ছোটগল্প

ছোটগল্প।। রিলিফ ওয়ার্ক ২০২০।। প্রিন্স আশরাফ

করোনা। সারাদেশে সর্তকতা। লক ডাউন চলছে। লক ডাউন সফল করার লক্ষ্যে আইনরক্ষাবাহিনির কড়া নজরদারি। লক ডাউনের মধ্যেও কিছু মানুষ বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। পেটের ক্ষুধা, সন্তানের ক্ষুধার্ত পাংশু মুখের কাছে লকডাউন তুচ্ছ, তুচ্ছ করোনার মৃত্যুভয়। মৃত্যুভয় পরাজিত পেটের কাছে।
চলছে ত্রাণ বিতরণ। যতটুকু বিতরিত হচ্ছে তার চেয়ে প্রচারই বেশি। ত্রাণবিতরণের প্রচারণা চলছে ফেসবুক জুড়ে। তাতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অনেকেই। নিজেকে বা নিজের দলকে বা নিজেদের গ্রুপকে প্রচারে রাখার জন্য হলেও ত্রাণ বিতরণে নেমে পড়েছে সরকারি বেসরকারি অনেক সংস্থা ও গ্রুপ।
সামিউল কায়সার, ফেসবুকের কায়েস সামী নিজেও লকডাউনে। ফেসবুকে ত্রাণবিতরণের ছবি দেখে দুস্থ মানুষের জন্য কিছু একটা করতে মনটা ছটফট করে। একে তো মেসের সব সদস্যরা লকডাউনের ছুটিতে বাড়ি চলে যাওয়ায় একা একা জেলখানার অনুভূতি নিয়ে থাকে, তারপর দুস্থ নিপীড়িত ভুখা মানুষের জন্য কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায়।
ফেসবুকে সে বেশ কয়েকটা গ্রুপের সাথে জড়িত, কিছু গ্রুপের সক্রিয় সদস্যও সে। কয়েকটা গ্রুপ নেমে পড়েছে ত্রাণকার্যে। সরকারী চাকুরে হওয়ার কারণে বৈশাখী ভাতা পেয়েছে সে। কিন্তু লকডাউনে থাকায় কোন বৈশাখি পোশাক কিনতে না পারায় পুরো টাকাটাই জমে গেছে। ভেবেছে এবার বৈশাখি ভাতার টাকাটা সে সক্রিয় গ্রুপের ত্রাণের তহবিলে দান করল।
সামীর অজান্তেই গ্রুপ থেকে তার ছবি এবং ত্রাণের দানের টাকার কথা উল্লেখ করে সচিত্র দান পোস্ট করায় সে একটু বিব্রত হলেও কমেন্টে দানবীর হাজী মহসীন, দাতা হাতেম তাই উল্লেখ করায় ভেতরে ভেতরে আপ্লতু হয়ে পড়ল। সে কারণেই যখন গ্রুপ লিডার তাকে ত্রাণ কার্যে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল তখন সে অনুরোধ ফেলতে পারল না।
করোনার ভয় উপেক্ষা করে হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক পরে ত্রাণের প্যাকেট বিতরণে বেরিয়ে পড়ল তার দল। পথে অনেক ভুখা লোকজনকে দেখা গেলেও তাদের ত্রাণের গাড়ি কোথাও দাঁড়াল না। শহর পেরিয়ে র্নিদিষ্ট একটা এলাকার মাঠে গিয়ে থামল গাড়িটা। ওখানে আগেই দরিদ্র ত্রাণপ্রত্যাশীরা নির্দিষ্ট দুরত্বের বৃত্তে ফাঁকা ফাঁকা বসেছে। কিন্তু ত্রাণদানের জন্য জড়ো হওয়া চেয়ারম্যান, মেম্বার, নেতা, পাতিনেতারা ছবি তোলার জন্য গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েছে। সামী মৃদুস্বরে কথাটা বলতেই গ্রুপনেতা বলল, উনারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ, উনাদের গায়ে কি আর করোনা আছে?
সামী নিজেকে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও উপস্থিত নেতাদের মধ্যে তাকে বড়ো ডোনার হিসাবে পরিচয় করানো হলো। তার হাত দিয়েও কিছু ত্রাণের প্যাকেট দিতে হলো। উপস্থিত সবাইকে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে না, কেউ কেউ পাচ্ছে, কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছে। সামী একটু রুষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতেই চেয়ারম্যান দেতো হাসি হেসে বলল, ওরা তো আমাদের গ্রুপের না, যে ত্রাণ তা গ্রুপের বাইরে দেওয়া যাবে না।
লাঞ্চের বিরতির আগেই ত্রাণকার্য সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো। ভেতরে তখনও অন্তত শখানিক মানুষের ত্রাণের প্যাকেট রয়ে গেছে। লাঞ্চের বিরিয়ানীর প্যাকেট খুলতে খুলতে সামী গ্রুপলিডারকে জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কখন দেবে? দুপুরের পরে?’
গ্রুপলিডার অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওগুলো দেবো কি?’ চেয়ারম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ওদের দিতে হবে না? এই সময় ওদেরও কত পরিচিতজন না খেয়ে আছে জানেন?’
সামী আর খুব বেশি কিছু জানতে চাইল না। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানের লোকের সাথে চেয়ারম্যানবাড়িতে গেল। চেয়ারম্যান দলবল নিয়ে আরেক জায়গায় ত্রাণ বিতরণে গেল।
গেষ্টরুমে শুতেই ক্লান্ত শরীরে ঘুম এসে গেল সামীর। প্রস্রাবের বেগ পেতেই ঘুম ভেঙে গেল সামীর। গেষ্টরুমে কোন বাথরুম নেই, একটু খুঁজে পেতেই বাথরুম পেয়ে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সামীর। বাথরুম ভর্তি ত্রাণের প্যাকেট। প্রসাব করার জায়গাটুকুও নেই। সামী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে হেটেই চলে এলো ত্রাণ বিতরণের স্কুলে।
রাতে ত্রাণের খালি ট্রাক নিয়ে শহরের পথে ফেরার সময়ই ফেসবুকে নিউজটা পেয়ে গেল সামী।
ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগে চেয়ারম্যান গ্রেফতার। চেয়ারম্যানের বাড়ির বিভিন্ন ঘর থেকে ত্রাণসামগ্রী উদ্ধার, এমনকি বাথরুমের মধ্যেও পাওয়া গেছে ত্রাণের খাদ্যসামগ্রী!
অকল্যাণের এই দিনগুলোতে ফেসবুকই এখন আসল প্রশাসন!
মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিওটুকু তাতে কাজে এসেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *