ছোটগল্প।।যে নেই জীবনে।।দিলতাজ রহমান
দীলতাজ রহমান
মা মারা যাবার আগে দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগেছিলেন। মা যখন বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু প্রায় আসন্ন, তখনও মার পিতা-মাতা জীবিত থাকলেও মা তার একমাত্র বোনটির কাছে ফিক্সড ডিপোজিট করা মোটা অংকের টাকা এবং নিজের সমস্ত গহনাসহ এই আমাকে সমর্পণ করে গিয়েছিলেন। আজীবন আমাকে খালা নিজের সন্তানের মতো দেখবেন এই আশায়।
সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে জেনে-শুনেই খালার দু’টো মেয়ের সঙ্গে আমিও তাকে মা ডাকি। অনেকে যেমন জানে আমি খালার মৃত বোনের সন্তান। তারও চেয়ে বেশি মানুষ জানে আমি তার দ্বিতীয় সন্তান। আগ বাড়িয়ে কারো এটুকু ভুল অবশ্য এ বাড়ির কেউই ভেঙে দিতে যায়নি ঢেকে রাখা ছাড়া। খালার ছোট মেয়ে মৌলি আমার দু’বছরের ছোট। ডলি তিন বছরের বড়। এ বাড়িতে আসার পর, দিনে দিনে বাবার চেয়ে খালুকেই আমার বেশি আপন মনে হয়েছিলো। ক্রমে বাবা হয়ে উঠেছিলেন আমার দূরের মানুষ। বাবা অনেকগুলো বছর পর্যন্ত বছরে দু’বার দু’টো ঈদ উপলক্ষে দু’সেট পোশাক এবং জন্মদিনে ঝলমলে একটি জামাসহ ইয়া বড় একটি কেক এনে তার কর্তব্য কর্মটুকু সেরে যেতেন। বাবার ইচ্ছেয় নয়, বরং খালা-খালুর পীড়াপীড়িতে বাবার হাত ধরে কয়েকবার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছি। সেখানে আমার মায়ের অনুপস্থিতি আমার বুকে ঝড় তুলতো। অথচ সে তাণ্ডব কাউকে বোঝানোর ভাষা আমার জানা ছিলো না। বাবার পাশে গুটিসুটি হয়ে থাকা তার কিশোরী বধূটিকে দেখেও বিব্রত হতাম। তাকে মা ডাকা দূরের কথা, আজো পারতপক্ষে তার কাছে ঘেঁষি না। এতে অবশ্য আমি ছাড়া কারো কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
ডলি আপা, আমি আর মৌলি একই সঙ্গে ঘুমতাম, খেলতাম, খেতাম। নিজেকে কখনো ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ মনে হয়নি আমার। শুধু নানা-নানু আর মামারা মাঝে মধ্যে এসে আমার মায়ের অকালমৃত্যুর জন্য তাদের যে মর্মবেদনা জাহির করে যেতেন, তাতেই আমার মনে হতো সত্যি এই পৃথিবীতে আমি একা। কেউ নেই আমার। আমার বিষণ্ণ দৃষ্টির ব্যাখ্যা খালু কিছুটা বুঝতে পারতেন হয়তো। তিনিই প্রতিবাদ করতেন ওদের কান্নাকাটিতে।
অনিন্দ্য সুন্দরী ডলি আপাকে আর ঘরে রাখা সম্ভব ছিলো না। একের পর এক আসা বিয়ের প্রস্তাব থেকে যাছাই বাছাই করে অবশেষে এ বাড়ির জামাই হওয়ার সৌভাগ্য যে অর্জন করলো, সে বড়লোকের একমাত্র সন্তান। তার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সর্বোচ্চ। তবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি যেমন নেই, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটু-আধটু নেশা করা ছাড়া তেমনই বখে যাওয়ার মতো বড় কোনো দোষও চরিত্রে নেই। এমন নিরেট সুন্দরী মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেলে ঐ তরলের নেশাটা ফিকে হতে বাধ্য। ঠিক এমনই আশায় ডলি আপার বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়েছিলো হাসান ভাইয়ের সঙ্গে।
ডলি আপা সহজ-সরল মানুষ। পৃথিবীতে নিজের মতো করে তার কোনো চাওয়া নেই। সবার পছন্দই তার পছন্দ। সবার খুশিই তার খুশি। এমতাবস্থায় এটাই হয়েছে এই পরিবারে জন্য শাপে বর। হাসান ভাইয়ের স্বভাব থেকে বয়সের বালখিল্যতা কমে তো নাই, বরং স্ত্রীপক্ষের সব উঠতি বয়সী সরল প্রাণেরাও তার সঙ্গে যোগ হয়ে গেছে নির্দোষ আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতে। টাকার জন্য কেউ নতুন আসা সিনেমাটি দেখতে পারছে না, এ কথা শুনতে পেলে সেই ভুক্তভোগীর চেয়ে হাসান ভাইয়ের দুঃখই বেশি হয়ে যায়। নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তবেই এর সুরাহা করে। এসব ব্যাপারে ডলি আপার নিঃস্পৃহ ভাবটি আমি আর মৌলিও কাজে লাগিয়েছি বহুবার। আমার চেয়ে মৌলি বরং কয়েক ধাপ এগিয়ে। কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার কেমন, দু’জনের কেউ একবার বয়ান করতেই হাসান ভাইয়ের ইশারায় আমাদের সাজগোজ শুরু হয়ে যেত। ফেরার সময়ে শ্বশুর-শাশুড়ির কথাও সে ভোলে না। তাদের জন্য আসে এক প্যাকেটে দু’জনার খাবার। এমনতর মহৎ অনেক দোষের মধ্যে হাসান ভাইয়েরে বড় যে গুণটি, তা হলো ডলি আপাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। স্ত্রীকে রেখে শ্যালিকা দু’টিকে নিয়ে খাওয়াবে অথবা বেড়াতে নিয়ে যাবে, তা সে কখনোই করতো না। এ বিষয়টি লক্ষ করেই খালা-খালুর কোনো আপত্তি ছিলো না হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের দু’বোনের কোথাও যেতে।
এমনি করে যখন আমরা ক’জন কোথাও যেতাম, তখন হাসান ভাই আরো একজন যাকে হায়ার করে আনতো, সে হাসান ভাইয়ের মামাতো ভাই। নাম এমরান। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কটি যেন হরিহর। বয়সে কিছুটা মাত্র ছোট এই ভাইটি তার সঙ্গে না থাকলে তার কোনো আনন্দই যেন সম্পন্ন হয় না। দু’জনের একত্রে ঘটানো শত ঘটনা-দুর্ঘটনা বলে বলে আমাদের চমকিত করে রাখতো তারা। আর এটুকুর জন্যেই ক’দিন পরপরই অনিবার্য হয়ে গিয়েছিলো আমাদের ক’জনার একত্র হওয়া।
হাসান ভাইয়ের বাবার তরফ থেকে যে দায়িত্বগুলো হাসান ভাইয়ের কাঁধে এসে চাপে, সে তা নির্দ্বিধায় এমরানকে দিয়ে সারিয়ে বাবার কাছে সফল-ত্বরিতকর্মা প্রমাণিত হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে হাসান ভাই তার সঙ্গে আরও একধাপ ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে চেয়েছিলো। প্রথম দিকে যখন হাসান ভাই তাকে ‘ভায়রা’ বলে ডাকত, আমি আর মৌলি তখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতাম। অচিরেই হাসান ভাই এর একটা মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। ডলি আপাকে সাক্ষী রেখে, আমার চোখের মণিতে নজর বিদ্ধ করে এমরানের সামনেই সে বলেছিলো ‘শ্যালিকা এত কিছু বোঝো আর এটা কেন বোঝো না, আমি আমার ভাইটির জন্যে কোন শ্যালিকাটিকে মনোনীত করেছি।’ হাসান ভাইয়ের কথা বলার ধরন দেখে আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। এমরানের মুখেও কাচুমাচু ভাব ফুটে ওঠে। মৌলি হাততালি দিয়ে বিষয়টিকে আন্তরিক সমর্থন জানালো। ডলি আপা তার সহজ-সরল ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, ‘যাক তোমার ভাইয়ের জন্য আমাকে কষ্ট করে পাত্রী খুঁজতে হবে না।’ হাসান ভাইকে কথায় কেউ ঠেকাতে পারবে না। একধাপ উপরে তাকে থাকতেই হবে। তাই সে বললো, ‘তোমার শ্যামলা বোনটির জন্য আমার এমন টকটকে ভাইটিকে মুঠোয় এনে দিলাম এটা বুঝি কিছু না।’
আমার জন্য আসা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে খালু যে ক’বারই আলাপ করতে গেছেন, হতাশ হয়ে ফিরেছেন। বাবা তাকে সাফ সাফ বলে দিয়েছেন সম্বন্ধটি আপনাদের কছে ভালো মনে হলেও, আমি চাই আমার মেয়েটির আরো ভালো বিয়ে হোক। পাত্রটিকে অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত হতে হবে। এ বংশের অন্য জামাইগুলোকে দেখেন। তাছাড়া মেয়েটিও এমএ পাস করুক! এত তাড়াহুড়ো কীসের?
আসল সত্যটি খালু চেপে যান। আমাকে রেখে মৌলিকে বিয়ে দিতে বিবেকে বাঁধে হয়তো। যা হোক, সত্য সময় হলে আবরণ খসে তা এমনিতেই উন্মোচিত হয়ে যায়। আমি জানি সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা আমার বাবা কিছুতেই এমরানকে তার জামাতা হিসেবে মেনে নিবেন না। যদিও এমরানদের বাড়ি, গাড়ি, অর্থবিত্তের অভাব নেই। কিন্তু আমার বাবার কাছে যোগ্যতার মাপ কাঠি হচ্ছে শিক্ষা, রুচি, আভিজাত্যবাধের সমন্বয়ে যে স্ট্যাটাস। মেয়েকে তিনি হয়তো স্নেহে কাছে টানেননি, তাই বলে তাকে অপাত্রে দান করে দেবেন না, সে মর্যাদাবোধে তিনি যথেষ্ট টনটনে।
আর আমার ভয় পাওয়ার মাত্র ওইটুকু ছিলো কারণ। তবু আমরা কজন একত্রে কোথাও গেলে এমরানের পাশের চেয়ারটি আমার জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকত। একপর্যায়ে এসে ওরকম না হলে আমারও ভালো লাগতো না। সবার ভেতর থেকে এমরান আমার হাত ধরে তুলে নিয়ে অন্য কোথাও নির্জন হতে চাইতো। ওরা তিনজনও ব্যাপারটিতে একসময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। চোখে সয়ে যায় ধারে-কাছের সবারও। মৌলি মাঝে মাঝে বলতো, ‘যা, যা আমাদের মধ্যে তোদের ফুসুর-ফাসুর করতে অসুবিধা হচ্ছে।’
বাবা যা-ই বলুক এমরানকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। দিনে দিনে ও কখন আমার জন্য এতটা অপরিহার্য হয়ে গেছে, কদিন আগেও তা এভাবে টের পাইনি। হাসান ভাই অবশ্য আগে থেকে তাগাদা দিচ্ছে, গার্জিয়ান পর্যায়ে বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করতে। তার সিদ্ধান্তটি স্থির থাকবে জেনেও। এমএ পরীক্ষার দোহাই দিয়ে এতদিন আমিই ঠেকিয়ে রেখেছিলাম বাবার মনকষ্টের একটি ভার অন্তত লাঘব হবে ভেবে। আর এমরান তো হাসান ভাইয়ের সঙ্গে জোড়া বেঁধেই চলা মানুষ। এমরান তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতে গিয়ে বিএ পরীক্ষাও দেয়নি। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে থেকে থেকে তার স্বভাবের ধাঁচটিও ওইরকম হয়ে গেছে। তবে অর্থবিত্তে আগ্রহ হাসান ভাইয়ের থেকে এমরানের বেশি। খালা-খালুকে হাসান ভাই দিন-তারিখ জানিয়ে গিয়েছিলো। তার মামা-মামী অর্থাৎ এমরানের বাবা-মা শিগগিরই পাত্রী দেখতে আসছেন। যথাসময়ে পাত্রপক্ষ বড়িতে ঢুকে তাদের নজর আটকে গেলো মৌলির প্রতি। আর আমি হয়ে পড়লাম একেবারে মনোযোগহীন। তার প্রথমত কারণ আমার গায়ের রং শ্যামলা। দ্বিতীয়ত আমি ও বাড়ির মেয়ে নই এবং ঘরের সৎ মা। তৃতীয়ত আমার শিক্ষগত যোগ্যতা এমরানের চেয়ে বেশি। সেটাকেও আমার একটা মাইনাস পয়েন্ট হিসাবে ধরে নেয়া হলো। অথচ ওইটুকুর জোরেই বাবার অমত হবে জেনেও আমি এমরানের দিকে এগিয়েছিলাম। খালা-খালু স্পষ্ট করেই জানতেন আমার সঙ্গে এমরানে সম্পর্কটি কি। তারপরও তারা মৌলিকে এমরানের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। মা নেই। বাবাও তেমন করে আমার খোঁজ নেন না। তবু কখনো পৃথিবীটা আমার কাছে অসুন্দর মনে হয়নি। নিষ্ঠুর মনে হয়নি। কখনো মনে হয়নি মা বেঁচে থাকলে খালার চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসতেন। খালুকেও আমি আমার বাবার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। নির্ভর করেছিলাম।
মৌলির বিয়েতে বাড়ির সবার উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনের ভেতরে প্রচণ্ড প্রত্যাশাটি ক্ষীণ হতে হতে একসময় মিলিয়ে গেলো। ভেবে পাচ্ছিলাম না, এমরান কি করে এটা মেনে নিচ্ছে? একবার আলাদা করে একটু যোগাযোগ পর্যন্ত করলো না। তার মত না থাকলে এগুলো ঘটছেই-বা কি করে! ডলি আমার বড় বোন। মৌলিকে ছেড়ে কোথাও আমার একমুহূর্ত ভালো লাগে না। আমি এখন কোথায় যাবো? একনাগাড়ে ঘরে বন্দি হয়ে থেকে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীটা থেমে গেছে। মনে হচ্ছিলো অনেকদিন রোদ ওঠে না। বৃষ্টির তোড়ে সব ভেসে যাচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত ঘরের দরজা-জানালা বোধহয় আমারই ঘরের দরজা-জানালার মতো বন্ধ। স্যাঁতসেঁতে। ঘর এলোমেলো।
সানাই বাজা করুণ বিষাদঘন কোনো এক মুহূর্তে খালা এসে বিছানা থেকে আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তারপর বললেন, ‘ওরা মৌলিকে পছন্দ করেছে। আমরা রাজি না হলে ফিরে যেত। আর তোর বাবাও তোর জন্য এমরানকে পছন্দ করতেন না। তার টাকাপয়সা যা আছে, তার চেয়ে বেশি তার নামের জোর। পদমর্যাদা। তোর বিয়ের জন্য তাকে বেগ পেতে হবে না। অথচ তোর খালু ছাপোষা মানুষ…।’
খালার কথাগুলো বজ্রপাতের মতো চৌচির করে দিলো আমার এতদিনের বিশ্বাসের ভিত্তি। জীবনবিনাশী সে বজ্রালোয় এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম, আমি এদের কেউ নই। মা মারা যাবার আগে যে মোটা অঙ্কের টাকা এবং গহনাসহ আমাকে এখানে রেখে গেছেন, বাবা কোনোদিন সেগুলোর খোঁজ নিলেন না। বরং মা এ কাজটি করে যাওয়ায় তিনি মহাঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আজ আমার জন্য তার যে ভাবনা তা শুধু বংশের ধারাটি বজায় রাখতে। কারো কাছে যেন তার শির অবনত হতে না পারে। না হলে কেন তার প্রতি আমাকে অনুরাগী করার চেষ্টা করেননি। স্নেহে, সাহচর্যে কেন তার অন্য সন্তানের মতো আমার জীবনটাও নিজে ভরিয়ে তোলেননি। কেন ফেলে রেখেছিলেন পরের কাছে?
দু’হাতে মেহেদি মেখে, হলুদ শাড়ি আর গাঁদা ফুলের মালা পরে আল্পনা আঁকা নতুন শীতল পাটির ওপর নত মুখে বসে আছে মৌলি। তাকে ঘিরে আছে বরের বাড়ির মেয়েরা। পাড়া-পড়শি মেয়েরাও। আত্মীয়-পরিজনে গিজগিজ করছে বাড়িটি। হেমন্তের রোদের সোনালি আভা এসে উপচে পড়ছে প্রশস্ত আঙ্গিনায়। ডলি আপাকে আজ খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে। ছোট বোনের বিয়ে। বড় বোন হিসেবে তার ভাগে পড়েছে অনেকখানি দায়িত্ব। খালুর মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ আজ তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় তিনি এখন ভীষণ ব্যস্ত।
এতবড় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে এ বাড়িতে। অথচ যার উজ্জ্বল উপস্থিতি এ সময় অত্যন্ত জরুরি সেই একমাত্র বড় জামাই আবুল হাসানকে ক’দিন যাবত কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু কিছু কিছু যাত্রা আছে যা ঠেকানো যায় না। ফেরানো যায় না। এক্ষেত্রে তা-ই হলো। আড়াই দিনের নাইওর শেষে এমরান-মৌলি তাদের গৃহে ফিরে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে মধ্যাকাশের সূর্যের মতো হাসান ভাই উদয় হলো আমাদের অন্দরে। তাকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো। ‘তোমাদের সব আয়োজন তো সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখানে আর প্রয়োজন না হলে এবার বাড়ি চলো। আর আপত্তি থাকলে থাকো, আমি চলে যাই।’ ডলি আপাকে লক্ষ করে এ কথাটি বলতেই তার হাঁফ ধরে গেছে।
হাসান ভাইয়ের এহেন আচরণে ডলি আপা থতমত খেলেও খালা তাকে আক্রমণাত্মক কথা শোনাতে ছাড়লেন না। কৈফিয়তও তলব করে বললেন, কেন তাদের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে একমাত্র জামাই হয়েও সে উপস্থিত থাকলো না। কার জন্য তার এত দরদ? ডলি আপাকে উদ্দেশ করে খালা এও বললেন, ‘এবার তোর কপাল না পোড়ে!’ টের পেলাম খালু খুব ধীর-স্থিরভাবে খালাকে ডেকে যা বলছেন তার সার কথা এই – ‘মেয়েটিকে এবার ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও। মেয়েদের মন এমনিতেই ছোট। তার উপর আবার হাসানের প্রশ্রয়…। ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব বেঁধে যাবে।’
এমরানকে নিয়ে দু’দিন যাবত একনাগাড়ে বন্ধ করে রাখা দরজাটি খুলে ছুটে এসে মৌলিও আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে যা বলে গেলো তা আর কেউই শুনতে পেলো না বটে, শুধু কথার দু’ধার ছুরিতে আরো ফালাফালা করে গেলো আমার ক্ষতবিক্ষত হৃৎপিণ্ডটি। যার চোখে মুখের স্নিগ্ধতা আমাকে বিভোর করে রাখতো, তার দৃষ্টিতে এত বিষ ঢাকা ছিলো? আমার চোখের ওপর দৃষ্টি মেলে দু’বার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করা মৌলি কেমন করে বলতে পারলো, ‘রিনি আপা তোর চেয়ে বেশি যোগ্যতা থাকাটা কি আমার দোষের?’
জীবনের এতটাদিন এখানে কেটে গেলো। কোনোদিন আমি এদের অবাধ্য হইনি। এদের দুটি সন্তানের সঙ্গে একাকার হয়ে থেকেও আমি এদের সন্তান হতে পারলাম না! অথচ দুটো বিয়ের সম্পূর্ণ খরচই গেছে আমার টাকা থেকে। যদিও তা ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে নেয়া। মায়ের গহনারও কতটা গেছে আর কতটা আছে, তাও আমার অজানা।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। পড়ে থেকে লাভ কী? কে দেখতে আসছে ভেতরের ভাঙচুর? অনেকদিন পর বাইরে বেরোনোর প্রস্তুতি নিলাম। সেজে-গুজে আয়নায় নিজেকে পরখ না করেই খালুর মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তাকে বললাম, বাবা তোমরা শুধু মেয়েদের মনের সংকীর্ণতাই দেখেছো, তাদের কোনো মহত্ত¡ই কি দেখোনি? খালি মাঠে গোল দেয়ার মতো সব ভূমিকাই তো তোমরা পালন করো। মেয়েরা তোমাদের দোষগুলো ঢেকে রাখে বলে, চেপে যায় বলে সমাজের চোখে তোমাদের রূপটি স্বাভাবিক থাকে। পিতা হয়ে তুমি কি করে পারলে জেনেশুনে মেরুদÐহীন একটা পুরুষের হাতের তালুতে নিজের মেয়েটিকে পুতুল করে দিতে? তবে আমাকে এভাবে রক্ষা করার জন্য তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’
খালু মুখ খোলার আগে বেরিয়ে এলাম বড় রাস্তায়। কিন্তু কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? হাসান ভাই ছাড়া আর কারো মুখ আমার মনে পড়ছে না। রামাপুরায় তার বাবার সাজিয়ে দেয়া অফিস কক্ষটিতে তাকে পাবো কিনা, না ভেবেই একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ালাম। দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দেখলাম, এলোমেলোভাবে ফাইলপত্র পড়ে থাকা টেবিলটির ওপর পা দুটো তুলে চেয়ার হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। বসার জন্য চেয়ারটি টান দিতেই যে শব্দ হলো তাতেই ঘোর ভেঙে গেল হাসান ভাইয়ের। আমাকে এভাবে একা দেখে শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে তোর?’ বললাম ‘বড় সুখে যে তরলটি তুমি গলাধঃকরণ করো, আজ আমার দুর্দিনে তার একটু ধার দেবে? কথা দিচ্ছি সুদে আসলে শোধ করে দেবো। বিশ্বাস করো। শুধু এরই আশায় আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি হাসান ভাই।’
আমার কথা শুনে বিলাপ করে কেঁদে উঠলো হাসান ভাই। তার অস্পষ্ট, ভাঙা ভাঙা শব্দগুলো জোড়া দিলে এই হয়, আমি তোমার সব সুখ নষ্ট করে দিলাম। এমনটি হবে আমি কি জানতাম!’ হসান ভাইয়ের বিলাপ শুনে বললাম, তোমার কোনো দোষ নেই হাসান ভাই! বরং প্রমাণ হয়ে গেলো, তুমি ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসনি। কেউ আমার কথা ভাবেনি।
– তুই এখন কোথায় থাকবি ঠিক করেছিস?
– কোথায় থাকবো সেটা বড় কথা নয়।
দু’টি আশ্রয়স্থলই এখন আমার কাছে সমান। তুমি বরং আমাকে একটি চাকরি খুঁজে দাও। অথবা আমার মায়ের রেখে যাওয়া টাকা এবং গহনা তোমাদের দুটি বিয়ের খরচ বাদে এখনো যা আছে নেহায়েত কম হবে না। যদি ওগুলো তোমাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করো, সে উপলক্ষেও আমি তোমাদের অফিসে কিছু করতে পারবো। আমি এখন সব বলয় ভেঙে একা থাকতে চাই। নিজের মত করে বাঁচতে চাই। চেষ্টা করে বেঁচে থাকা যাকে বলে।
হাসান ভাই তখনই কিছু বলতে পারছিলো না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে পড়লাম। জীবনে এই প্রথম টের পেলাম, আসন্ন সন্ধ্যাকে কেন্দ্র করে মানুষের ব্যস্ততা অন্যরকম হয়ে যায়। ধাবমান স্রোতের মতো প্রবল বেগে মানুষ সমস্ত বিচ্ছিন্নতাকে ঠেলে ছোটে। কিন্তু আমি কোনো পিছুটান অনুভব করছি না। কোনো ঘর, কোনো মুখ আমাকে আর আকর্ষণ করছে না। আমার স্নায়ুতে কোনো একটি ডাকেরও প্রতিধ্বনি টের পাচ্ছি না। এতদিনের সব স্মৃতি ঘনিয়ে আসা আঁধারে কত সহজে তলিয়ে যাচ্ছে। কোনো শাসনের কোনো ভয়ই আর আমার মনে উদ্রেক হচ্ছে না। আমি হাঁটছি অনভ্যস্ত পায়ে, অনভ্যস্ত পথে। ফ্ল্যাটবাড়ির জানালা গলিয়ে উপচে পড়ছে যে আলোর ঢল, আমি তাতে দেখতে পাচ্ছি শুধু দ্ব›দ্ব, অবিশ্বাস, গোঁজামিলে জীবনযাপনের অসহ্য গ্লানিময় ক্লেদ। স্নেহের মুখোশে ঢাকা কঠিন নির্মমতার আভাসও ফুটে উঠেছে তাতে।
কলিংবেল-এ চাপ দেওয়ার আগেই দরজা খুলে গেলো। দেখলাম বাড়ির সবাই একসঙ্গে বের হচ্ছে মৌলি-এমরান আর তাদের সঙ্গে আসা অতিথিদের বিদায় জানাতে। আমার দিকে চোখ পড়তেই সবাই যেন একই সঙ্গে চমকে উঠলো। এমরান দু’পা পিছিয়ে আমাকে ঘরে ঢোকার পথ করে দিলেও, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ডলি আপাকে লক্ষ করে বললাম, আমার বাবা গাড়িতে অপেক্ষা করছেন। আমি আর ঘরে ঢুকবো না। আমার পড়ার টেবিলের ওপর থেকে আমার মায়ের ছবিখানা শুধু এনে দাও।