ঈদ সংখ্যা ২০২১- এর ছোটগল্প।। সিলিকোসিস।। মোস্তফা অভি
তারাগঞ্জ দরবার শরীফের মেহমানখানার দোতলায় লেকটার সঙ্গে পরিচয়। লোকটা পাথরের ব্যবসায়ী আর সে উত্তর অথবা পূবের কোনো সীমান্ত থেকে এসেছে। এমন এক শ্রেণির মানুষ আছে ওরা দরবার শরীফে মানতি নিয়ে আসে আর ওরা বিশ্বাস করে, ঢালাইকরা কবরের নিচে শুয়ে থাকা লোকটি খুশি হলে যে কোনো অসাধ্য সাধন হতে পারে। ওদের হৃদয়ের গহীনে প্রোথিত বিশ্বাস সূর্যোদয়ের সাথে তেজদীপ্ত হয়। যে-কোনো নির্বাচনের পূর্ব প্রস্তুতির সময়ে এখানে সাম্ভব্য প্রার্থীদের আনাগোনা খুব চোখে পড়ে। আর তখন মেহমানখানার দোতলা সরগরম হয়ে ওঠে। এটা দূর-দূরান্তের ভক্তদের পথের ক্লান্তি দূর করার মত সাময়িক বিশ্রামাগার নয়। ঘরটা উত্তর-দক্ষিণ দিকে লম্বালম্বি, দোচালা। দু’পাশে পলেস্তারাখসা নোঁনায়ধরা ওয়াল। টিনের ছাউনিটা অন্য যে কোনো ঘরের চেয়ে উঁচু আর কাঠের তক্তার মাছার উপর পায়রার খোপের মত ছোট ছোট জানালা। বেঁকে যাওয়া কাঠের পাল্লা খুললেই সামনের শাখা নদীটা চোখে পড়ে। আমি লোকটার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে বহুদূরের জেলেদের নৌকার আলো দেখছিলাম। আলোগুলো ঢেউয়ের দুলুনিতে ওঠানামা করছে। পাথর ব্যবসায়ী লোকটার মতে, তার জীবনটা দূরের ওই দোল খাওয়া বাতিগুলোর মতই দোদুল্যমান। লোকটা চিন্তিত, বিষন্ন আর ক্ষুধার্থ সাবকের মত ধীর। দরবারের বোডিংখানায় রাতের খাবার খেতে টিকেট কিনতে হবে। যেহেতু আমি তাকে জানিয়েছি রাতে খাওয়া হয়নি। লোকটা বিণয়ের ভঙ্গিতে তাকালো আমার দিকে। আর সে অনুরোধ করল বোডিংখানায় তার সঙ্গী হতে। সে আরো জানালো আজ রাতের খাবার খেতে বোডিংখানার টিকিটটা আমাকে উপহার দিতে চায়। মেহমানখানার নিচে রান্নার উচ্ছ্বিষ্টেভরা কতগুলি হাণ্ডি রাখা, একপাশে নানান পদের মিশ্রিত গুঁড়ের কুপ। পাশাপাশি চারটি কুপ যেন ছাদে বসানো একেকটা চৌবাচ্চার মত। আর ওগুলোর নির্যাস জলজ বাতাসে মিশে বাতাসটা ঢেকুরতোলা টক গন্ধের মত রি রি করে। কি করে খাবার পেটে যাবে বলনতো? আমি তাকে বললাম। লোকটা মধ্যবয়সের চেয়ে আরেকটু বুড়ো। চোয়াল ভাঙা, সামনের দুটো দাঁত চোখে পরার মত উঁচু। ঘনো ঘনো সিগারেট ধরায় আর ছাইগুলো জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়।
প্রথম প্রথম তার সঙ্গে আলাপ জমাতে গিয়ে দেখতাম, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বেগানা মানুষের মত চুপ করে থাকত। আর বেশি বিরক্ত করলে সিগারেটের ধোঁয়া ভেতরে দম নিয়ে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করত তারপর রকেটের রেখার মত ছেড়ে দিত সামনের দিকে। অবশ্য কিছুটা সরল হয়েই এখন দু’চারটা আলাপ সহজে জমাতে আসে আমার সঙ্গে। আমি সুযোগটা নিজের অনুকূলে মনে করে তার দরগায় শিন্নি দেওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। লোকটা সিগারেটের গোড়াটা জানালার ফাঁক দিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে মৃদু নিশ্বাস ছেড়ে আরো এগিয়ে এসে আমার কাছাকাছি বসল। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, নিজের লোক ভাবতে পারেন আমাকে। আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, আপনার যে কোনো কথা সাদরে গ্রহণ করব। ভেবে দেখলাম, অন্যের কথা খোলাখুলিভাবে শোনার আগে লোকটার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। আর আমি তাকে পেয়ার উদ্দিনের দরবারের মেহমানখানায় আসার বিস্তারিত বিবরণ শোনাতে চাইলাম। আসলে আমার গন্তব্য ছিল এখান থেকে আরো পঁচিশ মাইল দক্ষিণে। একটা থানা শহরের মেয়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল আলাপ। আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি সুদূর রাজধানী থেকে। অচেনা ভূগোল, বিদেশ বিভূঁই। আসলে আমার ভুল হওয়াটা একারণেই স্বাভাবিক ছিল। কেননা, এই দরবার শরীফের ওপার যে লঞ্চ স্টেশন, সেটাও একটা থানা শহর। রাত তিনটার দিকে লঞ্চের সঙ্গে পণ্টুনের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যায় আমার। আমি তখন ঘুমকাতুরে চোখে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সেখানে নেমে পড়লাম। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম, লঞ্চটা দীর্ঘ হুইসেল দিয়ে ব্যাগারে টান দিল আর ওটা ধীরে ধীরে শাখা নদী থেকে বড় নদীতে পড়ল। আমি বুঝতে পারলাম ঠিক গন্তব্যে আমি পৌঁছতে পারিনি। আস্তে আস্তে যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে চলে গেল আর আমি অন্ধকারে পণ্টুনের পুরোনো লোহার পাতের ওপর বসে রইলাম। তখন ঊর্ধাকাশ থেকে পণ্টুনের চারিধারে কেমন একটা নীরাবতা নেমে এল আর আকাশের তারাগুলো ক্রমশ নিভে যেত লাগল। নিস্তব্ধতা বড় ভয়ঙ্কর! তাকিয়ে দেখলাম, আমার চারপাশটা যেন বোবা হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। তিনমুখো নদীর প্রত্যেকটি মুখ নির্বাক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাঝেমাঝে শুধু শোনা যায় বড়শিঅলার নৌকায় বৈঠার ছপছপানি। আমাকে রেখে যাওয়া লঞ্চটা চোখের সামনে
ক্রমশ ছোট হতে লাগল আর লঞ্চের বাতিগুলো কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি তখন ঠিক জানিনা, আমার কী করা উচিৎ! একমুখো নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে মনের ভেতর একটা দুঃখ দুঃখ ভাব জমা হতে লাগল। ধূসর, বিজন নদীর দুই তীর। গভীর এক বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ছে দুইতীরে। আমি পুরনো দিনের স্মরণীয় সময়গুলোর কথা মনে করতে লাগলাম। আমি আমার প্রেমিকাকে ফোন করতে পারতাম, কিন্তু আমি পথ ভুলে যে বোকামোটা করেছি এটা তাকে জানাতে চাইলাম না। আর এজন্যই হয়ত নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে আমার ভেতর পেছনের দুঃখগুলো জেগে উঠল। ভোরের রক্তিম ছটা ধূসর আকাশের বুক থেকে তারাদের শেষ চিহ্নটুকু মুছে নিচ্ছে। আস্তে আস্তে পূবদিকের আকাশ ফর্সা হয়ে উঠল। আর তখন পণ্টুনের খুব কাছ দিয়ে একটা জেলের নৌকা ঝুপঝুপ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি মাঝিকে থামিয়ে সমস্যাটা আলাপ করলাম। জেলে লোকটা এই দরবারের মেহমানখানার কথা জানিয়ে এপার নামিয়ে দিল। লোকটি শুকিয়ে যাওয়া কাঠের পাটাতন থেকে উঠে বসল। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছ ঘেঁষে বসে কালো ঠোঁটদুটো চুকচুক করল কিছুক্ষণ। দৃশ্যটা যে কারও কাছে বিরক্তিকর লাগবে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলাম। তখন উত্তরের বাতাস একটু ঘূর্ণি দিয়ে পূবের দিকে সরে গেল। দরবারের পাকশালা থেকে গরম ভাত আর ডালের সুবাস আসে। লোকটা ঠোঁট চাটতে চাটতে বলল, চলেন, খাওয়াদাওয়া সেরে আসি। বোডিংঘরে যেতে যেতে কুঠারে ফাড়া কতগুলো কাঠের স্তুপ দেখলাম, আর আমি লোকটিকে বললাম, দুপুরে কাঠুরে লোকটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। লোকটি গাট্টাগোট্টা আর পেটানো শরীর তার। কুঠার মেরে অনায়াসেই কাঠ ফালাফালা করে আর দরদর করে ঘাম নামে ওর শরীর থেকে। আর আমি ওর থেকে জানতে পেরেছি এই কাজ থেকে না-কি ভালো মুজুরি পাওয়া যায়। এই মজুরির কথা শুনেই লোকটা বলল- খাবার আগে আপনাকে একটা কারখানার কথা শোনাতে পারি। সেখানে ছায়ায় বসে কাজ করেও আপনি বেশি পারিশ্রমিক পেতে পারেন। আর এই কারখানাটা আমাদের গ্রামে আর সেখানে যে কেউ চাইলে বেশি মজুরিতে কাজ নিতে পারে। বলতে পারেন কাজটা মাঝারি পরিশ্রমের। আপনাকে কখনো রোদে পুড়তে হবেনা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুঠার মেরে কাঠ ফাড়তে হবেনা আর কাজটা এমন
ভাড়িও কিছু নয়। আপনি মাথার উপর একটা চালা পাবেন আর রোজ সর্বোচ্চ মুজুরিতে লেবারের কাজ করতে পারবেন। নদী তীরবর্তী উত্তরমুখি চারটা কারখানা আছে সেখানে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কারখানায় অনবরত পাথর কাটার খুট খুট শব্দ হয়। সূর্য লাল হয়ে ওঠার সময় প্রত্যেকে হাজার টাকার নোট নিয়ে বাড়ি ফেরে। আপনি চাইলে সেই শিলপাটার কারখানায় কাজ করতে পারেন। যদি আপনার মনে হয় এই কাজটা আপনার জন্য সহজ আর ভালো আয়ের পথ, তাহলে আপনি অনায়াসে কাজটা শুরু করতে পারবেন। এজন্য আপনাকে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দিতে হবে আর দিন পাঁচেক হাতের কাজের ট্রেণিং। আপনি জানলে অবাক হবেন, ট্রেণিং শেষ হলে আপনি অগ্রিম টাকা পাবেন পঞ্চাশ হাজার। আপনি নিজের জীবনের পরিবর্তন আনতে পারবেন আবার চাইলে আপনার পরিবারের জন্যও টাকা পাঠাতে পারবেন। কিন্তু এই সহজ কাজটির উপসংহারে আছে যমদূতের ছায়া আর করুণ মৃত্যু। আমরা মেহমানখানার নিচে নামলাম। নদী পাড়ের সান বাঁধানো ঘাটের ওপর দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। উত্তর থেকে দূরগামী একটা লঞ্চ এসে ওর গতিটা শ্লথ করে দিল। মাজারের কাছে লঞ্চের ভেতরের অপুষ্ট আলো আঁধার ঠেলে ঘাটের ওপর পড়ছে। জানালার ধারে এক মোটাসোটা মহিলা ছোট বাচ্চাকে বুকের সাথে চেপে রেখেছে, ঝাল-মুড়িঅলার হাতের তালুতে কৌটা পেটানোর শব্দ শুনে জিভে জল এসে যাচ্ছে। লোকটি আমাকে বলল-মাজারটা খুব গরম ছোটভাই! ইঞ্জিনচালিত সবকিছু মাজারের কাছে এসে গতি শ্লথ করে। আর এভাবে ওরা মৃত আত্মাকে পবিত্র ভেবে সম্মান জানায়। আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে মাজারের প্রতি ইঞ্জিনচালিত যানের সম্মান প্রদর্শন দেখলাম। আমার কেন যেন মনে হল, ওই কারখানার সাথে লোকটির এই মাজারে আসার নিশ্চয়ই কোনো গোপন যোগসূত্র আছে। আর আমি নিঃসংকোচে তার কাছে সেই কারণটা জানতে চাইলাম। লোকটি তার মেয়ের কথা বলল। মেয়েটা জন্মাতে তার পায়ে শেকল পরে গেল। কাজে-অকাজে দূর- দূরান্তে যাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গেল তার ধানখেতের আগাছাগোলো যেমন তরতর করে বড় হয়, মেয়েটা সেরকম অযত্নেই বেড়ে উঠতে লাগল। বারো-তেরো বছরে একটা অসুখ ধরা পড়ল ওর। অসুখটা মুত্রনালীর। ডাক্তার বলল- ইউটিআই। মেয়েটার পিঠের নিচ থেকে ব্যথা শুরু হয়ে উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। প্রথম প্রথম ব্যথাটা হজম করে নিত মেয়েটা। কখনো মায়ের পেটে থাকা বাচ্চার মত বিছানায় দলা-মোচড়া হয়ে পড়ে থাকত।
আবার কখনো পুকুর ঘাটের দিকে কোমড়ে হাত রেখে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। শেষে সইতে না পেরে মুখ খুলল মেয়েটা। আর এই ব্যথার সুবাদে বাড়ির সবচেয়ে বুড়ো লোকটি বলল, একমাত্র বিয়ে দিলেই এই রোগের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। মেয়ের মা এমনভাবে ধরল, বিয়ে না দিয়ে আর উপায় ছিল না।
-বয়স কম হলেও ওই ঘোর দুষ্কালে মেয়েটা বিয়ে দিতে পেরেছেন এটা তো ভালো খবর। আমি তাকে বললাম। না। তেমন কিছু না। ব্যপারটা এমনই জটিল আর মর্মান্তিক হয়ত এ মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারছেন না আপনি। আমি তার কাছে কৌতুহলী হয়ে থাকতে চাইলাম না। ঘাট থেকে এই দরবারের প্রধান খাদেমের বাড়ি খানিক দূরে। বাড়িটা পেরিয়ে যাবার সময় ঘরের ভেতরের হাসির হররা, মৃদু চিৎকার, মেয়েলী কণ্ঠের খালি গলায় চাপাস্বরের গান খুব ভালো লাগছিল আমাদের আর রাতের খাবারের প্লেটের টুটাং শব্দ খিদেটা আরো উসকে দিল। একটু বামে এগিয়েই খানাপিনার বোডিংঘর। খোলা মাঠ, তীরতীরে হাওয়া মাঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। লোকটি তার মেয়ের কথা আবার বলতে লাগল। মেয়েটির বয়স সবে উনিশ। স্বামীর মৃত্যুর পর একটা বাচ্চা নিয়ে মেয়েটি যখন অকূল পাথারে তখন এক কথিত দেবতার সন্ধান পেল মেয়েটি। যে বাড়িতে কাজ করতে যায়, বাড়ির মালিকের পেটের ভূঁড়িটা যেমন মোটা তেমন পয়সাওয়ালা। লোকটা মেয়েটিকে আড়ালে ফুঁসলাত। দূরে ব্যবসার কাজে গেলে আড়ালে বলত ওর ভ্রমণসঙ্গী হতে। আর এই আব্দারের সাথে লোকটা মেয়েটির চোখের সামনে বাড়িয়ে ধরত চকচকে নোট। আর সে আরো লোভ দেখাত যা একটি অসহায় মেয়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লোকটি মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিত। সে ছিল পঞ্চাশোর্ধ, আধাজলা মাথা, মস্তভূড়ি আর বেটে। ঘণো গোঁফগুলো তা দিতে দিতে কেমন কামুকের মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকত। আর মেয়েটাও হয়ত চকচকে নোটের মোহে লোকটার আহ্বানে সাড়া দিতে লাগল। ব্যবসার নাম করে লোকটা প্রথমে মেয়েটাকে নিয়ে গেছে মোংলা পোর্ট। তারপর খুলনার গল্লামারি পার্কে ঘুরেটুরে সন্ধ্যায় ঘাটের কাছাকাছি একটা হোটেলে। মেয়েটা লোকটির সাথে কয়দিনের ঘোরাফেরার ঠাটবাট আর আর্থিক জৌলুস ইতোঃপূর্বে দেখেনি। অথচ মেয়েটার বিগত জীবন ছিল দারুণ অর্থবহ আর আনন্দময়।
মাঠের পথটুকু শেষ হতে খাদেমের বাড়ির টিভির আলোর রেখা পায়ের কাছে পড়ল। কেমন অশুদ্ধ আর ম্যরম্যারে কণ্ঠে একটা মেয়ে সংবাদ পড়ছে। আমরা খাদেমের বাড়ি পেছনে রেখে বোডিংঘরে ঢুকলাম। একদিকে হেলেপড়া কাঠের দোতলা ঘর। কাঁচা কাঠের ধোয়ার গন্ধে ঘরটা ভোঁ ভোঁ করছে। আমাদের দুজনের সামনে দুটো প্ল্যাস্টিকের প্লেট দেয়া হল। হাত ধোবার আগে এক জাপসিওয়ালা, কল্লিদার জামাপরা লোকের হাতে টিকিট দিলাম। লোকটি চিবানো পানের গুঁড়ো ছিটিয়ে বলল- পান খাওয়ার পয়সা দ্যান, প্যাটঠিকা খাওয়াব। বোডিং ঘরটা পনেরো ষোলোহাত লম্বা। দু’মাথায় দুটো মৃদু পাওয়ারের কাঁচের বাল্ব। উঁচু-নিচু মাটির পাতালে বিছানো চটের বস্তা। বাতির আলোয় পাতলা ডালের ওপর তেল চকচক করছে। খেয়েদেয়ে দুজন এতিমখানা মাঠের দক্ষিণ দিকে দাঁড়ালাম। সামনে খোলা জমিন, বাড়ি-ঘর নেই। বহুদূরে অন্ধকারেও কয়েকটা গাছের ফোকর দিয়ে নদীটা দেখা যায়। আমি লোকটার কাছে আবার মেয়েটির বিষয় জানতে চাইলাম। লোকটা জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের পাতায় রাতের আঁধার রহস্যময়ভাবে খেলা করছে। তার ভ্রুযুগোল এমনভাবে নড়াচড়া করছে তাতে তার চোখের অভিব্যক্তিটা আমার চোখে সরলভাবে ধরা পড়ল। সে যে ঘটনার বিবরণ দিল আর ঘটনাটা ছিল মর্মান্তিক আর বেদনার। রাজেশপুর পূর্বপাড়া আমাদের গ্রাম। এখানে ভারতের ভূ-খণ্ড বাংলাদেশের পেটের ভেতর এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যাতে মনে হয় একটা তীরের চওড়া মাথা এপারে শক্তভাবে গেঁথে আছে। সীমান্তের ওপারের অঞ্চলকে বলা হয় নগর। ভারতের ভেতর থেকে একটা জিরিয়ে নেওয়ার মত দীর্ঘ জঙ্গল পাড়ি দিয়ে লোকজন সীমান্তের ছোট্ট খালের পাড়ে নগরে জড়ো হয়। যদিও এপাড়ের মানুষ ওদের নিজভূমে বসবাস করার জন্য স্বাগত জানায় না। তবে এপাড়ের সমতল ভূমি, ইরি ধানের খেতের ওপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাস ওদের দৃষ্টি জুড়িয়ে দেয়। আর বিস্তৃত সরেজমিনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু মেহগিনির বাগানের নিরিবিলি পরিবেশ ওদের ইশারায় আহ্বান করে। ওদের অনেকেই কাঁটা তারের বেড়ার সাথে জড়িয়ে থাকা লতা, যা কিছু সমতল ও নতুন এবং এপারের ছোট ছোট খুপরি ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকে, যতক্ষণ না ওদের পলক পড়ে। ওদের নিস্পলক চাহনি মনে হত ক্লান্ত পশুর মত।
মাঝেমধ্যে এত বেশি আবেগাপ্লুত হত, ওরা কাঁটাতার দু’দিকে বাঁকিয়ে দলবেঁধে এপার ছুঁটে আসত। যদি সেটা দিন-দুপুর হত তখন বিএসএফ বন্দুকের নল আকাশের দিকে তাক করে ফাঁকা গুলি ছুড়ত আর তখন ওরা দলছুট হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। আসলে ওদের প্রধান উদ্দেশ্য এপারের কারখানায় ভালো পারিশ্রমিকে কাজ করা। দু’দেশের যে কোনো পণ্য এখানে সহজে পাওয়া যায়। বিশেষকরে চোরাই পথে কিছু পাথর আসে এখানে। আর লোকজন পাথর নিয়ে যায় দেশের আনাচে কানাচে বিভিন্ন কারখানায়। ওসমান নামের এক লোক প্রথমে এখানে কারখানা খোলে। সে জোয়ান ছেলেদের দাদন দিতে থাকে। বিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার, আশি হাজার। নতুন টাকা পেয়ে জোয়ন ছেলেদের জীবনমানে পরিবর্তন আসে। ওরা দামি ফোন কেনে, পছন্দের মদ আর সীমান্তে ওপারের নারী। ওরা প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত সীমান্তের খোলা বিলে দল মিলিয়ে ওপারের তরুণদের হাই দিতে থাকে। তারপর ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে মেহগিনির বাগানে ঢুকে পড়ে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে চাঁদের আলো নড়াচড়া করে। ওরা বাগানের মাটিতে গামছা বিছিয়ে পরস্পর আলাপ জমায়। ওদের আলাপের বিষয়বস্তু সীমান্তের ওপারের দীর্ঘ জঙ্গলের অপার রহস্য, চোখের পলকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া চোরা কারবারি আর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কাঙ্ক্ষিত নারী। ওরা ওসমানের প্রসংশা করে আর ওর মেয়ের নিতম্ব নিয়ে কথা বলে। ওসমানের মেয়ে ওদের সামনে দিয়ে যখন পাছা দোলাতে দোলাতে চলে যায়, ওরা সান্ধ্যকালীন আকাশে উজ্জ্বল তারাটি দেখার মত ভ্রু কুঁচকে ওসমানের মেয়ের দিকে তাকায়। ওসমান ওখন দূরে বসে দৃশ্যটা দেখে আর মুখটিপে হাসে। সে সাদা স্ট্যাম্পে দাদনের বিপরীতে স্বাক্ষর নিয়ে দেখকদের জন্য কারখানায় কাজ শুরুর প্রহর গোনে। অবশেষে একদিন কারখানায় চালু হয়। সকালে বাইরের আবহাওয়া সম্পূর্ণ তপ্ত হওয়ার আগে কারখানায় শুরু হয় বাটাম আর ছেনির ঠুকঠুকানির শব্দ। শ্রমিকরা টুকরো পাথর নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে খুঁটেখুঁটে ঝুরে