ছোটগল্প উপেক্ষিত শফিক নহোর
আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে আসি , আমার চাচা তো ভাইয়ের সঙ্গে । তিন মাস মৌসুমী গার্মেন্টস এ কর্মরত ছিলাম সহকারী অপারেটর হিসাবে । অনেক মেয়ে আমার সঙ্গে সস্তা প্রেমের আবদার করত , আমি এসব বুঝি না বলে এড়িয়ে চলতাম । কেউ-কেউ আমাকে একটু ভিন্ন নজরে দেখতো । অনেক-ই সন্দেহ করতো আমি তৃতীয় লিঙ্গের কেউ কি—না আমি প্রচণ্ড লজ্জা পেতাম। পরের মাসে আমার রেজাল্ট হল আমি রাজশাহী বিভাগে ১১তম । সারা বাড়িতে আনন্দের ঢেউ । আবেগ আপ্লুত হই , আনন্দে আমার চোখ ভিজে ওঠে।
আমি আগামী দিনের স্বপ্নের বীজ বপন করি , কিন্তু তা থেকে যায় আমার কল্পনার ভিন্ন জগতে । তবুও স্বপ্ন দেখি । একদিন এ সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচব । বুকের ভিতর স্বপ্ন নিয়ে আমার পথচলা । শহরের কলেজে আমার ভর্তি হওয়া অদৃঢ় । পারিবারিক অনাটনের কারণে । গ্রামের কলেজের সবার চাইতে আমার রেজাল্ট ভাল । মজিদ স্যার আমাকে বিভিন্ন সময় , বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে । আমি তখন কলেজে পড়ি । কিন্তু আমার কোন জুতা ছিলনা । কলেজে সবাই জুতা পড়ে আসত । স্যার ও বলতো ক্লাসে জুতা পড়ে আসতে হবে ? কিন্তু আমার পড়ে আসা হত না । স্যার ও অনুমান করতো , স্যারকে বলে ছিলাম
‘স্যার আমাকে একটা টিউশনি দিন আমি পারব’
কি করে সম্ভব ! তুমি কলেজে পড়ে তোমার সহপাঠীকে পড়াবে ? আমি সব সময় বলতাম স্যার ‘আমি পারব’ আমার হাত খরচের টাকা চলে আসত । কলেজ লাইফটা এত কষ্টের ছিল তা ভাষাহীন । সবার কাছ থেকে এত পরিমাণ অবহেলা পেয়েছি ; যা প্রকাশ করবার মত নয় ।
ফাইনাল পরীক্ষার আগে ছোট মামার বিয়ে ,আমার তখন জলবসন্ত । মা, সঙ্গে নিলেন না । জেসিকে রেখে গেল আমার সেবার জন্য । সে নিজেই সন্ধ্যা হলে ভূতের ভয়ে মরে । মা বাবা বিয়ের বড় যাত্রী , বউ নিয়ে আসবার পথে প্রচণ্ড ঝড়, নৌকা ডুবে যায় । দু’দিন পরে মায়ের লাশ পেলাম । বাবার লাশ নদীতে খোজা-খুঁজি করে পাওয়া গেল না । আমি বাবার জন্য এখনও নদীর তীরে অপেক্ষা করি , হয়তো বাবা ফিরে আসবে । মাকে যে জায়গায় কবর , দিয়ে ছিলাম । আজ তা নদী গর্ভে-বিলীন । মায়ের কবরের চিহ্ন পর্যন্ত আজ নেই ! আমি মনে মনে ঠিক ভেবে নেই এখানেই মায়ের কবর ছিল ।
পরের বছর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই । অনেক কষ্ট করে আমার লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে নিতে হচ্ছে । কিছুদিন পরে একটা টিউশনি পেলাম । মেয়েটি ক্লাস সেভেনে পড়ে, বাবা-মা দু’জন-ই সরকারি চাকরি করেন । সন্ধ্যার পরে বাসায় গিয়ে পড়াতে হয়।
‘আমার অন্য বন্ধু রা গল্প করে’,
দোস্ত আজ রাতে খেয়ে এসেছি । ওদের মত কপাল আমার হয়নি, তবে মাঝে মধ্যে চা, নাস্তা দেয় । আমি তা খেয়েই থাকি । মেসে রাতের মিল বন্ধ থাকে।
বেশিরভাগ সেমিস্টার গুলোতে আমার পরীক্ষার ফলাফল অনেক খারাপ আসতে লাগল ! আমার টিউশনি করাতে আর মন সায় দিল না । কিছুদিন পরে আমাকে ফোন দিয়েছে লিনার ‘‘ মা ’’ আমি মিথ্যে বলে দিলাম আমার শরীর খারাপ , কোন ভাবেই ছাড়তে পারলাম না টিউশনি;যদিও আমার খুব প্রয়োজন ছিল তখন । লিনার প্রিয় তার বিড়াল ,নাম দিয়েছে ক্যাটি। আমি নাম শুনে মনে-মনে হাসি ।” বড়লোক দের কি বিচিত্র সখ ” পড়া শেষে আমার জন্য টেবিল ভর্তি খাবার । আমি তো দেখেই বেহুঁশ । এত খাবার তাও আমার আমার জন্য । পেট ভরে খেলাম । মনে হচ্ছে তিন’চারদিন আর কিছুই খেতে হবে না ।পরের দিন পড়াতে গিয়ে লীনাকে কৌতূহল বসত প্রশ্ন করলাম ?
‘আমার জন্য এতকিছু রান্না করেছিল তোমার মা?’
লীনা মুচকি হেসে বলল,
‘না স্যার।’
গতকাল তো, বাবা মায়ের ম্যারেজ-ডে ছিল । খাবার গুলোতে আমার ক্যাটি মুখ দিয়েছে বলে । কেউ খায়নি । তাই সব খাবার আপনাকে দিয়েছিল ।আমার বমি চলে আসল , বেসিনে বমি করে বের হলাম ।
আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল । আমি লীনাদের বাসা হতে দ্রুত প্রস্থান করি ।
সহজ সরল জীবনের সমীকরণের কাছে শত বার হেরে গিয়েছি আমি। তবুও স্বপ্ন গুলোকে কখনো ব্যথা পেতে দেয়নি , অনেক চেষ্টার পর একটি টিউশনি পেলাম । শুভ ক্লাস নাইনে পড়ে । আগামী মাসের এক তারিখ হতে পড়াতে হবে । প্রথম দিন পড়াতে যাবার পর । আমার ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করল ।
আমার তো নাজেহাল অবস্থা। কিছুদিন যাবার পর থেকে সে আমার জন্য নাস্তা তৈরি করে । অথচ -বেচারি আমার জন্য অনেক কিছু তৈরি করলেও আমি একদিন ও তা খায়নি । আগেই শুভ এর বাবাকে বলে ছিলাম । আমি আপনার ছেলেকে পড়াতে পাড়ি কিন্তু ? “কোন প্রকার নাস্তা আমাকে দিবেন না “। ভদ্রলোক আপত্তি জানিয়েছিল । তবে আমি খুব করে বলাতে তিনি রাজি হয়েছিলেন ।
শোভা কারণে-অকারণে যখন পড়াতাম, তখন রুমে ঢুকে বলতো-
‘স্যার আপনাকে নাস্তা দেই ?’
আমি মিষ্টি করে হেসে বলতাম ,
আজ দুপুরে এত বেশি খেয়েছি –মনে হয় তিন-চারদিন কিছুই খেতে হবে না ।
হা হা হি হি ।
‘চা খাবেন ?’
আমি খুব ভাল চা বানাতে পারি,কথাটা অবশ্য বাবা বলে থাকেন ।
ধন্যবাদ শোভা ,অন্যদিন চা খাবো। আজ আমার একটু তাড়া আছে ; তাই যেতে হচ্ছে । আমি শোভাকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম । আমি জানি শোভা আমাকে ভীষণ পছন্দ করে, ভালবাসে । তার অনেক প্রমাণ আছে । সব প্রমাণ, সব সময় দেখাতে নেই । তাতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা থাকে বহু গুণ।
আমি শোভাকে দিনে-দিনে ক্ষণে-ক্ষণে শোভাকে আপন করে নিবার নিপুণ স্বপ্নে মগ্ন।শোভা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ,আমাদের সংসার হবে । কি বিচিত্র ওঁর স্বপ্ন । আমার খুব হাসি পায় । একটা সময় আসে দু’জন আলাদা থাকা সদ্ভাব হয় না । আমি শোভার মাকে আমাদের সম্পর্কের কথাটা বলি । ওর বাবা পরের দিন। আমাকে দু’মাসের টাকা অগ্রিম দিয়ে বললো-
মেহেদি , আমরা তো সামনের মাসে টাঙ্গাইল চলে যাচ্ছি । হঠাৎ করে তোমাকে না করলে তুমি হয়তো বিব্রত বোধ করবে তাই …!
‘সরি মেহেদি তুমি কিছু মনে করোনা ।’
‘চাচা একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম ।’
‘আবার কী কথা ?’
‘দু’মাসের অগ্রিম টাকা তো দিয়েই দিয়েছি ।’
শোভার বাবার ব্যবহার দেখে মনে হলো আমি তার অপরিচিত । সময় খারাপ হলে মানুষ হয়তো এমন ব্যবহার-ই করে মানুষের সঙ্গে । একটি প্যাকেজ নাটকের চিত্র নাট্য এর মত মনে হল আমার কাছে সবকিছু । অব্যক্ত থেকে গেল আমার একান্ত কিছু কথা । প্রকাশিত হলো শুধু তাঁদের কথা , আমার বেকারত্ব নিয়ে কথা হয়েছিল । আমি অযোগ্য ছিলাম কোন ভাবেই অনুরূপ ছিলাম না শোভার জীবন সঙ্গী হিসাবে।
শোভা মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল । আমার সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় । শোভার খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী পুতুলের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি । শোভা ভাল আছে জেনে , আমিও সেচ্ছায় যোগাযোগ করিনি । শোভা সংসার নিয়ে ব্যস্ত, নতুন অতিথি এসেছে শোভার কোলজুড়ে। শুনেছি , খুব সুখে আছে ।আমি এখন বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত আছি । এবার শেষ চেষ্টা চলছে বিসিএস ।তার কিছুদিন পরে রেজাল্ট হল । আমি ক্যাডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলাম । এক’বছর পর আমার কর্মস্থান টাঙ্গাইলে । শোভার বাবা, আমার কলিগ ! আমি তার স্যার ।
পৃথিবীতে আমার আপন বলতে তেমন কেউ নেই । ছোট বেলায় ,খালার কাছে মানুষ হয়েছি ঠিকই সেখানে ভালবাসা বলে কিছু ছিলনা । খালা অসুস্থ আমার এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছি অনেক বার, কিন্তু খালার শর্ত ছিল । রিক্তাকে বিয়ে করতে হবে । তাহলে সে আমার বাসায় আসবে । উঠতে বসতে খোঁটা দিত ।এত বড় হয়ে গেছি তবুও অপমান করতো, খালাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে ও পারতাম না । নিমক খেয়ে নিমকহারামি করতে পারবো না । আমার গল্পটা ঠিক এমন ছিল ছাত্র জীবনে ।