ছোটগল্প।। স্বস্তি।। পলাশ মজুমদার
হঠাৎ এত ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাবেন, তা কয়েক বছর আগেও তৌফিক আলম ভাবেননি। তাঁর অবস্থা এমন হয়েছে, বলা যায়, আঙুল ফুলে কলাগাছ।
বেশির ভাগ আঙুল ফুলে কলাগাছদের উত্থানের পেছনে রয়েছে দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের কাহিনি। কিন্তু তৌফিক আলমের ক্ষেত্রে তা নয়; তাঁর কোনো টাকাই অবৈধ নয়। তিনি জড়িত নন কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে। তাঁর জীবনটা একেবারে কাচের মতো স্বচ্ছ। তাঁর সব কর্মকাণ্ড স্পষ্ট। কখনো কোনো অন্যায়ের সঙ্গে তিনি আপস করেছেন, তা কেউ বলতে পারবে না।
তিনি কত টাকা বেতন পান, কোন টাকা কোত্থেকে আসে, কোন টাকা কোন খাতে খরচ হয়—সব তিনি একটি খাতায় লিখে রাখেন। এটা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। চলার পথে কোনো অযাচিত অর্থ সমাগম তিনি কখনো মেনে নেননি, এমন প্রখর তাঁর আত্মসম্মানবোধ।
তবু প্রায় সময় তাঁর মনে হয়, এই টাকা ঠিক নিজের নয়। তাঁর কাছে স্রোতের মতো টাকা কেবল আসছে, যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় রাতারাতি তিনি এখন অঢেল বিত্তবৈভবের অধিকারী; অকস্মাৎ তিনি পেয়ে গেছেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ।
তৌফিক আলম ছিলেন নির্দিষ্ট বেতনের চাকুরে। থাকতেন সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে। মোটামুটি আয় দিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল সংসার; স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সেখানে অভাব ছিল না সত্য, তবে স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল না। বিশ বছর চাকরি করেও তিনি ঢাকা শহরে একটি ফ্ল্যাট বা এক টুকরো জায়গার মালিক হতে পারেননি। অবশ্য ফ্ল্যাটের কথা তিনি কোনোকালেও ভাবেননি।
স্থায়ী সম্পদ বলতে তাঁর কিছু ছিল না। এ জন্য তিনি আফসোস করেননি কখনো। আফসোস করার মতো সময় কোথায় তাঁর! তিনি তো সব সময় ডুবে আছেন নিজের মধ্যেই। তাঁর যে নিজস্ব একটি জগৎ আছে, সেখানে তিনি স্বয়ং নৃপতি। জগদীশ্বর।
তাঁর এ ভাবনার জগৎ নিয়ে স্ত্রী সুরমার অভিযোগের অন্ত ছিল না। প্রায় কথা শোনাতেন সুরমা, কিন্তু তিনি কোনো কিছুই কানে নিতেন না। তাঁর এই নির্লিপ্ততা সুরমার মধ্যে জাগিয়ে তুলত পুরোনো ক্ষোভ।
সুরমার জন্য সজল নামের তাঁদের এক সহপাঠী দেওয়ানা ছিল। সুরমা তাঁকে পাত্তা না দিয়ে তৌফিক আলমের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাস্টার্সে পড়ার সময়। তখন ক্লাসের সবার মধ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার একটা তীব্র প্রবণতা ছিল। সুরমা সজলকে অগ্রাহ্য করে হাত বাড়ান তাঁর দিকে। সজলের গাড়ি-ফ্ল্যাট সব হওয়ার পর সুরমা মাঝেমধ্যে আফসোস করে বলতেন, সজলের সঙ্গে বিয়ে হলে তিনি অনেক ভালো থাকতেন।
তখন তৌফিক শুধু বলতেন—তুমি তো জেনেশুনে আমাকে বিয়ে করেছ। আমার সম্পর্কে কোনো কিছু তোমার অজানা ছিল না। তখনই কেবল চুপ হয়ে যেতেন সুরমা; এ বিষয়ে আর কথা বাড়াতেন না।
সুরমার সঙ্গে তাঁর বিয়েটা হয়েছিল সুরমার ইচ্ছাতে। সুরমার মা-বাবা তাঁকে বিয়ে না করার জন্য অনেক বোঝালেও সুরমা তাঁদের কথা অগ্রাহ্য করে এই আত্মভোলা মানুষটিকে বিয়ে করেন। হয়তো তৌফিকের মধ্যে শিশুসুলভ যে সরলতা আছে, তা-ই সুরমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ ছিল; কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। তবে এটা সত্য, সুরমা ছাড়া তাঁর জীবনে আর কোনো নারী আসেনি।
তিনিও জীবনের এ দিকটি নিয়ে কখনো ভাবেননি। শুধু কলেজজীবনে সরস্বতী নামের সহপাঠিনী এক হিন্দু মেয়েকে ভালো লেগেছিল তাঁর। ব্যস, এটুকুই। সে কথা তিনি কারো কাছে কখনো প্রকাশ করেননি; মেয়েটির কাছেও নয়। মনের কথা মনেই চেপে রেখেছেন। এমনকি সুরমাকে তা বলেননি; বললে হয়তো সুরমা কথা প্রসঙ্গে খোঁচা দিত কখনো।
আশপাশে কে কী বলল, তা নিয়ে তিনি কোনো সময়ে মাথা ঘামাননি। তিনি সব সময় চলেছেন নিজের মতো। তথ্য অধিদপ্তরের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও তিনি ধরে রেখেছেন পুরোনো অভ্যাসটি।
বেসরকারি চাকরি করলে বই পড়ার জন্য সময় পাবেন না বলে ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি ছেড়েছিলেন ব্যাংকের চাকরি। অথচ তাঁর সহপাঠী ব্যাংকার বন্ধুরা অনেক আগেই গাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন; পদোন্নতি পেয়ে তরতর করে এগিয়ে গেছেন শীর্ষ পদে। দিনে দিনে বেড়ে যায় সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য। এসব ভেবে তিনি বন্ধুদের কোনো প্রোগ্রামে যেতেন না; বরং সবাইকে এড়িয়ে চলেছেন সব সময়।
ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর বই পড়ার অভ্যাস। বিশেষত সাহিত্য, দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাস তাঁর বরাবরই প্রিয়। পড়তে পড়তে চাকরিজীবনের শুরুতে হঠাৎ লেখা শুরু করেন একটি উপন্যাস। প্রায় তিন বছর ধরে একটু একটু করে এটি লিখেছেন তিনি। তাঁর ধারণা ছিল উপন্যাসের মাথামুণ্ডু কিছুই হয়নি। অনেক দিন ধরে এটি ড্রয়ারের ভেতর ফেলে রেখেছিলেন; ভুলেও গিয়েছিলেন হয়তো।
পাঁচ বছর আগের সেই দিনের কথা তৌফিক আলমের প্রায়ই মনে পড়ে। কেন নজরে পড়ল খরবটা! যদি অনেক সংবাদের মতো এটিও তাঁর নজর এড়িয়ে যেত। তাহলে আজ তাঁর ভাগ্য এখানে এসে দাঁড়াত না। তিনি থাকতে পারতেন নিজের মতো করে।
সেদিন শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালবেলায় পত্রিকার পাতা ওল্টাতে গিয়ে তিনি ভেতরের পাতায় হঠাৎ দেখতে পান ছোট্ট খবরটি। একটি জাতীয় দৈনিক ঈদ সংখ্যার জন্য অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়সি বাংলাদেশিদের কাছ থেকে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আহ্বান করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বয়সের হিসাব করেন তৌফিক; দেখেন, ওই তারিখে তাঁর চল্লিশ বছর হতে এক দিন মাত্র বাকি।
কী ভেবে যেন তৎক্ষণাৎ বের করেন পাণ্ডুলিপিটি। উল্টেপাল্টে দেখেন। শুরুতে-মাঝে-শেষে পড়ে খারাপ লাগছে না। তখনই ল্যাপটপ নামিয়ে শুরু করলেন টাইপ। অফিসের বসকে বিশেষ কাজের কথা বলে পনেরো দিনের ছুটি নিলেন; ডুব দিলেন লেখালেখির মধ্যে। প্রথম দশ দিনের মধ্যে টাইপ করা শেষ। তারপর শুরু করলেন সম্পাদনা। তিনি খেয়াল করে দেখেন, উপন্যাসের চেহারা একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এটি তিনি লিখেছেন।
সিরিয়াসলি লেখালেখি করেন একদিন এমন এক সাহিত্যিক-বন্ধুকে পড়তে দিলেন পাণ্ডুলিপিটি। তখন তৌফিকের চোখে-মুখে দ্বিধা স্পষ্ট ছিল, যেন তিনি গর্হিত কোনো কাজ করতে যাচ্ছেন। তবে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন; বন্ধুটির কাছে নিজের নাম প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন, উপন্যাসটি দেবাশীষ বড়ুয়া নামে তাঁর এক সহকর্মীর লেখা; নতুন লেখক হিসেবে সহকর্মীটি তাঁর মতামত জানতে চাইছে।
দিন সাতেক পর বন্ধুটির প্রতিক্রিয়া জানতে পারেন তিনি; বন্ধুর প্রশংসায় তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাসে যেটুকু ঘাটতি ছিল, তা পূরণ হয়ে গেল। বন্ধুটি জানান, এটা নতুন হাতের লেখা নয়। বেশ পাকা লেখা। চালিয়ে গেলে বাংলা কথাসাহিত্যে এই লেখকের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অবধারিত।
অবশ্য কথাগুলো জানিয়েছিলেন ফোনে, তাই তাঁর মুখের রেখা বন্ধুটি দেখতে পাননি; দেখলে হয়তো ঠিক বুঝে ফেলতেন। আর তিনি মুখ লুকাতেন ধরা খাওয়ার লজ্জায়।
প্রতিযোগিতার একেবারে শেষ দিন তিনি উপন্যাসটি মেইল করে পাঠিয়ে দিলেন পত্রিকার নির্ধারিত ঠিকানায়। পাঠানোর সময়ও তাঁর ধারণা ছিল, এখানে অনেক ভালো ভালো পাণ্ডুলিপি জমা পড়বে; তাঁর লেখাটি পাত্তাই পাবে না। তিনি একরকম আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো কাজে যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
হঠাৎ একদিন অচেনা নম্বর থেকে ফোন। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর কণ্ঠটি তাঁকে জানায়, আপনার পাঠানো উপন্যাস ‘দ্বীপবাসিনী’ আমাদের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে।
এ কী শুনছেন তিনি! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সারা শরীরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন তিনি।
তারপর ঈদ সংখ্যায় ঘোষণা দিয়ে তাঁর উপন্যাস প্রকাশ করল পত্রিকাটি। উপন্যাসের নামের নিচে বড় বড় অক্ষরে তাঁর নিজের নাম দেখে চোখ ছানাবড়া। তিনি অনুমান করতে পারছিলেন, তাঁর জীবনের গতি অন্যদিকে বাঁক নিতে যাচ্ছে। স্ত্রীকে এই কথা জানাতেই তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। বলেন, লঙ্কা অনেক দূর!
তৌফিক আর কিছু বলেন না।
এদিকে ধন্য ধন্য করতে লাগল পাঠক। এসব শুনে তিনি লাল হয়ে উঠছেন লজ্জায়। কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক যখন এই উপন্যাস নিয়ে কথা বললেন, তা নজর কাড়ে সাহিত্যবোদ্ধাদের। সেই কথাগুলো সংযুক্ত করা হয় বইটির ভূমিকা অংশে। বইমেলায় বাংলাবাজারের এক স্বনামধন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা হয় উপন্যাসটি।
প্রতিযোগিতায় প্রথম না হয় হলেন, কিন্তু উপন্যাসটি যে এত পাঠকপ্রিয়তা পাবে, এক বইমেলায় যে বইটির ছয়টি মুদ্রণ প্রকাশ হবে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি। মেলার প্রথম দুদিনেই প্রথম মুদ্রণ শেষ। প্রথম মুদ্রণে এক হাজার কপি হলেও কাটতি দেখে প্রকাশক পর্যায়ক্রমে প্রতি মুদ্রণে কপি সংখ্যা বাড়াতে থাকেন; যথাক্রমে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৪০ হাজার এবং সর্বশেষ ৫০ হাজার কপি।
গত পাঁচ বছরে বইটির ত্রিশটি মুদ্রণ বের হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে প্রতি মুদ্রণে ছাপা হয়েছে এক লাখ কপি। প্রকাশক পূর্ণাঙ্গ হিসাব দিয়ে এই বইয়ের রয়্যালটি বাবদ এই পর্যন্ত দিয়ে গেছেন প্রায় আশি লাখ টাকা।
সেই মেলা শেষে অন্যান্য প্রকাশকও তাঁর কাছে ধর্ণা দিয়েছেন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দেওয়ার জন্য। প্রকাশকদের এই তীব্র চাহিদা মেটানোর জন্য এই পাঁচ বছরে তিনি উপন্যাস লিখেছেন বিশটি। ওই বইগুলোর রয়্যালটি অগ্রিম দিয়ে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেছেন প্রকাশক। প্রতি মুদ্রণের আগেও পাচ্ছেন চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা।
তার ওপর আছে লেখা দেওয়ার জন্য চাপ। কেবল প্রকাশক নয়, পত্রিকাওয়ালাদের চাহিদাও মেটাতে হয়। তারাও অগ্রিম টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। সাক্ষাৎকারের জন্যও চাপ থাকে। তিনি টিভিতে যেতে অনিচ্ছুক। বিভিন্ন পত্রিকা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রকাশনাকে মুখের ওপর না করতে পারেন না। তাই মাঝেমধ্যে তাদের দাবিও মেটাতে হয়।
‘দ্বীপবাসিনী’ প্রকাশের এক বছরের মাথায় পেশাগত ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। চাকরি করে এত লেখা সম্ভব হচ্ছে না বলে হুট করে ছেড়ে দিলেন চাকরি। তিনি ভেবে দেখলেন, চাকরিটা তো আলটিমেটলি টাকার জন্যই। ওই সময় অনুভব করলেন, লিখে তিনি যে আনন্দ পাচ্ছেন, তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। টাকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সম্মান, ভালোবাসা তো এর কাছে নস্যি। মনে হচ্ছে, তিনি প্রতিনিয়ত আনন্দের সাগরে ভাসছেন। তবু মনের কোণে খেলা করে এক বিপন্ন বিস্ময়।
চাকরি ছাড়ার বিষয়টিতে তাঁর স্ত্রীরও সায় ছিল। সুরমার এখন তাঁর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। ঘুরতে ও কেনাকাটা করতে সুরমা খুব পছন্দ করেন; স্বামীর সীমিত আয়ের কারণে ইচ্ছাটা চেপেই রেখেছিলেন। সেই সুযোগ করে দিয়েছে তৌফিক আলমের লেখালেখি।
সুরমা এখন যা মন চায়, তা-ই কিনতে পারেন; তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করে নিচ্ছেন, যা এতকাল মনের নিচে চাপা পড়ে ছিল।
বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে তৌফিকের প্রায় আমন্ত্রণ আসে; সেসব স্থানের সাহিত্য সংগঠনগুলো তাঁকে পেতে উদগ্রীব। এমনকি আমন্ত্রণ পান দেশের বাইরে থেকেও। ইতিমধ্যে ১৫টি দেশে তাঁদের ঘোরা হয়ে গেছে। কেবল সুরমার কথা ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি দেশে-বিদেশে যেতে রাজি হয়ে যান। তাঁর উপস্থিতি মুগ্ধ করে আয়োজকদের।
তাঁর এই অভূতপূর্ব উত্থানে পেছনে লেগে যায় সাবেক বন্ধুরা। আগে যাদের কাছে তিনি পাত্তা পেতেন না, তারা এখন সমীহ করে কথা বলেন। যে বন্ধুর মাধ্যমে তিনি লেখালেখির জগতে পা রাখলেন, তিনিও লাগলেন পেছনে। আত্মীয়স্বজন টাকার জন্য এসে বসে থাকে। চারদিকে রটে গেছে যে তিনি এখন অনেক টাকার মালিক। প্রয়োজনমতো দিতে পারছেন না বলে তারাও অন্যদের কাছে তাঁর নামে নিন্দা শুরু করে।
সব খবরই কোনো না কোনো মাধ্যমে তাঁর কানে আসে। মনে আছে, ওই সময়ে চাকরি ছাড়ার পেছনে সহকর্মীদের ঈর্ষাকাতরতা ও উপদ্রবও ভূমিকা রেখেছিল। তা না হলে হয়তো তখন চাকরিটা তিনি ছাড়তেন না। তবে এসব তাঁর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি সব সময় ঝামেলা বাঁচিয়ে চলতেন। অথচ তাঁকে প্রতিনিয়ত অদেখা বাণে বিদ্ধ হতে হচ্ছিল।
তিনি এখন কোথাও বের হতে পারেন না। অটোগ্রাফের জন্য হামলে পড়ে লোকজন। বইমেলায় গেলে পুলিশ প্রটেকশন দিয়ে রাখতে হয়। প্রকাশক বিরক্ত হয়ে বলেন, মেলায় আপনার আসার প্রয়োজন নেই। বই তো চলছে। শুধু শুধু আমাদের ঝামেলায় ফেলে লাভ কী!
তাঁর মনে পড়ে, একসময় তিনি অফিস শেষে পুরো সন্ধ্যা ঘুরে ঘুরে মেলা থেকে বই কিনতেন। কত রকমের বই! বই নিয়ে বাসায় ফিরলে স্ত্রীর বকা শুনতে হতো—এত বই রাখব কোথায়! এমনিতে বলো টাকা নেই, বই কিনতে গেলে টাকা আসে কোথা থেকে! এ রকম হাজারটা অভিযোগ।
ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ব্যস্ততা এত বেড়ে যেত যে সুরমা খুব বিরক্ত হতেন। অথচ এখন তিনি মেলায় যেতে পারেন না; না যেতে পেরে বাসায় বসে হাঁসফাঁস করেন। তাঁর এই অবস্থা দেখে আড়ালে হাসেন সুরমা।
যখন তাঁকে কেউ চিনত না, তখন তিনি সব কাজেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। নিজের মতো পারতেন জীবন যাপন করতে। সম্পদের জন্য তিনি কোনো কালেও লালায়িত ছিলেন না। অনেক সময় বলতেন যে তিনি স্থায়ী সম্পদে বিশ্বাস করেন না; স্থায়ী সম্পদ যন্ত্রণার অপর নাম। এসব কথা শুনে তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই হাসত। ভাবত লোকটা আসলে পাগল।
সবাই তাঁর নিরাসক্ত জীবন নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করত। তিনি কোনো কিছু গায়ে মাখতেন না। তিনি জ্ঞানের পূজারি, জ্ঞানের সন্ধানে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতেন আর বই পড়তেন, সেখানেই পেতেন সুখ।
বই লিখে তৌফিক কেবল প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন তা নয়, ইতিমধ্যে তাঁর কিছু খাস ভক্ত জুটেছে, যারা তাঁর একটু সান্নিধ্য পেতে মরিয়া। কয়েক দিন আগে একজন ধনী ভক্ত যিনি কর্মসূত্রে ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থান করছেন, তাঁকে সপরিবার আমন্ত্রণ জানান বালি দ্বীপ ভ্রমণের জন্য। জানান, তাঁর এক টাকাও খরচ করতে হবে না। সুরমা ও মেয়েদের কথা ভেবে তিনি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।
বালিতে দিন চারেক ভ্রমণ শেষে ফেরার সময় নাগুরাহ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বন্ধু সজলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সজলও পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছিল; তিনি এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকের ডিএমডি। তাঁর টাকাপয়সা হওয়ার আগে সুরমা বারবার সজলের সঙ্গে তুলনা করতেন। হঠাৎ সুরমার সেই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে তাঁর। সুরমাকেও তা মনে করিয়ে দিলেন। কিছু না বলে সুরমা কেবল মুচকি হাসেন। সে হাসিতে বোঝা যায়, ওই সময়ের এমন ব্যবহারের জন্য সুরমা অনুতপ্ত।
ভিআইপি লাউঞ্জে বসে কথা বলার সময় সজলের কথায় বারবার প্রকাশ পায় যে তাঁর সাফল্যে সজল ঈর্ষাকাতর; কী নেই তাঁর! নাম-যশ-অর্থবিত্ত। কাক্সিক্ষত নারীর ভালোবাসা। পেয়েছেন মনের মতো জীবন। একজন মানুষের জীবনে আর কী চাই।
সজল তাঁকে আরো বলেন, দেখো আমাদের দুজনেরই আজ অনেক টাকা। কোনো অভাব নেই। পার্থক্য কেবল, আমাকে কেউ চেনে না। মরলে পরিবারের লোক ছাড়া কেউ কাঁদবে না। আর তোমার জন্য কাঁদবে দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত। তুমি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে।
সজলের মুখে এসব প্রশংসা শুনে তৌফিক তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না। একপর্যায়ে বলেন, আমি বরং আগেই ভালো ছিলাম।
ভালো লাগল গল্পটা।