ফেলে। তারপর ছেনি দিয়ে সাইজ করে কেটে ফিনিসিং দেয়। জোয়ান ছেলেগুলোর হাত খুব ভালো চলে। ওরা প্রভাতের একটু পরে কাজ শুরু করে আর একবিন্দু আলোর সময়টুকুও অযথা ব্যয় করে না। আর ওরা প্রতিদিন বিকেলে কারখানার সামনে জড়ো হয়ে অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়। দিনশেষে চকচকে টাকায় ওদের কপালের ঘাম শুকিয়ে যায়। সন্ধ্যায় সীমান্তের জংধরা কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারের জঙ্গলে মেয়েদের ডেরায় গিয়ে ক্লান্তি দূর করে। ওরা লোভনীয় কাজের প্রতি ওপারের ছেলেদের আগ্রহ জাগায়। ওসমান এপারের মত ওপারের ছেলেদেরও কাজে নিয়োগ দিয়ে কারখানা বড় করে।
দিনে একেকজন শ্রমিক পাঁচ থেকে সাতখান পাথর সাইজ করে শিলপাটা বানিয়ে ফেলে আর ওসমান পাটাগুলো দেশের দূর-দূরান্তে পাঠিয়ে দেয়। আর তাতে সে কয়েকদিনেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠে। কিন্তু হঠাৎই সীমান্তের ওপর বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়। এনআরসি প্রশ্নে পুরো ভারতজুড়ে বাঙালিদের ভেতর শুরু হয় চরম উৎকণ্ঠা। চারদিকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে-বাঙালি খেদাও। কিন্তু খোদার আসমানের নিচে সবুজ ঘাসের প্রান্তরে ওরা বছরের পর বছর বেঁচেছে, ওদের মায়েরা বাচ্চা জন্ম দিয়েছে আর পোয়াতি হয়েছে স্ত্রীগুলো। ধর্মীয় পরিচয়ে ওদের আর মুক্তি মেলে না, যে কোনো ধর্ম কিংবা গোত্রের লোককে ভারতীয় আধারকার্ড থেকে বঞ্চিত করে ওদের বাঙলাদেশি বলে সাব্যস্ত করা হয়। আর এতে নিজেদের পূর্বপুরুষ আর শেকড়ের প্রশ্নে বেশ শংকিত হয়ে পড়ে ওরা। অসম এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় যারা শতবছর ধরে ভারতের সুযোগ ভোগ করেছে হঠাৎই তারা হয়ে গেল উদ্বাস্তু। যারা এক দু’শো বছর পারিবারিকভাবে ওখানে বসবাস করছে ওদেরকেও বিদেশি বলে ভারত সরকার জেলে পাঠাচ্ছে– যেন নিজভূমে পরবাস। পুরো ভারতের বাঙালি অধ্যূষিত অঞ্চল যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে, বাঙালিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আর পরিবেশ হয়ে উঠছে ক্রমশ উত্তপ্ত। সীমান্তে হঠাৎ পাহারা বেড়ে গেল, ওপারের শ্রমিকরা কাজে আসা বন্ধ করে দিল। ক’দিন আগেও সেই ভূমির কাঁটাতারকে যে কারো কাছে অদৃশ্য মনে হত, ওপার এবং এপারের মাঝে আত্মীয়তার পরিবেশ চোখে পড়ত অথচ সেই দৃশ্যটা এখন নিকট অতীত। ওসমান ওপারের দক্ষ শ্রমিকদের হারাল আর এখানেই ছিঁড়ে গেল দু’দেশের প্রাণের বন্ধন। সীমান্তের কাছে ওসমানের ব্যবসা নিয়ে লোকটি যে আলোচনা করছিল সেটা শুনতে দারুণ লাগছিল আমার। আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে এটা শোনাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সময়কে বসিয়ে না রেখে সুসমভাবে পার করে দেয়া যে কোনো বুদ্ধিমানের কাজ। আমি জীবনে এমন আশ্চর্য আর কৌতুহলতায় ভরপুর বিষয় নিয়ে আলোচনা খুব কম-ই শুনেছি। আমার ভেতরে টানটান উত্তেজনা চলছে আর আমরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এগিয়ে গেলাম। লোকটা প্রায় শতায়ু একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে বলল, আচ্ছা আপনার কি মনে হয় ওই গাছের পাতার ফাঁকে বসা পাখিগুলো এই মাজারের ভক্ত? লোকমুখে শোনা যায়, ওরা দিনের বেলায় ওই ডালে বসে চোখবুজে জেকের করে।
আর ওই যে মাঠের একপাশে মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাম্মামখানা, তবারকখানা আর মোছাফিরের বৈঠকখানা ওগুলোর প্রত্যেক খাতে খাতে গ্রামের ধর্মবিশ্বাসী লোকদের থেকে টাকা আসে। আর আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন, বড়সড় ডেসকিতে এত এত মানুষের রান্না হয়, ইট-বালুর তৈরি চৌবাচ্চা কিংবা বড় একটা হাউজ বলা যেতে পারে যেটাকে, ওটার ভেতর এত সের সের গুড় জমা হয়। আর প্রতিদিন কত সের চালের শিন্নি রান্না হয় এখানে! অথচ, পনেরো টাকা হলেও দাম দিয়ে খাবারের টিকেট কিনতে হয়। মাজারের খাদেম কর্তৃক দানের পয়সা তছরুফ করা কিংবা তার জৌলুসে জীবন ইত্যাদি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। জন্ম থেকেই আমি প্রকৃতির যেকোনো বিষয় নিয়ে অপেক্ষাকৃত কৌতুহলী। আর এজন্য আমি এখন ওসমানের শিলপাটার কারখানার ব্যপারে শুনতে চাই। লোকটির মতে সে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টির কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে— এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল কয়েকমাস পর। একজন দুজন করে শিলপাটা কাটার শ্রমিক শরীরের ওজন হারাতে থাকল।ওদের শ্বাসপ্রশ্বাস এমনভাবে ওঠানামা করে যাতে দূর থেকে বুকের পাঁজরের মাঝখানে জেগে ওঠা কড়ির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। ওদের গাল বসে যেতে থাকে আর চোখদুটো কোটরের ভেতর ফ্যালফ্যাল করে। এভাবে গ্রামের দশ-পনেরজন শিল পাটার কারিগর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ল। ওদের হৃৎস্পন্দন কমে যায়, চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে আর কথা বলার শক্তি নিমিষেই ফুরিয়ে যায়। মেসার্স রানা স্টোন হাউজের দুজন কারিগর বিছানায় পড়ল। কোনো এক জানুয়ারীর শীতের ভোরে প্রথম শ্রমিক মারা যায়। আমরা মৃত কারিগরের লাশটাকে উঠানের এক কোণে জামবুরা আর মেহেন্দি গাছের মাঝখানে এমনভাবে দাফন করলাম, যাতে মৃত আত্মা কিবলামুখি হয়ে মসজিদের যাবতীয় কার্যকলাপ অবলোকণ করতে পারে। সেসময় শীতের প্রচণ্ডতার মধ্যে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় গ্রামে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল। আর আমরা কিছুদিন প্রতিবাদ করে চুপ করে থাকলাম। ওসমান আমাদের বুঝিয়ে দিল এ রোগ ছোঁয়াছে আর এটা শত শত বছর ধরে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে। সভ্য সমাজে আমরা এটাকে যক্ষ্মারোগ বলে চিহ্নিত করতে পারি। আর এই মারণ রোগে কেউ মারা গেলে এতে ওর কারখানার কোনো দায় দায়িত্ব নেই। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মৃত্যুর সংবাদটি আসে মাসদুয়েক পরে। অসহনীয় ঠাণ্ডায় আমরা দুঃখ আর হতাশার মধ্যে ডুবে থাকতাম।
হিমালয়ের দিক থেকে প্রচণ্ড হিম বাতাস এসে চারপাশটা বরফের মত ঢেকে দিত। আমাদের পর্যাপ্ত শীতের কাপড় ছিলনা। শহর থেকে কিছু কম্বল আমাদের জন্য পাঠানো হত কিন্তু সংসারের বৃদ্ধ সদস্যের জন্য রেখে আমরা শীতে ঠুকঠুক করতাম। আর এভাবেই একদিন বসন্ত আমাদের জন্য আশীর্বাদের বাতাস নিয়ে আসে। সমতল ভূমির ওপর দিয়ে অতিবাহিত হতে লাগল সুন্দর ও আনন্দপূর্ণ হাওয়া। আমরা গ্রামবাসী নিজেদের সুখি অনুভব করলাম। আমার মেয়েটার বিয়ের বয়স তখন উনিশ মাস। নারী হিসেবে ওর পরিপূর্ণতা চূড়ান্ত পর্যায়ে কেননা ও একটা শিশুপুত্রের মা। বাচ্চাটা মাত্র একপা-দুপা হাঁটে। ছোটছোট বুলিতে কথা বলে আর প্রকৃতির যে কোনো সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি হাসে। বসন্তের সেই সময়ে মেয়েটার জামাই প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রথমে ওর শরীর অসাড় হয়ে যায়, তারপর কথাবলার শক্তি হারাতে থাকে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে। ওর গলা বুক শুঁকিয়ে হাড়গিলার মত দেখাত। শুধু একটা লাঠির ওপর ভর করে ঘরের ছোট্ট জানালার পাশে দুঃখ আর ভারাক্রান্ত মনে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু ওর শরীরটা এত অসহায় ছিল যাতে দাঁড়ানোটা মোটেও স্থায়ী হতনা। নিজের বাচ্চাটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাত আর মুখ থেকে স্বচ্ছ জলের ধারা ঠোঁটের কোণ গড়িয়ে পড়ত। আমরা তখন আর কি-ইবা করতে পারতাম! উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সুরহা না পেয়ে নিয়ে গেলাম মেডিকেল কলেজ। ডাক্তার হিস্ট্রি শুনে আমদের জানালো এটা যক্ষ্মার মত উপসর্গ হলেও রোগটা একেবারেই ভিন্ন। পাথরের গুঁড়া ধীরে ধীরে ফুসফুসে জমা হয়ে এমনভাবে অকার্যকর হয়ে গেছে, এর কোনো চিকিৎসা নেই। আর এই রোগটাকে বলে সিলিকোসিস। এখন আমরা সবাই ওর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারি। গ্রামের আরো লোক অসুস্থ্য হল, অনেক মহিলা সংসারের শুরুতেই বিধবা হল আর এক বৃদ্ধা হারাল একমাত্র পুত্রকে। মেয়েটা ঘরের এককোণে বসে অন্ধকারে চোখের জল ফেলত। শিশুটির মুখে দুধের বোটা গুঁজে দিয়ে বিরবির করে বলত- সিলিকন। এটা এমন একটি শব্দ যা মেয়েটির স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আর ডাক্তার এই শব্দটি প্রত্যেক স্বাক্ষাতের সময় বলত। মেয়েটির কাছে তো বটেই, আমার কাছেও মনে হত, সিলিকন পৃথিবীর এমন একটা বিষ যা পুত্রের কচি হাতের স্পর্শ থেকে পিতাকে নিমিষেই অনন্তলোকে নিয়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে অলস চিন্তায় মগ্ন থাকতাম।
এনআরসি আর শ্রমিক মৃত্যুর কারণে দারুণ অভাবে পড়লাম আর ঋণগ্রস্থ হলাম। মেয়েটিকে ব্যস্ত রাখতে আর আমার অভাবের কারণে পয়সাওয়ালা লোকটির বাড়িতে কাজে পাঠালাম। আর আপনি নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন, পেটের দায় বড় নিদারুণ। মানুষ ক্ষুধা আর দারিদ্র্যতার জন্য যে কোনো পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর এই নিয়তির অমোঘ নিয়মে বয়স্ক আর ভূড়িওয়ালা লোকটির সঙ্গে আমার মেয়েটি নিরুদ্দেশ হয়েছে। লোকটির সংসার হয়েছে হাবিয়া দোজখ। আমি শুনেছি লোকটি এই মাজার এলাকার কোথাও মেয়েটিকে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। অবোধ শিশুটির মায়ের জন্য ব্যাকুলতা আমাকে প্রতিনিয়ত আহত করে। আর ওর মুখের দিকে তাকালে দেখতে পাই খোদার প্রেরিত স্বর্গীয় দূতের ছায়া। শিশুটির কান্না আমাকে এই দরবারে টেনে নিয়ে এসেছে। আমরা মেহমানখানার দোতলায় নিশ্চুপ শুয়ে আছি। সামনের শাখা নদীটায় ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে, শতবর্ষী গাছের পাতার ফাঁক থেকে শোনা যায় পাখিদের ডানা ঝাপটানি। মনে হল, খোদার আরশ ছেদ করে একটা করুণ সুর এসে মেহমানখানার চারপাশে বাজছে। আমি লোকটির কাঁধের ওপর হাত রাখলাম।
অদ্ভুত রোগ। অদ্ভুত লেখকের বর্ণনাশৈলী। যদিও অসংখ্য কমন বানান ভুলের কারণে গল্পের মাধুর্য নষ্ট হয়েছে, হোঁচট খেয়েছি বারবার।
মোস্তফা অভি তাঁর নিজস্ব রীতির গদ্যশৈলীতে সমাজের নিচুতলা মানুষকে বরাবারই তুলে ধরেছেন সুন্দর বয়ানে