ছোটগল্প

ছোটগল্প লোভ -তন্ময় আলমগীর


বোনের রক্তাক্ত লাশের পাশে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোহান। ভেতরটা কষ্টে বরফের মত জমাটবাঁধা পাথর হয়ে গেছে। করুন চোখে একবার বোনের নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকায়, আবার কী যেন ভেবে চোখ নামিয়ে নেয়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর দেয় না। বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
একমাত্র আদরের বোন ফাহিমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। এইচএসসি পাশ করার পর মেডিকেলে ভর্তির জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সোহানের কষ্ট হত খুব। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেওয়া বোনকে নিয়ে গর্বে বুকটা ভরে যেত তখন।
সোহানের বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি বিরাট বড় প্লাস্টিকের কারখানা আছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। এছাড়া কনস্ট্রাকশনের ব্যবসাও আছে তাদের। সোহান আর সোহানের বোন ফাহিমাই শুধু স্থায়ীভাবে দেশে থাকে। ব্যবসায়িক কাজে বাবাকে বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে কাটাতে হয়। বাবার অনুপস্থিতিতে দেশের ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব সোহানের। মা বেঁচে নেই। তিন বছর আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন তিনি। তখন এমবিএ শেষ করে সবেমাত্র বাবার প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে সোহান আর ফাহিমা এসএসসি পরীক্ষার্থী।
মানুষে বাড়িটা গিজ গিজ করছে। ফাহিমার সহপাঠীসহ অফিসের কর্মচারী, শুভানুধ্যায়ীরা ভিড় করছে সমবেদনা জানানোর জন্য। কিছুক্ষণ আগে এসেছে পুলিশ ও ডিভির লোকজন। খুন হওয়া লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া ছোঁয়া যায় না। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছে ডিভি পুলিশ। ফাহিমার লাশের ঠিক পাশেই একটি ঘরি কুড়িয়ে পেল। সোহানকে দেখাতেই চিনতে পারল সোহান। গত বছর দুবাই থেকে এনে বন্ধু জলিলকে উপহার দিয়েছিল। ফাহিমার কাছে আসলো কিভাবে? তবে কী জলিল…!


সোহান আর জলিলের এক বিজনেস সেমিনারে পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। যেনতেন নয়, একদম প্রগাঢ় বন্ধুত্ব যাকে বলে। জলিল ভাড়া বাসা ছেড়ে এখন সোহানের সাথেই থাকে, একই বিছানায়। আলাদা আলাদা ব্যবসা হলেও সোহান চাচ্ছে জলিল তার ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে যাক। শুধু পার্টনার না, পরিবারের একজন সদস্য বানিয়ে নেবে বলেও ঠিক করে নিয়েছে। এতকিছু ভাবার নেপথ্যে আছে ছোট্ট একটি কারন। প্রতিদ্বন্ধী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অনুকা ট্রেডের রোষানলে পড়েছিল সোহান। তারা সোহানকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা গ্রহন করে। সুদুর প্রসারি পরিকল্পনা। গাড়িচাপা দিয়ে মেরে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দেবে। অনুকা ট্রেডের সাথে পণ্য লেনদেন হয় জলিলের। সেই সূত্রে জলিলের কাছে সব ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। যার জন্য প্রাণে বেঁচে যায় সোহান।
সোহান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, ফাহিমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই বিয়ে দেবে। জলিলকে জানিয়েছে তার এই সিদ্ধান্তের কথা। বলেছে, ফাহিমা আমার কলিজার টুকরা। তার বিয়ের ব্যাপারে ভাবতে গেলে কোনো মানুষের উপর ভরসা করতে ভয় হয়। তাই ঠিক করেছি ফাহিমাকে মানুষ নয়, ভূতের সাথে বিয়ে দেব আর সেই ভূতটা হলি তুই। জলিল কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল- আমি!
হ্যাঁ তুই- বলে মাথা ঝাঁকিয়ে সোহান আরো বলল- সবার নজর আসলে আমাদের টাকা-পয়সার দিকে। টাকার ধান্দায় থাকলে ফাহিমাকে ভালবাসবে কখন? একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছি তোকে। আমি আসলে ফাহিমার জন্য একজন সত্যিকারের ভালবাসার মানুষ খুঁজছি।
জলিল বলল- এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার মতামত জানতে চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না? সোহান বলল- না। কারন এ ব্যাপারে আমার অধিকার আছে। বন্ধুত্বের অধিকার, আমার প্রাণ বাঁচানোর অধিকার।
সেই সৎ, নিঃস্বার্থ জলিলের ঘরি পাওয়া গেছে ফাহিমার লাশের পাশে। তবে কী ফাহিমাকে জলিল খুন করেছে! কিন্তু কেন?


ফাহিমা বেশ সুন্দরি। চিকন নাক, চিপচিপে গড়ন। চঞ্চল, সাথে মৃদুলাপী। এক নজরেই ভাল লেগে যাওয়ার মত মেয়ে। জলিল অনেকদিন ধরে তাকে ছোট বোনের মত দেখে আসছে। সোহানের প্রস্তাব পাওয়ার পর থেকে বদলে যায় তার চিন্তা-ভাবনা। ফাহিমাও ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে।
ফাহিমার প্রতি ঝুঁকতে থাকা জলিলের মনোভাব বুঝে একদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বলল- জলিল ভাই, জানি শুনে মন খারাপ হবে আপনার। ভাইয়াও অনেক কষ্ট পাবে। তারপরও ব্যাপারটা এখনই জানানো দরকার। আমি আসলে অন্য একজনকে ভালবাসি এবং তাকেই বিয়ে করব।
জলিল কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে খুব আহত হয়। সোহান একদমই মেনে নিতে পারেনি। সে নিজে তো বুঝিয়েছেই, ফাহিমার বন্ধু-বান্ধব দিয়েও বুঝিয়েছে। সোহান জানে, জলিলের মত ভাল ছেলে আর দ্বিতীয়টি নেই।
জলিল এতদিন ঠিকই ছিল। বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর থেকে মনের কোণে জমতে থাকে ফাহিমার জন্য ভালবাসা। সাথে আরেকটা জিনিস- সম্পত্তি। সুন্দরী ফাহিমা আর সম্পত্তি এ যেন একই সাথে রাজ্য ও রানী পেয়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি কিছু টাকা-পয়সার লোভ যে জলিলের একদমই ছিল না, তা না। ছিল এবং এখনো আছে। তবে এভাবে এত সহজে পেয়ে যাবে ভাবেনি। এখন কেবল ফাহিমাকে রাজি করাতেই পারলেই হল।
শত চেষ্টার পরও ফাহিমার মন গলাতে পারছে না জলিল। ফাহিমা দৃঢ়ভাবে বলে দিয়েছে, মরবে, তবু ভালবাসার অলিদকে ছাড়তে পারবে না। এ ধরনের কথার পর আর কিছু কী বলার থাকে? থাকে না। অলিদের খোঁজ নিল জলিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছে, ফাহিমা যাকে ভালবাসে, অলিদ, জলিলের চির শত্রু সে। ব্যবসায়ীক শত্রু। ফাহিমাকে বিয়ে করলে ওর সাথে আর টেক্কা দেওয়া যাবে না। এতদিনের শ্রম, সাধনা সব বৃথা যাবে জলিলের। তাছাড়া একদম হাতের নাগালে থাকা সম্পত্তি হাতছাড়া করবে কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *