ছোটগল্প// থুতু // সেলিনা হোসেন
ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন দুপুর। সামনের ছয়তলা দালানটার ওপর আকাশ নুয়ে এসেছে মনে হয়। তবু ইচ্ছে করলে ও লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঐ নীলটুকু ছুঁতে পারে না। ওর চোখের সামনে বদলে যাওয়া এই শহরটা এমনই। ধুলায় ধূসরিত। চারদিকে আবর্জনার স্তূপ। রাস্তায় নামলে গা ঘিনঘিন করে। ও পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে মুখে দেয়। প্রায়ই ওর জিভ তেতো হয়ে যায়। এই বিস্বাদ তাড়াতে ও লজেন্স চোষে। বাবার বন্ধুরা মাঝেমধ্যে বলে, তোমার ছেলেটি একসেনট্রিক। ওর দিকে খেয়াল রেখো।
বাবার সময় নেই ওর দিকে খেয়াল করার। বরং ও যা চায় তার সবকিছুই দিতে পারে, শুধু নিজের সময়টুকু ছাড়া। ও নিজে অনেক ভেবে দেখছে যে, ওর আসলে চাইবার কিছুই নেই। ও বুঝতে পারে ওর কী যেন হয়েছে। থুতু ফেলতে পারে না। থুতু ফেলতে গেলেই বমির ভাব হয়। ও তখন তাড়াতাড়ি থুতু গিলে ফেলে। কিন্তু সে আর এক যন্ত্রণা। তখন পেটটা ভীষণ মোচড়াতে থাকে, যেন নাড়িভুঁড়ি উঠে চলে আসবে।
ঘরে এ অবস্থা হলে ও উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে, রাস্তায় এমন হলে পেট চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। মাসছয়েক আগে এ অবস্থার শুরু। ইদানীং ঘন ঘন হচ্ছে। ও ভেবে পায় না যে এই নোংরা শহরে ওর স্বাভাবিক থুতু ফেলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন?
ও মিজান। ভালো নাম মিজান মহিউদ্দিন। বাবা ব্যবসায়ী। মোটামুটি বিত্তশালী ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই শহরে ওর জন্ম। ওর বয়স এখন ছাব্বিশ। মাস ছয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রি অর্জন করেছে। এখন কিছু করে না। বেকার হলেও বাপের উপার্জন ওর পকেটে থাকে। মা আবার আদর করে একটু বেশিই দেয়, চাইতেও হয় না। মা মাঝেমধ্যে বালিশের নীচে রেখে দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরও ওর নিজের কিছু করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু পারছে না। বাবার পরিচয় কিংবা ঘুষ দিয়ে ও এগোতে চায় না। তাই সব জায়গায় মিসফিট হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বদ্যিালয়ের ডিগ্রি নেবার পর থেকেই নিজের ওপর ঘেন্নাটা বাড়তে থাকে। ডিগ্রিটা ওর কোনো কাজেই আসছে না। একটা অর্থহীন লেজ নামের পেছনে যুক্ত করার অধিকার পেয়েছে মাত্র। ওর মনে হয়, ডিগ্রি দিয়ে না নিজেকে শিক্ষিত করতে পেরেছে, না কোনো যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। যোগ্যতাই যদি অর্জিত হবে তবে সব জায়গায় এমন অপাঙক্তেয় হয়ে যাচ্ছে কেন? একটা লজেন্স শেষ হলে ও আর একটা মুখে পোরে। ঘরে ঢুকে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে থাকে। ধবধবে সাদা বিছানার চাদর ওর, পর্দাগুলো সাদা, দেয়ালের রং সাদা। এত কিছু সাদার মধ্যে নিজেকে দেবদূত ভাবতে বেশ আনন্দ পায় ও। যে জিনিসটি চোখে দেখা যায় না, যার একটি বায়বীয় অস্তিত্ব আছে, তেমন কিছু নিয়ে কল্পনা করতেই তো সুখ। ঘরের সাদা ছাদে ওর দৃষ্টি নিবব্ধ থাকে। একটা বিশাল মাকড়সা বুকের মধ্যে সাদা রঙের ডিমের খোলস নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। দেয়ালে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মাকড়সা। ওর নিজেকে তখন মাকড়সার মতো মনে হয়। ও দুহাতে মুখ ঢাকে। যেন ওর শরীর বেয়ে উঠে আসছে মাকড়সার বাচ্চা। ও খাট থেকে নেমে দেয়ালের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দেখতে পায় ওর মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, ওর হাত ঊর্ধ্বমুখী। জিহ্বা একটা ডিমের খোলসের মতো। ও চেঁচিয়ে ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয় এমন কতগুলো মাকড়সা ছড়িয়ে দিয়েছে এই শহরে। এরা এখন খাদ্যের অন্বেষণে ব্যস্ত। এরা জানে না কে এদের পিতা- কার ঔরসে ওদের এমন জন্মের পরিহাস। একটু থেমে বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি পিতা হতে চাই। এই বেশ্যা সমাজের গায়ে থুতু দেবার জন্য আমি বেশ্যার গর্ভে একটি সন্তান জন্মাতে চাই।
গনগনে দুপুরে ও শহরের রাস্তায় নেমে আসে। একটা হাঁফ-ধরা চারদিকে। অল্পে হাঁপিয়ে ওঠে মানুষগুলো। অপুষ্টির শিকার তো। গাছের আড়ালে একটি গরু শুয়ে জাবর কাটছে, পাঁজরের হাড়গোনা যায়। ও মনে মনে বলে, গরুর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় যে, এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য কেমন হবে। ও প্রবল অবজ্ঞায় রাস্তার ধারে মোটা গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে পেসাব করে। ইচ্ছে করে পেসাব করে গোটা শহরটা ভাসিয়ে দিতে। এখানকার খোলা ম্যানহোল মানুষের মুখের মতো হাঁ করা, যার ভেতরের মোটা অন্ত্রনারী দিয়ে নামতে থাকলে হজম হয়ে যাওয়া খাবারের অসার বস্তুগুলো দেখা যায়। পেসাবে ভিজে আছে ঘাস। ওগুলোর রং সতেজ সবুজ নয়, বিবর্ণ। কড়–ইয়ের ডাল থেকে ঝরেপড়া হলুদ ফুলগুলোও ফ্যাকাসে। কর্কশ স্বরে কাক ডাকছে। নিজেকে ভারমুক্ত করে আবার ফুটপাথে এসে দাঁড়ায়। বিচিত্র রঙের গাড়িগুলো পাশ দিয়ে ছুটে যায়। কোনো কোনো মেয়ে উৎসুক চোখে ওকে দেখে। হয়ত ভাবে, বেকুব একটা। কিংবা বেকার যুবক। ও হাত ওলটায়, যা ভাবে ভাবুক। কী এসে যায়। এই সমাজে কে বেকুব নয়? একদল তো আরেক দলকে অনবরত বেকুব বানিয়ে যাচ্ছে। এই ক্রমাগত রূপান্তরের ইতিহাস এক সময়ে স্থির হয়। ও আপন মনে নিজেকে ধমকায়, একটু বেশি ভাবনা হয়ে যাচ্ছে না কি? এক সময়ে বিপুল শব্দে গাড়ি থামে। ডাক গ্লাস সরিয়ে মুখ বাড়ায় শিহাব, কোথাও যাবি নাকি?
ভাগ শালা। পিঁয়াজি করা হচ্ছে।
ওর মুখ খিস্তিতে শিহাব আর দাঁড়ায় না। বন্ধুরা শিহাবকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ ও দু’হাতে বাপের টাকা ওড়ায়। শহরময় গাড়ি দৌড়ে বেড়ায়। বন্ধুরা বলে, ও একটা জিনিয়াস। মেয়ে মহলে ওর দারুণ কদর হেভি হ্যান্ডসাম বলে। এ সবই আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রধান আকর্ষণ। রূপ এবং বাপের বিত্ত। মিজানের মুখ ভরে থুতু আসে। ও কোনোরকমে ঘিলে ফেলে গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও এখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। মোটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গাছের বাকল খোঁটে। ঝুরঝুরিয়ে পড়ে যায় মরা বাকল, বেরিয়ে আসে ভেতরের কাঁচা অংশ, ঈষৎ সবুজ এবং সজীব। মাথার ভেতর গাড়ির হর্ন প্রবল হয়ে ওঠে।
মনে পড়ে দূর সম্পর্কের বোনের বিয়ে ঠিক হলে ও জিজ্ঞেস করেছিল, ছেলে কী করে?
বোন কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিয়েছিল, বাপের অনেক টাকা আছে।
ও খুব ঠান্ডা গলায় চোখ নামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেছিল, ছেলে কী করে?
বোন একই কায়দায় উত্তর দিয়েছিল, বাপের টাকার অভাব নেই।
ও বেকুবের মতো মুখ হ্যাঁ করে বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করেছিল, ছেলে কী করে? বোন বব চুল ঝাঁকিয়ে কায়দা করে উত্তর দিয়েছিল, শহরময় বাবার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ও নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, তাহলে একটা কাজ শিখেছে, ড্রাইভিং। অর্থাৎ ড্রাইভার। ভালো, খুব ভালো। একটা কিছু জানাটাই বড়ো কথা। এই হতভাগা দেশটায় শ্রমের মূল্য নেই বলেই যতো ঝামেলা। যাকগে, লেখাপড়া কতদূর?
বোন বিরক্তির সঙ্গে বলেছিল, ওটা দিয়ে কী হবে? ইংরেজি বলতে পারে।
মিজান হা হা করে হেসে বলেছিল, গুড। চমৎকার। বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে প্রবল বেগে থুতু উঠে এসেছিল।
ওর বোন রেগে বলেছিল, ন্যাস্টি। তোর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। নিজে তো কিছু করতে পারলি না, পরের ভালোও দেখতে পারিস না।
এর পরে আর কথা বাড়ানোর রুচি হয়নি ওর। আসলেই ও নিজের ভালো বুঝতেই পারলো না। ও ভেবে দেখলো ভালোর বোধটা ওর মধ্যে অনেক কম। তাহলে বুঝি মন্দের বোধ বেশি? লোকে বলে ও যা কিছু ভাবে সবটাই উল্টো ভাবনা। এমন ভাবা সুস্থতার লক্ষণ নয়। ও হাত উল্টে দাঁত কিড়মিড় করে, হবে হয়ত। দাঁতের ঘর্ষণ ওর বেশ ভালো লাগে। একা থাকলে ও দাঁত নিয়ে খেলে। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যখন আর ঘুম আসে না তখন এই দাঁতের খেলায় অন্ধকার ছিন্ন করে। দ্রুত মনে হয় এখনই সময় অনেক কিছু ছিন্ন করার। কি? এক, মগজের ঘুঁটে, যেটা মানুষ এই শহরের দেয়ালে সেঁটে শুকোবার জন্য রেখে দিয়েছে। দুই, ভালোমন্দ বোধ, যেটা এই শহরের ডাস্টবিনে জমিয়ে রাখা হয়েছে, আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেবার জন্য। তিন, ক্রোধ, যেটা দ্রুত হিমায়িত হয়ে যাচ্ছে এই শহরের ধমনী থেকে। মিজান একটা রিকশা নিয়ে বাসায় আসে। ওর শরীর খারাপ লাগছে। দরজায় মা’র সঙ্গে দেখা। উদ্বিগ্ন জননী এগিয়ে আসে, কিরে কী হয়েছে?
ভালো লাগছে না।
মিজান পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চায়।
শোন, এমন করছিস কেন? রোদে কেমন পুড়ে গেছে চেহারা। একটু শরবত খাবি? না, মা।
তাহলে গোসল করে খেতে আয়।
ও এক মুহূর্তে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকায়, কী স্নিগ্ধ এবং মায়াবী কথা। দ্রুত শরীরের ভেতর ঢুকে গিয়ে ঘুম-পাড়ানির কাজ করছে। ও এলোমেলো পা ফেলে নিজের ঘরে আসে। শার্ট খুলে ছুঁড়ে দেয় মেঝেতে, জুতো জোড়া চলে যায় একপাটি ঘরের কোণায়, অন্য পাটি খাটের নীচে। বেল্ট খুলে খাটের ওপর ছুঁড়ে মারে। তারপর বাথরুমে ঢোকে। ঝরনা ছেড়ে দিলে ওর মনে হয় শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ওর বোনের সেই পরিতৃপ্ত কণ্ঠ শুনতে পায়, ইংরেজি বলতে পারে। ও রাগে লাফিয়ে উঠে ঝরনার মুখটা ধরতে চায়। কী পরিতৃপ্তি। যেন একটি বিদেশি ভাষা শিখে বিরাট মহত্ত্ব অর্জন করেছে। আর কিসে মহত্ত্ব অর্জন করা যায়? শহরময় গাড়ি চালিয়ে? কি বিষাক্ত এইসব বোধ। মিজান ঝরনা বন্ধ করার জন্য হাত বাড়ায়, পারে না। পানির ধারা যেন তীরের মতো ফুঁড়ছে। ও সেই আঘাত গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে জানে না। একযুগ নাকি এক শতাব্দী? দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। গুম গুম একটা শব্দ হচ্ছে। বাথরুমের চার দেয়াল কাঁপছে সেই শব্দে। ওর ভয় করে, হয়ত দেয়ালগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। চারদিক থেকে কাচা গোবরের গন্ধ আসছে। তীব্র গন্ধ। নিজের শূন্য মাথাটা চেপে ধরে ও। দরজায় ধাক্কা জোরালো হয়। মা’র গলা শোনা যায়, ডাকছে ওকে। ও দরজা খোলার জন্য ছিটকিনি টেনে ধরে। তারপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায়। ওর আর কিছুই মনে থাকে না।
সম্পূর্ণ সুস্থ হতে মাকখানেক লেগে যায়- বিছানার পাশের টেবিলে কত ধরনের খাবার এবং ফলমূল থাকে। স্যুপের গন্ধ পেলে থুতুতে ওর মুখ ভরে যায়। মা রাগ করে নীরবে উঠে যায়।
তখন ও সাদা ছাদের দিকে তাকায়। ওটাকে আর কিছুতেই সাদা মনে হয় না। মনে হয় কত বিচিত্র রঙে ভরে আছে ছাদ, দেয়াল। এই শহরে কোথাও কোনো মাকড়সা নেই। কোনো মাকড়সা-শিশু তার পিতার মাংস খুবলে খায় না। প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে এই শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে মগজহীন, ক্রোধহীন, বোধহীন। এ নিজের শিরা-জাগা হাতটা শূন্যে ওঠায়। দেখতে পায় একটি কঙ্কাল ঝনঝনিয়ে হেঁটে যায় শহরের বড়ো রাস্তা দিয়ে। দুপাশে উৎসুক জনতা। কারও মুখে ধ্বনি নেই। চোখের জল নেই, সহানুভূতি নেই। কঙ্কালের করোটিতে অজস্র ফুটো। মিজানের চোখের পাতা বুঁজে আসে, ঘুম নয়, নেতিয়ে যায় অনুভূতি। শব্দের বুদ্বুদ ওঠে, এমন করেই কি কেটে যাবে সময়?
ভালো হয়ে যাবার পর অস্থিরতা ওকে পেয়ে বসে। কিছুই ভালো লাগে না। যতক্ষণ বই পড়তে পারে ততক্ষণ স্বস্তি, নইলে বাকিটা যন্ত্রণা। ও কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না। বারান্দার ওপর থেকে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় অনেক নীচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে- হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা সেই পথে এই শহরের মানুষগুলোকে ডেকে নিয়ে যায়। মানুষেরা নাচতে নাচতে প্রবেশ করে অন্ধকার গহ্বরে। ওরা আর একটি সুড়ঙ্গ পথ বেরিয়ে আসে এবং আবার ঢোকে। ওদের চেহারায় অন্ধকার লেপটে থাকে। তখন ও হাশেম মিয়াকে দেখতে পায়। ও নিষিদ্ধ এলাকার লোক। ক্লাসের কায়েসের সঙ্গে ওর যোাগযোগ ছিল। সেই সূত্রে ও হাশেম মিয়াকে চেনে। ওকে দেখে দ্রুত রাস্তায় নেমে আসে মিজান।
হাশেম মিয়া ওকে দেখে অবাক হয়। বলে, আপনার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গেছে স্যার?
তুমি কেমন আছো হাশেম মিয়া?
ভালো খুব ভালো।
ও বিগলিত হাসি হাসে। মিজানের মুখ ভরে থুতু উঠে আসতে চায়। ও পেট চেপে ধরে। হাশেম মিয়ার ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে গালে থলথল মাংস। চোখজোড়া কুতকুত করছে। বছরদুয়েক আগেকার হাশেম মিয়া অনেক বদলেছে। ওর চোয়ালের হাড় যখন উঁচু হয়েছিল, চোখ ছিল কোটরগত। তখন ওর মধ্যে এক ধরনের দীপ্র সৌন্দর্য ছিল। এখন ওর দিকে তাকালে খাসি খাসি মনে হয়, যেন যে-কোনো হাটে বিকোবার উপযুক্ত। ওর জন্য ক্রেতার অভাব হবে না।
স্যার, আপনি আমাকে কিছু বলবেন?
হ্যাঁ, বলতে চাই।
মিজান আমতা আমতা করে।
বলেন স্যার?
হাশেম মিয়া ওকে উৎসাহিত করে।
মিজান গড়গড়িয়ে বলে, আমাকে একটি মেয়ে দিও নতুন আমাদানি। যার ঘরে আমি প্রথম যাবো।
ঐ রকমপাবেন না স্যার। কত হাত বদল হয়ে আসে বোঝেন না।
হাশেম মিয়া চোখ টিপ মারে। ও এখন একজন ব্যবসায়ী। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। মিজান দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি, মুখে ঘাম সরে যায়। মরিয়া হয়ে বলে, তাহলে এমন একটি মেয়ে দিও যার বয়স ষোলোর মধ্যে এবং যার কোনো সন্তান হয়নি।
এটা আর কি কঠিন? এ ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু আপনি এমন মেয়ে চাচ্ছেন কেন?
কারণ ওর গর্ভে আমি একটি সন্তান চাই।
হাশেম মিয়া এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে। মিজানের মনে হয় মেয়ের দালালেই কেবল এমন হাসি হাসতে পারে। আর কেউ নয়। কী জঘন্য,কী অশ্লীল। জোরে নয়, আস্তেও নয় অথচ হাতুড়ির মতো বাড়ি মারে কানের গোড়ায়।
ও রেগে বলে, হাসির কিছু নেই হাশেম মিয়া।
কিন্তু মেয়েটি মা হতে চাইবে কেন?
চাইবে না আমিও জানি। আমি ওর মাতৃত্ব কিনবো। যত টাকা লাগে। যতদিন প্রয়োজন হবে, ততদিন ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার।
তারপর সন্তান হলে?
আমি নিয়ে নেবো।
এতিমখানায় রেখে আরও বড়ো হলে ওকে কোনো স্কুলের হোস্টেলে দেব।
বাহ্ সব প্ল্যান কর রেখেছেন। বড়োলোকের খেয়াল-খুশি আর কি! যাকগে, আপনি মেয়ে পাবেন। তবে মা হবে কিনা সেটা আপনি ওর সঙ্গে কথা বলে জানবেন।
মিজান হাশেম মিয়ার হাত চেপে ধরে, কবে?
আম খবর দিয়ে যাবো। আসি।
হাশেম মিয়া রাস্তা পেরিয়ে চলে যায়। মিজানের মনে হয় কতগুলো উজ্জ্বল মুহূর্ত ওকে বেষ্টন করে রেখেছে। ও দেয়ালের গা থেকে নিজেকে টেনে তোলে। স্যান্ডেলে জড়িয়ে যাওয়া একটি লতা উপড়ে ফেলে। ইচ্ছে করে রাস্তা পেরিয়ে সামনের পার্কে গিয়ে বসতে। ঐ পার্ক পেরিয়ে হাশেম মিয়া চলে গেছে, হ্যামিলনের বংশীবাদন শুনতে শুনতে। ওকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ও খুব ঠান্ডা মাথায় ঘরে ফিরে আসে। মা-র কাছ থেকে চেয়ে স্যুপ খায়। দুপুরে জন্য কি রান্না হয়েছে জিজ্ঞেস করে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মসলার সুগন্ধ ওর ভালো লাগে। তারপর বাথরুমে ঢুকে ঝরনা ছেড়ে দিয়ে মনের সুখে দাঁড়িয়ে থাকে। এমনকি গুনগুনিয়ে গানও গায়।
দিনসাতেক পর হাশেম মিয়া ওকে ডেকে নিয়ে যায়। মেয়েটি কৈশোর পেরিয়েছে কেবল, ষোলোয় পা দিয়েছে। ওর গুমোট ঘরে কম পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। ঘরের বাতাসে পাউডারের গন্ধ। মেয়েটির মুখে তেমন সজীবতা নেই। গালে ব্রণ, কপালে কাটা দাগ, শরীরে কিছুটা আড়ষ্টতা। খুব করে বেড়ে ওঠার সময়ে হঠাৎ থমকে যাওয়া ভাব পুরো অবয়বে। মিজান ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। হঠাৎ করে কোনো কথা ও খুঁজে পায় না। এসব ক্ষেত্রে কী করতে হয় এমন কোনো ধারণা ওর নেই। মেয়েটি কিছু বলছে না, মৃদু হাসে। কপালে কাজলের টিপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। মিজানের মনে হয় চেনা।
মিজান দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি ওর সামনে। একদম নাগালের মধ্যে। তবু ও হাত বাড়াতে পারে না। মেয়েটি হাতলবিহীন একট চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে, বসেন?
মিহি কণ্ঠস্বর। যেন কোনো পাখি শব্দ করলো, একটু পর গান গেয়ে উঠবে। মিজান ওর কপালের কাটা দাগের ওপর আঙুল রাখে, এখানে কী হয়েছিল?
বাড়িউলি মেরেছিল।
কেন?
ও তিক্ত হাসি হেসে বলে, প্রথমদিকে নখরামি করেছিলাম। তারপর নিজের আঞ্চলিক টানে বলে, এই কাম করতে রাজি হইছিলাম না। ক্যামনে বুঝবো কন যে গরিবে এতো কিছু মানায় না।
মিজান ওর মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরায় না। ঘরে কিছুক্ষণ নীরবতা। মিজান বলে, বাড়িউলি বুঝি শহরের ভাষা শিখিয়েছে?
হ।
তোমার নাম কী?
মহুয়া।
বেশ নাম।
ও খিলখিলিয়ে হেসে বলে, খেলে নেশা হয়।
কে রেখেছে নামটি? বাবা না মা?
যার দয়ায় এখানে আছি তারা রেখেছে।
ও বাবা, পৈতৃক নাম থেকেও খারিজ হয়ে গেছো তুমি? তোমার ভবিষ্যৎ কী?
পতিতার আবার ভবিষ্যৎ কী? ভবিষ্যৎ তো জোয়ান পোলা গো।
বাহ্ বেশ তো কথা বলতে পারো।
বাবায় নাম রাখছিল ফালানি। অহন শহরের বাসিন্দা হইছি। গাঁয়ের কথা মনে করলে ঘিন্না হয়।
মহুয়া দ্রুত হাতে ওর কাপড় খোলে।
মিজান বাধা দেয় না। কিছু বলেও না। ও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেলে মিজান ওর তীক্ষ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে সম্মোহিতের মতো বলে, ফালানি তুমি আমার সন্তানের মা হইবা?
মা? মহুয়ার কণ্ঠ চিরে যায়।
ভয় পাইও না। আমি তোমার সব দায়িত্ব নিমু।
মহুয়া ভয়ার্ত চোখে মিজানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে ওর চোখ জলে ভরে ওঠে।
মিজান ওর হাত ধরে, কথা বলছ না কেন মহুয়া? মহুয়া হাত ছাড়িয়ে নেয়। ব্যাকুল দৃষ্টিতে মিজানের দিকে তাকিয়ে বলে, একটা গল্প শুনবেন? ফালানি আর মহুয়ার গল্প? ফালানি ক্যান মহুয়া হয় সেই গল্প না কিন্তু।
মিজান ঘাড় কাত করে। দুজনে চৌকির ওপর পাশাপাশি বসে। ফালানির কাঁধের ওপর মিজানের হাত। ফালানির দৃষ্টি মিজানের মুখের ওপর। যেন অনেকদিন পর ও একজন প্রিয় মানুষ পেয়েছে, যে শুধুই ওকে ছিড়েখুঁড়ে পেতে চায়নি, ওর এক নিষিদ্ধ ভুবনের দরজায় করাঘাত করেছে।
থেমে থেমে ফালানি গল্প বলে, একবার আমার কঠিন অসুখ হয়। পেটে খুব ব্যথা। বাবা আমাকে ময়মনিসংহ নিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হই। আমার চৌদ্দ বছর বয়সে একটা অপারশন হয়। কী অসুখ হয়েছিল জানতাম না, শুধু জেনেছিলাম আমার জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমি ভালো হয়ে গেলাম। যেদিন ছুটি হবে তার আগের দিন রাত্রে যে তরুণ ডাক্তার আমাকে দেখতো সে আমার কাছে আসে। কতক্ষণ গল্প করে। এক সময়ে বলে, তুমি খুব সুন্দর। ডাক্তার আমার বুকে হাত দেয়। আমি বাধা দিতে পারিনি। কারণ ডাক্তার বলেছিল, তোমার জন্য আমার মায়া হয়। তুমি আর কোনোদিন মা হতে পারবে না।
কী বললে? মিজান ছিটকে ওঠে। মহুয়া দুহাতে মুখ ঢাকে। মিজান ঘরের মেঝেয় দাঁড়িয়ে নগ্ন মহুয়ার আন্দোলিত শরীর দেখে। ও কাঁদছে।
মিজানের চোখের সামনে একটি অনুর্বর শহর প্রবল হয়ে ওঠে। ওর মুখ ভরে থুতু আসে। ও ভীত চোখে মহুয়াকে দেখে। পতিত জমির অন্ধকার ছেড়ে ও কোথায় পালাবে?
ভালো লেগেছে।