আবিদ আল হাসান এর ছোটগল্প আর্তনাদ
ঘনঘন সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্সটা বেরিয়ে গেলো। মানুষের জটলা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবার চোখে মুখে আতংক। কেউ বলছে মেয়েটা মারা গেছে। কেউ বলছে এখনো মারা যায়নি, তবে অবস্থা আশংকাজনক।
মুয়াজ্জিন সাহেব একপ্রকার দৌঁড়ে এসে কাকে যেন জিজ্ঞাসা করলেন ‘ভাই মেয়েটা কে? পপি নাকি হ্যাপি?’
সেখানেও কনফিউশান। কেউ বলছে পপি। আবার কয়েকজন বলছে হ্যাপি। মুয়াজ্জিন সাহেব হতাশার স্বরে বললেন ‘সে যেই হোক ভাই, পপি-হ্যাপি যে কোনো একজনই তো হবে তাইনা? তা সে কি বেঁচে আছে ভাই?’
এলাকার প্যারামেডিকেল পড়া ডাক্তার মুয়াজ্জিন সাহেবের দিকে এগিয়ে এলেন। আফসোস করে বললেন ‘বাঁইচা আছে হুজুর, কিন্তু কতোক্ষণ বাঁচবে কে জানে! বুঝলেন হুজুর, ওরা বইন দুইটার কপালই খারাপ, গরীব ঘরে সুন্দরী কন্যা জন্মানো উচিৎ না, একেবারেই উচিৎ না, আহা কোন জানোয়ার যে এই সর্বনাশটা করলো, জানোয়ারগুলা বাচ্চা আর বুড়ি দেখে না’
মুয়াজ্জিন সাহেব হাত ঘড়ি দেখলেন। জোহরের আজানের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি মসজিদে যেতে হবে।
হ্যাপি ও পপি দুই বোন। দুজনের জন্ম দুই মিনিটের ব্যাবধানে। জন্মের পর থেকেই তারা সবার নজর কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর। বয়স সেইম হলেও পড়ার ক্ষেত্রে হ্যাপি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আর পপি চতুর্থ শ্রেণিতে। পপির টাইফয়েডের কারণে এই এক বছর পিছিয়ে যাওয়া। তবে দেখলে মনে হয় পপিই বড়। দুজন এক রকম জামাকাপড় পরে বলে পরিচিত জনরাই তফাৎ করতে পারে না কোনটা কে! তবে এখন চেনার ক্ষেত্রে অনেকেই মুখের দিকে না তাকিয়ে কানের দিকে তাকায়। কারণ কিছুদিন আগে হ্যাপির কান ফোড়ান হয়েছে। বাবা শখ করে স্বর্ণের গোল রিং কিনে এনেছেন। সেটা এখন তার কানে। অথচ পপি ভয়ে কান ফুটোই করতে পারেনি। তাই কানের দুল আছে কি নাই তা দেখে দুজনকে আলাদা করতে সহজ হয়।
মুয়াজ্জিন সাহেব দ্রুত পায়ে সামনে এগুচ্ছেন। জোহরের আজানের সময় ১০ মিনিট পেরিয়েও গেছে। ঠিক সময়ে আজান না দিলে এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি কথা শুনাতে দ্বিধা করেন না। কথায় কথায় চাকুরীচ্যুতের হুমকিও দেন। মুয়াজ্জিন সাহেব অনেকদিন ধরেই ভাবছেন যে তার মা কিছুটা সুস্থ হলে সুযোগ বুঝে চাকুরীটা ছেড়ে দেবেন। এখন ধৈর্য্য ধরে থাকার বড় কারণই হচ্ছে তার মায়ের অসুস্থতা। ডেইলি দুইশত টাকার ঔষধ লাগে। হুট করে চাকুরী ছেড়ে দিলে পরে মায়ের ঔষধ কেনার টাকা যোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যাবে। মসজিদের সামনে আসতেই দেখেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানের ছেলে মতি মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মুয়াজ্জিন সাহেব তাকে দেখেই চমকে উঠেন। ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে সালাম দিতেই মতি মিয়া চিল্লিয়ে ওঠে ‘কই গেছিলেন হুজুর? আজান দেওয়ার কথা মনে আছেতো নাকি? আসলে আপনারা কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষ, দায়িত্বটাও ঠিকমতো আদায় করতে পারেন না, বইসা বইসা খানতো, তাই এমন হইছে…!’
মুয়াজ্জিন সাহেব দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইলেন। এখানে থাকলে তার আরো কথা শুনতে হবে। মতি মিয়া ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো’এই হুজুর শোনেন, নামাজের পর ঘোষণা দেবেন সবাই যেন ক্লাবে যায়, আব্বা বক্তব্য রাখবে, এলাকার ঘটনা জানেনতো নাকি?’
: কী ঘটনা?
: এইতো বলছি না যে আপনাদের কাম কাজ নাই, খালি খাওন আর ঘুমানিই আপনাদের কাম, ঐ যে করিম কাকার মেয়ে পপিরে কারা যেন ধর্ষণ করছে, আব্বায় সেই বিষয়ে বক্তব্য দেবে, নামাজ শেষে সব মুসল্লিদের নিয়া ক্লাবে চইলা আসবেন।
মুয়াজ্জিন সাহেব আমতা আমতা করে বললেন ‘তাহলে পপিকেই ধর্ষণ করা হয়েছে?’
: হ, কি আর বলমু, পোলাপাইনও যেমন মেয়েগুলাও তেমন, কেউই শয়তান কম না, মেয়েগুলাতো ছোট বয়সেই ফুইট্টা যায়, ধর্ষিত হবে না তো কি হবে! শুধু ধর্ষণই হয় নাই, এক্কেবারে গণধর্ষণ হইছে, দেখলাম জামা পায়জামাও রক্তে ভিজে গ্যাছে।
মুয়াজ্জিন সাহেব এবার ধীর স্থান ত্যাগ করলেন। বুকের কোথাও যেন চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তবে বসে থাকলে চলবে না, তাড়াতাড়ি আজান দিতে হবে। নামাজের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
চেয়ারম্যান সাহেবের বক্তব্য চলছে। ‘ঠি…ক, ঠি…ক’ বলে চিৎকার করে যাচ্ছে উজ্জীবিত জনতা। চেয়ারম্যান সাহেব হুংকার দিয়ে বলছেন যে ‘আগামী ১২ ঘন্টার ভেতরেই ধর্ষকদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে’ আবারো উত্তাল জনতার আকাশ কাঁপানো চিৎকার ‘ঠিইইইইক’।
ইতোমধ্যেই অনেক নেতাকর্মীরা এসে জমা হয়েছে। কেউ কেউ গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে। আবার কেউ কেউ শান্ত থাকার আহবান করছে। স্থানীয় সাংবাদিকরাও ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে অনবরত। ক্যামেরার সামনে যে যার মতো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এলাকার অধিকাংশ লোকজন। মঞ্চ কাঁপানো রাজনৈতিক বক্তব্যের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ইমার্জেন্সিতে থাকা মৃত্যু পথযাত্রী একজন ধর্ষিতার কলজেফাটা আর্তনাদ। চাপা পড়ে যাচ্ছে পপির বাবা-মায়ের ডুকরে ওঠা করুণ আকুতি। আরো কি কেউ কাঁদছে? হয়তো হ্যাঁ, অথবা না। হতে পারে বিশাল এ পৃথিবীতে একজন ধর্ষিতার জন্য কাঁদার মতো কেউ নেই।
আসরের নামাজের পরই আবার শোনা গেলো এম্বুলেন্সের শব্দ। আবার কি হয়েছে জানতে আশেপাশের উৎসুক জনতা দ্রুত জড়ো হলো। এম্বুলেন্স গিয়ে থামলো পপিদের বাড়ির পাশে। দু’তিনজন ধরাধরি করে কাকে যেন বের করে আনছে। দৌঁড়ে কাছে গেলেন মুয়াজ্জিন সাহেব! আরে এতো হ্যাপি! ওর আবার কি হলো!
মূল ঘটনা জানতে আরো কাছে গেলেন তিনি। হ্যাপিকে ভালোভাবে দেখেই চমকে উঠলেন। গায়ের জামা প্রায় ছিড়ে ফেলা হয়েছে। পরনের সবুজ পায়জামা রক্তাক্ত। গালের উপরে ছোপ ছোপ জমাটবাঁধা রক্ত। ঠোঁটের এক কোনে বড়সর এক ক্ষত দেখা যাচ্ছে। এক কানে স্বর্ণের দুল চকচক করলেও আরেক কান থেকে রক্ত ঝরছে। সে কানে দুলও নেই। মনে হচ্ছে কান ছিড়ে গেছে। মানে কি! সকালে পপি আর বিকেলে হ্যাপি!!
ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই এম্বুলেন্সে তুলে ফেলা হলো হ্যাপিকে। মুয়াজ্জিন সাহেব মাথা চেপে ধরে বসে পড়লেন। কী হচ্ছে এসব! এ কেমন গজব!
ভেতর বাড়ি থেকে কারো কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয়তো ধর্ষিতার জন্য কান্না করার মতো কেউ একজন আছে! কে যেন চিৎকার করে করে বলছে- পপিকে নিয়ে ওর বাবা মা হাসপাতালে ব্যস্ত থাকায় বাড়িতে হ্যাপিকে একা পেয়ে ধর্ষকরা আবারো হানা দেয়। কিভাবে পারে এরা?
ওদিকে চেয়ারম্যান সাহেবের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন আর এদিকে আবারো ধর্ষণ! আবার কতো ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হবে!
মুয়াজ্জিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। নতুন আল্টিমেটাম শুনতে যেতে হবে। হয়তো আবারো ১২ কিংবা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হবে। নতুন করে হুংকার দেবেন জনগণের প্রতিনিধিগণ। ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হবে রাজপথ। মিছিলে মিছিলে এবার হয়তো হ্যাপির আর্তনাদও বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু…।
মসজিদের কাছাকাছি আসতেই দেখা হলো মতি মিয়ার সাথে। মুয়াজ্জিন সাহেব সালাম দিতেই মতি মিয়া চোখ গরম করে বললো ‘ঐ হুজুর, খাওয়ার সময় সালাম দিতে হয় না আপনি জানেন না?’
মুয়াজ্জিন সাহেব তাকিয়ে দেখলেন মতি মিয়ার হাতে সিগারেট। সে সিগারেট ফেলতে ফেলতে বললো ‘আব্বার সমাবেশে যান নাই?’
: গেছিলাম আবার যা…চ্ছি। কথা শেষ করার আগেই চমকে উঠলেন তিনি। চোখ বড় বড় তাকালেন মতি মিয়ার শার্টের বুতামের দিকে। হ্যাঁ, বুতামের সাথেই আটকে আছে গোল রিং আকৃতির একটি কানের দুল। এইতো; হ্যাপির এক কানে এমন একটা দুল-ই তো ছিলো। আর ছিড়ে যাওয়া কানের দুলটা মতি মিয়ার শার্টের বুতামে আটকে গেলো কিভাবে? তাহলে কি ধস্তাধস্তির সময় এমন হয়েছে…?
দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন মুয়াজ্জিন সাহেব। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে বারবার। নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে ঢলে পড়লেন মতি মিয়ার সামনে। মতি মিয়া কাকে যেন ডেকে বললো ‘এই পোলাপাইন, হুজুরের কি জানি হইছে, তাড়াতাড়ি মাথায় পানি ঢাল’।