ঈদ সংখ্যা ২০২১-এর ছোটগল্প।। স্বপ্ন হলেও সত্যি।। আজাদ মন্ডল
গত কয়েক রাত ধরেই জহিরের হ-য-র-ল-ব মার্কা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজও গেল। স্বপ্ন সাধারণত মানুষ হালকা ঘুমের সময়ই দেখে থাকে, যে সময়ে মানুষের চোখের তারা বেশ নড়াচড়া করে। কিন্তু, তার মনে হয় স্বপ্ন দেখা চলে গাঢ় ঘুমের সময়, আর সে সময় তার চোখের তারা থাকে ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া মানুষের চোখের তারার মতো! সে বিচলিত হলো, তার চোখের তারার সাথে ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া মানুষের চোখের তারার তুলনা করল কেন? চিন্তা করলে প্রত্যেক বস্তুর স্বরূপ চিনতে পারা যায়, সেও পেল কিন্তু যা পেল তাতে সে আবারও বিচলিত হলো। স্বপ্নগুলো সত্যিই কী হ-য-র-ল-ব মার্কা ছিলো? নাকি, সময়ের কলে চারপাশে ঘটে যাওয়া যেসব উদ্বেগ-উৎকন্ঠার আবহ দিনের আলোয় তার চেতন মনে দোলা দিচ্ছিল সেগুলোই জমা হচ্ছিল অবচেতন মনে, আর রাতের গভীরে ঘুমের ঘোরে অবচেতন মনের জমে থাকা হিসেব-নিকেষের ফল প্রকাশ হচ্ছিল স্বপ্নের মধ্যমে?
জহির বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খেল। গভীর রাত, ফুল ভলিউমে ফ্যান ঘুরছে, তবুও মনোজাগতিক উৎকন্ঠার জন্য সে রীতিমতো ঘেমে যাচ্ছে। সে আবার বিছানায় সুয়ে পড়ল, আগের সব রাতের সুবিধা ছিল স্বপ্ন দেখার পরে সে সহজে ঘুমিয়ে পরতে পারত, কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে, সে আর ঘুমাতে পারবে না। তার হৃদপিন্ডের স্পন্দনের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচন্ড মানসিক উত্তেজনায় সে আবার বিছানা থেকে উঠে আরেক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় বসে বসে বিগত সব রাতের স্বপ্নের এবার পর্যালোচনা করতে লাগল।
প্রথম রাতের স্বপ্ন ঃ রাজ্যের অপরাধীদের বিচারের জায়গা ফুটবল মাঠের মতো তবে ঘাসবিহীন আর বালুময়। মাঠের চারদিকে লোহার প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রোগা-পাতলা চোখ বাঁধা অপরাধী। একদিকে সুসজ্জিত আসনে বসে আছে প্রাসাদের মনিব তার পরিবার আর সভাসদরা। অন্য তিনদিকে হাজার হাজার রাজ্যবাসীর সমস্বরের চিৎকার ,খাঁচা খুলে দাও, খাঁচা খুলে দাও, বিচার করো, বিচার করো…মনিব রাজ্যবাসীর চিৎকারে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের লাল নিশানা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিতেই লোহার খাঁচার দরজা খুলে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে একটি ক্ষুধার্ত সিংহ খাঁচা হতে বের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অপরাধীর উপড় আর মুর্হূতের মধ্যই অপরাধীর শীর্ণ দেহ ছিঁন্ন-ভিন্ন হয়ে গেলো সিংহের ভয়ংকর সব থাবা আর দাঁতের কামড়ে। বালুময় মাঠে অপরাধীর যে রক্ত গড়িয়ে পড়ল তা শুকিয়ে যেতেও বেশি সময় লাগল না।
অপরাধীর বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা আর সিংহের ভীবৎস রূপে মানুষের রক্ত -মাংস খাওয়ার দৃশ্য দেখে সবাই যখন নিরব, তখন কেবল একজন চিৎকার করে উঠল , এমন নিষ্ঠুর বিচার মানি না, মানি না…
প্রথম রাতের এরূপ স্বপ্ন দেখে জহির ভেবেছিল, বহুদিন বা বহুবছর আগে সে এমন ভয়ংকরভাবে অপরাধীর বিচার হওয়া ট্র্যাজিডি হয়ত কোন বইতে পড়েছিল কিংবা সে কোন সিনেমায় দেখেছিল। সেই পুরোনো স্মৃতির কোন দৃশ্য সে স্বপ্নে দেখতেই পারে। তবে স্বপ্নে তার ঘোর লেগেছিল এইজন্য- এমন নিষ্ঠুর বিচার মানি না, মানি না… বলার মানুষটি ছিল সে। তবে সেই রাতে তার ঘুমের কোন ব্যঘাত ঘটেনি, হাস্যকর স্বপ্ন দেখে ঘুম না আসার কোন যুক্তিই ছিল না।
