ছোটগল্প/ শৈত্যপ্রবাহ/ ওয়াসি আহমেদ
হিমঠান্ডা ঘরে আহমদ হোসেনের শীত-শীত করছে। চৈত্র মাস, আগুনের হলকা উড়ছে আকাশে-বাতাসে। সকালে বেরোনোর সময় বাসে গরমে সেদ্ধ হবেন জেনেও প্যান্টের সঙ্গে ফুলহাতা শার্ট পরেছেন, পায়ে অবশ্য বরাবরের মতো স্যান্ডেলই। অফিসে পৌঁছে ঘামে ভেজা জামাকাপড় নিয়ে নিজের এত বছরের চেয়ারে বসতে গিয়ে সংকোচ হচ্ছিল, মাথার ওপরে সিলিংফ্যানের হাওয়া খেতেও।
অফিসে শেষ দিন বলেই কি না কে জানে ছোট ঘরটার এদিকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে মনে হচ্ছিল এভাবে খুঁটিয়ে কোনোদিন দেখা হয়নি। কম তো না, একনাগাড়ে পনেরো বছর একই ঘরে। চেয়ার, টেবিল, স্টিল কেবিনেট, কাঠের কত বছরের কে বলবে পুরনো আলমারি কিছুই বদলাতে হয়নি। নতুন জিনিস বলতে ঢুকেছে কম্পিউটার, আবার বদলাতেও হয়েছে বারকয়েক, তিন-চারবার তো হবেই। ব্যবহার হয়েছে সবচেয়ে বেশি চেয়ারটাই। কাঠের হাতলওয়ালা পুরনো ধাঁচের চেয়ার। গোটা অফিসে সম্ভবত এই একটাই। বছরে একবার পুরনো আসবাবপত্র বিদায়ের সময় আর কত এ চেয়ারের মায়া ধরে রাখবেন এমন কথা উঠলে আহমদ হোসেন মুচকি হেসেছেন, যেন মায়া হোক বা আর যা-ই হোক এ নিয়ে মুখ খুলতে চান না। তবে পনেরো বছরে যা হয়নি, আজ তা হচ্ছে। সংকোচ বললে কম বলা হয়, লজ্জা লাগছে, না তাও না, এক ধরনের অপরাধবোধ কি? চেয়ারটাকে তো ফেলে দেয়া হবে আগামীকাল। হায়দার আলী, যে গতকাল তার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে, ঘোষণা দিয়ে রেখেছে আগে চাকা লাগানো রিভলভিং চেয়ার ঢুকবে ঘরে, তারপর সে। ফলে অপরাধবোধকে যেমন ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না, তেমনি লজ্জা লাগছে এই ভেবে ফেলে দেয়ার আগে ঘাম-জবজব জামাকাপড়ে তিনি এই চেয়ারেই চেপেছেন। সিলিংফ্যানের হাওয়াটা যে খাচ্ছেন তাও ঠিক ন্যায্য মনে হচ্ছে না। ফ্যানটা পুরনো, ফেলেই দেবে হয়ত।
এসব সকালবেলার ব্যাপার। কিন্তু এখন এই ঠান্ডা ঘরে এত এত লোকের সামনে খোদ ম্যানেজিং ডিরেক্টারের পাশে বসে শীতে, সংকোচে আড়ষ্ট আহমদ হোসেনের ভেতরে যে একটা গোলমাল পাকাচ্ছে তা তিনি বেশ টের পাচ্ছেন। এ-ঘরটা সাহেবসুবাদের, এখানে বোর্ড মিটিং হয়, সিনিয়ার অফিসাররা কোম্পানির কাজকর্ম নিয়ে প্রতি সপ্তায় সভা করেন, গণ্যমান্য দেশি-বিদেশি ডেলিগেটদের আপ্যায়নও এখানে হয়। এ-ঘরটা যে এত ঠান্ডা একাউন্টস অফিসার আহমদ হোসেন জানবেন কী করে! ভাগ্যিস পাতলা পাঞ্জাবির বদলে ফুলহাতা সূতি শার্ট পরে আছেন। পায়ে স্যান্ডেল বলে হাঁটুর নিচ থেকে পা-টা মনে হচ্ছে জমে যাচ্ছে।
