ছোটগল্প।।পোস্টার ও কলম কাহিনি।।মোহিত কামাল
দরজায় ভারি পর্দা ঝুলছে। পুবমুখী বন্ধ জানালার ফ্রেম জুড়েও রয়েছে একই রঙের দামি পর্দা। এখন সকাল দশটা। রোদ উঠছে, সূর্যের তেজ ক্রমশ বাড়ছে। সে-রোদ এসে জানালার বাইরের দিকে গ্লাসে আছড়ে পড়ছে, সরাসরি রোদ ঢুকতে পারছে না ঘরে, তবে রোদের কোমল ছায়া আধো অন্ধকার ঘরটাকে মায়াময় আলোয় ভড়িয়ে দিয়েছে।
রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র শীতের অনুভূতি ক্রমশ কমছে। ওম পাওয়া উষ্ণতায় ভরে উঠছে দেহ, ভরে উঠছে মন। শান্ত মন নিয়ে টেবিলে বসেছে হৃদয়। লিখছে।
খুট করে একটা শব্দ হওয়ায় দরজার দিকে মুখ তুলে তাকাল ও। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া মুখটা দেখে চোখ ফেরাতে পারল না। অবাক বিস্ময়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল, যেন শক্তিশালী এক চুম্বক হৃদয়ের দু’চোখ সেঁটে ধরেছে, পলক ফেলার শক্তি নেই। ওর চোখজোড়া প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
দরজার পর্দা সরিয়ে হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়াল হীরা। কেবল রূপবতী নয়, কেবলই লাবণ্যময়ী নয়, যেন এক উজ্জ্বল হীরকখণ্ড দরজা পেরিয়ে ভেতরে এসে আলো ছড়াচ্ছে, হাসছে। ওর হাসিতে যে কী আছে! শুধু দেখতে ইচ্ছে করছে। প্রকৃতির সব অনিন্দ্য সুন্দর একত্রে জমা হয়েছে হীরার মুখে। এত সুন্দর! এত সুন্দরী কেনো হয় কোনো তরুণী!
সুন্দর মুখের দিকে তাকাতেই পারে না হৃদয়। ভয় পায়। অজানা ভয়ে এখনও বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠল মুহূর্তের জন্য। অন্যমনস্ক হয়ে গেল ও।
‘এমন বোকার মতো তাকিয়ে আছো কেন ?’ বলতে বলতে সামনের চেয়ারে বসল হীরা। তার হাতে আছে মোড়ানো একটা পোস্টার।
প্রশ্ন শুনে নড়ে ওঠে হৃদয়। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমাকে দেখে কি বোকা মনে হয় ?’
‘এমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে বোকা আর হ্যাংলা মনে হবে না ? মনে হলো প্রথম দেখছো আমায়!’
‘তোমাকে যতবারই দেখি, মনে হয় নতুন করে দেখছি, চোখ ভরে না। মনও না। প্রতিবারই দেখার মাঝে অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে। আরও দেখি আরও দেখি এমন একটা অতৃপ্ত অনুভূতি রয়েই যাচ্ছে।’
‘তাই নাকি ?’
‘কেন, সন্দেহ হয় ?’
মুখে কোনো উত্তর না-দিয়ে হীরা কেবল চোখ গোল গোল করে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল হৃদয়ের মুখের দিকে। ওর চোখ থেকে পা পর্যন্ত শিরশির করা এক আনন্দধারা বয়ে গেল সংগোপনে।
‘হাতে ওটা কি ?’
‘পোস্টার।’
‘কিসের ?’
‘দেখলেই বুঝবে।’
‘দাও দেখি।’
‘পরে দেখো। এখন আমি তোমাকে দেখছি, ভালো লাগছে ভীষণ।’
প্রাণকাড়া কথা শুনে চুপ হয়ে গেল হৃদয়।
দুজন দুজনকে দেখছে। দুজনের চোখের উজ্জ্বল আলো ঢুকে যাচ্ছে দুজনেরই বুকের গহণে; প্রাণসঞ্চারি টান তৈরি করছে, আবেগের শুদ্ধ শেকড়-বাকড় ভেতরে গেড়ে বসছে। শেকড়ের বিস্তার কতটুকু। জানে না ওদের কেউই। দরজার বাইরে খসখস শব্দ হচ্ছে। কেউ আসছে মনে হলো। হ্যাঁ, গৃহকর্মী হালিমা ট্রে হাতে ঘরে ঢুকছে। দুজনের ধ্যান ভেঙে গেল।
‘মা কোথায় রে ?’
‘রান্না ঘরে, রাঁধছে। আফারে দুপুরে খাইতে কইছে।’ হালিমা ঝটপট জবাব দিয়ে ট্রেটা টেবিলে রেখে কেটে পড়ল। হৃদয় আবার তাকাল হীরার দিকে।
‘মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে ?’
‘হুম। আগে আন্টির সঙ্গে দেখা করেছি। তারপরই তোমার ঘরে এসেছি।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হৃদয় হাত বাড়াল পোস্টারটির দিকে।
‘না।’ ধমক দিয়ে বলল হীরা।
সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে হৃদয় প্রশ্ন করল,
‘না কেন ?’
‘এখন দেখলে ওটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে তুমি। আমার কথা ভুলে যাবে। আমার দিকে আর খেয়াল থাকবে না তোমার। তখন আমার মন খারাপ হয়ে যাবে।’
‘মন খারাপ হবে ? তাহলে এমন পোস্টার আনলে কেন ?’
‘আমার দিকে নজর দিবে না বলেই মন খারাপ। তবে পোস্টারটি দেখলে তোমার ভালো লাগবে। তাই এনেছি।’
খুশি হয়ে হীরাকে এবার সামনের চেয়ার থেকে টেনে এনে পাশের চেয়ারে বসাল হৃদয়। আলতো করে ওর ডান হাত তুলে নিল নিজ দুহাতের ভেতর। কিছুক্ষণ চেপে ধরে বসে রইল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সময় চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘোরমগ্ন সময় থেকে জেগে উঠে হৃদয় তাকাল হীরার মুখের দিকে। ওর চোখ বোজা।
‘তুমি এত সুন্দর কেন ?’
হৃদয়ের প্রশ্ন শুনে ঝট করে চোখ খুলে গেল হীরার। হাতটা টেনে গুটিয়ে নিয়ে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ‘এটা একটা প্রশ্ন হলো ?’
‘কেন ? প্রশ্ন হয়নি কেন ?’
‘কেউ আমাকে সুন্দর বললে আমার খারাপ লাগে, জানো না ?’
থতমত খেয়ে গেল হৃদয়। এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারল না ও। হীরার মুখে বিষাদের ছাপ বসে গেছে। এমন ভালোলাগার মুহূর্তে এ ছাপ মানায় না। তবু পরিবেশ জটিল হয়ে গেল। হঠাৎ সৃষ্ট এ বিষাদের সঠিক কারণ বুঝতে পারল না হৃদয়।
‘আমি আজ যাই।’ হীরা চলে যেতে উদ্যত হয়।
‘সেকী! এখনই যাবে ?’
‘হ্যাঁ, ভালো লাগছে না।’
‘নাকি আমার সান্নিধ্য ভালো লাগছে না ?’
‘লাগে। তবে এখন লাগছে না। যাই।’
‘এত যাই যাই করছো কেন ? আর একটু বসো, প্লিজ! তাছাড়া মা তোমার জন্যে রাঁধছেন।’
হৃদয়ের কাতার মুখের দিকে তাকাল হীরা। ‘যাই’ ‘যাই’ বললেও উঠতে পারছে না। বুকের গহনে লুকোনো হীরকখণ্ড আলো ছড়াচ্ছে অবিরত; চুম্বকশক্তির সঞ্চালনও ঘটাচ্ছে। আর তা ওকে ঠেসে ধরেছে চেয়ারে, উঠতে দিচ্ছে না।
‘এত মন খারাপ হলো কেন তোমার ?’ হৃদয়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
জবাব দিচ্ছে না হীরা। শীতল আচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে লাগল। ছোটবেলা থেকে নানাভাবে ও নিজ-রূপের প্রশংসা শুনে আসছে। আর তার জন্য নানা-কৌশলের নিপীড়ন-নির্যাতনও ভোগ করে করে বড়ো হয়েছে; হচ্ছে। এ ধরনের প্রশংসার প্রতি বিরক্তি জমে গেছে। প্রশংসা আর শুনতে চায় না, অন্য মেয়েদের স্বভাবের উল্টো ও। ও মেধাবী ছাত্রী। মেডিকেলে পড়ছে, পঞ্চম বর্ষে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করে। লেখালেখি সূত্রেই হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা, সম্পর্ক, ভালোবাসা। তরুণ সাংবাদিক হৃদয়, নাম করা গল্পকারও। কেন সে ওর রূপের দিকে তাকাবে। ওর মনের কেউ প্রশংসা করে না। সুন্দর শরীরের ভেতরও যে সুন্দর মন লুকিয়ে আছে, থাকতে পারে, কেউই তা দেখে না। হৃদয় ওর চোখে আলাদা, কেন সে ব্যতিক্রম হবে না ? কেন হবে গতানুগতিক ?
কাতর হয়ে হৃদয় বলল, কদিন পর বিজয় দিবস। এখন ব্যস্ততায় সময় কাটাতে হচ্ছে। তোমার সঙ্গেও হয়তো দেখা হবে দেরিতে। তুমি মন খারাপ করে চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।’
‘আমার মন বোঝো তুমি ?’ প্রশ্ন করল হীরা।
‘বুঝি না! সন্দেহ হয় ?’
‘হ্যাঁ, সন্দেহ হয়। মনে হয় কেবল আমার রূপই দেখো, মন বোঝো না।’
‘ঠিক বললে না। তোমার মনই দেখি আমি। সুন্দর মনের মেয়ে তুমি। তোমার রূপ আমাকে মুগ্ধ করে, এক শ ভাগ সত্যি। ভাবায়ও প্রচুর। এটাও শতভাগ সত্যি। তোমাকে দেখে দেখে ভয় পেয়ে যাই মঝে মাঝে।’
‘কেন, ভয় পাও কেন ? আমি কি ভয়ংকর প্রাণী ?’
‘তা নয়। তোমার রূপ ভয়ংকর সুন্দর। অসহ্য রকম সুন্দরী তুমি। রূপে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য হাত এগিয়ে আসবে, অসংখ্য লোভী চোখ গিলে খেতে চাইবে তোমায়। এ বয়সেও টের পাও নি ?’ বলতে বলতে অন্যরকম হয়ে গেল হৃদয়। ওর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেছে। চোখে-মুখে কঠিন অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। পেরিয়ে আসা নিজ বয়সের সিঁড়ি টপকে দ্রুত ও চলে গেল একাত্তরে। একাত্তরের দিনগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠল চোখের সামনে। ফ্ল্যাশব্যাক তা জেগে ওঠল মনের ক্যানভাসে : হৃদয়ের বড় বোনের নাম উজলা। প্রাণোচ্ছল ঝলমলে এক তরুণী। কলকল করে মাতিয়ে রাখে সারাবাড়ি, যেকোনো আসর কিংবা আড্ডা। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী সে। লম্বা, স্লিম। একবার তার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। চট্টগ্রামের আগ্রবাদ এলাকাতে ওদের বাসা। হৃদয় খুব ছোট। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
পঁচিশে মার্চের রাত্রি, উনিশ শ একাত্তর সাল।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। নীরব হয়ে শুয়ে আছে পুরো শহর, রাস্তাঘাট, বাড়ির ভেতর-বাইর।
হঠাৎ রাতের স্তব্ধতা ভেঙে গেছে।
সবাই জেগে উঠেছে। বাইরে বিকট শব্দ হচ্ছে। বিপুল বিস্ফোরণ শুনে মনে হচ্ছে চারপাশের ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কেবল অলৌকিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ি। উজলা লাফিয়ে উঠে সুইচ অন করে। নাহ! ইলেকট্রিসিটি নেই। উত্তরের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায় ও। চারপাশ গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকারের ঘনত্ব বোঝা কঠিন। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে ঝলক দিয়ে ওঠে আলোকমালা। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ-চমকানোর মতো চারদিকে ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ে। পলকের জন্য ও দেখে নেয় বাইরের ঘর-বাড়ি। না, এখনো এলাকার কিছুই ধ্বংস হয়নি।
এবার দক্ষিণের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল উজলা।
বাইরে তাকিয়ে দেখল আকাশের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আগুনের গোলা। কামানের গোলা। থর থর করে কেঁপে উঠছে জানালা। একই সঙ্গে কেঁপে উঠছে সবার বুক। এই বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে সব―ওদের বাড়ি, চারপাশও।
বড়রাস্তার পাশেই ওদের বাসা। বাইরের ভয়াল শব্দের জন্যে এতক্ষণ রাস্তার দিকে খেয়াল করে নি কেউ। রাস্তা দিয়ে গরগর করে ঢুকছে ট্রাকলরি। প্রতিটা লরিতে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের সশস্ত্র রণসজ্জা; শহরের ভেতর ঢুকছে, বন্দরের দিক থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছে লরিবহর।
ওদের বাবা, রউফ চৌধুরী, অন্ধকার হাতড়ে এসে মেয়েকে ধরে বললেন, ‘এদিকে চলে এসো। পর্দা ছেড়ে দাও।’
‘ভয় নেই বাবা, ওরা বাইর থেকে দেখতে পাবে না ভেতরের কিছু।’
‘বেশি বোঝার চেষ্টা কোরো না, ভেতরে এসো।’
পর্দা ছেড়ে দেয় উজলা। তর্ক না-করে ভেতরে আসে। আর খাটের এক কোণে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে হৃদয়। হৃদয়ের এক হাত শক্ত করে ধরে ও।
‘ভয় পেয়েছিস ?’
‘হ্যাঁ, আপু ভয় করছে।’
‘ধুর বোকা। ভয় পাসনে। শক্ত থাক। কিচ্ছু হবে না।’
‘কিচ্ছু হবে না মানে? দেখছো না আমাদের বাড়ি কেমন কাঁপছে!’
‘কাঁপুক। তবুও সাহস হারাবি না, খবরদার।’ শক্ত একটা ধমক দিল উজলা।
‘উজলা! চুপ করো, মা।’
বাবার ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলে ও। এক ধরনের অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগল। গোলার শব্দ কমছে না, বাড়ছেই। জ্বলন্ত আগুনের পিণ্ড শাঁ শাঁ করে ছাদের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে উত্তর দিকে।
‘বাবা। কোত্থেকে কামান দাগানো হচ্ছে, বুঝতে পারছো ?’
‘মনে হচ্ছে পতেঙ্গা উপকূলের নৌসেনা ইউনিট থেকে আক্রমণ করছে হানাদাররা।
‘লক্ষ্যস্থল বুঝতে পারছো ?’
‘পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে সেনানিবাস কিংবা কোর্ট-বিল্ডিং-এর দিকে যাচ্ছে এসব গোলা।’
‘বাবা। ওরা বোধ হয় ধ্বংস করে দেবে দেশ। বাঙালির কোমর ভেঙে দেবে।’
‘আস্তে কথা বলো মা।’
‘নিশ্চয় আমাদের সাহসী ছেলেরা কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। হানাদাররা শেষ করতে পারবে না আমাদের। দেখে নিয়ো, জয় আমদের হবেই।’ উজালার ভেতর অজানা উত্তেজনা বাড়ছে।
‘উত্তেজিত হচ্ছো কেন, চুপ করো মা।’
আশপাশে ভয়ানক এক বিস্ফোরণ ঘটল।
সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় আপুকে জড়িয়ে ধরল।
রউফ চৌধুরী শংকিত হয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমাদের এলাকাতে বোধ হয় কামান দাগানো শুরু হয়েছে।’
‘না বাবা। ওদের সৈন্যরা এ-পথে যাওয়া আসা করছে, এখানে কোনো অসুবিধে হবে না। ধ্বংসযোগ্য কিছু ঘটলে লেলিয়ে দেওয়া সৈন্যরা ঘটাবে।’ বলল কলেজ পড়ুয়া উজলা আপু।
এ সময় বাইরে কান্নার শব্দ শুনতে পেল ওরা। হানাদাররা কি তবে নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ?
তাই হবে বোধ হয়। শ্বাসরোধ করা উৎকণ্ঠা বাড়ছে। মা জমিলা বেগম এগিয়ে এলেন। খাটের তলে টর্চ লাইট জ্বালালেন। পরিষ্কার করছেন তিনি। একটা বেডশিট বিছিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সবাই খাটের তলে ঢুকে যাও। শুয়ে থাকো ওখানে ?’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হলো, মা ?’ উজলা প্রশ্ন করে।
‘তর্ক করো না। যা বলছি শোনো। ঢুকে যাও।’
ওনার স্বরে কী ছিল কে জানে। কেউ প্রতিবাদ করল না। উজলা খাটের নিচে ঢুকে গেল হৃদয়কে নিয়ে। বিল্ডিং-এর ছাদে গোলা এসে পড়লে কি খাট ওদের রক্ষা করতে পারবে ? পারবে না। বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে জীবন বাঁচাতে চায়, এটাও তেমন একটি চেষ্টা। ভাবল উজলা।
‘পাঞ্জাবিরা কি আমাদের মেরে ফেলবে, আপু ?’
‘এত সোজা! আমাদের শক্তি জনতা, জনতার ক্রুদ্ধ হাত ওদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবে না ?’ উজলা সাহস দেয় হৃদয়কে।
‘ওরা তো বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে সব, আজই বোধ হয় মরতে হবে!’
‘থাম! সকালে উঠে দেখবি সব পাঞ্জাবি মরে ভূত হয়ে গেছে। পাকিস্তানি দস্যুনেতা ইয়াহিয়া, টিক্কা ভয় পেয়ে পালিয়েছে। জনতার মিছিল ওদের হাড় গুঁড়ো করে দেবে।’
একদিন পরের সকালের ঘটনা।
ওরা রেডিও শুনছে। রেডিওটি ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে। সবাই নাশতা খেতে বসেছে। করো মুখে কোনো কথা নেই। কেউ খেতে পারছে না। বিভীষিকাময় সময় কেড়ে নিয়েছে ওদের ক্ষুধা। হঠাৎ সবাই সচকিত হলো। উজলা খপ করে রেডিওটি তুলে নিল নিজের হাতে। উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে যন্ত্রটির দিকে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বেতারযন্ত্র থেকে বিশেষ ঘোষণা হচ্ছে। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। তরুণদের মাঝে বিপুল উৎসাহ। ওরা দলে দলে নেমে পড়েছে কাজে। বালতি হাতে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। কেউ রুটি দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে ডাল। উজলাও বসে নেই। রুটি বানিয়েছে অনেক। হৃদয়কে দিয়ে পাঠিয়েছে তরুণদের কাছে। সব যোগাড় করে তরুণরা নিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে। সাহসী বাঙালি সন্তানেরা ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বেঁচে যাওয়া সৈন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে বিভিন্ন অবস্থানে প্রতিরোধের ব্যুহ গড়ে তুলেছে। রসদ যাচ্ছে ওদের জন্য।
মার্চের পর এপ্রিল।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ক্ষুধার্ত পাগলা কুকুরের মতো বেপরোয়া তাদের পৈশাচিক উল্লাস। দিশেহারা সবাই, শহর ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। কারও হাতে ছোটখাটো পোটলা, কারও হাতে ব্যাগ, কারোর কোলে সন্তান। পথে শত্রুদের মুখোমুখি হবার ভয়। তারপরও এগিয়ে যাচ্ছে… গ্রামমুখী, প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ভারতমুখী মানুষের মিছিল। বিধ্বস্ত সবাই। বিধ্বস্ত হলেও তেজ এবং প্রত্যয়ের ঘাটতি নেই। পথে পথে গর্ভবতী মহিলারা সন্তান প্রসব করছে। নবজাতকের কান্নায় ভরে গেছে সবুজ প্রান্তর, প্রথম প্রশ্বাসে টেনে নিয়েছে ওরা বারুদের গন্ধ। বারুদের কালো ধোঁয়া নতুন জগতে অভিবাদন জানিয়েছে ওদের।
হৃদয়দের পরিবারও অগ্রসর হচ্ছে। উজলা প্রায় সারাক্ষণই ওর হাত ধরে রেখেছে, হাঁটছে।
ওরা যাচ্ছে কুমিরার দিকে, বড় রাস্তা থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে পশ্চিমের গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে ওদের এলাকার আরও তিন পরিবার। মোট বাইশ জনের একদল। সঙ্গে আছে একজন বেশ শক্ত-সামর্থ্য যুবক, সৈকত। সৈকতদের পরিবারও আছে ওদের দলে। হৃদয়দের পাড়ারই ছেলে, তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়। উজলার সঙ্গে অন্যরকম সখ্য, ঘনিষ্ঠতা। হৃদয় অল্প অল্প বোঝে। দুজনের চিঠি আদান-প্রদান করেছে, ভালোই লাগে সৈকত ভাইয়াকে।
বড়রাস্তা থেকে একটা চওড়া মেঠোপথ নেমে গেছে পশ্চিম দিকে। জায়গাটা ফৌজদারহাটের কাছে। ওই- পথ পার হওয়ার সময় দেখা গেল একটা জিপ দ্রুতগতিতে পুবদিক থেকে ছুটে আসছে, ধুলা উড়ছে পেছনে। আট-দশজন সশস্ত্র সৈন্য মুহূর্তের মাঝে ঘিরে ফেললো ওদের। ওদের চোখ স্থির হলো উজলার দিকে। উজলার চুল এলোমেলো। ওর শরীর বেয়ে দরদর করে নামঝে ঘাম। হেঁটে আসার কারণে টকটকে লাল হয়ে আছে গাল। চোখ উজ্জ্বল। মুখে তেজ, ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। এক হাতে ধরে আছে হৃদয়ের হাত, অন্য হাতে একটা ভারি ব্যাগ।
একজন হানাদার প্রথমে উর্দুতে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে উজলার দিকে এগিয়ে গেল। চোখে হায়েনার দৃষ্টি, বিভৎস চাউনি। বিকট আকৃতির গোঁফ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উজলা হাত ছেড়ে দিয়েছে হৃদয়ের। ব্যাগটিও ছেড়ে দিয়েছে মাটিতে। স্পর্ধিত সাহস নিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি কঠিন, যেন ভস্ম করে দিচ্ছে দস্যুটাকে। হায়েনাটা খপ করে উজলার বাম হাতের কব্জি চেপে ধরে টান দেয়। মুহূর্তেই ডান হাত দিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল সে হানাদারটার বাঁ গালে। পিশাচটি ক্ষেপে গিয়ে বন্দুকের বাট উঁচিয়ে আঘাত করার জন্যে উদ্যত হয়।
‘স্টপ!’ ভয়ংকর গলার স্বর ওদের টিম লিডারের।
রাইফেলের বাট নেমে গেল। কমান্ড শুনে সোজা হয়ে দঁড়াল হায়েনাটা। আশ্চর্য! উজলার একটুও ভয় নেই। ঔদ্ধত্যপূর্ণ ফণা তুলে রুখে দাঁড়িয়েছে সে, প্রচণ্ড শক্তি ভর করেছে ওর ডান হাতে। যদি একটি ধারালো অস্ত্র থাকতো এ মুহূর্তে এককোপে খণ্ডবিখণ্ড করে দিতে পারতো পিশাচটাকে।
‘লড়কি বহুত খুব ছুরত হে, গতর ভি। ইছকো মাত মারো। গাড়ি মে ভেজালো’…টিম লিডারের ভরাট কণ্ঠ।