দ্বিতীয় রাতের স্বপ্ন ঃ রাস্তার মোড়ে বৃত্তের আকারে অনেক মানুষের সমাগম এবং প্রায় মানুষই মুখে এক ধরণের সুর তুলে হাতের আঙ্গুল বারবার সামনের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে, দূর হতে জহিরের মনে হলো বৃত্তের কেন্দ্রে কোন খেলা দেখানো হচ্ছে। সে অতি উৎসুক হয়ে ভীড় ঠেলে বৃত্তের পরিধির কাছে যেতেই বড় ধরণের ধাক্কা খেল। একজন আঠারো-কুড়ি বছরের যুবককে অনবরত তারই সমবয়সী কয়েটি ছেলে তালবেতাল পিটিয়ে যাচ্ছে, আর ভীড় করা লোকজন বেশি করে মারধরের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে-মার আরো মার, শালা চোর, বদমাইশ , হিরুনচি, মেরে ফাঁটিয়ে দে, চোখ কানা করে দে, শালা আর যেনো এই গলি চিনতে না পারে…মানুষের হাতে মানুষ রক্তাক্তের এমন বীভৎস চিত্রে জহির স্থির থাকতে পারল না, সে প্রায় চিৎকার করে বলতে লাগল- ভাই আর মারবেন না, চোর, ডাকাত, নেশাখোর যাই হোক এই ছেলে আমাদের দেশের সন্তান, অন্যায় যদি সে করে থাকে তবে তার বিচার করবে আদালত, আপনারা আদালতের বিচার নিজেরা করছেন কেন? একে পুলিশের হাতে তুলে দিন, খবরদার আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। কেউ একজন জহিরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে, খুব খারাপ ভাষায় বকতে লাগল-শালা তুইও তবে এর সাথে যুক্ত আছিস, তুইও আমাদের এলাকায় নেশা বিক্রি করিস, চুরি বদমাইশি করিস, আমাদের ছেলেদেরকে নেশাখোর বানানোর পিছনে তোরও হাত আছে, মার শালাকে, কিন্তু মারার আগেই জহির উঠে দাঁড়াল অবাক বিষয় সে উঠে দাঁড়াল বাউলবেশে! মাথায় লম্বা চুল, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, হাতে একতারা, সে গাইলেন- নিজাম নামের বাটপার সেতো, পাপেতে ডুবিয়া রইতো, তার মধ্যি সুমতি দিলে, আউলিয়া খাতায় নাম লেখালে…এলাহী আল মিন গো…
ঘুম ভেঙ্গে গেলে জহির রুমের মধ্য কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর এরূপ হ-য-র-ল-ব মার্কা স্বপ্নে দেখার সে একটি কারণ খুঁজে পেয়েছিল, মাধ্যমিকে বাংলা ব্যকরণে সে যে একজন চোরের আত্মকাহিনী পড়েছিল, বহুবছর গত হয়ে গেলেও তার রেশ এখনো অবচেতন মনে সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে, কিন্তু, সে বাউলবেশে সবাইকে নিজাম খুনির গান শোনালেন কেন? এই রহস্যের কোন কূল-কিনারা জহির করতে না পারলেও সেই রাতে ঘুমানোর তার কোন অসুবিধা হয়নি।
তৃতীয় রাতের স্বপ্ন ঃ প্রায় শত বছরের পুরোনো বটগাছ, শাখা-প্রশাখার বিস্তারে আকাশ দেখা যায় না, গাছের চারপাশে শান পাথর বাঁধানো, তার উপরে মানুষ বিশ্রামও নিতে পারে আবার অনেক সময় তা প্রতিবাধ-প্রতিরোধের সভা-সমাবেশের বক্তিতা দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। জহির বটগাছের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল, বটগাছের সামনে অসংখ্য মানুষ মাথায় হরেক রঙের ব্যাচ পড়ে মঞ্চের একজনের বক্তব্য শুনছেন, জহিরও কৌতুহলী হয়ে মঞ্চের সামনে এগিয়ে গেল, কেউ একজন এসে তার মাথায়, ‘ মানুষ হত্যা বন্ধ করো ’ লেখা লাল রঙের একটি ব্যাচ পড়িয়ে দিলেন, জহিরের কৌতুহলের মাত্রা বেড়ে গেল , ইতর প্রাণী হত্যা বন্ধের সভা সমাবেশ হতে পারে, হয়েছেও অনেক কিন্তু মানুষ হত্যা বন্ধের সমাবেশ?
জহির মঞ্চের বক্তার বক্তব্য শোনার চেষ্টা করল- ভাইসব, সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী, কাউকে অমানুষিক বা লাঞ্চনাকর দন্ড দেওয়া যাবে না।’ কিন্তু কোথায় আজকের আইন? বন্দুকের নলের মাথায় পবিত্র সংবিধান আজ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে, মানুষ আর পশুর মধ্য আজ কোন পার্থক্য নাই। আপনারাই বলুন রাস্তা-ঘাটে চোখ বাঁধা অবস্থায় মরে পড়ে থাকার মতো নিষ্ঠুর মৃত্যু আর কী হতে পারে? এটা কি যন্ত্রণাকর অমানুষিক মৃত্যু নয়? ঐ বাঙালি কথা কস না ক্যা?
