ছোটগল্প।। লালচানের চিঠি।। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
বলাই মুন্সীর বাড়িতে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। শুকনো মুখে উঠানে পা রাখতেই পুত্রবধূ মমতার মুখও কিঞ্চিৎ শুকিয়ে যায়। শ্বশুরকে দেখে এগিয়ে আসে। শ্বশুর বলেন, ‘না রে মমতা। আইজও কোন চিঠি আইলো না।’অলক্ষ্যেই মমতার চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক লক্ষ্য করা যায়। যথাসম্ভব সে ঝিলিক গোপন করেই দুঃখ দুঃখ ভাব এনে বলে- ‘থাউক বাবা, আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। দেইখেন, একদিন না একদিন চিঠি আইবোই।’ মমতার এমন সাহসের সুরে বলাই মুন্সী যেন কূল খোঁজার চেষ্টা করে। তবুও পাংশু মুখে বলে-‘মনডা যে মানে না মমতা। তোর মুখের দিকে চাইলে কইলজাডা হুগায়া যায়।’ মমতার শ্বশুর বলাই মুন্সী আর কিছু বলতে পারে না। মমতা শ্বশুরের সামনে লোকদেখানো চোখের জল মোছে। অন্য চোখে চিকচিক করে ওঠে নিষিদ্ধ সম্পর্কের চোরাবালি। তবুও শ্বশুরের হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। বৃদ্ধ মানুষ এতটা পথ হেঁটে এসে সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।বলাই মুন্সীর ছেলে জালালের চিঠি না এলেও পাশের ঘরের রহিমদ্দির ছেলে লালচান বিদেশ থেকে চিঠি ও ক্যাসেট পাঠিয়েছে। সেই চিঠি পড়ানোর জন্য লালচানের স্কুলপড়ুয়া ছেলে কালুকে ডেকে আনা হয়েছে স্কুল থেকে। বাড়ির সামনেই স্কুল। বাপ-দাদার ভিটায় স্কুল করার জমি দিয়েছে রহিমদ্দি। সেই স্কুলের শিক্ষকরা তার কথা শুনবে না, তা কি হয়? তাছাড়া বাপের চিঠি পড়বে ছেলে। তাই হেড মাস্টার ওকে ছুটিই দিয়ে দিল। কেবল একমাস হলো লালচান বিদেশ গেছে। লালচানের স্নানঘাটা বাজারে একটা মুদি দোকান ছিল। সেই দোকান আর বাপের জমি বিক্রি করার পর বাকি টাকা ধার-দেনা করে বিদেশ গেছে লালচান। বলতে গেলে গ্রামে এখন ঘরে ঘরে ‘বিদেশি’ আছে। ফলে চিঠি লেখা ও পড়ার জন্য স্কুলে পড়া ছেলে-মেয়ের কদর বেশি। উঠানের ওপর হোগলাপাটি বিছিয়ে মাঝখানে বসেছে কালু। কালুকে ঘিরে গোল হয়ে বসেছে দাদা-দাদি, ফুফু, চাচি, মা, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা। কালু জোরে জোরে পড়ছে-‘পরম শ্রদ্ধেয় বাবা-মা,পত্রের শুরুতেই আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও কদমবুছি গ্রহণ করবেন। আশাকরি আপনারা সকলেই ভালো আছেন। আমিও খোদার ফজলে আপনাদের দোয়ায় বিদেশের মাটিতে ভালোই আছি। পর সমাচার এই যে, আমি ভালোভাবেই বিদেশের মাটিতে পা রাখছি। সবকিছু গুছগাছ করে কাজে যোগ দিতে দিতে একটু দেরি হইয়া গেল। তাই চিঠি পাঠাইতে পারি নাই। এর জন্য আপনারা রাগ করবেন না। তাছাড়া আমি নিজে তো লিখতে পারি না।সে যা-ই হোক, খুশির খবর হইলো-আমি ভালো একটা কাজ পাইছি। খুব বেশি কষ্টের কাজ না। আমার মালিক অনেক ভালো। অন্য মানুষের মতো আমি সুইপারগিরি করি না। খেজুর বাগানের গাছও পরিষ্কার করি না। আমি মালিকের বাসায় আরামের কাজ করি। বেতনও মাশাল্লাহ ভালো। থাকার ব্যবস্থাও মালিক করে দিছে। তোমরা চিন্তা করো না। প্রথম মাসের বেতন পেলেই মানি অর্ডার করে পাঠায়া দিবো। আব্বা ও মা, আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। যে কয় টাকা দেনা হইছি, ইনশাল্লাহ আগামী ছয় মাসে শোধ কইরা দিতে পারবো। আপনারা আমার বউ-পোলার দিকে খেয়াল রাখবেন। ওরা যাতে কষ্ট না পায়। মন খারাপ না করে। কালুকে ঠিকমতো স্কুলে যেতে বলবেন। মানুষের মতো মানুষ হতে বলবেন।দেশে কেউ গেলে আব্বার জন্য চার্জার লাইট, মার জন্য জায়নামাজ, পোলার জন্য টেপ রেকর্ডার, বউয়ের জন্য গলার চেন পাঠিয়ে দিবো। বেশি না, একটা বছর দুবাইতে পড়ে থাকলে আর কোন চিন্তা নাই। মাশাল্লাহ, দুই হাতে টাকা কামাতে পারবো। আজ আর বেশি কিছু বলবো না। আমি তো লিখতে পারি না। পাঁচ মাইল দূরে এসে এক বাংলাদেশিকে দিয়া চিঠিটা লেখাইলাম। উনি বিএ পাস করে এখানে এসেছেন। খুব ভালো মানুষ। বাড়ির সবাইরে শ্রেণিমত আমার সালাম, শ্রদ্ধা ও স্নেহ জানাবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।ইতি, আপনাদের লালচান।’লালচানের পাঠানো চিঠি পড়া শেষে উঠানে যেন কান্নার রোল পড়ে গেল। ক্যাসেট শোনার কথা ভুলেই গেল। সবাই যে যার মতো কাঁদছে। কেউ বাবারে, কেউ ভাইরে, কেউ চাচারে বলে কাঁদছে-সে কী কান্না। সেই কান্নায় উঠে আসে কত স্মৃতি। লালচানের বাবা গামছা দিয়ে চোখের কোণা পরিষ্কার করেন। ধরা গলায় বলেন, ‘কই গেলা কালুর মা, চিঠিখান তোমার কাছেই রাখো। আর ক্যাসেটটা তো হোনা হইলো না। থাউক, তোমার ধারে রাইখা দেও। পরে হুনমু।’ কালুর মা মনে মনে খুব খুশি হয়। মনে মনে ভাবে, রাতে একা একা কালুকে দিয়ে চিঠিটা আবার পড়াবে। শত হলেও লালচান তার স্বামী। লালচানের উঠানে কান্নার উৎসব দেখে মমতার চোখেও পানি আসে। এ কান্না নাড়ি ছেড়া ধনের। এ কান্না আবেগের। এ কান্না ভালোবাসার। এভাবে কাঁদতে পারলেও মনটা হালকা হয়। মমতা কাঁদতেও পারে না। মমতা জানে, প্রিয়জন দূরে থাকলে মাঝে মাঝে কাঁদতে হয়। মন উজাড় করে কাঁদতে হয়। কান্না চেপে রাখতে হয় না। চিৎকার করে কাঁদতে হয়। তাহলে বিরহ-ব্যথা কিছুটা প্রশমিত হয়। মমতা তাই কান্নাভেজা চোখেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে ঘরে যাওয়ার তাড়া দেয়। তা না হলে তারা আরও ভেঙে পড়বে।