ছোটগল্প।।স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন।। ইলিয়াস ফারুকী
অস্বচ্ছ একটা আকাশ হঠাৎ সামনে চলে আসে। সেই আকাশে নিজেকে ভাসতে দেখে অনিরুদ্ধ। তুলার মতো সাদা স্বচ্ছ মেঘ তাকে যেন কোলে নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার আনন্দে ছেদ পড়ে। হঠাৎ যেন মেঘ ফুঁড়ে তেড়ে আসে দূরন্ত অগ্নি গোলক। একটার পর একটা গোলক ধাওয়া করে অনিরুদ্ধকে তখনি অনিরুদ্ধের ঘুম ভেঙ্গেঁ যায়। নিশ্চিন্ত ঘুম ছেড়ে উঠে বসে অনিরুদ্ধ, কেমন যেন আচ্ছন্ন ভাব তাকে জড়িয়ে থাকে। পা দুটো বুদ্ধ দেবের মত ভাঁজ করে মনসঃযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু অস্থিরতা তাকে বসে থাকতে দেয়না। আবারো শুয়ে পড়ে। সে ইদানিং প্রায়ই এই স্বপ্নটা দেখছে। মুরব্বিদের নিকট জেনেছিল খারাপ স্বপ্ন দেখলে আস্তগফার পড়তে হয়ে। কিন্তু স্বপ্নটাকে খারাপ না ভালো কোন খাতে ফেলবে তাই ঠিক করতে পারেনা সে। স্বপ্নটাকে নিরপেক্ষ রেখে মাথার ডান পাশে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে শুয়ে থেকেই মুখটা খুলে খানিকটা পানি গলায় ঢালে। বাম পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখে নেয়। স্মার্টফোন আসার পর থেকে রিষ্টওয়াচ ব্যবহার ছেড়েই দিয়েছে। একটা সময় ছিলো যখন তার হাত ঘড়ির প্রচুর সখ ছিল। এখনো বিভিন্ন ব্রান্ডের ঘড়ি তার সংগ্রহে রয়েছে। কিন্তু ঘড়িগুলো এখন অনেকটা অবহেলায় তার আলমারিতে স্থান নিয়েছে।
মোবাইল ঘড়িতে রাত তিনটা। শেষ পৌষের হিমেল রাত। শুয়ে থাকতেও পারল না। অজানা অস্থিরতা তাকে মেঝেতে নামতে বাধ্য করল। কী মনে করে নিজের কক্ষেই বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল অনিরুদ্ধ। হঠাৎ গান শুনার ইচ্ছে হলো। নিস্তব্ধ রাতের ধ্যানকে বিরক্ত না করতে মোবাইলের হেডফোন নিজের কানে ঠেঁসে দিলো। রবী ঠাকুরের “যতবার ভেবেছিনু আপনার ভুলিয়া। তোমারই চরনে দেবো হৃদয় খুলিয়া” গানটি তাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। সূরের মুর্ছণা এক সময় তাকে ঘুমের মুগ্ধতায় তলিয়ে দিলো।
প্রেমের ব্যাপারে অনিরুদ্ধ খুবই সাবধানী। প্রেম করার মতো উৎসাহ কিংবা সাহস কোনটাই তার নেই। কিন্তু তাই বলে মেয়েদের সান্নিধ্য ভালো লাগে না এমনটা নয়। সেই ভালো লাগা থেকে কলেজ জীবনে এলিজার প্রতি এক ধরনের ভালোবাসার পক্ষপাতিত্ব ছিল। এলাকার নেতার মেয়ে বলে নিজের ইচ্ছেকে কোন দিন প্রকাশ করতে পারে নাই। কিন্তু এলিজা ঠিকই বুঝতে পারতো। কলেজ জীবনের কথাগুলো মনে করে কেমন যেন ভাবুক হয়ে উঠে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেও আজ সে তার কল্পনাকে মুক্ত ক্যানভাসে ছেড়ে দিলো। তার কল্পনার বিচরণে তারতো কোন ক্ষতি করছে না। এবং লজ্জারও কোন ব্যাপার নেই। কারণ তার কল্পনায় বিচরণে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। সুতরাং কল্পনার লাগামটা খুলে দিয়ে যতেচ্ছা বেড়ানোর জন্য ওকে মুক্ত করে দিলো।
নারী দেখে ভালো লাগা কিন্তু নারীর কাছে যেতে ভয়, এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে এই পর্যন্ত তার জীবনের চল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ সব কিছুতে এগিয়ে ছিল, কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি কিংবা সবাইকে তার ইচ্ছেমত কান ধরে উঠ বস করানো। কিন্তু শুধুমাত্র নারী নীতির ক্ষেত্রে সে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। সুন্দরী অসুন্দরী যে কোন ধরণের নারী তার নিকট এলেই তার চিন্তা সূত্রের জালিকা ভয়ে জট পাকিয়ে ফেলে।
এতক্ষণ মুক্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকা অনিরুদ্ধের কল্পনা হঠাৎ হোঁচট খেলো। একটি সৃতীব্র অথচ সুরেলা কন্ঠের ডাক তাকে থামিয়ে দিলো। একই সাথে তার শরীরে একটা অদৃশ্য কম্পন সৃষ্টি করল। কন্ঠটা অনুসরণ করতে গিয়ে ঘুড়ে দাড়াতে চেষ্টা করল। তখনি বুঝতে পারল তার স্নায়ুতন্ত্রে সেই স্বর তীব্রভাবে আঘাত হেনে তাকে অসাড় করে দিয়েছে। মনের সমস্ত শক্তি জড় করে নিজেকে ঘুরে দাড়াতে সাহায্য করলো। সময়টা হয়ত কয়েক সেকেন্ড কিংবা তার চেয়েও কম। কিন্তু অনিরুদ্ধর মনে হলো যেন কয়েক ঘন্টার চেষ্টায় ঘুরে দাড়াচ্ছে। ঘুরে যাকে দেখল তার কাছ থেকে ডাক সে আশা করেনি। এ যে স্বয়ং পাটির স্থানীয় প্রধান এবং প্রভাবশালীর কন্যা এলিজা। যার জন্য তার ভেতরে নদীর কলকল ধ্বনি উঠেছিল বহু পূর্বেই তবু সে তাকে শাসন করে রেখেছিল।
‘কেমন আছো অনিরুদ্ধ’ তার কন্ঠে ঝংকার উঠে। কিন্তু এই ঝংকার অনিরুদ্ধের জন্য বাজখাঁই বজ্রের মতো।
অনিরুদ্ধ কোন প্রকারে বলতে পারলো ‘বলো।’
‘বাবা তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।’
কিন্তু কেন। কথাটা মনে মনে ভাবলো অনিরুদ্ধ। অনুভব করল আড়ষ্ট ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মৃদু হাসির রেখা দেখা দিয়েও মিলিয়ে গেল। এলিজার প্রতি কলেজ জীবন থেকে অনিরুদ্ধের দূর্বলতার কথা জানতেন নেতা। কলেজে তখন সে ডাকসাইটে ছাত্র নেতা। কিন্তু নেতার কথায় চলতে রাজি না তাই এলিজাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ছাত্র অবস্থায় তাকে বিয়ে দেন। কিন্তু এলিজার বিবাহিত জীবন সহজ হলো না। পর পর দুবার তার স্বামী বদল হলো। এবং দুবারই তার বিবাহ হলো তার বাবার হিসেব মতো। কিন্তু তার সংসার বাবা সূর্যের সূর্যমুখী হয়েই থাকল। তার নিজের জীবনে গন্ধরাজ ফুটলো না। অনিরুদ্ধের বুঝতে বাকী থাকলো না। নেতাই তাকে পাঠিয়েছেন। তার মনে পড়ে গেল গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের “প্রণয়ের ওপারে মরণ” গল্পের লরা ফারিনাকে। চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরো গল্পটি। আবারো অনিরুদ্ধের চোহারায় আতংক স্পষ্ট হয়ে উঠল। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস সে পেয়ে গেছে।
অন্কেক্ষণ আদি অন্ত চিন্তা করল। নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে গভীর ব্যবচ্ছেদ করতেই নিজের ভেতর এক অদ্ভূত জীবনিশক্তি ফিরে পেল। খুব সম্ভর্পনে মাথা তুললো এবং আতঙ্ক প্রবাহটি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। এরপর খুব শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো।
‘বলো এলিজা আমার সাথে তোমার কী কাজ ?’
‘বাবা তোমাকে দেখা করতে বলেছেন, সম্ভব হলে আজকেই’ বললো এলিজা। কন্ঠে কিছুটা দ্বিধা।
‘আমিতো রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি এলিজা’ ইচ্ছে করেই সে নামটার উপর জোর দিয়ে উচ্চারণ করল।
‘বাবা চাইছেন তোমার মতো প্রতিভাবান রাজনীতিতে ফিরে আসুক। তোমার সে যোগ্যতা রয়েছে। একটা ভুলের জন্য তুমি আস্তা কুড়ে চলে যেতে পারো না।’ এলিজার বলার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল সমস্ত কথাই তার বাবার মুখের।
আচমকা প্রশ্ন করে বসল অনিরুদ্ধ। ‘তো এই প্রস্তাবের জন্য তোমাকেই কেন বেছে নিলেন তোমার বাবা তারতো চেলা
চামুল্ডার অভাব নেই। তাদের থেকে একজনকে পাঠালেই পারতেন।’
‘তা বাবাই ভালো বলতে পারবেন।’
‘ঠিক আছে, আমি যাবো এবং দেখা করব তোমার বাবার সাথে। তবে তোমার বাবার কোন রাজনৈতিক ইচ্ছে পুরনের জন্য নয়। তিনি নেতা সে হিসেবে তার সম্মান আছে। তার সে সম্মানেই শুধু আমি তাঁর সাথে দেখা করব।’
‘তুমি যেটা ভালো বুঝো’ কথাটা বলেই এলিজা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অনিরুদ্ধের চোখে সরাসরি তাকালো। তার এই তাকানোটা অনিরুদ্ধকে আবারো মূর্তি বানিয়ে দিলো। অনেক দিনের বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃদয়টা যেন আবার চাঙ্গাঁ হয়ে উঠল। অথৈ সাগরে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়া জাহাজ যেন হঠাৎ সচল হয়ে উঠল। একই সাথে তার শক্ত খোলসের করটির ভেতরে নরম মগজটাও সচল হয়ে গেল। সম্ভাব্য তিনটি বিষয় তার মগজে গেঁথে গেল। নেতা কেন ডাকতে পারে। সম্ভাব্য বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলো। প্রথমটি নেতা বর্তমানে রাজনীতিতে কিছুটা কোনঠাসা অবস্থায় আছেন এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তার মত সহযোগীর প্রয়োজনে। দ্বিতীয়ত্ব তাদের পারিবারিক কিছু অব্যবহৃত জমির প্রতি তার নজর এবং সর্বশেষ তার কন্যা এলিজাকে আবারো পাত্রস্থ।
গভীর হিসাব নিাকাশে ডুব লাগালো অনিরুদ্ধ। নেতার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তার নিজের ভেতর তখন খট খটে কংকালের ঘিনঘিনে হাসি। হাসিটা যেন তাকে ব্যঙ্গঁ করছে। অনিরুদ্ধ বুঝতে পেরেছে, যে কোন ভাবেই হোক নেতা তাকে ব্যবহার করবেন। নিজে ব্যবহৃত হওয়ার পথ তাকে বন্ধ করতে হবে। নিজের ভেতরের সিদ্ধান্তটাকে চূড়ান্ত করে ফেলল সে। সে নিজেই তার সাহসের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানালো। হঠাৎ এলিজার ডাক ‘কী খবর অনি তুমি যে একবারে রুদ্ধ হয়ে আাছো। সাহস হারিয়েছো না পালাতে চাচ্ছো। তুমি না এক সময় সাহসি ছাত্র নেতা ছিলে, এই তার নমুনা’ বলেই ‘ছিঃ’ করে উল্টো হাঁটতে শুরু করল এলিজা। ‘থামো’ শব্দটা খুবই গম্ভীর ও আত্মবিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করলো অনিরুদ্ধ। এলিজার ‘ছিঃ’ তাকে আরো দৃঢ় হতে সাহায্য করেছে। সোজা এলিজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমার বাবার কছে যেতে পারি, কিন্তু এভাবে না,
তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।’
‘হ্যাঁ আমিতো তোমাকেই নিতে এসেছি।’
‘চলো তাহলে যাবো। তবে প্রথমেই তোমাকে আমার সাথে কাজি অফিসে যেতে হবে। কাজি অফিসের ঝামেলা চুকিয়েই তোমার বাবার সাথে দেখা করব।’
অনিরুদ্ধের কথাগুলো শুনে এলিজা তখন নিজের উপর থেকে ভূত তাড়াতে ব্যস্ত। তাঁর চেহারা যুগপৎ বিস্ময় ও নোনতা নান্দনিকতায় চমকে উঠছে।