তাকে ফেয়ারওয়েল দেয়া হবে এমন কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি আহমদ হোসেন। কথা ছিল একাউন্টস সেকশনের কয়েকজন সহকর্মী অফিসের পরে তার সঙ্গে বসবে, তার ছোট ঘরেই গাদাগাদি করে বসবে, চা-টা খাবে, আড্ডার মতোই হবে ঘটনাটা। কিন্তু দুই দিন আগে গোটা অফিসের পক্ষ থেকে তাকে রীতিমতো সাড়ম্বর ফেয়ারওয়েল দেয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়তে আহমদ হোসেন নিজে তো বটেই, সহকর্মীরা যারা এক সঙ্গে বসে চা-টা খাবে বলে পরিকল্পনা করেছিল, চুপিচুপি চাঁদা তুলে একটা কমদামি স্মার্টফোন উপহার দেবে বলেও ঠিক করেছিল, তাদেরও চোখ কপালে না উঠে উপায় রইল না। খোদ এমডি পারসোন্যাল সেকশনকে হুকুম দিয়েছেন অফিসের জন্মলগ্ন থেকে জড়িত আহমদ হোসেনকে যেন যথাযথ বিদায়সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান হবে কনফারেন্স রুমে, তিনি নিজেও থাকবেন অনুষ্ঠানে।
খবরটা আহমদ হোসেন প্রথম পান পরসোন্যালের পিওন নীলরতনের কাছে। নীলরতনের নিজেও আহমদ হোসেনের মতো অফিসের সেই শুরুর দিন থেকে আছে। তবে আহমদ হোসেন আগে আরও দুটো চাকরি করেছেন বলে বয়সে নীলরতনের চেয়ে বছর দশেকের বড় তো হবেনই। খবর দিতে এসে নীলরতন নিজেও যে অফিসের গোড়া থেকে আছে কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে আহমদ হোসেনের বিষয়ে খুশি হওয়ার পাশাপাশি তার নিজের ব্যক্তিগত খুশির কারণটাকে প্রচ্ছন্ন রাখতে গিয়েও পারেনি। খবর শুনে আহমদ হোসেন অবিশ্বাসী চোখে নীলরতনকে দেখছিলেন আর ভাবছিলেন এমন গ্যাঁড়াকলে পড়লেন শেষবেলা! একে তো কনফারেন্স রুম, আবার এমডিও থাকবেন! অফিসে ওঠানামার পথে বা করিডরে সামনাসামনি পড়লে সালাম দেয়া ছাড়া এত বছরে কোনো যোগাযোগই ঘটেনি এমডির সঙ্গে। মাত্র একবার এমডির ঘরে ডাক পড়েছিল, তাও তার একার না, জিএম ফাইন্যান্স-এর পিছু পিছু ঢুকেছিলেন ফাইলপত্র নিয়ে, কথাবার্তা যা বলার জিএমই বলেছিলেন।
গতকাল দিনটা গেছে ফেয়ারওয়েল নিয়ে নানা ভ্যাজরভ্যাজর শুনে। অন্যান্য সেকশনের লোকজনও তাকে কেতাবি ঢঙে কনগ্রেচুলেশন বলে গেছে। আর একাউন্টসের সহকর্মীরা কে কতটা খুশি হয়েছে জানতে না পারলেও এটুকু বোঝা গেছে নিজেদের তারা মার্কেটিং, প্রোকিওরমেন্ট বা পিআর-এর সমতুল্য ভাবতে শুরু করেছে। মূল কারণটা সোজাসরল, একজন একাউন্টস অফিসার যার অবস্থান অফিসে মধ্যম পর্যায়েরও বেশ নিচে, ওঠা-বসা ক্লারিকেল স্টাফদের সঙ্গে, তাকে বিদায় জানাতে এই তোড়জোড় অবশ্যই ব্যতিক্রমী। আহমদ হোসেনের সমপর্যায়ের বা কিছু ওপরের দিকেরও যারা গত কয়েক বছরে অবসরে গিয়েছে, কারও বেলায়ই কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি। তবে সেই গোড়া থেকে আছেন বলে আহমদ হোসেনের ব্যাপারটা হয়ত টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে অন্যরকম।
