ছোটগল্প

ছোটগল্প।। বরফপানি।। কানিজ পারিজাত

অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘটনাটা ঘটে গেল। সকালে যাদব স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়ার সময় বুশরা প্রস্তাবটা দেয়। নাদিয়া বুশরার এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে দারুণ উৎফুল্ল হয়েছিল। ব্যাচ থেকে ফিরে খুব দ্রুত স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয় নাদিয়া। ভেতরে এক অদ্ভুত চাপা আনন্দ। নাদিয়ারা বিভাগীয় শহরে এসেছে ছ’মাস। এর আগে একটা মফস্বলে ছিল। শহরের নামি সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে অষ্টম শ্রেণিতে। একটু লাজুক আর চুপচাপ স্বভাবের নাদিয়ার তেমন কোনো বন্ধু এখনো জোটেনি। সকালে যাদব স্যারের ব্যাচ থেকে বের হবার সময় হঠাৎ থাই কাট চুলের বুশরা নাদিয়ার কাছে এসে বলে, ‘তুমি আজ স্কুলে আসছ তো?’ নাদিয়া ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়তেই, বুশরা একটা লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে গলাটা ঈষৎ নামিয়ে একটু চাপা স্বরে বলে,
‘টিফিনের ফাঁকে একটা দারুণ মজা করব। মনে রেখো কিন্তু।’

সেই থেকে নাদিয়ার ভেতর এক চাপা আনন্দ। কেউ একজন এসেছে, তার কাছে এসেছে, তাকে বন্ধু বানাতে এসেছে। দারুণ উল্লাস আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে স্কুলের জন্য রিকশায় ওঠে নাদিয়া। রিকশার দুলুনি ছাপিয়ে তার চোখে ভাসে থাই কাটের বুশরার সিল্কি মসৃণ চুলের দুলুনি─ ‘মনে রেখো কিন্তু।’

আজ ক্লাসে ঠিকমতো মন দিতে পারছে না নাদিয়া। তিনটা পিরিওড পরে টিফিন। ইস্ কত্ত দেরি! বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে সে। বুশরা বসেছে ডানদিকের সারির সেকেন্ড বেঞ্চের কোণায়, আর নাদিয়া বাম দিকের সারির ফোর্থ বেঞ্চের মাঝামাঝি। নাদিয়ার চোখ বারবার বুশরার দিকে যাচ্ছে। বুশরা-রাইসা-সুবর্ণা, ওরা পাশাপাশি বসা, ক্লাস টিচারের চোখ এড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলছে, কী একটা বই যেন স্কুল-ব্যাগের নিচে লুকিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝেই দেখছে আর খুব চাপাভাবে হাসছে। বুশরার মতো রাইসা আর সুবর্ণাও কি নাদিয়ার বন্ধু হতে যাচ্ছে? কী মজা হবে? ওরা কী কী খেলবে? বরফপানি, রুমাল চুরি, নাকি

বউচি? নাদিয়ার অবশ্য ‘বরফপানি’ খেলতে দারুণ লাগে।

টিফিনের আগের পিরিয়ড বকুল ম্যাডামের। ইংরেজি পড়াচ্ছেন─ নাদিয়া কোনোভাবেই মন বসাতে পারছে না। কয়েকবার সে বুশরার দিকে তাকিয়েছে, বুশরা তাকে আশ্বস্ত করার হাসি উপহার দিয়েছে। টিফিনের বালতি হাতে দপ্তরি এসে ক্লাসরুমে ঢুকল। সবাই টিফিন নিতে ছুটে গেলেও নাদিয়ার আজ টিফিন নিতে একদম উৎসাহ নেই। তার সমস্ত মনোযোগ বুশরার দিকে। টিফিনে আজ দিয়েছে শিঙাড়া। নিজের জন্য এবং নাদিয়ার জন্য একটি শিঙাড়া হাতে বুশরা এসে নাদিয়ার হাত ধরে─ ‘ওদিকে চলো।’ হঠাৎ বন্ধু লাভের অপার আনন্দে নাদিয়া দারুণ আপ্লুত। সে বুশরাকে জিজ্ঞেস করে─ ‘আমরা কি কিছু খেলব?

‘বরফপানি নাকি রুমাল চুরি?’ বুশরা একটু মিষ্টি হেসে বলে─ ‘চলোই না, দেখবে’ বলে একটা নির্মাণাধীন ভবনের দিকে নাদিয়ার হাত ধরে এগিয়ে যায় বুশরা। নতুন বিল্ডিং, দোতলা─ তাদের স্কুলের মাঠের এক পাশে, পুরো কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফাঁকা বিল্ডিংয়ে অল্প কিছু মেয়ে দোতলা ও তিনতলায় ঘোরাঘুরি করছে। মাঠে না-খেলে নতুন বিল্ডিংয়ের দিকে কেন যাচ্ছে বুশরা, তা নাদিয়া বুঝতে পারছে না। তবু বুশরার বন্ধুমাখা হাতের বন্ধনে নিজের কৃতজ্ঞ হাতখানি রেখে সে এগিয়ে যায়। বুশরা নাদিয়ার থেকে একটু লম্বা ও ফর্সা, সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার থাই কাটের চুল─ সবসময় সেখান থেকে মিষ্টি ল্যাভেন্ডারের ঘ্রাণ ভেসে আসে। আর নাদিয়া ভারি মিষ্টি চেহারার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়ে। তার কোঁকড়া দীঘল চুলে মা রোজ দুটো বিনুনি করে দেয়। সারামুখে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার ভাসা ভাসা মায়াকাড়া দুটি চোখ। তারা দুজন দোতলায় উঠে এলো। এক সারি ক্লাসরুম, কয়েকটিতে কিছু মেয়ে ঘোরাঘুরি করছে। একটি ক্লাসরুম ফাঁকা দেখে বুশরা নাদিয়াকে নিয়ে ঢুকল। কয়েকটি চেয়ার ও বেঞ্চ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো─ তারই একটাতে নিজে বসে,

নাদিয়াকে তার মুখোমুখি বসতে বলে বুশরা। নাদিয়া বুঝতে পারছে না─ এখানে দুজনে কী এমন মজার খেলা খেলবে? বুশরা হঠাৎ বলে, ‘তোমার হাত দুটো দাও─  আর আমার হাত ধরো।’ নাদিয়া একটু অবাক ও অপ্রস্তুতভাবে তাই করল। বুশরা বলল, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও’─নাদিয়া তাকালো। বুশরা কেমন এক অদ্ভুত মুখে বলল─ ‘মনে করো, আমি একটা ছেলে─ আর তুমি একটা মেয়ে─ ওই যে সিনেমায় দেখো না হিন্দি সিনেমায়─ তারপর সিরিয়ালে দেখা যায়, যেন তুমি নায়িকা─ এমনভাবে তাকাও, আমি যেন নায়ক─ আমরা একে অন্যের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকব।’ নাদিয়ার কেমন একটা অস্বস্তি লাগে─ সে হাত ছাড়িয়ে নেয়─ তারপর বলে, ‘আর কোনো খেলা নেই?’ বুশরা একটু গম্ভীর হয়ে বলে,

‘এটাই তো মজার খেলা। তোমার কি ভালো লাগল না?’ নাদিয়া একটু বিব্রত মুখে বলে─

‘টিফিনের পরে বিজ্ঞান ক্লাসের পড়াটা আমাকে রিভাইজ দিতে হবে। চলো, আমরা যাই এখান থেকে।’ বুশরা কেমন হতাশ ও বিরক্তমুখে উঠে দাঁড়াল। তারা যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে, ঠিক তখনই নাদিয়া সেই অবিশ্বাস্য ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখতে পেল। স্কুলের হেড ম্যাডাম একটি লম্বা বেতের লাঠি হাতে মাঠ পেরিয়ে নতুন বিল্ডিংয়ের দিকে তেড়ে আসছেন, আর চিৎকার দিয়ে দপ্তরিকে বলছেন─ ‘সিঁড়ির সাথের কলাপসিবল গেট লাগাতে, যারা যারা নতুন বিল্ডিংয়ে উঠেছে, একটা মেয়েও যেন বের হতে না পারে। নাদিয়া একটুর জন্যে বাঁচলো─ দপ্তরি গেট বন্ধ করতে করতেই ঝড়ের গতিতে সে নিচে নেমে এলো। নিজের ক্লাসরুমের দিকে ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে সে দেখল─ বুশরাও বের হতে পেরেছে। আর যা দেখল তাতে তার মুখ পাংশুবর্ণ─ হেড ম্যাডাম গেটের ভেতরে আটকে পড়া মেয়েগুলোকে বেত দিয়ে সপাং সপাং পেটাচ্ছেন। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে, নাদিয়া কিছুই বুঝতে পারল না─ তার ঢিপ ঢিপ করা বুকের ভেতর একটা কথাই বারবার বাজতে লাগল─ নতুন বিল্ডিংয়ে ওঠা মেয়েদের হেড ম্যাডাম পেটাচ্ছেন কেন?

দুই

অদ্ভুত এক মন খারাপ নিয়ে ঘুম ভাঙে নাদিয়ার। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। একটা সাপ, খুব সম্ভবত সাপের বাচ্চা একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছে। সাপটার গায়ের রং কেমন বর্ণহীন, অনেকটা ওয়াটার কালারের মতো, আর একটা ব্যাপার হলো সাপটার গায়ে কোনো চামড়া নেই। প্রায়ই সে চামড়াহীন-বর্ণহীন সাপ নয় শুয়াপোকা স্বপ্নে দেখে। ইদানীং কেন যে সে এই বিশ্রী স্বপ্ন দেখছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। শুক্রবার, নাদিয়ার স্কুল আজ ছুটি। বাসায় শুধু বুয়া আর নাদিয়া। মা নাদিয়ার ছোটভাই মুন্নাকে নিয়ে ড্রইং ক্লাসে গিয়েছে। দুঘণ্টা পরেই ফিরবে। নাদিয়া বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসে বেডরুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাদের এই বাসাটা দোতলায়, ভাড়া নেওয়া। জানালার পাশেই একটা বেশ টলটলে পুকুর, তার ওই পাশে একটি মাঠ। মিশনারিজ এক আশ্রমের মাঠ ওটি। বেশ কিছু গাছ মাঠের চারদিকে লাগানো। জানালায় দাঁড়িয়ে পুকুর পাড়ের ওই মাঠের দিকে তাকালে নাদিয়ার মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। মফস্বলের সেই বাসাটার কথা, স্কুলের কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলে সবসময় ফার্স্ট হতো নাদিয়া। স্যার-ম্যাডামরা কত আদর করত তাকে। বিশাখা, উর্মি তার বন্ধু ছিল। কত কি খেলত তারা স্কুলের মাঠে─ গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বরফপানি। বিকালবেলা বাবার সাথে মোটর বাইকে চড়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেত। বাবা তাকে রূপকথা, ভ্রমণকাহিনিসহ কত্ত মজার মজার বই এনে দিত। তারপরই নাদিয়া হঠাৎ বড়ো হয়ে গেল─ মা বলল, ‘নাদিয়া নাকি এখন সব খেলা খেলতে পারবে না, সবার সাথে মিশতে পারবে না, সবসময় নাকি তাকে সাবধানে থাকতে হবে। সে নাকি আগের মতো ছোট নেই।’ এভাবে হঠাৎ বড়ো হয়ে গিয়ে নাদিয়া যেন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল─ কেমন যেন নিঃসঙ্গ আর একা।

কলিং বেলের শব্দে এগিয়ে যায় নাদিয়া। বাবা বাসায় নেই। মা বলে গেছে, পরিচিত কেউ না হলে দরজা না খুলতে। নাদিয়া ভিউ দিয়ে দেখে─ মামা। নাদিয়ার মেজো মামা। নাদিয়ার কেমন একটা অস্বস্তি হয়─ বেশ অনিচ্ছা নিয়ে সে দরজাটা খুলে দেয়। মামার বয়স ত্রিশের কোঠায়, বিয়ে করেননি এখনো। একাধিকবার এসএসসি ও এইচএসসিতে অকৃতকার্য মামা বাড়িতেই থাকেন। মাঝে মাঝে উড়ে আসা পতঙ্গের মতো নাদিয়াদের বাসায় কয়েকটা দিন থেকে বেড়িয়ে যান। মামা নাদিয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন। ‘কেমন আছ নাদিয়া, মনমরা কেন, শরীরে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’ নাদিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। বুয়া রান্না ঘরে। নাদিয়া অস্বস্তি এড়াতে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মা আসার আগ পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে চায় সে।  তার মনে পড়ে, মফস্বলের সেই বাসাটায় যখন সে অদ্ভুত কিছু শারীরিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছিল─ মামা তখন তাদের বাসায়। নাদিয়াকে একা পেলেই মামা তাকে কিছু অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল, ‘নাদিয়ার কী হয়েছে? মন খারাপ নাকি? নাদিয়ার শরীরে কি কিছু হয়েছে? এত ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে কেন নাদিয়া? মামা কাউকে বলবে না─ নাদিয়া যেন তাকে বলে’ নাদিয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। এমনকি নাদিয়া বাথরুমে গেলে মামা বাথরুমের দরজায় টোকা দিত, খসখস শব্দ করত। সবার সামনে স্বাভাবিক মুখে ঘুরে বেড়ানো মামা নাদিয়াকে একা পেলেই কেমন মুচকি মুচকি হাসত, আর এই অদ্ভুত প্রশ্নগুলো করত─ সেই থেকে মামাকে দেখলেই অসহ্য লাগে নাদিয়ার। বাথরুমের দরজায় খসখস শব্দ হচ্ছে। নাদিয়া শব্দটার সাথে পরিচিত। অপেক্ষার প্রহর গুনছে নাদিয়া, মা কখন আসবে? ভীষণ দমবন্ধ লাগছে তার!

তিন

স্কুলে নাদিয়ার পাশে যে-মেয়েটি বসেছে তার নাম লীরা। একটু মিশুক প্রকৃতির। হোমওয়ার্ক খাতায় নাদিয়া তার তিনটি অঙ্ক মিলিয়ে দিল। লীরা খুশি হয়ে নাদিয়াকে বলল,

‘আরে, তুমি দেখি জিনিয়াস!’ টিফিনের ফাঁকে আরো টুকটাক কিছু কথা বলেই লীরা নাদিয়াকে যে প্রশ্নটি করল, ‘অ্যাই, তোমার পেছনে কয়জন?’ নাদিয়া না বুঝে চোখ বড়ো করে তাকাল─ লীরা বলল, ‘আরে বুঝলা না? তোমার পেছনে কয়টা ছেলে ঘোরে?’ তারপর গলাটা আর একটু নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওই যে সুবর্ণা, রাইসা, বুশরা─ ওদের পেছনে নাকি ২-৩ জন করে ঘোরে।’ নাদিয়ার কাছে খুব অদ্ভুত লাগে এসব কথা। লীরা হড়বড় করে বলেই যাচ্ছে, ‘এ’ সেকশনের সুজানা, পুতুল─ ওদের তো রীতিমতো

‘অ্যাফেয়ার’ আছে। নাদিয়া অবাক হয়ে বলে, ‘কী আছে?’ লীরা আরও চাপা স্বরে বলে
‘অ্যাফেয়ার’! ‘অ্যাফেয়ার’! নাদিয়া অবাক হয়। তার ১৩ বছরের সরল ছোট্ট জীবনে এই কথাগুলো কেমন অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।

─‘আচ্ছা, টিফিনের ফাঁকে নতুন বিল্ডিংয়ে ওঠা মেয়েদের হেড ম্যাডাম পেটালেন কেন?’

নাদিয়ার এই প্রশ্নের উত্তরে বিস্মিত লীরা বলে, ‘তাও জানো না?’ যেন গুপ্তধনের সন্ধান দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে লীরা হাত নেড়ে চাপা স্বরে বলে, ‘ওই বিল্ডিংয়ের ওই পাশে কয়েকটা বাড়ির ছাদে ছেলেরা আড্ডা দেয়, ওই বিল্ডিংয়ে যাওয়া মেয়েদের সাথে টাংকি মারে, চিঠি চালাচালি করে─ শুনেছি অনেক মেয়ের বয়ফ্রেন্ডরাও নাকি ওঠে ওইসব ছাদে।’ নাদিয়া কেমন শিউরে ওঠে।

তার চোখ যায় বুশরার দিকে। সেদিনের পর থেকে বুশরা তাকে কেমন এড়িয়ে যায়। যাদব স্যারের ব্যাচে সে কথা বলতে গেলেও বুশরা তাকে পাত্তা দেয়নি। নাদিয়া টের পায় বুশরা, রাইসা, সুর্বণারা কেমন তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে তাকে, বাকি মেয়েদের সামনে কেমন হেয় করে কথা বলে। এই তো দুইদিন আগেই রাইসা নাদিয়াকে বলল, ‘তুমি কি রোজ চুলে তেল দাও?’

নাদিয়া ‘হ্যাঁ’ বলতেই রাইসা বলল, ‘শ্যাম্পু দাও না’? নাদিয়া একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলে
‘করি তো, সপ্তাহে একদিন।’ রাইসা নাক সিটকিয়ে বলে ‘এ! মা! রোজ তেল দিয়ে থাকো
কীভাবে?’ নাদিয়া বিব্রতমুখে সরে আসার চেষ্টা করে। পেছন থেকে শুনতে পায় বুশরা আস্তে
করে বলছে─ ‘ক্ষ্যাত’।
 নাদিয়া বিষণ্ন হয়ে যায়। বাবার চাকরির বদলিসূত্রে তারা এই শহরে এসেছে। শহুরে স্কুল, স্কুলের মেয়েগুলো কেমন কঠিন─ একটুও আপন নয়। বিষণ্ন দৃষ্টিতে নাদিয়া স্কুল-মাঠের দিকে, মাঠের পাশের পুকুর ঘাটের দিকে তাকায়। স্যার-ম্যাডামদের কথা মনে পড়ে, বন্ধুদের কথা মনে পড়ে, আর মনে পড়ে তার প্রিয় খেলা ‘বরফপানি’র কথা।

চার

বছর শেষে নাদিয়া বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেবে। বাসায় তাই একজন স্যার নাদিয়াকে পড়ায়। ওবায়েদ স্যার। বাবা কার কাছে যেন শুনেছে স্যার অলরাউন্ডার। কোনো স্কুলে না পড়ালেও স্যারের নিজস্ব কোচিং সেন্টার আছে। বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইংরেজি─ স্যারের সাজেশনে নাকি কনফার্ম স্কলারশিপ। স্যার আজ জ্যামিতি পড়াচ্ছেন, সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র বোঝাচ্ছেন। নাদিয়াদের বাসার বারান্দায় পড়ার টেবিলে বেশ নিরিবিলিতে পড়ান স্যার। সমকোণী ত্রিভুজ─ এক বাহু লম্ব, এক বাহু অতিভুজ আর এক বাহু ভূমি─ স্যার নাদিয়ার দুই হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ত্রিভুজের ক্ষেত্র বানিয়ে দেখাচ্ছেন। নাদিয়ার কাছে স্যারের এই পড়ানোর ভঙ্গিটা একটুও ভালো লাগছে না। স্যারের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, দুই হাতে শ্বেতী, আঙুলগুলো কেমন যেন বর্ণহীন, শ্বেতীর কারণে মনে হয় যেন আঙুলগুলোর উপরে চামড়া নেই। জ্যামিতি রেখে স্যার ফুলের পরাগায়ন ধরলেন─ এগুলো নাদিয়া পারে─ তবু স্যার অনেক সময় নিয়ে ফুলের পরাগায়ন বোঝাতে চান─ নাদিয়ার একটুও ভালো লাগছে না─ এই কথাগুলো সে কাকে বলবে? গতকালই তো তারা বাইরে বেরিয়েছিল, মা-বাবা মুন্নাকে কোলে নিয়ে এক রিকশায় বসেছিল, আর তাকে দিয়েছিল মামার সাথে রিকশায়। সারারাস্তা মামা কেমন তার গায়ে চেপে বসেছিল─ নাদিয়া যতই রেগে যাচ্ছিল, মামা ততই একটা গা জ্বালানো হাসি হাসছিল। রিকশা থেকে নেমে মামা আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। নাদিয়া কার কাছে বলবে?

কেউ কি তার কথা বিশ্বাস করবে? এর আগে তো সে মাকে বলেছিল মামার কথা। মা তো বিশ্বাস করেইনি উল্টো নাদিয়াকেই ধমকে বলেছিলেন ‘যত সব পাকামি? গল্পের বই পড়ে পড়ে বেশি পাকা হয়ে যাচ্ছ, তাই না?’ সেই থেকে নাদিয়া আরও খানিক গুটিয়ে গেছে! কেন যে সে বড়ো হলো? কেন তার আশেপাশের সবকিছু এমন করে বদলে যাচ্ছে ? গভীর এক দুঃখে মনটা ছেয়ে যায় নাদিয়ার!

পাঁচ


ক্লাসে পরপর দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। বকুল ম্যাডাম যিনি কিনা খুব কড়া, ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছিলেন─ হঠাৎ থার্ড বেঞ্চের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে সুবর্ণা, রাইসা, বুশরা ওদেরকে ব্যাগ খুলে দেখাতে বললেন। ওদের ব্যাগ থেকে তিনটি বই পাওয়া গেল─ ‘নীলা প্রকাশনীর’। ম্যাডাম একে একে সবার ব্যাগ চেক করলেন। মোট ১১টি বই পাওয়া গেল ‘নীলা প্রকাশনীর।’ ম্যাডাম ১১জনকে বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। সমস্ত ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। যারা দোষ করেনি তারাও ভয়ে শ্বাস বন্ধ করে আছে। ‘ক্লাসটা পড়াশোনার জায়গা─ এইসব বাজে বই বা নভেল পড়ার জায়গা নয়। এ-সব কি তোমাদের বয়সের বই? ছিঃ ছিঃ এসব অশ্লীল কুৎসিত বই এই বয়সে তোমাদের হাতে! কোথায় পেয়েছ এগুলো? কী ব্যাপার, কথা বলছ না কেন?’ বকুল ম্যাডামের হুংকারের জবাবে খুব আস্তে আস্তে একজন‘স্যরি ম্যাডাম’ বলে। ম্যাডাম ১১ জনের নাম টুকে নিলেন এবং পরদিন অভিভাবকসহ ম্যাডামের সাথে দেখা করতে বললেন। টিফিনের পরের পিরিয়ডে ‘সমাজ ও নৈতিক শিক্ষা’ ক্লাস নিতে নতুন এক ম্যাডাম এলেন।

নূপুর ম্যাডাম। কী চমৎকার কথা বলেন! সবুজ রঙের একটা শাড়ির সাথে সবুজ রঙের ফুলস্লিভ ব্লাউজে ম্যাডাম যেন একটুকরো সবুজ আবেশ। নাদিয়ার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। ম্যাডাম সবাইকে দারুণভাবে চমকিত করলেন─ প্রথম ক্লাস বলে ম্যাডাম সবার সাথে গল্প করলেন, কে কী পারে জানতে চাইলেন, কেউ কেউ দুই লাইন গান গাইল, নাদিয়া ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটা আবৃত্তি করে শোনাল। ম্যাডাম মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুমি নাদিয়া?

নাদিয়া কোমানিচির মতো তুমি একদিন অনেক বিখ্যাত হবে।’ নাদিয়া যখন ম্যাডামের কাছ থেকে হেঁটে বেঞ্চের দিকে যাচ্ছিল তখন দেখতে পেল─ বুশরা, রাইসা, সুবর্ণারা কেমন অবাক হয়ে আড়চোখে তাকে দেখছে।

ছয়


গতকাল রাতে নাদিয়া খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে। সবুজ রঙের এক ছোট্ট টিয়া পাখি জানালা দিয়ে উড়ে এসে নাদিয়ার হাতে বসল─ নাদিয়া পাখিটার জন্য খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইদানীং স্কুলে নূপুর ম্যাডামের পিরিয়ডের জন্য নাদিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। পড়ানোর বাইরেও ম্যাডাম এত সুন্দর সুন্দর কথা বলেন! কাল যেমন ক্লাসে বলছিলেন,

‘তোমরা সবসময় সত্য কথা বলবে, যদি মন্দ কিছু দেখ, লুকিয়ে রাখবে না, শেয়ার করবে, প্রতিবাদ করবে’। ক্লাসের শেষ দিকে ম্যাডাম হঠাৎ নাদিয়াকে লক্ষ্য করে বলেন ‘নাদিয়া কোমানিচি, আজ আমাদের কী শোনাবে? কবিতা না গল্প?’ নাদিয়া ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্যা সি’ গল্পটা শোনালো─ নাদিয়া যখন গল্পটা বলছিল, নূপুর ম্যাডামসহ সমস্ত ক্লাস নাদিয়ার দিকে তাকিয়েছিল।

সন্ধের সময় ওবায়েদ স্যার পড়াতে এলেন। স্যার আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি পড়াচ্ছেন। গ্রহ, নক্ষত্র, মিল্কিওয়ে, ছায়াপথ– গ্রহের কক্ষপথ পড়াতে পড়াতে দুটি গ্রহের মুখোমুখি সংঘর্ষ বোঝাতে গিয়ে স্যার হঠাৎ নাদিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। কয়েক সেকেন্ডের ঘটে যাওয়া ঘটনায় নাদিয়া প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গেল─ তারপর পড়া বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ভেতর এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের শত প্রশ্নের মুখেও নাদিয়া কোনো উত্তর দিল না। বাবার জন্য অপেক্ষা করছে সে। অনেকদিন হয় বাবার সাথে মন খুলে কথা বলা হয় না। মা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন ─ নাদিয়া নিশ্চুপ। দৃঢ়, অবিচল পায়ে নাদিয়া অপেক্ষা করছে বাবার জন্য─ বাবাকে কিছু বলার আছে তার ─এতদিনের না বলা অনেক কিছু।

সাত

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। নাদিয়া ফার্স্ট হয়েছে। সমস্ত স্কুলের দুই শাখা মিলিয়ে সে ফার্স্ট। রেকর্ডসংখ্যক মার্কস পেয়েছে সে। বোর্ডে রেজাল্ট টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই দাঁড়িয়ে রেজাল্ট দেখছে। বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট আসবে আরো পরে। টিচাররা বলাবলি করছে, ‘নাদিয়া ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পাবে, খুব সম্ভবত এই জোনে সে-ই ফার্স্ট হতে যাচ্ছে’।

স্কুলটাকে ভালোবেসে ফেলেছে নাদিয়া। শহরটাকেও। বাসায় মামার আসা বন্ধ করেছেন বাবা। সেদিনের পর ওবায়েদ স্যারকেও খুব কড়াভাবে বিদায় দিয়েছেন। নাদিয়া হেঁটে যাচ্ছিল স্কুলের মাঠের পাশ দিয়ে; পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকায়। রাইসা, সুবর্ণা আর বুশরা দাঁড়িয়ে। সবাই কেমন মুগ্ধ চোখে দেখছে নাদিয়াকে।
‘খেলবে আমাদের সাথে?’─ জিজ্ঞেস করে বুশরা।
নাদিয়া অবাক হয়ে বলে─ ‘কী?
বুশরা এগিয়ে এসে নাদিয়ার হাত ধরে─ ‘বরফপানি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *