ছোটগল্প

ছোটগল্প- দ্যুতি- আহমেদ সৈয়দ শাহনুর

দ্যুতি।। আহমেদ সৈয়দ শাহনুর

​ইংল্যান্ডের সারে কাউন্টির শান্ত শহর গিল্ডফোর্ডের পুরোনো কিন্তু পরিপাটি একটি বাড়িতে বাস করেন নূর আহমেদ। বাইরে থেকে দেখলে তাঁকে আর দশজন সাধারণ অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ-বাংলাদেশীর মতোই মনে হবে। মৃদুভাষী, পরনে হালকা উলের সোয়েটার, আর সকালে টিউলিপ লাগানো ছোট বাগানটিতে একটু হেঁটে আসা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। এই সাধারণ মানুষটির ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি বিশাল হৃদয়ের সমাজ সেবক। তাঁর সমাজসেবা কোনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া, লোক দেখানো শীতের কাপড় বিতরণ বা কোন সংগঠনকে বড় অনুদানের চেক তুলে দেওয়ার মতো নয়; তাঁর সেবা একেবারে নীরব, ব্যক্তিগত এবং অত্যন্ত আন্তরিক।

​নূর সাহেব একসময় লন্ডনে একটি ছোট একাউন্টিং ফার্ম চালাতেন। ব্যবসা থেকে যা উপার্জন করেছেন, তার একটি বড় অংশ তিনি আলাদা রেখে দিতেন সমাজ সেবা করার জন্য। তাঁর কাছে সম্পদ হলো একটি দায়িত্ব, যা তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করে তোলার জন্য ব্যবহার করতে হবে। নূর আহমেদ এর পুরোনো বন্ধু জহির সাহেব, যিনি এখন কুমিল্লায় থাকেন, হঠাৎ করে জানতে পারলেন তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য সঞ্চিত টাকা তার চিকিৎসার কাজে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। জহির সাহেব খুবই লাজুক প্রকৃতির, তাই নূর সাহেবকে জানাতে পারেননি। নূর সাহেব নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। একদিন ফোনে শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “জহির, তোর বাড়ির পাশে যে পুরনো আম গাছটা, সেটা কি এখনো আছে?”
জহির সাহেব অবাক হয়ে উত্তর দিলেন, “আছে, কিন্তু তুই হঠাৎ…”
নূর সাহেব কথা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, “শোন, আমি একটা দরকারি কাগজপত্রে তোর ঠিকানাটা ব্যবহার করব। তাই তোর ব্যাংক একাউন্ট নম্বরটা আর ফোন নম্বরটা লাগবে। কোনো চিন্তা করিস না।”
পরের সপ্তাহেই জহির সাহেবের একাউন্টে একটি মোটা অঙ্কের টাকা জমা হলো ‘পুরোনো পাওনা’ উল্লেখ করে। সঙ্গে একটি ছোট্ট মেসেজ: “আম গাছটার যত্ন নিস। বিয়েতে যেন কোনো কমতি না হয়। তোর বন্ধুর উপহার।” জহির সাহেব বুঝতে পারলেন কে এই বন্ধু নীরবে পাশে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু নূর সাহেবকে ধন্যবাদ বলার সাহস পেলেন না, কারণ তিনি জানতেন নূর সাহেব সামান্যতম প্রচারও পছন্দ করেন না।

নূর আহমেদ সাহেবের দূর সম্পর্কের এক ভাতিজা, তারেক। সে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। সে অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। নূর সাহেব তারেকের সাথে নিয়মিত ইমেইল চালাচালি করতেন। তারেক যখনই কোনো বই বা ল্যাপটপের অসুবিধার কথা উল্লেখ করত, তার পরের মাসেই তারেকের বাবার একাউন্টে “কৃষি পণ্যের অগ্রিম মূল্য” হিসেবে টাকা চলে যেত। তারেকের পরিবার কখনো জানতে পারত না যে এটি নূর সাহেবের পাঠানো অর্থ। তারা মনে করত স্থানীয় কোনো ব্যবসায়ী সাহায্য করছেন।
একবার তারেক অসুস্থ হলো এবং চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন পড়ল। তারেকের বাবা খুবই চিন্তিত। নূর সাহেব তারেককে শুধু ইমেইলে জিজ্ঞেস করলেন, “তারেক, শরীর কেমন? পড়াশোনা ঠিক চলছে তো?”
তারেক জানালো যে শরীর ভালো নয়। নূর সাহেব এর উত্তরে শুধু লিখলেন, “আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তিন দিনের মাথায় তারেকের চিকিৎসার সমস্ত খরচ মেটানোর জন্য টাকা চলে এলো, যা পাঠানো হয়েছিল একটি অজ্ঞাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে। নূর সাহেব জানতেন, তারেকের আত্মমর্যাদা খুব বেশি। সরাসরি সাহায্য করলে সে নিতে চাইবে না। তাই তিনি এমনভাবে সাহায্য করতেন যেন তা প্রকৃতির স্বাভাবিক দান বা অপ্রত্যাশিত কোনো সুযোগ বলে মনে হয়।

​নূর সাহেবের এই নীরবতা এবং ব্যক্তিগত সাহায্য অনেকের জীবনেই আলো ছড়িয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, দান করলে ডান হাত যা দেয়, তা যেন বাম হাত জানতে না পারে—এই শিক্ষাটাই সবচেয়ে বড় মানবতা। তিনি নিজেকে ‘সমাজ সেবক’ মনে করেন না, তিনি মনে করেন, তিনি কেবল নিজের দায়িত্ব পালন করছেন।

​একদিন গিল্ডফোর্ডের একটি কফি শপে তাঁর এক প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, “আহমেদ, আপনার এত সময় কী করে কাটে? কী করেন আজকাল?” নূর সাহেব মৃদু হেসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলেন, “আমি শুধু পুরোনো স্মৃতিগুলো একটু ঝালিয়ে নিই, আর খেয়াল রাখি যেন আমার প্রিয় মানুষগুলোর জীবনে নতুন কোনো বিষাদের ছায়া না পড়ে। এটাই আমার অবসর বিনোদন।”
তিনি তাঁর কাজটা প্রচারের আলো থেকে দূরে, ইংল্যান্ডের ঠান্ডা আবহাওয়ার মতো শান্ত ও স্থিরভাবে করে চলেন। তিনি এক নীরব, নিভৃতচারী আলোর দূত, যিনি নিঃশব্দে অনেকের অন্ধকার দূর করে দেন।

নূর আহমেদ সাহেবের সাহায্য শুধু দেশের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও তিনি ছিলেন একটি অদৃশ্য অবলম্বন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে বাস করতেন রেশমা। তিনি বিধবা হওয়ার পর একটি ছোট টেক-অ্যাওয়ে শপ চালিয়ে দুই সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন, কর্মচারীর বেতন আর লন্ডনের চড়া ভাড়া মেটাতে গিয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পরিস্থিতি দেখে কমিউনিটির অনেকেই সহানুভূতি দেখাতেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। ​রেশমার সাথে নূর সাহেবের পরিচয় ছিল সামান্যই, একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল মাত্র। কিন্তু নূর সাহেব কমিউনিটির মানুষের খোঁজখবর রাখতেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। তিনি জানতে পারলেন যে রেশমা প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। তিনি সরাসরি রেশমার কাছে না গিয়ে, তাঁর বিশ্বস্ত প্রাক্তন অফিস সহকারী, মিস্টার হ্যারিসকে দিয়ে একটি পরিকল্পনা করলেন। হ্যারিস রেশমার দোকানে গেলেন এবং একটি “স্থানীয় উদ্যোক্তা সহায়তা প্রোগ্রাম”-এর কথা বলে একটি ফর্ম জমা দিতে বললেন। সেই ফর্মে রেশমার ব্যবসার আর্থিক বিবরণ ছিল। এক মাস পর, রেশমা জানতে পারলেন যে তাঁর দোকানের সব পুরোনো ধার শোধ হয়ে গেছে এবং তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একটি জরুরি কার্যনির্বাহী তহবিল জমা হয়েছে, যা তাঁকে পরবর্তী ছয় মাস স্বস্তিতে ব্যবসা চালাতে সাহায্য করবে।ফান্ডিং লেটারে প্রেরকের নাম হিসেবে একটি অলাভজনক সংস্থার নাম লেখা ছিল, যার ঠিকানা ছিল লন্ডন থেকে দূরে ম্যানচেস্টারে। রেশমা মনে করলেন এটি হয়তো সরকার বা কোনো বড় দাতব্য সংস্থার সাহায্য। তিনি জানতেন না, এই পুরো প্রক্রিয়ার পেছনের মূল চালক হলেন গিল্ডফোর্ডের নীরব নূর আহমেদ সাহেব, যিনি নিজের পরিচিতি গোপন রাখতে কয়েক স্তর দূরে থাকা একটি শেল কোম্পানি ব্যবহার করেছেন। রেশমার আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়, সে ব্যাপারে নূর সাহেব ছিলেন সজাগ।

​নূর আহমেদ সাহেব তাঁর জীবনে যা করেছেন, তার বিনিময়ে তিনি কখনো কোনো ধন্যবাদ বা প্রতিদান চাননি। তাঁর কাছে মানসিক শান্তিই ছিল সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কিন্তু জীবন কখনো কখনো নীরবে আলো ছড়ানো মানুষটিকেও সম্মান জানাতে পিছপা হয় না। একদিন সকালে, নূর আহমেদ সাহেব তাঁর ছোট বাগানটিতে কাজ করছিলেন। এমন সময় বাইরে একটি ক্যুরিয়ার ভ্যান থামল এবং একটি বেশ বড় পার্সেল তাঁকে ডেলিভারি দিয়ে গেল। পার্সেল খুলে তিনি দেখলেন, ভেতরে তাঁর একটি সুন্দর পোট্রেট (ছবি) আঁকা। ছবির নিচে একটি ছোট কাঠের ফলক লাগানো ছিল, যেখানে ইংরেজিতে লেখা:
“To the silent supporter, whose light shines brightest in the shadows. From those whose lives you touched.”
(সেই নীরব সমর্থকের জন্য, যার আলো অন্ধকারে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। তাদের পক্ষ থেকে, যাদের জীবন আপনি স্পর্শ করেছেন।)
তিনি বুঝতে পারলেন না কে এটি পাঠিয়েছে। কয়েকদিন পরে, তাঁর ফোন এলো। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন তারেক (তাঁর সেই ভাতিজা, যার উচ্চশিক্ষায় তিনি সাহায্য করেছিলেন)। তারেক এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি ভালো চাকরি পেয়েছে। তারেক বললেন, “চাচা, আপনি হয়তো জানতে পেরেছেন যে আমি এখন আমার পায়ে দাঁড়িয়েছি। নূর সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি শুধু বললেন, “তোমরা সবাই ভালো থেকো। তোমাদের ভালো থাকাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।”
তিনি পোট্রেটটি তাঁর বসার ঘরের সবচেয়ে আলোকিত স্থানে রাখলেন। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা নূর আহমেদ এর জীবেন এই পোট্রেটটি নীরবে এই সাক্ষ্য দিয়ে চলে যে, সত্যিকারের সমাজসেবা শব্দের চেয়ে কাজে এবং প্রচারের চেয়ে নীরবতায় অনেক বেশি শক্তিশালী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *