ছোটগল্প

হাসান আজিজুল হক এর ছোটগল্প সাক্ষাৎকার


লোকটা গত শতাব্দীর কায়দামাফিক সূর্যাস্ত দেখছিল। তার চোখে ফুটে উঠেছিল তন্ময় কল্পনা : বাঁদিকে চওড়া নদী, সেখানে সূর্যের প্রতিবিম্ব ডুবে যাচ্ছে, খানিকটা স্রোত সিঁদুরের মতো হিঙুল, স্রোত পেরিয়ে বালির চড়া, ধূসর হতে হতে আস্তে মিলিয়ে যায়; লোকটার ডানদিকে বিরাট মাঠ, মাঠ উঁচু-নিচু, মধ্যে মধ্যে টিলা আছে। এতক্ষণ লাল রং মাখানো ছিল, এখন মিলিয়ে যাচ্ছে।

সূর্যাস্তের আগে এবং পরে অনেক কিছু দেখার থাক। সূর্যাস্তের পরে খানিকক্ষণের মধ্যে সব কিছু আঁধারে ডুবে গেলেও। তখন পাকা রাস্তার উপরে গরাদ আর ইস্পাতের পাত দিয়ে ঘেরা কামরা পিঠে বয়ে নিয়ে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালে তার টের পাবার কথা নয়। রাস্তার উপরে বুটজুতোর আওয়াজ সে খেয়াল করেনি। বুটজুতোগুলি চষা জমির উপরে নেমে ধপধপ শব্দ তোলে তাও তার খেয়ালে আসে না। কিন্তু যখন সে মোলায়েম মৃদু গলার কথা শুনতে পায় তার কানের কাছেই ‘আসুন’ তখন আর তার সচেতন না হয়ে উপায় থাকে না। সে পিছনে ঘাড় ফেরাতেই আবার মৃদু গলায় আহ্বান শুনতে পায়, আসুন। সঙ্গে সঙ্গে সে ফিরে আসে। তীরের অগ্রভাগের মতো সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণ বর্তমানের মুহূর্ত তাকে আগাগোড়া গেঁথে ফেলে।
যারা ডাকে তাদের সংখ্যা দুই কিন্তু তাদের ভালো দেখা যায় না। লোকটা শুধু টের পায়, তার ঘাড়ের নিচে থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত একটা হিম স্রোত নেমে গেল। একজন এগিয়ে এসে তার কনুইয়ের কাছে ধরলো। বরফের মতো ঠাণ্ডা স্পর্শ। লোকটা উল্টোদিকে ঝুঁকে পড়ে। বুটজুতোঅলারা তার ঘাড়ের কাছে খিমচে ধরে তাকে টেনে তোলে। তখন লোকটা তাদের অনুসরণ করে মাতালের মতো টলতে টলতে পাকা রাস্তায় এসে ওঠে। এতোক্ষণে সে হুমদো গাড়িটাকে দেখতে পায়। সেখান থেকে একজন আরো মোলায়েম গলায় বলে, এই যে এদিকে। বেশ কষ্ট করে গাড়িটার পিছন দিক দিয়ে সে খাঁচায় ঢুকলো। সিঁড়ি নেই, থাকলে ভালো হতো। ভিতরে ঢুকতেই ঘাড়ে ধাক্কা দিলো কেউ। লোকটা বোধ হয় হাঁ করে ছিল ধাক্কার চোটে ঠোঁটের উপর দাঁত পড়ে গিয়ে একটু কেটে গেল। রক্তের নোনতা স্বাদটা ভালো না লাগায় সে লোহার গরাদের ওপর জিব ছোঁয়ালো। কেমন ধোঁয়াটে আলুনি স্বাদ। তার জিব গুটিয়ে গলার কাছে চলে যায়।

এর মধ্যে গাড়ি সূর্যাস্তের নদী আর মাঠ পিছনে ফেলে হু হু করে ছুটতে থাকে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, তবু লোকটার কপালে ঘাম জমে। হাওয়ায় শুকিয়ে গেলেও আবার লোমকূপের গোড়ায় জমে। সে তার ঠাণ্ডা সাপের মতো কিলবিলে আঙুল দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু আবার বিন বিন করে কপালের উপর ঘাম জমে যায়।
একটা বড়ো ফটকের কাছে গাড়ি দাঁড়াতে সে গরাদের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। এখানে সেখানে বিদ্যুতের আলোই জ্বলছে বটে কিন্তু ফটকের ওধারে বিরাট উঠোনটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই ঝন্‌ঝন্‌ করে ফটক খুলে গেলে গাড়িটা গর্জন করে ভিতরে ঢোকে, অন্ধকার উঠোন পার হয় টালমাটাল করতে করতে। শেষে দাঁড়িয়ে যায়।

গাড়ির পিছনের দরজা খুলে গেলে আবার ধাক্কার চোটেই লাফ দিয়ে লোকটা নেমে পড়ে। চওড়া চওড়া অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠলে তবে বিরাট বারান্দা। সেখানে একটা লাল বাল্ব জ্বলছে। হুশ করে সামনের দরজা খুলে যায়। বিরাট একটা ঘর, লাল মিটমিটে বাল্ব জ্বলছে। কেউ নেই। ঘর পেরিয়ে ওপাশের দেয়ালের দিকে যেতেই বাঁদিকে আবার দরজা খোলার শব্দ। আর একটা ঘর। কেউ নেই। টেবিল-চেয়ার নেই। চুন আর বার্নিশের গন্ধ। ঠাণ্ডা কিন্তু আটকানো বাতাসের গুমোটও আছে। হাওয়া উঠেছে, পিছনে একটা খোলা দরজা ক্যাঁচ শব্দ করে বন্ধ হয়েও ককাতে থাকে ক্যাঁ-এ্যা, কিঁচ।

আবার ঘর। ফাঁকা—মাত্র একটি টেবিল। কোনো আলো নেই। দুমদাম করে সবকটি দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা আঁধারের মধ্যে ডুবে গিয়ে চুপ করে একা দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সমস্ত শরীরে ঘাম। অন্ধকারের ভিতর থেকে পথ দেখানোর মতো গলায় আওয়াজ আসে, এই যে এদিকে আসুন।
কিন্তু কোন্‌দিকে যাবে লোকটা ঠিক করতে পারে না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে এলোমেলো এগোতে গিয়ে গুবড়ে পোকার মতো শুকনো শক্ত দেয়ালে ধাক্কা খায়। একই গলায় যেন শূন্য থেকে আহ্বান আসে, আসুন, এই যে! গলা অনেক দূরে চলে যায়, হাল্‌কা মৃদু শিস দেবার মতো ডাকে, কই আসুন।

লোকটা দেয়াল ধরে হাতড়াতে হাতড়াতে খানিকটা যেতেই একটা বন্ধ দরজা পেয়ে যায়। মনে হলো হাত লাগার আগেই দরজাটা খুলে গেল। কোনো লাভ নেই। একই রকমের অন্ধকার। ঘরে ঢুকে দেয়াল ধরে এগোতে থাকে। এখন কেউ আর ডাকছে না। কান পেতেও সে আর কোনো শব্দ শুনতে পেল না। দেয়াল ধরে লম্বালম্বি পেরিয়ে গেল সে। তারপর আড়াআড়ি দেয়ালটার মাঝামাঝি আসতেই ফের একটা দরজা। কিন্তু দরজাটা এবারে সে টানাটানি করেও খুলতে পারে না। খানিকটা করে খোলে আবার ঢক্‌ করে বন্ধ হয়ে যায। প্রাণপণ শক্তিতে লোকটা দুহাতে দরজার একটা কড়া ধরে টানে। তখন আচমকা হুশ করে দরজাটা খুলে যেতেই তীব্র শাদা আলোর বন্যায় লোকটা একেবারে অন্ধ হয়ে যায়। আলোর ধাক্কায় হাঁটু ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে সে মেঝের ওপর বসে পড়ে দুহাতে চোখ দুটি চেপে ধরে। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে চোখ থেকে হাত সরিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় একটা বড়ো ন্যাংটো কালো প্লেন টেবিলের পিছনে তিনজন লোক বসে আছে। তাকে দাঁড়াতে দেখে তিনজন সমস্বরে টেনে টেনে বলে, আসুন, আসুন।

চারদিক থেকে টানা টানা কাঁপা কাঁপা প্রতিধ্বনি ওঠে, সুন সুন—হৌ হৌ।
লোকটা একটু ভালো করে চেয়ে দেখে ঘরে আছে চুনকাম করা শাদা দেয়াল—৪; বড়ো টেবিল—৩; টেবিলের পিছনে তিন চেয়ারে মানুষ—৩; টেবিলের সামনে ফাঁকা হাতলহীন কালো চেয়ার—১।
মাঝখানের লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে রোগা লিকলিকে, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো, চামড়ার উপর দিয়ে হাতের গিঁটটা ফুটে উঠেছে। বোঝা যায় সে খুবই সঙ্গমদক্ষ। তার চোখ একটুও নড়ছিল না। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলটাকে ঘুরে এগিয়ে এসে লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, ধন্যবাদ, এসেছেন বলে আপনার কাছে আমরা বড়োই কৃতজ্ঞ—একটু হেঁট হয়ে সে বলে, দয়া করে আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
প্রতিধ্বনি ওঠে, উনন্‌ন্‌ হৌ হৌ।

এই কথা বলে সে লোকটার হাত ধরে তাকে ফাঁকা হাতল-ছাড়া চেয়ারটার উপর বসিয়ে দেয়। কাঠিখোঁচার উপর জামা-কাপড় চাপিয়ে কাক-তাড়ুয়া বানালে যেমন দেখতে হয়, তাকে ঠিক তেমনি দেখাচ্ছিল। লোকটা সবসময় তার গা থেকে মেয়েমানুষের মাংসের গন্ধ পেতে লাগল। সূর্যাস্ত প্রেমিকটিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে টেবিল ঘুরে সে তার নিজের চেয়ারে ফিরে গেল। অন্য দুজন চুপচাপ বসে আছে। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর শুকনো কনুই দুটো রেখে সে চিন্তিতভাবে মোটা চাপা গলায় বললো, তারপর, কেমন আছেন রহমান সাহেব?

অন্য দুজন মৃদুকণ্ঠে সায় দিলো, হ্যাঁ, তারপর কেমন আছেন রহমান সাহেব?
লোকটা অবাক-হওয়া গলায় খানিকট ঠেকে ঠেকে উত্তর দিলো, আমার নাম তো রহমান নয়। দেয়াল-টেয়াল চারিদিক থেকে পরিষ্কার শোনা গেল, নাম তো রহমান নয়। অয় অয় অয়।
মেয়েমানুষের গন্ধঅলা সঙ্গমদক্ষের মুখে মৃদু হাসি ফুটলো আর শিকারী বেড়ালের মতো তার গোঁফ একটু নড়ে উঠলো, রহমান নয় নাকি? তাহলে নামটা কি শুনতে পাই?
লোকটা তিনবার ঢোক গিলে বললো, আমার নাম হুমায়ুন কাদির।

তাই নাকি? তা রহমান সাহেব, কবে থেকে হুমায়ুন কাদির নামটা চলছে?
আমার নাম তো বরাবরই হুমায়ুন কাদির।
বরাবরই হুমায়ুন কাদির? বা বা বা—আপনার নাম বরাবরই হুমায়ুন কাদির! শাবাশ, বেড়ে বলেছেন রহমান সাহেব, থুড়ি হুমায়ুন কাদির সাহেব। বেড়ে বলেছেন।

বেড়ে বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
সামনের লোকটা তখন ভয়ানক গম্ভীরভাবে বললো, ইয়ে, রহমান সাহেব, ওসব কথা থাক। আমাদের একটা খবর দিতে হবে। আপনাদের এক-একটা নাম কতদিন চলে? আর মোট কটি করে নাম আপনাদের এক-একজনের আছে? আর মোট কজন আপনারা আছেন? আমাদের মাত্র একটি নাম—আমার নাম গোলাম কবির, এর নাম গোলাম রব্বানী, এর নাম গোলাম নবী।
এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে লোকটা চুপ করে।

বাঁদিকের লোকটি, সে বড়ো চমৎকার দেখতে, তাকে সঙ্গমপ্রিয় বলা যায়, বললো, গোলাম রব্বানী আমার নাম।
ডানদিকের টেকো মোটা লোকটা, পুরনো ময়লা টাকার গন্ধ বেরুচ্ছে তার গা থেকে, বললো, আমার নাম গোলাম নবী।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর গোলাম কবির খুব ধীরে ধীরে, গোপনে গালাগালি দেবার মতো করে দাঁতের ফাঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ঠিক আছে রহমান সাহেব, বাজে কথায় সময় নষ্ট করার দরকার কি? আপনি শুধু বলুন শেষ কবে আপনার নামটা বদলিয়েছেন? হুমায়ুন কাদির নামটা কবে নিলেন? আপনাকে সময় দেওয়া যাচ্ছে। বলে ডান হাতটা সে উঁচু করে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুজনও ডান হাত তোলে।

লোকটা, হুমায়ুন কাদির, একটু কেঁপে কেঁপে উঠে বলে, আমি জানি না।
জানেন না, না? আচ্ছা মনে করে দেখুন তো দুমাস আগে মঙ্গলবার দিন সন্ধে সাতটা ঊনত্রিশ মিনিটে চার নম্বর মোড়ের দোকান থেকে পান খেয়েছিলেন। পান মুখে সিগারেট ধরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই একটা সাইকেল আপনার গায়ের উপরে পড়ে, সাইকেলঅলা আপনাকে বলে, এখানে কি? অবিশ্যি তা আপনার শুনতে পাবার কথা নয়। আপনার নামটা কি সেদিনই রাখা হয়নি? বেশ করে ভেবে দেখুন, মনে পড়ে কি না?
হুমায়ুন কাদির চুপ করে বসে থাকে।

বুঝতে পারছি আপনি কিছুই স্বীকার করতে চান না। তাতে কিছু এসে যায় না অবিশ্যি। কারণ আমরা সবই জানি কাজেই আর কিছু জানার নেই। কারণ আমরা কিছুই জানি না অতএব আর কিছুই জানার নেই। ঠিক আছে, বলুন আজ সন্ধেয় কোথায় গিয়েছিলেন? গোলাম কবির একটু গলা তুলে বলে, কোথায়?
বাকি দুজন বলে, কোথায়?
আয়, আয়, আয়, আয়—শব্দ উঠলো।
সূর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিলাম।
কোথায় গিয়েছিলেন বললেন? সূর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিলাম? হ্যাঁ, দেখবার মতোই জিনিস বটে। চমৎকার ধাপ্পা। আমাদের বন্ধু সূর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিলেন—বলে গোলাম কবির গোঁফের তলায় মৃদু মৃদু হাসতে শুরু করে।

হুমায়ুন কাদির বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখে মৃদু হাসিটা তার অল্পে অল্পে উঁচুতে উঠছে, হাসির মধ্যে বহু কষ্টে একবার বলে, সূর্যাস্ত, বাঃ সুন্দর কথা, সূর্যাস্ত—বলতে বলতে হো হো করে হাসতে শুরু করে সে, দমকে দমকে হাসি উঠে আসতে থাকে তার নাভি থেকে—হাঃ হাঃ হাঃ বলে কিনা সূর্যাস্ত, হাঃ হাঃ হাঃ বলে কিনা সূর্যাস্ত। চারদিক থেকে প্রকাণ্ড প্রতিধ্বনি হুড়মুড় করে ছুটে আসে, আস্ত আস্ত আস্ত—হাসির দমকে ছাদ ফেটে যাবার দশা। গোলাম কবির একটানা হেসে যায়, খানিকক্ষণের মধ্যে তার দুচোখে পানি জমে যায় টলটলে হয়ে, মুখ টকটকে লাল হয়ে যায়। কপাল ছেড়ে চোখ দুটো ঠিকরে বাইরে চলে আসার উপক্রম হয়। একনাগাড়ে বলতে থাকে, সূর্যাস্ত বললেন তাই না? তা কেমন দেখতে জিনিসটা? কি রং, কি মাপ—কত ফিট বাই কত ফিট, ওপরটা কেমন, ভেতরটা কেমন—মানে অভ্যন্তর ভাগ? আপনার বউয়ের ইয়ের মতো নাকি? এইখানে সূর্যাস্ত দেখাতে এসেছেন? বলেই হাসি একেবারে বন্ধ করে দিয়ে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গোলাম কবির বললো, আসলে কথাটা বলুন, কতজন ছিলেন?
আর তো কেউ ছিলো না।

পাঁচজন তো ছিলোই। আপনাকে ভালো কথায় বলছি। পাঁচজন নিশ্চয়ই ছিলো। কোথায় বসেছিলেন আপনারা? আর কার কার আসার কথা ছিলো? তাদের নাম-ধাম বলুন। আমাদের কাছে নিশ্চিত খবর আছে, দুদিন আগে বেলা দুটোর সময় আপনারা বলেছিলেন, ভেবে দেখতে হবে। কি ভেবে দেখতে চেয়েছিলেন আপনি? অতো ভাবাভাবির কি আছে? তারও আগে একদিন সন্ধেবেলায় একজন যখন আপনাকে জিগগেস করে, এ বিষয়ে আপনার মত কি? সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে আপনি কিনা তাকে বললেন, চিন্তা করে দেখতে হবে। একবার ভেবে দেখবেন, একবার ভাবনাচিন্তা করে দেখবেন—ওসব বেয়াদবি আপনাকে কে করতে বলেছে? জানেন না সব ভাবনাচিন্তা আপনার অনেক আগেই করা হয়ে গেছে? কি? জানেন না নাকি? চুপ করে রইলেন যে!

হুমায়ুন কাদির অসহায়ভাবে বললো, আমি একটুও ভাবনাচিন্তা করতে চাই না। আপনাআপনি এসে যায়। গোলাম কবির ভেংচি কেটে বললো, আপনাআপনি এসে যায়। আচ্ছা গেল। এরও আগে একদিন শনিবার বিকেলবেলায় আপনি কান উঁচু করে—আপনি জানতেন না আপনার পাছাও উঁচু হয়ে গিয়েছিল—বলে একটু চোখ মেরে গোলাম কবির কথাটা শেষ করলো, আপনি কান উঁচু করে বলেছিলেন, একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
গোলাম রব্বানী, গোলাম নবী একসঙ্গে একটা একটা করে বলে, আপনি কান উঁচু করে বলেছিলেন, একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
প্রতিধ্বনি শোনা গেল, ছি—ছি—ছি—।
গোলাম কবির একটু দেরি করে বলে, একথা কেন বলছিলেন?

হুমায়ুন কাদির খুবই বিব্রত, এলোমেলো; হাবার মতো বলে, আমরা শিক্ষিত লোক।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গোলাম কবির বলে, হ্যাঁ, শিক্ষিত লোকের কান গাধার মতো লম্বা হয়ে গেছে। যাকগে, যাকগে—এইভাবে দেখা যাচ্ছে আপনি বলেছেন, গন্ধ পাওয়া যায় কিংবা গরম লাগছে বা বিস্বাদ মনে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এসব কথা আপনি একবার নয়, বার বার বলেছেন। খেতে বসে বলেছেন, দিনকাল খারাপ। বলে বাঁ হাত মাটিতে ঠুকেছেন, তাতে আপনার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে আঘাত লাগে, একটা বিড়েল আহত হয়। অথচ আপনি ভালো করেই জানেন—বলে গোলাম কবির ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, একবার বাঁদিকে ফিরে চোখ সামান্য কাঁপায়, তারপর ডানদিকে ফিরে একইভাবে চোখ কাঁপায়, তাতে গোলাম রব্বানী ও গোলাম নবী অনিচ্ছার সঙ্গে ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়ায়। তারা স্থির হয়ে দাঁড়ালে গোলাম কবির তাদের দিকে একটু ঘাড় ঝুঁকিয়ে শুরু করে, অথচ আপনি ভালো করেই জানেন যে বচনে বা রটনায় বা ইঙ্গিতে বা ব্যবহারে—

বাকি দুজন মাটির দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে আবৃত্তি করে যায়, বচনে বা রটনায়, ইঙ্গিতে বা ব্যবহারে—
এই হলো এক নম্বর।
এই হলো এক নম্বর।
নিদ্রায় বা স্বপনে বা জাগরণে—গোলাম কবির আবার শুরু করে।
নিদ্রায় বা স্বপনে বা জাগরণে—অন্য দুজন প্যানপেনে গলায় বলে।
এই হলো দুনম্বর।
এই হলো দুনম্বর।
খেতে, শুতে, উঠতে, বসতে, রাজদ্বারে, শ্মশানে, গোরস্তানে, আহারে, বিহারে বা নারী সহবাসে—অন্য দুজন একইভাবে বলে যায়, খেতে, শুতে, উঠতে, বসতে, রাজদ্বারে, শ্মশানে, গোরস্তানে, আহারে, বিহারে বা নারী সহবাসে—
ইত্যাদি—
ইত্যাদি—
এবম্প্রকার, উল্টোসিধে কোনো প্রকার
এবম্প্রকার, উল্টোসিধে কোনো প্রকার
নিষেধ।
নিষেধ।
এই হলো তিন নম্বর।
এই হলো তিন নম্বর।
গোলাম কবির দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে ইশারা করলে গোলাম রব্বানী এবং গোলাম নবী অসন্তুষ্ট মুখে বসে পড়ে।

গোলাম কবির কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। আস্তে আস্তে সে তার রোগা বুকটা চিতিয়ে দেয়, হাতা-গোটানো বাঁদুরে হাত দিয়ে জামার কলার ঠিকঠাক করে, দুবার কাশে, দুবার গলা ঝাড়ে—একবার নাক ঝাড়ে, তিনটে বল্টু খুলে যাবার ঘটাং ঘটাং শব্দ হয়—ঘ্‌র্‌রর করে বুকের মধ্যে একটা চাকা চালু হবার আওয়াজ আসে। তারপর অতি দ্রুত সে তার গলার ভিতর থেকে বাজ ফেলতে থাকে। ঘনঘন বাজ পড়ার আওয়াজে আর বিকট প্রতিধ্বনিতে হুমায়ুন কাদিরের কানে তালা লেগে যায়। কোনো রকমে সে শুনতে পায়, আমরা নিজেরা নিজেরা একতা আইন-শৃঙ্খলা দাঁড়িয়ে বসে বা মাটিতে শুয়ে যদি তা কোনদিন দেখিয়ে দিতে পারি একসঙ্গে একসঙ্গে যে যেখানে আছে ঠিকঠাক পরিকল্পনা
বেশ। তাহলে এই আপনার শেষ কথা? তাহলে এই হচ্ছে আপনার সর্বশেষ মারাত্মক জঘন্য—
অন্য দুজন একটু নড়েচড়ে বললো, আপনার সর্বশেষ মারাত্মক জঘন্য—

গোলাম কবির ভয়াবহ চিৎকার করে উঠলো। তার রগের দুপাশে শিরা উঁচু হয়ে উঠে চোখে রক্ত দেখা দিলো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাতে পাঁজর চেপে ধরে বিরাট একটা দম নিয়ে সে ফেটে পড়লো, বলুন।
চারটে শাদা দেয়াল একসঙ্গে দুলতে থাকে। আলো কমে আসে। আবছা আলোর মধ্যে হুমায়ুন কাদির দেখতে পায় তিনজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শাদা দাঁত বের করে বোমার মতো ফেটে পড়লো, বলুন। তিনজনে একসঙ্গে তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে রাগে কিশকিশ করতে করতে বললো, এই শেষ তাহলে।
বলেই গোলাম কবির লাফ দিয়ে টেবিল ছেড়ে মেঝেয় দাঁড়িয়ে বললো, তাহলে শুরু করা যাক। বাঁশ দুটো কোথায়!
গোলাম নবী মুহূর্তে উধাও হয়ে গিয়ে একজোড়া হাত চারেক লম্বা বাঁশ নিয়ে ফিরে আসে। তখন গোলাম কবির হুমায়ুন কাদিরের কাছে এসে বললো, জামাটা খুলুন।
সে জামা খোলে।
গেঞ্জিটাও খুলুন।
গেঞ্জি খোলা হলে সে বলে, জুতো-মোজা খুলে ফেলুন। হ্যাঁ, এইবার মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসুন।
হুমায়ুন কাদির হাঁটু গেড়ে বসলো।
খুবই সহানুভূতির সঙ্গে তার হাত দুটো উপরের দিকে তুলতে তুলতে গোলাম কবির বলে, হাত দুটো এই রকম করে তুলুন।
সে হাঁটু গেড়ে খালি গায়ে হাত তুলে বসলে গোলাম কবির বলে, রব্বানী তোমার সেই দামেস্কের ছুরিটা কই?
বিরাট শাদা একটা ছুরি বের করে গোলাম রব্বানী বললো, এই যে।
গোলাম কবির নির্দেশ দেয়, এদিকে এগিয়ে এসো, এর ঠিক পিঠের কাছে দাঁড়াও। মাত্র একবার চান্স পাবে। হ্যাঁ ঠিক আছে। এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকো। এসো গোলাম নবী। বাঁশ দুটো গলার দুদিকে ঘাড়ের উপর একটা, গলার দিকে একটা লাগাও। এই আমি এদিকটা ধরছি—ওদিকটা তুমি। মাত্র একবার চাপ দেবে, মনে আছে? আচ্ছা রহমান সাহেব, দুমিনিট ইচ্ছে হলে কিছু ভেবে নিন।

[অনেককাল আগে একবার সবুজ ঘাসের মধ্যে শুইয়া আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম। উহার এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত দেখা গিয়াছিল, উহা হালকা নীল ছিলো। পরে উহা চুম্বনের দাগের মতো মিলাইয়া যায়। ইহার পর মানুষের জগতে ফিরিয়া আসি—তাহাতে নোনা টক গন্ধ আছে এবং আক্রোশ ও ঘৃণা রহিয়াছে এবং ভালোবাসা ও মমতা রহিয়াছে। মানুষের জীবনে কোথায় অন্ধকার তাহার সন্ধান করিতে গিয়ে আমি ঘন নীল একটি ট্যাবলেটের সন্ধান পাই—মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষেরই কাছে প্রার্থনা জানাইব—কারণ মানুষেই মানুষের গা ঘেঁসিয়া বসিয়া থাকে—যদিও ঐ দাগ দেখা যায় না। অসংখ্যবার সঙ্গম করিয়াও যেমন আমি নারীতে ঐ দাগ কখনো দেখি নাই। কোথাও কিছু পাই নাই বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সব কিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছু্ই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *