ছোটগল্প

ছোটগল্প।। অলৌকিক চশমা।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

সে এখন না কিশোর না যুবক। ওর বয়সী ছেলেকে আবর্জনার স্তুপে ঘুরে বেড়াতে, খোঁচাখুঁচি করতে সচরাচর দেখা যায় না। এমন ছিন্নমূল কাউকে কাউকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে, নেশায় আসক্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চিতে নেতিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে ভদ্রলোকেরা নানাভাবে ব্যবহার করে। তবে মানিক নগরের পথে যাতায়াতের সময় রাস্তার পাশে কমলাপুরের ময়লার ডিপো পাশকাটিয়ে যাওয়ার সময় আবর্জনার স্তুপের উপর ওকে দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য ওকে দেখে স্বাভাবিক মনে হয় না। নেশাসক্ত মনে হয়। লিকলিকে দেহ। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, নাটকের ছেলেদের মতো। থুতনিতে কয়েকটা পাতলা দাড়ি আর তেমনি পাতলা গোঁফ শুকনো ঠোঁটের উপর। ছেলেটা ভাগাড়ের আবর্জনা খুঁচিয়ে উচ্ছিষ্ট কুড়ায়। এ কাজই সে করে বেশ ক’বছর। যা যা কুড়ায় ভাঙারির দোকানে নিয়ে বেচে। যা টাকা পায় তা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মিটে যায়। পেটের ক্ষুধা ছাড়া আর কোনো ক্ষুধা এখনো অনুভব করে না। হয়তো এ কাজটাই সে করতে পারে বলে আর কিছু করার কথা ভাবেও না। কুড়ানোর কাজ সে শুরু করেছিল খাবার কুড়ানো দিয়ে।
তখন ওর বয়স দশের কম হবে, ওকে খৎনা করানো হয়েছিল এর আগের বছর। এর পর একদিন ঘুম ভাঙলে দেখেছিল পরিত্যক্ত বগির আশে পাশে ওর মাও নেই। বাপ আগেই কোথাও চলে গিয়েছিল, সে বাপের মুখ মনে করতে পারে না। খৎনা দেবার আগে মা ওকে বলেছিল খৎনা করানো হলে সে আর ছোট থাকবে না। বড় হয়ে যাবে। তখন সে নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি করতে পারবে। ঘুম থেকে জেগে মাকে খুঁজতে প্লাটফর্মে গিয়েছিল। মাকে সেখানে পায়নি। এর পর ক্ষুধায় টিকতে না পেওে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া খাবারের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেয়েছিল। এর পর মাকে প্লাটফর্মে আরও অনেকদিন খুঁজেছিল, মাকে না পেলেও উচ্ছিষ্ট খাবার পেত। সেগুলো খেয়ে দিন যাচ্ছিল।
রাতে সেই মালগাড়ির ভাঙা বগিতে ঘুমাত। একদিন ভাঙা মালগাড়ির বগিটা ওর মা বাপের বয়সী দুজন এসে দখল করে ওকে সেখান থেকে ভাগিয়ে দিল। সে প্লাটফর্মে রাত কাটিয়ে রেল লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল। হেঁটে হেঁটে স্টেশন ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে কমলাপুরের ময়লার ভাগাড়ে ওর কাছাকাছি বয়সী কিশোরদের ময়লার স্তুপ থেকে কী সব কুড়াতে দেখতে পায়। সে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলে ওরা ওকে বলে, কুড়াবি, আয়। কুড়িয়ে কী করে− জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে, বেচবি। টাকা পাবি। খাওয়া কিনে খাবি। ওরাই বলেছিল কোথায় কুড়ানো জিনিস বেচা যায়। সে কুড়ানো শুরু করে আর ওদের সাথে বেচতে যায়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ছেলেটা আবর্জনার স্তুপ থেকে বেচার মতো ভাঙা জিনিস কুড়ায়। আর কিছু করার কথা ভাবে না। ওরা যা করে, যেখানে কুড়ায় কেউ বাধা দেয় না। ভাঙাচোরা জিনিস কুড়িয়ে বেচে ওর খাওয়ার টাকা হয়ে যায়।
আর আবর্জনার স্তুপে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস দিয়েই কখনো কখনো শখও পূরণ করে। জিন্স পেন্ট, শাটর্, গেঞ্জি কেডস এসবও কুড়িয়ে পেয়ে যায়। ওর বেশি পছন্দের জিনিস চশমা। চশমাও কুড়িয়ে পায়। এসব কাপড় আর চশমা পরেই সে কুড়িয়ে বেড়ায়।

কিছুদিন আগে দুজন যুবক এসে ওকে তাদের সাথে যেতে বলেছিল। পরিশ্রমের কাজ নয়, রাস্তায় থাকা, জটলায় থেকে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল মারা। সে রাজি হয় নি। ওরা ভয় ওকে দেখিয়েছিল। তবুও সে যায় নি। সে দেখিয়ে ছিল, ওর সারা গায়ে ময়লা। তারা ভয় দেখাতে কাছে আসতে চাইলে সে আবর্জনা থেকে ভাঙা একটা বোতল ছুঁড়ে মেরেছিল। তাতেই কাজ হয়েছিল। ওরা চলে গিয়েছিল। এর পর অনেক কা- ঘটে গেছে। কতখানে আগুণ জ্বলল! তখন পুলিশ এসে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকও ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল। সে আবর্জনার স্তুপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। পুলিশ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। ওর দিকে তাকিয়ে ওর লেবাস দেখে পুলিশ এবং এর ক্দিন পর সেনাবাহিনীর লোকও ওর কাছে ভেড়ে নি। সে এতে বুঝতে পারে, সে যা করছে তাতে কেউ দোষ দেখে না। এমন কি, চশমা পরে থাকলেও কেউ মনে কিছু করে না। রঙিন চশমা চোখে পরে থাকার সুবিধা সে এখন বোঝে। পুলিশ আর সেনাবাহিনী কেন রঙিন চশমা পরে সে জানে। কুড়িয়ে পাওয়া চশমা পরেই বুঝতে পেরেছিল। রঙিন চশমা যার চোখে থাকে সে ঠিকই দেখে, তবে অন্যরা তার চোখ দেখে না। সে এতে খুব মজা পায়। ময়লার স্তুপে ঘাটাঘাটি করতেও সুবিধা। ধীরে ধীরে সে চশমার প্রতি আসক্ত হয়ে গেছে। ময়লার স্তুপে জিনিস খুঁজতে গিয়ে সে চশমাও খোঁজে। মাঝে মাঝে খুঁজে পায়ও। সে নানা রকম চশমা জমিয়েছে। এগুলো বদল করে করে চোখে দেয়। অবশ্য কয়েকটার কাচ ফাটা, ডাঁটি ভাঙা। তাতে অসুবিধা হয় না। একটার ডাঁটি স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে আরেকটাতে লাগিয়ে নিয়েছে। এখন সে চশমার ভাঙা কাঁচও বদলাতে পারে। চশমার মোহ যেন ওকে পেয়ে বসেছে। যা পায় ভাঙারির দোকানে সব দেয়, কেবল চশমা দেয় না। একটা কাপড়ের ঝোলায় রেখে দেয়। ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে।

তবে একদিন সে আশ্চর্য এক চশমা পেয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের ট্রাক কোথা থেকে ভাঙা দালানের আবর্জনা এনে ফেলে গিয়েছিল। দালানের আবর্জনা এখানে আগে সে ফেলতে দেখে নি। এবারই সে দালান ভাঙা আবর্জনা ভাগাড়ে ফেলতে দেখল। এর মধ্যেই কিছু পাওয়ার আশায় এটা ওটা সরাতে থাকে। হঠাৎ সে একটা রক্তে ভেজা পাঞ্জাবি দেখতে পায়। এটার পকেটে কিছু আছে কিনা পরখ করতে নিয়ে একটা পুরোনো চশমা পায়। চশমাটা দেখে সে অনুমান করতে পারে এটা পাওয়ারযুক্ত চশমা হবে। সে আরও ভাবে, পাঞ্জাবিটাও একজন বয়ষ্ক মানুষেরই হবে। পাঞ্জাবিটা ময়লার স্তুপে পাওয়া গেল, চশমাটাও, তাহলে লোকটার লাশটা গেল কই? ভাবতে গিয়ে সে নিজের বোকামির কথা ভেবে নিজেই হাসে। মানুষটা মরে গেলে হয়তো কবর দিয়েছে। আর বেঁচে থাকলে কোথায় আছে সে কেমন করে বলবে? দেশের কত মানুষ আর কত পুলিশ নাকি মরে গেছে, তাদের লাশও পাওয়া যায় নি। আবার ময়লার স্তুপে কোনো লাশ পাওয়া গেলে সে লাশের পরিচয় নাকি মেলে না। এমন দু’একটা লাশ পুলিশ এসে নিয়ে গেছে। সে চশমাটার দিকে খেয়াল করে। চশমাটা অনেক পুরোনো। ফ্রেম কালো। কাচ মোটা. ঘোলা হয়ে গেছে। আর এমন চশমা ওর চোখে মানাবে না, ওর কোনো কাজেও লাগবে না। তব্ও সে একবার চোখে দেয়। আর তাতেই সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। একি কী দেখছে সে! সে যা দেখছে তাতো সিনেমার মতো। কিন্তু কোনো কাহিনি নেই। টেলিভিশনে দেখানো চেনা অচেনা সব নেতা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আরও অনেককে সে দেখতে পাচ্ছে। তারা কী সব কথাও বলছে! কারা কাকে খুন করছে, গুলি করছে, মেরে ফেলে যায় এ সব কথা বলছে। ওর কাছে সব এলোমেলো হয়ে গেলে ভয় পেয়ে চশমাটা চোখ থেকে সে সরিয়ে ফেলে। তখন আবার সব ঠিক দেখতে পায়। সে রক্তাক্ত পাঞ্জাবিটার দিকে তাকায়। চশমাটার কাচের দিকে ভালো করে তাকায়। সে চশমাটা আবার পরে। পাঞ্জাবিটার দিকে তাকালে দেখতে পায় বুল্ড্রোজার একটা দেয়াল ভেঙে ফেলছে। আর পাঞ্জাবি পরা একটা লোক দেয়াল ঠেলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সামলাতে না পেরে লোকটা দেয়ালের তলে পড়ে যায়। সে এর পর আর দেখতেও চায় না। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে ফেলে। চশমা সরিয়ে নিলে আবার সে ময়লার স্তুপে নিজেকে ঠিকঠাক দেখতে পায়। সে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে। এর পর ওর বিশ্বাস জন্মে যে এই চশমাটার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। চশমাটা যারা পরবে তারাও ওর মতো অন্যকিছু দেখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *