমুখি হলও নাবিলার।
- ধন্যবাদ খাওয়ানোর জন্য। শুধু একটা কথা মনে রাখা উচিত। কারও মনে কষ্ট দিয়ে কেউ কোনোদিনও সুখী হতে পারেনি। চাচা অনেক বিশ্বাস করে তোকে এই শহরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। আর তুই? ছিঃ! টাকা তো আমিও কামাই করেছি বিদেশে গিয়ে। কয়টা বছর লেগেছে মাত্র। এইটুকু সময়ও অপেক্ষা করতে পারলি না? এত লোভ! সময় তো পালিয়ে যাচ্ছিলো না রে। তবু বড়লোকের ছেলে দেখে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে হলও তোকে ? এইটুকুন লোভ সামলাতে পারলি না! এট লিস্ট পড়াশুনাটা তো কমপ্লিট করতে পারতি।
- একটা কথা কাউকে কোনোদিনও বলিনি সবুজ ভাই।আজ তোমাকে বলতে খুব ইচ্ছে করছে।
মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে এই খবরটা শুনে বাবা আমাকে ঘৃণা করলেও বেঁচে তো আছেন। কিন্তু সত্যি কথাটা শুনলে আমার বাবা সাথে সাথে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতেন। ছোটবেলা থেকে বাবা আমাকে মা বলে ডাকতেন। মা হয়ে কি করে ছেলের মৃত্যু চাইতাম বলও?
মেয়ে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছে এটা বাবা মানতে পারলেও, কেউ উনার আদরের মেয়েকে বিয়ের আগেই ধর্ষণ করেছে, মেয়ের এত বড় অসম্মান বাবা কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। - মানে? কি বলছিস তুই! তুই ওকে বিয়ে করলি কেন?
- আত্মহত্যা করার সাহস পাইনি বলে। ওরা যেমন বড়লোক, তেমনি ক্ষমতাধর। আর কোনও কথা না সবুজ ভাই। তোমার উদ্দেশ্য ছিল খাওয়া। খেয়েছও, এখন বিদায় হও। পরিসংখ্যান অফিসের আইডি কার্ড দেখতে চাইলে কিন্তু তোমার বন্ধুসহ তুমি বিপদে পড়ে যাবে।
- এখনও আমাকে এতটা বুঝতে পারিস?
- বুঝ হবার পর থেকেই তো তোমাকে বুঝতে শিখেছি।আমি তোমার মতো নাকি? যে খুব সহজে ভুল বুঝবো?
- তুই সুখী তো নাবিলা?
- একজন রেপিস্ট এর বউ যতটা সুখে থাকে ঠিক ততোটাই সুখে আছি। গুলশানের কিংবা বারিধারার ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে খুব বেশীদিন জায়গা হয়নি আমার।এজন্য এখানে এই নিরিবিলি জায়গায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আমার বড়লোক শ্বশুরমশাই। উনার অনেক দয়া কিনা! তাই ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়নি আমার। তবে সন্তান স্নেহ অবশ্য আমার সন্তানদের পিতার মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণেই আছে।
- আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবো নাবিলা।
- আমার ছেলে-মেয়েকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। আমি নিজে যেটা কর্মদোষে হারিয়েছি।
রাস্তায় বের হয়ে কত কথা বলছিলো নাহিদ। সবুজের মনে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেয়েদেরকে ভালবাসতে যতোটা সময় লাগে,ওদেরকে ঘৃণা করতে বোধহয় এর সিকিভাগ সময়টাও লাগে না। কত সহজে এই সমাজ মেয়েদের ভুল বুঝে, লোভী ভাবতে পারে।অথচ আসল সত্যটা অনেক ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে থাকে।