জহিরের সবার সাথে বক্তার যুক্তির সাঁয় দিতে যেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল, তবে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও সে বির বির করে বলতে ছিলো, ঐ বাঙালী কথা কস না ক্যা? ঐ বাঙালী কথা কস না ক্যা?
এই স্বপ্ন দেখার পর জহিরের পরবর্তিতে ঘুমাতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল, সে তো কোনদিনও দেশের সংবিধান পড়ে দেখেনি আর শেষের দিকে সে-ই বক্তা হলেন কেন? তবে, স্বপ্নের আগামাথা কোনকিছু না বুঝলেও স্বপ্নটিকে একেবারে পূর্বের মতো হ-য-র-ল-ব মার্কা বলতে তার কেমন যেন দ্বিধা লেগেছিল, স্বপ্নের মাহার্ত্যরে গভীর একটা ছাপ তার মনে ফেলে দিয়েছিল।
চতুর্থ বা আজকে রাতের স্বপ্ন ঃ লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি পড়া একজন মাঝ বয়সি মহিলা, জহিরের শিয়রে বসে আছে, জহির মহিলাকে চিনতে পারল না, মহিলা জহিরের মাথার চুলে বিলি কাটতে লাগলে জহির প্রশ্ন করল-
- কে আপনি?
-আমি তোর মা, মাকে চিনতে পারছিস না? - না না আপনি আমার মা নন, আমার মা আপনার চেয়ে বৃদ্ধ, এই শাড়ির রঙ তার নয়।
- হা হা হা, জন্মধাত্রী কি শুধু মা হয় নাকি রে গাধা? আরো তো অনেক মা-ই আছে, দেশও তো মা, তাই না বল?
জহির নির্বাক হয়ে গেল, বিশেষ করে দেশ মায়ের কথা শুনে, এই নামের সাথে লাল সবুজের সম্পর্ক তো অতি ঘনিষ্ঠ, সে দ্রুত যা বুঝার বুঝে নিল,
-ক্ষমাপ্রার্থী মা, প্রথমে চিনতে পারি নাই, আপনি কেমন আছেন? - ভালো নেই রে বাছা,
- কেন মা?
- জহির তোর কী মনে হয়? সন্তান সে যতই খারাপ হোক কোন মা কী সেই সন্তানকে ত্যাগ করতে পারে?
- মায়েরা সাধারণত পারে না।
- এই জন্য ভালো নেই রে বাছা, হোক পাপী তবুও তো ওরা আমার সন্তান, আমার সন্তানদের রক্ত বইতে বইতে আর পারছি নারে বাবা।
- মা, আপনি শান্ত হোন।
- আমার কথা হলো, অন্যায় যদি আমার সন্তানেরা করেই তবে তাদের বিচার করে সাঁজা দাও, প্রমাণ হইলে ফাঁসি দাও, বিনাবিচারে মারবে কেন?
জহির কোন কথা বলতে পারল না, তার ঘুম ভেঙ্গে গেল, সত্যিই তো অপরাধী যত বড় অপরাধ করুক তার সাঁজা হবে দেশের আইন অনুসারে বিচারের মাধ্যমে, বিশেষ করে স্বাধীনতার এতো বছর পর বিনা বিচারে মানুষ মরবে কেন?
বিগত রাতের স্বপ্নগুলো পর্যালোচনা করে জহিরের হৃদপিন্ডের স্পন্দনের মাত্রা অনেকটাই কমে এসেছিল, মনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কয়েকদিনের জমানো অস্থিরতার ধুঁয়া মুক্তির কুন্ডলী হয়ে বের হলে সে কিছুটা স্বস্থি অনুভব করতে লাগল। জহির আবার বিছানায় সুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর, তার দরজায় ঠকঠক শব্দ, এত রাতে রুমমেট ফযলু এল নাকি? নাহ্, ফযলু এলে তো আগেই ফোন করে জানিয়ে রাখতো আর ফরিদপুর তো ঢাকা হতে কম দূরও নয়।
দরজা এখন পূর্বের চেয়ে বেশি জোড়ে ঠকঠক করছে, সারা সিঁড়িতে বুটজুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছে, কয়েকটি ধরাম ধরাম বাজ পড়ার মতো শব্দও শোনা গেল, জহিরের গলা শুকিয়ে আবারও হৃদপিন্ডের স্পন্দনের মাত্রা বেড়ে গেল, পিপাসায় তার বুকের ছাতি যেন ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু পানির গ্লাস সে ধরতে পারছে না, তার হাত থরথর করে কাঁপছে। জহির নিজেকে আর মেলে রাখতে পারছে না, দরজা ভাঙ্গার শব্দে পৃথিবীর সমস্ত ভয় তাকে আঁকরে ধরল, জহির মনে প্রাণে কামনা করছে যা ঘটছে তা যেন সত্যি সত্যি স্বপ্নেই ঘটে , আর সকালবেলা উঠেই সে যেন তৃপ্তি নিয়ে নির্ভয়ে এক গ্লাস পানি খেতে পারে…