‘না’ আর্তচিৎকার দিয়ে এগিয়ে এলেন রউফ চৌধুরী, উজলার বাবা। একজন সিপাহি ত্বরিত গতিতে লাথি চালালো ওনার তলপেট বরাবর। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি, জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। জমিলা বেগম ছুটে এলেন, তাকেও এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল হায়েনাটা। দড়াম করে তিনিও পড়ে গেলেন মাটিতে।
দুই হানাদার কুকুর শক্ত করে ধরেছে উজলাকে। প্রবল আক্রোশে নিজেকে ছড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, একটুও নড়তে পারছে না ও। এক সময় মায়াময় চোখে সবার দিকে তাকাল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল হৃদয়কে। হৃদয় থেকে একটু দূরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৈকতকেও দেখল প্রাণভরে। হৃদয় পাথর হয়ে গেছে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৈকত মাটিতে বসে দ্রুত একটা কাঠের গুঁড়ি তুলে নেয় হাতে। মুহূর্তের মাঝে ছুড়ে মারে টিম লিডারের মুখ বরাবর। সাঁই করে গুঁড়িটা আঘাত হেনেছে দস্যুটির বা চোখে। চিৎকার দিয়ে পড়ে গেছে ক্ষুধার্ত পিশাচটা। তার চোখ ফুটো হয়ে গেছে, দরদর করে ছুটে আসছে রক্ত।
একজন সৈনিক বন্দুকের ফলা তাক করে ছুটে এসে সরাসরি ঢুকিয়ে দেয় সৈকতের বুক বরাবর। প্রচণ্ড এক লাথি মেরে হেঁচকা টানে বের করে আনে রক্তাক্ত ফলা, ফিনকি দিয়ে ছুটে আসে উষ্ণ রক্ত। সৈকত মুহূর্তের জন্যে তাকাল উজলার দিকে, ক্ষীণ চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কেবল দুবার উচ্চারণ করল উজলা! উজলা! চোখের পলকে উজলার দৃঢ়তা মিলিয়ে গেল। এ দৃশ্য সইতে পারল সে। প্রতিরোধ শক্তি শিথিল হয়ে পড়ল। লুটিয়ে পড়া সৈকতের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে উজলা মনে মনে বলতে লাগল, সৈকত তুমি আমার, তুমি আমার! অনন্তকালের জন্যে আমার হয়ে রইলে। পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে, স্বপ্ন-সাধ ভেঙ্গে গেছে। চারদিকে অন্ধকার, অন্ধকারে কয়েকটা পাকিস্তানি মানব-কুকুর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে উজালাকে। আহত লিডারকে দ্রুত ওরা তুলে নেয় গাড়িতে, স্টার্ট দেওয়ার পূর্বেই মেশিনগান তাক করে ব্রাশ ফায়ার করে অন্যদের দিকে। সাত জনের মৃত্যু হয় সঙ্গে সঙ্গে। কম বেশি সবাই আহত হয়। হৃদয়ের বাম বাহুতেও গুলি লেগেছে।
॥ দুই ॥
উজলা আর ফিরে আসেনি। ওর লাশও পাওয়া যায়নি। অনেক সন্ধান করা হয়েছে, ওর খোঁজ মেলেনি। স্বাধীনতা এসেছে, বিজয় দিবস আসে, বছর বছর। উজলা আসে না। উজলারা নিজেদের তেজ, রক্ত ও সম্ভ্রম দিয়ে স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গিত হয়েছেন, কেউ মনে রাখিনি তাদের। এখনো দিনে দুপুরে ব্রাশ ফায়ার চলে, লুটিয়ে পড়ে তরতাজা তরুণ। ছিনিয়ে নেয় মেয়েদের ইজ্জত। কী লাভ এই স্বাধীনতার ? কী আছে এ বিজয় দিবসে ? এসব ভাবতে ভাবতে হৃদয়ের চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু নেমে আসে। আর তখনই একাত্তরের মায়াজাল ছিন্ন করে ফিরে এল ও বর্তমানে।
হীরা দাঁড়িয়ে আছে পাশে। নরম করে প্রশ্ন করল―‘হৃদয়। আমি কি তোমাকে কষ্ট দিলাম, কাঁদছো কেন ?’
নিজেকে সহজ করে, কান্না থামিয়ে উজলার কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, যা ভেবেছে, স্মরণ আছে―সবই হৃদয় বলে গেল তরতর করে।
সব শুনে ক্ষণকালের জন্য হীরা স্তব্ধ হয়ে গেল।
শান্ত হয়ে হৃদয় বলল, ‘এ জন্যে আপুর মতো সুন্দর মেয়ে দখলে ভয় পাই।’
হীরা আর কথা বলতে পারল না, নিথর তাকিয়ে রইল হৃদয়ের দিকে।
হৃদয় আবার বলল, ‘জানো, বিজয় দিবস এলে আমাদের ঘরে বিষাদের ছায়া নামে। মানুষ উৎসব করে, আমরা ঘরে বসে কাঁদি। উজলা আপুর শেষ দৃষ্টি এখনো বুকে গেঁথে আছে। গেঁথে আছে চোখে। ত্রিশ লাখ ভাইবোনের রক্ত এবং দুই লাখ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা। আমরা ভুলে গেছি। এ জন্য ভীষণ কষ্ট হয় আমার। ভীষণ।’
‘তোমার হাতে কলম আছে এখন, সুযোগও আছে। আমিও আছি তোমার সঙ্গে। এসো, আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা, মানুষের ত্যাগ এবং কষ্টের কথা লিখব, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলব না আমরা।’ হীরার তেজোদ্দীপ্ত জবাব।
হীরার বাইরের রূপের চেয়ে ভেতরের রূপ আরও সুন্দর মনে হলো। ওর কোমল জায়গায় ভালোবাসার হাত রেখেছে সে। হীরার ভেতর থেকে হীরকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ছে। পুরোঘরে অন্যরকম রশ্মি ভাসতে লাগল।
হীরা একটি কলম তুলে দেয় হৃদয়ের হাতে, একটি নেয় নিজের হাতে। কলম থেকে ছুটে আসছে এক ধরনের রশ্নি, ভালোবাসা। শহিদদের জন্যে ভালোবাসা।
পোস্টারটি এবার খুলে ধরে হীরা। বিজয়মেলা থেকে কিনেছে। সাদা-কালো পুরোনো একটি ছবি দিয়ে শোভিত হয়েছে এটি। ছবিতে সবার মধ্যমণি হয়ে মাথা উঁচিয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। মাথা নিচু করে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবুল মঞ্জুরসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডারগণ।
উল্লসিত হয়ে ওঠে হৃদয়। হীরার ভেতরের চেতনা টের পেতে অসুবিধে হলো না। পোস্টারটি বুকের সঙ্গে সেঁটে ধরে, পরশ নিতে লাগল ত্রিশ লাখ শহিদের উষ্ণ রক্ত আর ভালোবাসার।
এবার ও একহাতে শক্ত করে ধরল হীরার কলম। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করতে লাগল, ‘আমি সাহসী হবো। আমার আছে হীরকরশ্মি, হীরার ভালোবাসা, আর আছে এই কলম। আমাদের কলম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে। আমাদের গৌরবদীপ্ত সব বীরেরা এক সময় একসঙ্গে ছিল। বঙ্গবন্ধুর নামে যুদ্ধ করেছিল। পোস্টারটি সেই প্রমাণ উপহার দিচ্ছে, সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাসের।