ছোটগল্প।। করোনাক্রান্ত বা করোনা অতিক্রান্ত দিনের কথা।। ইয়ার ইগনিয়াস
ক.
সূর্যাস্তের দিকে সূর্য তার সবটুকু রং ঢেলে দিয়ে দিগন্তকে ধীরে রাঙিয়ে তুলছে । যেন সে জানে, এই অস্তদৃশ্যই কারও কারও অন্তিমদৃশ্য। সমুদ্রের সঞ্চারপথ ধরে ঊর্মি কেটে কেটে যাত্রীবাহী স্পিডবোট এগিয়ে চলছে, চক্রব্যূহের সৈন্যের মতো আরও অগ্রগামী অগনিত ঢেউ এসে বোটটিকে থামিয়ে দিতে চাইছে যেন, জলজ-গর্জনে অন্তত তাই মনে হয়। ক্রমে আঁধারের আয়নিক বন্ধন গাঢ় হয়ে উঠলে বোটের হেডলাইট জ্বলে উঠে। সকলে আলোর উপর চোখ ফেলে ঢেউয়ের তাণ্ডব দেখছে, কখনো ঢেউকে মনে হয় উদ্যত ফণা এখনই ছোবল বসাবে, তলায়ে নিবে তড়িৎ গতিতে। আবার কখনো মনে হয় যাত্রীরা আপন আলয়ে ফিরে আসার সম্ভাষণে ঢেউগুলো কুলীন কুর্ণিশ জানাচ্ছে তাদের। এই দৃশ্যের ফাঁকে, লোকমানের চোখ গিয়ে পড়ে অনুর্ধ্ব-ত্রিশের এক যুবকের উপর, পরিসর থাকতেও যে শেষদিকের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লোকমান লোকটাকে ডাকে, সাড়া না-পেয়ে কাছে যায়, তার চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে, সূর্যাস্তের কিছু রং এখনো তার চোখে লেগে আছে। অভেদ্য অন্ধকারের দিকে তাকায়ে আছে, ঘনরাত্রির আব্রু সরায়ে কী দেখতে চাইছে সে? দিগন্তের ওপার?
লোকটিকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে লোকমান তার হাতে মৃদুস্পর্শ করে বলল— “এত জায়গা থাকতে এখানে এভাবে কোনঠাসা হয়ে বসে আছেন কেন? মধ্যিখানে গিয়ে বসুন।”
লোকটি নিঃস্পৃহ দৃষ্টি ঘুরিয়ে একবার লোকমানকে দেখে নিয়ে প্রত্যুত্তর না-করেই পূর্বের নিশানায় দৃষ্টি উড়ায়ে দেয়। লোকমানও দ্বিতীয়বার লোকটির হীরকধ্যান ভাঙার ব্যর্থ চেষ্টা না-করে বরং লোকটির মনস্তাপের মনস্তাত্ত্বিক উৎসের কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু কূল কই! চিন্তাও তো এক সমুদ্র; অতল, অথৈ। তবুও সে ঢেউ কেটে কেটে স্পিডবোটের মতো আগায়ে যায়, তার একটা কূল চাই-ই। সমস্ত চিন্তাকে সে মগজে ফিল্টার করতে থাকে, কিন্তু কোনো স্ফটিক ধরা পড়ে না। এরই মধ্যে তাদের বোটটি দুইকূলের সমান দূরত্বে এসে পৌঁছেছে। অথচ তার চিন্তার সমুদ্রে সে কি-কূলে, কি-মধ্যখানে, কি-গন্তব্যের কাছাকাছি কিছুই বুঝতে পারে না। পিছনে জলের ভীষণ শব্দ হয়, লোকজন চমকে ওঠে। লোকমান ওদিকে তাকায় না। ভাবে; হয়তো ডলফিন লাফায়েছে। এখন ডলফিনগুলো দুরন্ত হয়ে উঠেছে। ডাঙায় পর্যন্ত চলে যায়। মাসকয়েক আগে কক্সবাজারে একটা ডলফিনকে পিটায়ে মেরেই ফেলল। এই ভাবনার সার না-হতেই একজন যাত্রী বলে উঠল—-
”পিছনের যাত্রীটি কোথায় গেল? পড়ে গেলো নাকি?
পাশের জন বলল— “পড়ে গেলে তো চিল্লায়ে সাহায্য চাইত!”
আরেকজন বলে ওঠল— “তাহলে কি আত্মহত্যা?”
লোকমান শেষোক্তজনের মন্তব্য সাঁয় দিয়ে সারেংকে স্পিডবোটটি ঘুরানোর অনুরোধ করে। সারেং ঘুরে এসে দেখে তার দেওয়া লাইফজ্যাকেট কচুরিপানার মতো ভাসছে, মানুষটির চিহ্নমাত্র নেই। আর সন্ধ্যার সমুদ্রে কেউ ডুব দেওয়ার সৎ-সাহসও দেখাল না। অগত্যা গন্তব্যের দিকে বোট ফেরায় সারেং। আর যাত্রীরা তাদের বুদ্ধিজীবীতা জাহির করতে শুরু করে প্রায় একসাথে। পাড়ার চায়ের দোকানের মতো সবাই কথা বলছে, কে শুনে কার কথা!
স্পিডবোটটা ঘুরায়ে লোকটির জাম্পস্পটে ফিরে আসতে সর্বসাকুল্যে পাঁচমিনিট লেগেছিল। লোকটা আত্মহত্যা না-করলে অন্তত কিছুক্ষণ সাঁতরে ভেসে থাকার চেষ্টা করত, নয়তো সাহায্যের জন্য ডাক দিত, সে তো লাইফজ্যাকেটটা পরে নি! এইটা আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই নয়, আর তাকে শুরু থেকেই ভীষণ বিষণ্ন লাগছিল দেখতে, কিন্তু আত্মহত্যা কেন? এইসব ভাবতে ভাবতে বোট কখন ঘাটে এসে পৌঁছে লোকমান বুঝতে পাারে না। যাত্রীদের হুল্লোড়ে তার সম্বিৎ ফেরে। ঘাটে নেমে এ-কান ও-কান বদলে রাতেই রাষ্ট্র হয়ে যায় ঘটনাটা।
লোকমান, জেলা স্বাস্থ্য-অধিদপ্তরে গিয়েছিলো করোনাভাইরাস সম্পর্কে যাবতীয় নির্দেশনা জানতে। যাতে জনসাধারণকে সচেতন করা যায়। সে এই দ্বীপ ইউনিয়নের প্রধান স্বাস্থ্যকর্মী। বাসায় পৌছে, আসার পথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পূর্ণবর্ণনা করে। পরিবারের সদস্যদের চোখে-মুখে তখন দুনিয়ার তাবৎ তাজ্জব ফোটে উঠে। খেয়ে শুতে গেলেও স্ত্রীর উৎসুক্যে ঘটনাটা পুনর্বার বলতে বাধ্য হয় সে।
খ.
পরের দিন খুব ভোরেই লোকমানকে তার ব্যালকনিতে দাঁড়ায়ে থাকতে দেখা যায়। অন্যদিন এতো ভোরে কখনোই উঠতে দেখা যায় নি তাকে। হয়তো ঘুমের ভিতর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেছে। হতে পারে কাল সন্ধ্যার ঘটনাটা তাকে ঘুমাতেই দেয় নি। সঠিক কারণ জানা যায় না। পুবাকাশ আপেলের মাংসের মতো শাদা হয়ে আছে, সূর্যকুসুম তখনো জলের নিচেই। উঁকি দিবে দিবে এমন
। কয়েকটা মাছরাঙা মৎস্যশিকারের জন্য চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করছে। ভাটা হওয়ায় সমুদ্রকে শান্ত বালকের মতো লাগছে। আরও দূরে স্থির জল মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্নের মতো চিকচিক করছে। একদৃষ্টিতে তাকায়ে সে পরখ করার চেষ্টা করে কোনটার কান্তি বেশি! জলের? নাকি বেঁচে থাকবার স্বপ্নের? মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকবার স্বপ্ন দেখলেও সে জানে, জীবন কখনোই ওই জলের মতো চাকচিক্যময় নয়। সে জানে, “কত জীবন ফুলের মতন এই মাটিতেই ঝরে যায়, কে জানে কোন্ মানুষ কখন অস্তরাগের গান গায়, নগর জীবন একই রকম একই ধারায় বয়ে যায়, শুধু বয়ে যায়।” এভাবে আরও কিছুকাল প্রকৃৃৃতি দর্শন শেষে সে ঘরে ফিরে আসে। তৈরী হয়ে অফিসে যায়, সহকর্মীদের ব্রিফিং দিয়ে ফিরেও আসে।
গ.
লোকমান প্রায়ই বিকেলে ব্যালকনিতে বসে। সেদিনও বসে ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে একটা ফটো সমেত নিখোঁজ সংবাদ দেখে হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে যায়! সেই লোকটিই। যে, কাল তাদেরই স্পিডবোট থেকে লাফায়ে পড়ে সলিলসমাধি নিয়েছে। তারপর ওই লোকটির পরিচিতি জানতে দ্রুত সংবাদটি পড়ে চোখ বিস্ময়ে আরও বিষ্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে, জানা যায় লোকটির বাড়ি মাইজদী এবং সদ্য জার্মানিফেরত। একটি চিরকুটসহ মালপত্র বাসার আঙিনায় রেখে তিনদিন আগে থেকে লাপাত্তা। চিরকুটে যাবতীয় ডকুমেন্টের সাথে সে যে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত তাও জানায়। এতটুকু তে এসে লোকমান আর পড়তে পারে না। বৈকালিক হাওয়া সত্ত্বেও ঝুরঝুর করে গামছে। সেও যে সেই ভাইরাসের বাহক, তা তার বুঝতে বাকি থাকে না। এরই মধ্যে পরিবার এবং সহকর্মীদের সংস্পর্শে সে গিয়েছে। তারও বা দোষ কী! আত্মহত্যা করা লোকটি জায়গা থাকার পরেও এককোণে জড়সড় হয়ে বসার কারণ তো তার জানা ছিলো না। লোকটির সুখদ যাত্রার জন্য সে মানবিক আহবানই করেছিল সে। ঘুনাক্ষরেও কেউ ভাবে নি, এই ভাইরাস এত তাড়াতাড়ি এই দ্বীপদেশ পর্যন্ত চলে আসবে। সে যে লোকটির মনস্তাপের কারণ খুঁজেছিলো সে পেয়ে যায়, পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতেই হয়তো এই দূর সমুদ্রে এসে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ও- চিকিৎসা না নিয়ে মৃত্যু কেন বেছে নিলো?
লোকমান মাথা স্থির করতে পারে না। তার মাথার ভিতর নমরুদ-বধ মশা যেন কিলবিল করছে। সে সহকর্মীদের ফোন করে তার অবস্থা শেয়ার করে। তারা প্রায় প্রত্যেকেই বিষয়টা চেয়ারম্যান সাহেব কে বলে পুরো দ্বীপটা লকডাউন করার বন্দোবস্ত করতে বলেন। তাকেও সেল্ফ আইসোলেশনে থাকতে অনুরোধ করেন। এমনকি তার ফ্যামিলির প্রত্যেকটা সদস্যকে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেন তারা।
ঘ
দীর্ঘ আটষট্টি দিনের কোয়ারেন্টাইন ভেঙে সোহরাব আজ বাইরে বেরিয়েছে। সোহরাব হাসান। সুমহলায় বাড়ি । চাকরিসূত্রে এই দ্বীপদেশে থাকে। মা কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন, অন্যভাইদের সাথে তেমন বনিবনা নাই। অবিবাহিত। এই দ্বীপটি লকডাউন হয়ে গেলেও, তার বাড়ি যেতে বাড়তি উৎসাহ ছিলো না। জলবেষ্টিত এই স্বর্গচ্যুত গ্রামেই থেকে যায় সে। এখানে সে একাই থাকে। লোকমান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে সে কোয়ারেন্টাইন ছিলো। সে ছিলো লোকমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন। তারও কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলো, সে অনলাইন ঘেঁটে ওই অবস্থায় কী করণীয় জেনে নিয়ে সে-মত অনুসরণ করেছে। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সে রিকভারও করে। কিন্তু রিকভার করলেই যে তারে আর এই ভাইরাস ইফেক্ট করবে না এমনটা কিন্ত নয়; তাই সে সুস্থ হওয়ার পরও সেচ্ছায় গৃহবন্দী ছিলো।
আজও অল্পকিছু আহারের আশায় বেরিয়েছে। শেষ সতের দিন পার হয়ে গেছে পেটে পানি ভিন্ন কিছু পড়ে নি। না- খেয়ে পরগাছাক্রান্ত গাছের মতো জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। আগে কয়েকবার ত্রাণ পেয়েছিল। শেষবার পেয়েছিল দিনপঁচিশেক আগে। আগে সপ্তাহান্তে একবার দিত, এভাবে বারকয়েক পাওয়ার পর সঞ্চয়ের চিন্তা তার মাথায় আসে নি। তাই স্বাভাবিক ভাবে খেয়েদেয়ে পরেরবারের জন্য অপেক্ষা তার ছিলো। কিন্তু একসময় এমন হলো, সপ্তাহ কেটে যায় কেউ আসে না। পরের সপ্তাহও কেটে যায়, ত্রাণ নিয়ে কেউ আসে নি। তাই একরকম বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসে আজ। আর তার মনে পড়ে, দেশে তো চাল-চোরের তালিকা হয়েছিলো কিছুদিন আগে। সেখানে কী এই এলাকার চেয়ারম্যানের নামটাও ছিলো? তার মনে পড়ে না। হয়তো ছিলো, নইলে এত তাড়াতাড়ি ত্রাণের চাল শেষ হওয়ার তো কথা নেই! সামান্য এই দ্বীপে লোকসংখ্যাই বা কত? অনেকাংশ লোক এখানকার নয়, বাণিজ্য করতেই এখানে আসে তারা। যারা একেবারে ছিন্নমূল, তারা এই এলাকার আদি অধিবাসী। তারাই ছিলো শুধু। লকডাউনের সময় সবাই যে যার মতো নিরাপদ স্থানে চলে গেলেও তারা যেতে কোথাও যেতে পারে নি; তাদের তো বাসস্থান বলতে উপকূ নারকেল বাগানের তলে ঝুপড়ি মতো ঘরগুলো। তাও পর্যটনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মধ্যেমধ্যে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাইরে এসে সোহরাবের মনে হয়, এই স্বর্গোদ্যান এখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভূমি ছাড়া কিছুই নয়। কোনোদিকে কাউকে দেখা যায় না। দোকানপাট সব বন্ধ। এমনকি সব ঘরগুলোও। প্রায় ঘর বাইরে থেকে তালা দেওয়া। যে ঘরে তালা লাগানো নেই, সেই ঘরগুলোর দরজায় অনেকক্ষণ আঘাত করেও কোন প্রতি-উত্তর পায় না। মানুষের উপস্থিতি আছে কি না তাও জানা যায় না। আবার কোনো কোনো ঘরের ভিতর থেকে তীব্রগন্ধ আসে লাগে তার নাকে। ভিতরে লাশ পঁচে আছে। তবে কি সৎকারের জন্যও কেউ ছিলো না!
লাশপঁচা গন্ধে তার বমি হয়, আরও দূর্বল হয়ে পড়ে। তবুও হাঁটে। ধুকে ধুকে জীবনের এই পথচলায় চোখ পড়ে, পথের পাশে কিছু মরা পোড়ানোর ছাইয়ের স্তুপ আর অনেকগুলো নতুন কবর। তার বুঝতে বাকি থাকে না লোকমানকে দিয়ে যে মৃত্যুর শুরু হয়েছিলো, তা থেমে থাকে নি। যত্রতত্র ছাইয়ের স্তুপ আর নতুন কবরের চিহ্ন দেখে বুঝা যাচ্ছে এলাকায় মৃত্যুর হার কত! কাঙ্ক্ষিত লোক না-পাওয়ায় লাশ শ্মশান কিংবা গোরস্তানে নিতে পারে নাই হয়তো। ঘরের লোকেরা যে যেখানে পেরেছে সৎকার বা দাফন সম্পন্ন করেছে। এমন দৃশ্য সে দুইমাসেরও কিছু আগে ফেসবুকে দেখেছে। মুম্বাইয়ে করোনা সন্দেহে সৎকারের জন্য কেউ এগিয়ে না-আসায়, আত্মজারাই বাবাকে বহন করে শ্মশানে নিয়ে যায়।
এরপরে যারা মরেছে তাদের শেষকৃত্যও হয়নি। চিকিৎসা পাবে কি! লোকমান পর্যন্ত চিকিৎসা পায় নি। কোন স্টিমার ট্রলার ছিলো না তখন, জেলা স্বাস্থ্য অফিসারকে করে ওই পার থেকে একটা জলজ যান বা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করার আকুতি জানায়েছিল তার পরিবার। স্টিমার বা ট্রলারের মালিক প্রথমে রাজি না হলেও পরে পাঠাতে সম্মত হলেও বেঁকে বসে সারেং-রা। তাদের পিপিই নাই। তারা জানে রুগীকে তাদেরকেই ধরে ট্রলারে তুলতে হবে, আর তার জন্য চায় পার্সোনাল ইকুয়িপমেন্ট। তাদের দাবি সঙ্গত ছিলো। কিন্তু কেউ তাদের পিপিই ব্যবস্থা করে দিতে পারে নি। তারাও যায় নি। অন্যদিকে কোনভাবেই এয়ার এ্যাম্বুলেন্সও ব্যবস্থা করা যায় নি। একরকম চিকিৎসাহীনে মারা গেছে এলাকার প্রধান স্বাস্থ্যকর্মী লোকমান।
এসব সে ফেসবুকে দেখেছিলো। তখনো তার ফোনে ছিলো মেগাবাইট। মেগাবাইট শেষ আজ একটা দোকানও খোলা নাই, রিচার্জও করা গেল না। শোনা যায়, মরে গেলেই একমাত্র টাকার উপযোগিতা পুরায়। কিন্তু এখন এমনই এক সময়, টাকা মানুষের কোনো উপকারেই আসছে না, অথচ তার পকেটভর্তি টাকা কোন কাজে আসছে না। দোকান বন্ধ। কিছু খাওয়ার বা মেগাবাইট কিনে ফেসবুকে ফ্রেন্ডদের কাছে সাহায্য চাওয়ার সুযোগ নাই। কিংবা অন্য কারও ফোন থেকে হলেও পরিচিতদের কল করে নিজেকে উদ্ধারের জন্য বলতে পারতো কিন্তু হায় কাউকেই পাওয়া গেল না। দূরে কেউ বেঁচে আছে কি না জানে না, বেঁচে তো থাকবেই, করো আক্রান্ত হলেই যে মারা যাবে এমন নয়; রিকভার করার পার্সেন্টেজই বেশি। সে নিজেও রিকভার্ড।
ঙ
আজ একটু হেঁটেই সে যথেষ্ঠ টায়ার্ড। কোথায় কোথায় কে কে বেঁচে আছে তা বের করে, তাদের থেকে সাহায্য চাওয়ার শক্তিও তার আর অবশিষ্ট নাই। কিংবা যারা বেঁচে আছে, তারাও কি নিজ উদ্যোগে আরও কেউ বেঁচে আছে কিনা খুঁজে দেখবে? তার তেমন মনে হয় না। কারণ, সমাজ তাদের শিখিয়েছে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আর বিজ্ঞান শিখিয়েছে, ঘরে থাকুন, সামাজিক দূরত্বে থাকুন। প্রত্যেকেরই প্রাণের ভয় আছে। তাই লোকেদের আগায়ে আসার সম্ভাবনা শূন্যের কোটায়।
সরকার অন্তত এই সময়, মোবাইল কোম্পানির সাথে চুক্তি করে কিছুদিন পরপর গিগাবাইট ফ্রীতে দিতে পারতো। কতই বা টাকা! সরকারের প্রণোদনার কাছে তো তা একেবারেই নস্যি ব্যাপার! সরকারীদলীয় নেতারা যেভাবে চাল চোরের মহড়ায় মেতেছে, তাতে বেসরকারি দাতাগোষ্ঠী ছাড়া, সাধারণ জণগণের তো কোনো ভরসা নেই। গিগাবাইট পেলে অন্তত বেসরকারি দাতাগোষ্ঠীদের গ্রুপে যুক্ত হয়ে সাহায্য চাইতে পারতো, সোহরাবদের মতো অসহায়েরা।
এইসব ভাবনায় ভিতরে ভিতরে সে চূর্ণ হতে থাকে। সূর্যের চোখেও ধীরে ভর করছে মৃত্যুর মতো আঁধার। তার হাঁটার শক্তিও আরও হ্রাস হয়ে আসে। তাই সে বাসায় ফিরে যেতে উদ্যত হয়। ফিরতে ফিরতে সে ভাবে দেশের কী হাল! তার মনে পড়ে, দুইমাস আগে এক মৌলানার জানাযায় লকডাউন ভেঙে যে পরিমাণ লোকের উপস্থিতি সে ফেসবুকে দেখেছে, তাতে গোটা দেশে কোন মানুষ সুস্থ আছে কি না, তার অনুমানে কুলায় না, থাকলেও কতটুকু সুস্থ আছে তা নিয়ে তার সন্দেহ হয়। এই সন্দেহ নিতান্ত অমূলকও নয়। তবুও সে ভাবে, কোনো দাতাগোষ্ঠী বা কোনো সামরিক দল কিংবা কোনো মহৎপ্রাণ লোক তাকে সাহায্য করতে, বাঁচাতে নিশ্চয়ই আসবে।
মানুষ তো আশায় বাঁচে। সাহায্যের আশায় সে ফিরে যায়। যেতে যেতে ছাইয়ের স্তুপ থেকে একটা কয়লা হাতে তুলে নেয়। একটা সুদৃশ্য প্রাচীরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, কয়লা দিয়ে কিছু একটা লিখতে গিয়ে তার চোখে পড়ে মসৃণাক্ষরে লেখা একটা ছোট্ট নিষেধাজ্ঞা দ”দেয়ালে চিকা মারা ও পোস্টার লাগানো নিষেধ। —-আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।” লেখাটা দেখে সে থমকে যায়। কোথাও কেউ নেই। তবুও আইনকে অমান্য করে না। তাই সে কিছু না লিখে আবার হাঁটতে থাকে। এভাবে কয়েকটা দেয়াল পেরিয়ে সে একটা পরিষ্কার দেয়াল পেয়ে যায়, আদ্যোপান্ত পরখ করে নিশ্চিত হয়, কোনো নিষেধবাণী নাই। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে মহাকালের দেয়ালে লিখে দেয় “ত্রাণ চাই, আটদিন খাই নাই” নিচে তার মোবাইল নং টা ০১+++ +++ +++
ভালো লাগলো ইয়ার
ভালো হয়েছে ইয়ার
এই লেখকের লেখা গল্প প্রথম পড়লাম।ভালো লাগলো