তারপরও হিসাব মেলে না। হায়দার আলী যে তার জায়গায় বসবে, চেয়ার বদলে অবশ্যই, গতকাল লাঞ্চের পর পান চিবুতে চিবুতে আহমদ হোসেন পান খান না জেনেও খয়ের-জর্দা ছাড়া এক খিলি মিস্টি পান তার দিকে বাড়িয়ে, ‘নেন, ভালো লাগবে’ বলে ফিস্ফিসিয়ে জানতে চাইল, ‘কী ঘটনা, হোসেনভাই! বড় সায়েবের সাথে আপনার বা ভাবীর কোনো আত্মীয়তা-টাত্মীয়তা আছে নাকি? বড়লোকদের আত্মীয়-স্বজন সবাই তো এক মাপের হয় না, ঠিক না বেঠিক? এতদিন এক সঙ্গে আছি, কিছু টের পাই নাই।’ বলার পর তার নিশ্চয় ভুল ভাঙল। যেখানে বউয়ের দূর সম্পর্কের মামাতো ভাইয়ের শ্বশুরের ভায়রাকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিচয় দিয়ে লোকজন হরদম বুক ফোলায়, সেখানে আহমদ হোসেনের সাথে এমডির পরিবারের কোনো দূরতম যোগসূত্র থাকবে আর কেউ সেটা জানবে না তা হতে পারে না। আসলে অবিশ্বাস্য বিষয়টা তাকে এতই নাড়া দিয়েছে, সম্ভবত আহতও করেছে, সে কোনো ক্লু না পেয়ে একটা আলটপকা কথা বলে ফেলে শোধরানোর পথ খুঁজতে অন্য পথে এগিয়েছে, ‘বড়সায়েব আপনাকে ভালো জানেন, না? কিন্তু একাউন্টসের কাজকর্ম তো জিএম এর ওপরে যায় না। কি মনে হয়, জিএম আপনার সম্বন্ধে বড়সায়েবকে বলতে পারেন? মনে হয় না, কুমিল্লার লোক।’
ডিম্বাকৃতি বিশাল টেবিল ঘিরে তিন সারিতে লোকজন। প্রথম সারিতে হোমরাচোমরা সিনিয়ার অফিসাররা, চোখ মেলে তাকাতে গেলে কারও না কারও সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় সারিতে যারা তারাও কম যান না, অন্তত আহমদ হোসেনের মাপের কর্মচারীদের শোকজ করার ক্ষমতা রাখেন। তিন নম্বর সারিটা আড়ালে পড়ে যাওয়ায় ওখানে তার সমগোত্রীয় বা নিচের ধাপের যারা রয়েছে ওদের দেখতে গেলে সামনের দুটো সারির ফাঁক-ফোকর দিয়ে, তাও চোখাচোখি এড়িয়ে দৃষ্টি চালাতে হয়। কাজটা সহজ না, দু-একবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে মাথা নিচু করে সেই যে বসেছেন, মনে হয়েছে মাথা বুঝি আর তোলা হবে না। চারপাশ থেকে এত এত চোখ গিলে খেতে তৈরি, এ অবস্থায় এমডি যখন জানতে চেয়েছেন ছেলেমেয়ে কজন, বাসা কোথায়, জবাব দিতে গিয়ে তার মনে হয়েছে ঠান্ডায় শুধু পা দুটোই না, ঠোঁট, জিব-টিবও অসাড় হয়ে পড়েছে।
এসবের জন্য না হয় ঠান্ডা ঘরকে দোষ দেয়া চলে। কিন্তু একটু পরই যখন কোরান তেলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল, মানে একেকজন উঠে এসে মাইক্রোফোনে ফুঁ দিয়ে তার গুনগান করতে লাগল, আহমদ হোসেনের মনে হলো, পরিষ্কার মনে হলো একটা গোলমাল পাকাচ্ছে। বক্তৃতার পালা নিচের স্তরের কর্মচারিদের দিয়ে শুরু করে ওপরের দিকে ওঠাই দস্তুর। সে অনুযায়ী প্রথম সুযোগটা নিয়েছে পিওন নীলরতন। মাননীয় পরম শ্রদ্ধেয় এমডি স্যার ও সম্মানিত স্যারেরা দিয়ে শুরু করে, আজ আমরার বড় আনন্দের দিন, বলে সে জিব কাটল। দুঃখের না বলে বলেছে আনন্দের, তারচেয়েও বড় ভুল, সালাম-টালাম দেয়নি বা জোড় হাতে নমস্কার। পরিস্থিতি সে ভালোই সামাল দিল। অপনারার সবতারে আমার অন্তরের শত কোটি প্রণাম বলে সে আনন্দের জায়গায় দুঃখ বসাল। তার পর সবার জ্ঞাতার্থে জানাল বিদায়ী আহমদ হোসেনের মতো সেও এ অফিসে সেই পরথম দিন থেকে আছে। সে-কারণে আহমদ হোসেনকে যে বিদায় সমবদ্দোনা দেয়া হচ্ছে সেজন্য সে যারপরনাই খুশি। মানুষ হিসাবে আহমদ হোসেনের যে তুলনা চলে না সে পরিচয় তুলে ধরতে সে জানাল তিনি কোনো দিন তার বোনাস বা ওভারটাইমের পাওনা নিয়ে ঘোরাননি। তার জানা মতে অন্য কারও বেলায়ও তেমন ঘটেনি। কথাটা শোনামাত্র আহমদ হোসেনের মনে হলো কানে ছ্যাঁকা লাগল। কথাটা পুরোপুরি সত্য না, অন্তত অফিসের ড্রাইভারদের বেলায় তো না-ই। ড্রাইভারদের তো শুধু বোনাস-ওভারটাইম না, তেল মবিল সার্ভিসিং-এর নানা ফ্যাকড়া সারা মাস জুড়ে। তার ওপর আজ ব্রেকশু বদল, কাল সাসপেনশন, পরশু এসির কমপ্রেসার মেরামত Ñ কত কী! কেউ যদি প্রতিবাদ করতে উঠে দাঁড়ায়, ড্রাইভারদের কেউ!
আশঙ্কাটা যে একদম অমূলক তার প্রমাণ দিতে যখন একে একে বিভিন্ন সেকশনের সহকর্মীরা নীলরতনের কথাগুলোই সুন্দর করে ডালপালা ছড়িয়ে বলতে লাগল, শীতে-ঠান্ডায় কাবু অবস্থায়ও আহমদ হোসেনের মনে হলো বানিয়ে বলছে বলেই সুন্দর। শুনছে তো সবাই কান পেতে, কিন্তু বিশ্বাস করছে না। কী করে বিশ্বাস করে! এই যে মার্কেটিং-এর এবাদুর রহমান একটু আগে বলল আহমদ হোসেন এমন মানুষ, সারা জীবন অফিসের ভালো ছাড়া কিছু ভাবেননি, এ তথ্য সে কোথা থেকে জোগাড় করল! তার সারা জীবনের খোঁজই-বা সে পেল কী করে! এ অফিসের আগে আহমদ হোসেন আরো দুটো চাকরি করেছেন, প্রথমটা থেকে তাকে ছাড়ানো হয়েছিল, স্যাক করা হয়েছিল, অন্যটা নিজেই ছেড়েছিলেন, বেতন-টেতনের ঠিকঠাক ছিল না। স্যাক করার কারণটা কি ও জানে? বড়সড়ো ব্যাপার না, চেনা-জানা লোককে দিয়ে তিনটা ভুয়া কোটেশন আনিয়েছিলেন স্টেশনারি কেনার জন্য। আনাড়ি কাজ, ধরা পড়েছিলেন হাতেনাতে। এ অফিসে সুযোগ-টুযোগ না থাকলেও বার কয়েক এটা ওটা কেনাকাটার সময় নিজের ভাগ ঠিকই বুঝে নিয়েছেন। একবার অবশ্য একটা দাও একাই মেরেছিলেন। অফিসের জন্য বেশ কয়েকটা এসি, ফটোকপিয়ার, লেজার প্রিন্টার সদ্য ইমপোর্টেড বলে পাকা ইনভয়েস দিয়ে সাপ্লায়ার চেক নিতে এসেছিল, আহমদ হোসেন আন্দাজে ঢিল ছুড়ে এলসি, বিএল চেয়ে বসায় মুখ চুন করে বড়সড়ো বান্ডিল গছিয়েছিল। মেয়ের বিয়েতে খুব কাজে লেগেছিল।
ঘটনাটা এত চুপিসারে ঘটেছিল অফিসে কারো পক্ষে জানা দূরের, আন্দাজ করাও সম্ভব ছিল না। হঠাৎ টাকা জোগাড়ের বিষয়ে ভেবেছিলেন স্ত্রীকে বলবেন গ্র্যাচুইটির টাকা আগাম তুলেছেন। তাই বলে এতগুলো টাকা! স্ত্রী হয়ত বিশ্বাস করত, আবার পাওনাগন্ডা আগাম তুলে শেষ বয়সে ফৌত হওয়ার দুশ্চিন্তাও নিশ্চয় তাকে ভোগাত। এ চিন্তা থেকে স্ত্রীর কাছে বিড়ালটা থলে থেকে বের করবেন কি করবেন না, করা উচিত কি না এমন দোটানা সত্ত্বেও যখন এক রাতে, বেশ রাতে, মশারির ঘোর-ঘোর আবরুর মধ্যে বলে ফেললেন ঘুষ খেয়েছেন, স্ত্রীর আদুরে ঠোঁট উল্টানো দেখে আহমদ হোসেন তো তাজ্জব। আগে কও নাই ক্যান? আমার কাছে গোপন করলা! খুচরাখাচরা যে মাঝে মাঝে খাও সে খবর আমার জানা। সকালে পকেটে পঞ্চাশ টাকা নিয়া বারাইছো, রাতে একশো-পাঁচশোর কয়েকখান নোট কই থাইকা আসে! এমন তো কয়েকবার হইছে। টের পাও নাই, আমি এক-দুইবার এক-আধখান সরাইছি। কিন্তু এইটা আমারে না বইলা থাকতে পারলা! ঘুষ না খাইলে সংসারে আয়-উন্নতি বাড়ে! তুমি তাইলে বড় দানে খাইতে পারছো। এমন পরিস্থিতিতে সেরাতে অবধারিত স্ত্রীসংগম তৃপ্তিময় হওয়ার কথা, হয়েওছিল।
অফিসে মোটামুটি সবাই যে আহমদ হোসেনকে কাজের লোক বলে জানত এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে না। একাউন্টসের কাজ বলে সারাটা দিনই কাটত টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে নয়তো কম্পিউটার মনিটারে আঠা দিয়ে চোখ গেঁথে। বাঁধাধরা একই ধরনের কাজ, করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলেও কাজ শেষ না করে টেবিল ছাড়তেন না। বিদায়ী অনুষ্ঠানে এসব বলাবলি হবে জানতেন। এছাড়া এমন অনুষ্ঠানে ভালো ভালো কথা বলাই রেওয়াজ। কিন্তু নিজের এত গুণকীর্তন শুনে শুনে গোলমালটা যে অনেকক্ষণ ধরে ভেতরে পাকাতে শুরু হয়েছে, থামতেই চাইছে না। মাথা তো নিচু করেই আছেন, কার পর কে কথা বলতে উঠে দাঁড়াচ্ছে খেয়াল করছেন না, গলার আওয়াজেই যা কিছুটা ধরতে পারছেন। গোলমালটা আরও বড় হয়ে দেখা দিল যখন সিনিয়াররাও একই কায়দায় গলা মেলালেন। আমরা আমাদের এতদিনের সহকর্মী আহমদ হোসেনকে খুব মিস্ করব। তিনি ছিলেন অফিসঅন্ত প্রাণ, খুব কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন, সিনসিয়ার ছিলেন, এফিশিয়েন্ট ছিলেন, পাংচুয়াল ছিলেন- হেন ছিলেন তেন ছিলেন। কথাগুলো এমনভাবে কানে খোঁচাচ্ছে আহমদ হোসেন একবার সাহস করে চোখ তুলতে গিয়ে দেখলেন সামনে সব ঝাপসা, রাশি রাশি মাথাগুলো পি- পাকিয়ে থাকায় সেগুলোকে আর মাথা বলে মনে হচ্ছে না। ঘরটা দুলছে, সঙ্গে তার নিজের মাথাটাও। শীত কি আছে এখনও, টের তো পাচ্ছেন না। এবার একজন, গলা শুনে ধরা যাচ্ছে না কে, তবে সিনিয়াদেরেই কেউ, নতুন কথা বললেন। একাউন্টস-এর কাজ থ্যাংকলেস, সবাই জানে কাজটা ইম্পপরটেন্ট কিন্তু রিকগনাইজ করে না। আহমদ হোসেন এমন একটা থ্যাংকলেস কাজ এত বছর সততা ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে প্রমাণ করে গেলেন তিনি কোম্পানির এ্যাসেট ছিলেন।
ছিলেন ছিলেন। আহমদ হোসেনের ভেতরে গোলমালটা মহা তালগোল পাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে সবাই জোট বেঁধে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছে। মরার আগে কারো সম্বন্ধে এ কাজ করার নিয়ম নেই, নাকি আছে! মরা মানুষ সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ বলারও নিয়ম নেই, অন্তত মরার ঠিক পর পর। গোরস্তানে কবরের গর্ত খোঁড়ার সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যেখানে পাড়া-পড়শিরাই কবর খুঁড়তে কোদাল চালায়। ধীরেসুস্থে কোদাল চালাতে চালাতে বাড়ির উঠানে বা বারান্দায় কাফনঢাকা সদ্যমৃত লোকটার সঙ্গে কবে কার শেষ কথা হয়েছিল, কী বলেছিল এসব নিয়ে বিষণ্নতার মধ্যেও এক ধরনের বিনোদনের আয়োজন চলে। তার পর লাশ মাটিচাপা দিয়ে ধুলিমলিন টুপি মাথায় ফেরার সময় সবাই একই সুরে দুুনিয়া থেকে একজন ভালো লোক চলে যাওয়ার আফসোসকে চেটেপুটে যার যার পথ ধরে।
তবে কবরচাপা লোকটা তো নিজের সম্বন্ধে কথাবার্তাগুলো শুনতে পায় না। না কি পায়! পেলেও কোনো রহস্যময় কৌশলে পায়। এদিকে আহমদ হোসেন তুলতুলে ফোমমোড়া চেয়ারে পাছা ডুবিয়ে দিব্যি সব শুনতে পাচ্ছেন। পাবেনই-বা না কেন? তিনি তো কবরের গর্তের তিন হাত গভীরে ভেজা বা ঝুরঝুরে মাটির পিঠ বাঁকানো পুরু স্তরের নিচে চাপা পড়েননি যে শুনতে পাবেন না। ভাবতে গিয়ে তার মনে হলো কথাগুলো এখন অস্পষ্ট ঠেকছে, আগের মতো টক্ টক্ কানে বাজছে না। খেয়াল করতে নিশ্চিত হলেন, না, বাজছে না। একটা ভোঁতা অবিরাম ভোঁ ভোঁ আওয়াজ কানেই না কেবল, মাথার ভেতরে চরকি কেটে ঘুরছে ঘুরছে। পানির ঘূর্ণিতে কচুরিপানার দঙ্গলের মতো পাক খাচ্ছে। এক দঙ্গল ঘুরে ঘুরে অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, নতুন আরেক দঙ্গল এসে জায়গা জুড়ছে। এদিকে আওয়াজের জোরটা ধীরে ধীরে কমে আসছে, নিস্তেজ হতে হতে কানের পরদায় টাইট হয়ে, একি, ছিঁপির মতো বসে যাচ্ছে। শীত শীত অনুভূতিটা আবার প্রবল বিক্রমে ফিরে আসছে। পরপরই অবাক হলেন, একটা গন্ধ পাচ্ছেন। কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ। ঠিক। চারপাশ থেকে গন্ধটা আসছে। খারাপ গন্ধ বলা যাবে না, নেশা ধরানো ঠাসাঠাসি গন্ধ। মাথাটা ভারী পাথর। ভারী মাথাটা কিছুতেই আর ঘাড়ে টিকে থাকতে চাইছে না। ঘাড় ফসকে এক সময় যখন প্রায়-টাক মাথাটা টেবিপল ঠোকর খেয়ে স্থির হলো, আওয়াজ তেমন জোরেশোরে না হলেও যেটুকু হলো নেহায়েত কম না।
ওয়াসি আহমেদ এর শুধু মাত্র “তলকুঠুরির গান” বইটি এবার
( রকমারীডটকমএর মাধ্যমে)সংগ্রহ করে পড়েছি।এছাড়া প্রথম আলোতে ফিচার পড়েছি।তিনি ভালো লেখেন এইটুকু বোধে আছে।এ গল্পটি আরো ভালোলাগলো।
ধন্যবাদ সম্পাদক মহোদয়কে গল্পটি পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য