ছোটগল্প

গল্প।। রেডফার প্রেম ও একটি বিমান ছিনতাইয়ের গল্প।। শামস সাইদ

শামস সাইদ

তিনদিন আগে মোসাদ প্রধান হয়েছেন মের আমেত। ভয়াবহ এক যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইসরাইয়েল রক্ষা ও শক্তিশালী করার লড়াই। এলোমেলো অনেকগুলো ভাবনা তার মগজকে ঠোকড়াচ্ছে। প্রতিপক্ষের হাতে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান। যা তুলে দিয়েছে রাশিয়া। এই প্রযুক্তি সম্পর্কে তারা অন্ধকারে। এখানেই মার খাচ্ছে তাদের সব প্ল্যান। খেসারত দিতে হচ্ছে। পুরো প্রশাসন অস্থির। প্রতিরক্ষা বিভাগ চেষ্টা করছে মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান সম্পর্কে জানতে। নাগাল পাচ্ছে না। ইরাকও জানে না। পরিচালনা করছে রাশিয়া। এই মুহূর্তে তাদের দরকার একটি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান। চিন্তিত মুখে এক প্রতিরক্ষা অফিসার এলেন মের অফিসে। তখন সন্ধ্যা। চুপচাপ বসে রইলেন। কিছু বলছেন না। মের ভেবেছিলেন সময় পার করতে এসেছেন। কিছুক্ষণপরে বললেন, চলেন সন্ধ্যার নাস্তা খাই। এরপর তারা একটি রেস্তোরাঁয় বসলেন। কিছু উন্নত খাবার নিলেন। সাথে রেড ওয়াইন। অল্প আলোতে দেখছেন একে অপরের মুখ। হাতের গ্লাস রেখে মের বললেন, এই মুহূর্তে মোসাদ কী করলে ইসরাইলের সুরক্ষা বাড়বে?
প্রতিরক্ষা অফিসার এক চুমুক গিলে গ্লাস রাখলেন। একদমই স্বাভাবিক তিনি। মনে হচ্ছে না তারা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছেন। তার কাধে বিশাল দায়িত্ব। ইসরাইলের শক্তি মোসাদ। নাহয় তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকত না। তার প্রধান মের। অনেক কিছই করতে পারেন তিনি। তবু হুট করে প্রশ্নটা লুফে নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না। আরও কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর একটা আঙুল তুললেন। মের বুঝে নিলেন প্রতিরক্ষা অফিসারের চাহিদা। কিন্তু গুরুত্ব দিলেন না। কারণ, এটা অম্ভব। আকাশ কুসুম কল্পনা। কিছুক্ষণ পরে তারা বেড়িয়ে গেলেন। এই কথাটা বলতে এসেছিলেন অফিসার। ইঙ্গিতে হলেও বলতে পেরেছেন।
সেই রাতে আরও একজন প্রতিরক্ষা অফিসারের সাথে বসলেন মের। একই আলাপ তাদের। তারও চাওয়া মিগ। বললেন, একটা মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান আনতে পারলে দুর্দান্ত কাজ হবে। ওটা মোসাদ পারবে। এ বিশ্বাস আমি রাখি। আগে ব্যর্থ হলেও মের সফল হবে।
মের কিছু বললেন না। তিনি জানেন পারবেন না। তবু মাথায় গেঁথে রইল। কিছুদিন কেটে গেল। ওসব প্রায় ভুলে গেছেন মের। বিমান বাহিনী প্রধান হলেন এজার ওয়াইজম্যান। হঠাৎ এক সকালে মের অফিসে এলেন তিনি। সৌজন্য সাক্ষাৎ। নাস্তার টেবিলে মুখোমুখি বসলেন। গল্প করলেন। পছন্দের খাবার খেলেন। মোটেও চিন্তিত নন এজার। হয়তো প্রধান হওয়ার আনন্দ। সপ্তাহে দু-তিন দিন মের সঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসেন ওয়াইজম্যান। এটা যেন তার ডিউটির অংশ। গল্প করেন। নাস্তা খান। কিছু বলেন না। মের বুঝতে পারলেন রহস্য আছে। এজার এমনি সঙ্গ দিচ্ছেন না। কিছু একটা চাচ্ছেন। কিন্তু বলতে পারছেন না। বা বলছেন না। এই কৌতূহল লুকাতে না পেরে মের বললেন,ওয়াইজম্যানের জন্য কী করতে পারি?
মুখে রহস্যের হাসি ঝুলিয়ে ওয়াইজম্যান উত্তর দিলেন, খুব বড় কিছু না। একটি মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান হলেই হবে।
মের অবাক হলেন। সবার চাওয়া একই। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, আপনি পাগল হয়ে গেছেন? পুরো পশ্চিমা বিশ্বে একটি মিগ নেই। আপনার চাওয়াটা আকাশের তারা ধরার মতো।
ঠোঁট কামড়ে ওয়াইজম্যান বললেন, হুম। তবে আছে তো। যে করেই হোক একটা চাই। এর জন্য সব শক্তি নিয়োগ করেন। এর আগেও মোসাদ চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। জিন থমাস চেষ্টা করেছিল মিশরীয় পাইলটকে রাজি করাতে। তার নাম আদিব হান্না। প্রলোভন দেখিয়েছিল ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। হান্না রাজি হয়নি। চুপও থাকেনি। মিশরীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল। থমাসসহ পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলাল মিশর।
দুই বছরের মাথায় সফলতা পেল ইসরায়েল। ক্যাপ্টেন আব্বাস হেলমি ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্থ। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বিরোধ করে মিশর থেকে ইয়াক-১১ বিমান নিয়ে ইসরায়েলে চলে এলেন। কোনো কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তবে ওটা কাজে লাগেনি। দু’মাসের মাথায় হেলমিকে হত্যা করল দক্ষিণ আমেরিকায়।
কারা করল? জানতে চাইলেন মের।
ধারণা করা হয়, মিশরীয় গোয়েন্দাবাহিনী। এরপর চেষ্টা করা হলো ইরাক থেকে বিমান আনার। কিন্তু ইরাকেও ব্যর্থ হলো। ইরাকি দুই পাইলটকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছিল। কাজ হয়নি। তবে ওদের ছেড়ে দেয়নি। তাহলে তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। মারাত্মকভাবে আহত করল। যাতে কথা বলতে না পারে। এবার মনে হয় না ব্যর্থ হব।
মের বুঝতে পারলেন একটা মিগ ওয়ান ইসরাইয়েলে আনতে হবে। এই সফলতা তাকে ইতিহাসে আশ্রয় দেবে। পৃথিবীর বুকে ইসরাইয়েল হয়ে উঠবে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই প্ল্যান করতে বসলেন রহভিয়া ওয়ার্ডিকে নিয়ে। মিশর ও সিরিয়া থেকে মিগ আনার ব্যর্থ অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। ফেলে দেওয়া সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। শুনলেন সেই গল্প। কোথায় আটকে যাচ্ছিল। এরপর নতুন পরিকল্পনা করলেন পুরনো বাধাগুলো এড়িয়ে। রহভিয়া ঠিক বুঝতে পারছেন না কাজটা কীভাবে করবেন। মের কিছু নতুন প্ল্যান দিলেন। শেষে বললেন, মোসাদ ব্যর্থ হলে ইসরায়েল মুছে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। এই একটা বাক্য তাদের শক্তি হয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে মাঠে নামাল।
মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান মিশর, সিরিয়া ও ইরাকে থাকলেও এর নিরাপত্তা সোভিয়েতের হাতে। সেখান থেকে বের করা কঠিন। ওয়ার্ডি আরব দেশগুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। একটা টিম করলেন যারা এই কাজকে দ্রুত বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। ইরান থেকে তাদের এজেন্ট ইয়াকভ নিমরাদিও জানালেন তার পরিচিত একজন ইহুদি আছে ইরাকে। তার নাম ইয়োসেফ শিমিশ। তাকে কাজে লাগানো যাবে। কিছুটা বিশ্বস্ত। শিমিশের সঙ্গে ইরাকের বাইরে এক গোপন আস্তানায় দেখা করলেন মের। পরিচয় লুকিয়ে। শুধু একটুকু জানালেন সেও ইহুদি। একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা। বুঝতে চাইলেন তার মনোভাব। শিমিশ অবিবাহিত। হই হুল্লোড় করে জীবন কাটান। গলা ডুবিয়ে মদ খান। মেয়ে মানুষ পছন্দ করেন। কিন্তু বিয়ে করবেন না। মোসাদ এক নারী সদস্য নিয়োগ করলেন তার পেছনে। যে তার মন জয় করবে। তথ্য আনবে। তাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কারণ, মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাদের আস্থা অর্জনের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল শিমিশের। মের গ্রিন সিগন্যাল পেলেন। শিমিশ কন্ট্রোলে এসেছে। প্রস্তাব দেওয়া যায়। তখন আবার একদিন দেখা করলেন মের। সেই বৈঠক আরও প্রণবন্ত ও স্বপ্নময় হয়ে উঠল। পান শেষে কিছুটা স্থির হয়ে মের বললেন, একটা মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান চাই। বিনিময় যেকোনো কিছু হতে পারে। সেজন্য তার সহায়তা দরকার।
শিমিশ থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ লাগল বিষয়টা মাথায় নিতে। তারপর বললেন, কী চাই?
একটা মিগ। যা ইহুদি জাতিকে রক্ষা করতে পারে।
কোনো আশ্বাস দিলেন না শিমিশ। মের কিছুটা হতাশ। শিমিশ তাদের হয়ে কাজ করবে? না এসব ইরাকি বাহিনীকে জানিয়ে দেবে? পেছনে গুপ্তচর লাগালেন। তাহলে শিমিশকে মেরে ফেলবেন।



শিমিশ এক সন্ধ্যায় তার পুরনো বান্ধবীর কাছে গেলেন। যার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কমিয়ে ছিলেন। ওই বান্ধবী খ্রিস্টান। তার বোন কামিলা। যে বিয়ে করেছে ক্যাপ্টেন মুনির রেডফাকে। তাদের সাথে ভেঙে পড়া সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটালেন। শিমিশ জানতেন মুনির রেডফা একটা বিষয়ে অখুশি। দক্ষ পাইলট হওয়া সত্ত্বেও পদোন্নতি হয়নি। আবার নিজ দেশে কুর্দি গ্রামগুলোর ওপর বোমা ফেলতে বাধ্য করে। অফিসারদের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলেন, তখন বলা হলো খ্রিস্টান হওয়ার কারণে পদোন্নতি হবে না। কখনও স্কোয়াড্রন লিডার হতে পারবেন না। এসব এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শুনেছিলেন শিমশি। রেডফার উচ্চাকাক্সক্ষা আছে। যেকোনো লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করবে। তখন বলেছিলেন ইরাকে তাদের থাকার কোনো মানে নেই। মুনির রেডাফকের এই ক্ষোভ কাজে লাগাতে চাইলেন শিমিশ। মের বুঝতে পারলেন শিমিশ ঠিক পথে আছে। তাই আবারও দেখা করলেন। বাহবা দিলেন। মনে হচ্ছে এবার তারা সফলতার একটা পথ খুঁজে পেয়েছেন।
রেডফার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। একান্তে মিলিত হন। সুখে দুঃখে পাশে থাকেন। কিন্তু প্রস্তাবটা দিতে পারছেন না শিমিশ। মের জানিয়েছেন ইরাকের মাটিতে এ প্রস্তাব দেয়া যাবে না। কারণ তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটার ওপর ভিত্তি করবে সফলতা। তাই রেডফারকে ইরাকের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে বসে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে দেশে ফিরতে পারবে না। মেরে ফেলবে। তাই দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন শিমিশ। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না।
শিমিশ জানালেন ১৫ জন ইরাকি পাইলট আমেরিকা যাবে প্রশিক্ষণের জন্য। ওখানে তারা কাউকে ম্যানেজ করে নিতে পারবেন। রেডফাও থাকবে সে দলে। মের আমেত আমেরিকায় এজেন্ট নিয়োগ করলেন। যারা ওই পাইলেটদের টার্গেট করবেন। একজনকে রাজি করাতে পারলেই হবে। মোসাদ নারী এজেন্টরা পাইলটদের পেছনে লাগলেন। সবটা উজার করে দিয়ে তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন। একজনকে প্রস্তাব দিলেন। তিনি রাজি হলেন না। ওখানেই তাকে হত্যা করল। যাতে তাদের পরিকল্পনা জানিয়ে দিতে না পারে। ইরাক বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। বিদেশের মাটিতে পাইলট হত্যা খারাপ কিছুর ইঙ্গিত। দ্রুত পাইলটদের দেশে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু মোসাদ হাল ছাড়তে রাজি না। পাইলটদের সঙ্গে যাদের গোপন সম্পর্ক হয়েছিল এমন তিনজন এজেন্ট ওই বিমানে উঠে যায়। সেটা তিন পাইলটের বান্ধবী হিসেবে। কারণ আগেই তাদের পরিচয় হয়েছিল। অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছে। বিমানেও তারা তিন পাইলটের পাশের আসনে বসেছে। সারাক্ষণ তাদের মন ভুলানোর চেষ্টা। লিসা ব্রাট নামের মহিলা রেডফাকে প্রেমের জালে আটকে ফেলল। ইরাকে তারা অনেকদিন এভাবে কাটাল। রেডফা কিছুই বুঝতে পারল না। কোনোভাবেই বুঝতে দিল না লিসা। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তার সাথে মিশছে। অন্য দুজন মনে করল পাইলটরা তাদের কথায় রাজি হবেন। কেননা তাদের কোনো কথাই ফেলছেন না। তখন তারা প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু হলো উল্টো। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন কারলেন তারা। ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। দুজনকেই বাগদাদের মাটিতে হত্যা করল মোসাদের গুপ্তচররা। এই হত্যাকান্ড রেডফার ভেতরে এক ধরনের সন্দেহ ও ভীতি জন্ম দিল। সে লিসাকে এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু পারল না। লিসা তাকে আরও বেশি প্রেমে ফেলে দিল। সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখে। অনেকদিন পরে প্রস্তাব দিল বিমান ছিনতাইয়ের। তাতে রাজি হলেন না রেডফা। তখন শিমিশ এলেন। বুঝালেন এ প্রস্তাবে তার রাজি হওয়া উচিত। কিন্তু রেডফা তার মন পরিবর্ত করতে পারছেন না। এরপর বুঝতে পারলেন তাকে হত্যা করবে ওরা। শুধু তাকে না। তার স্ত্রী সন্তানও বাঁচতে পারবে না। এসব ভেবে রেডফা রাজি হলেন। তখন লিসা বলল, ইউরোপে গিয়ে মোসাদ এজেন্টদের সাথে দেখা করতে হবে। রেডফা যাবে কীভাবে? তার বাহিনী এই মুহূর্তে ছুটি দেবে না দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য। আবার সন্দেহ করতে পারে। কিছু একটা আচ করতে পারলে মেরে ফেলবে। এসব নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন।
কিছুদিন পরেই রেডফাকের স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। দেশের মধ্যে চিকিৎসা চলল। উন্নতি কম হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগালেন শিমিশ। তার বান্ধবীকে বললেন, কামিলার উন্নত চিকিৎসা দরকার। ইরাকে হবে না। পশ্চিমা চিকিৎসকদের দেখালে ভালো হয়ে যাবে। নাহয় বাঁচানো সম্ভব না। অবিলম্বে গ্রিসে নিয়ে যাওয়া উচিত।
একথা রেডফাককে জানানো হলো। আমতা আমতা করছেন তিনি। ডিপার্টমেন্ট থেকে রাজি হবে না। তিনিও বুঝতে পারছেন স্ত্রীর উন্নত চিকিৎসা দরকার। অসাহায়ত্ব পেশ করলেন। এই সুযোগ ব্যবহার করলেন শিমিশ। লিসাও তার পেছন ছাড়েনি। বলল চিন্তা করতে হবে না। সব ব্যবস্থা করছি। মেরকে জানিয়ে দিলেন। তারা যেন তৈরি থাকে।
কর্মকর্তাদের বুঝালেন কামিলা খুবই অসুস্থ। গ্রিসে পাঠানো উচিত। রেডফাক বিধ্বস্ত। কাজে মন দিতে পারছেন না। তার স্ত্রীর সুস্থতা জরুরি। কর্তকর্তারা রাজি হলেন। কিন্তু রেডফাকে স্ত্রীর সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি পেলেন না। এখানে এসে আটকে গেলেন শিমিশ। মের জানালেন যেভাবেই হোক ইরাকের বাইরে নিয়ে আসতে হবে। আবারও অফিসারের সাথে দেখা করলেন শিমিশ। বললেন, রেডফাকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। কারণ তার পরিবারের কেউ ইংরেজি জানে না। তাছাড়া এই মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থাকা ওর দায়িত্ব। ইরাকি কর্তৃপক্ষ রাজি হলো। তারা মনে করল মানবিক আবেদন। রেডফাক তখনো ঠিক জানে না এথেন্সে তার জন্য কারা অপেক্ষা করছেন। ওখান থেকে ফিরতে পারবেন কিনা।



মের একটা গ্রুপ এথেন্স পাঠালেন। যারা রেডফার সঙ্গে কথা বলবেন। শিমিশও তাদের সঙ্গে এথেন্স গেলেন। লিসা তার বন্ধুকে চোখে চোখে রাখছে। রেডফা কিছুই জানেন না। তিনি খুব চিন্তিত। স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। চিকিৎসা শুরু হলো। তেমন কোনো কাজ নেই তার। এই সুযোগটা শিমিশ নিলেন। বললেন, একটু প্রশান্তি দরকার। অনেকটা ক্লান্তি বাসা বেধেছে শরীরে। মনের অবস্থাও ভালো না।
রেডফা মাথা নাড়লেন। সেটাই। এরপর তারা একটি হোটেলে গেলেন। যেখানে আগে থেকেই ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর পাইলট কর্নেল জিভ লিরন তার সঙ্গীদের নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। শিমিশ ও লিসা তাদের সঙ্গে আগেই বসেছিলেন। এরপর লিসা আলাদা হয়ে গেলেন। তার দায়িত্ব শেষ। আমেরিকা চলে গেলেন। রেডফার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন শিমিশ। তার বন্ধু। সে রাতে প্রচুর মদ খেলেন তারা। পোড়া মাংস ছিল সাথে। হই হুল্লোড় করলেন। যাতে রেডফাকে তার স্ত্রীর অসুখের কথা ভুলে যায়। রাত গভীরে তারা হোটেলের কক্ষে ফিরলেন। রেডফার কক্ষে ঢুকল মোসাদের এজেন্ট এক নারী। অপূর্ব সুন্দরী। দারুণ চটপটে। কাউকে আকর্ষণ করার মতো রূপ তার মুখে বিদ্যমান। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে অনেকদিন নারী সঙ্গ থেকে দূরে ছিলেন রেডফা। লিসার সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছিল কিছুটা। শরীর মেলাননি তাই। সে রাতে হারিয়ে গেলেন সব ভুলে অন্য জগতে। রেডফা এতটাই আনন্দিত হলেন যে এরকম একটা রঙিন সকাল তার জীবনে আর আসেনি। ঘুম থেকে জেগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুহাত প্রশস্ত করলেন। ইহুদি কন্যা তখন হাসছে। সে সফল। রেডফার মন জয় করতে পেরেছে।
সেদিন সন্ধ্যায় তারা আবার মিলিত হলেন। তার মনে কৌতূহল। কারা তার সঙ্গে বসবে। লিসা কোথায় গেল? আজও আড্ডা দিল। মদ খেল। জিভ লিরন সেদিনও কিছু বললেন না। রেডফা জানতে চাইলেন সেও পাইলট কিনা। জিভ মাথা নাড়লেন। কিন্তু সে ইহুদি ও ইসরাইল বিমানবাহিনীর পাইলট তা বললেন না। তারা আরও বেশি আন্তরিক হলেন। সে রাতে নতুন কাউকে পাঠাতে চেয়েছিলেন রেডফার মন জয় করতে। রেডফা কালকের রাতের সেই কন্যার কথা বললেন। শিমিশ তখন বাধা দিলেন। নতুন কিছু উপভোগ করো।
রেডফা আর কিছু বললেন না। অন্য একজনকে পাঠাল তার সেবায়। চমকে গেলেন তিনি। কালকের সেই কন্যার থেকে কোনো অংশে কম নয়। আরও বেশি আবেদনময়ী। মনে হচ্ছে ওরা মানুষের মন জয় করার জন্যই পৃথিবীতে এসেছে। সে রাতটাও তার কাছে স্বর্গীয় মনে হলো। খানিক দূরেই শিমিশের রুম। সেও আনন্দ করছে। রেডফাকে বললেন, আনন্দ করো বন্ধু। বাকিটা আমি দেখব। চিন্তা করো না, কামিলা সেরে উঠবে। ডাক্তার চিন্তা কমিয়ে দিয়েছেন। পরদিন তারা আরও কিছুটা নিরাপদ ও গোপনীয় জায়গায় বসলেন। রেডফার দুপাশে দুই নারী। শিমিশ আজ নেই। সামনে জিভ ও তার দলের আরও এক সদস্য। জিভ খেতে খেতে রেডফাকের ব্যক্তিগত ও সার্ভিস জীবন নিয়ে আলাপ তুললেন। স্ত্রী অসুস্থ। ব্যক্তি জীবন কিছুটা অশান্তিতে নিমজ্জিত। সার্ভিস জীবন নিয়ে হাতশ। তাকে মূল্যায়ন করছে না। শুধু ধর্মের কারণে আটকে দিচ্ছে। এই আলাপ দীর্ঘ হলো। রেডফার ক্ষোভ প্রকাশ পেল। তখন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মিগ বিমান নিয়ে ইরাক ত্যাগ করলে কী হতে পারে?
রেডফা একটুও ভাবলেন না। বললেন, ওরা মেরে ফেলবে। মানে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনবে। পালাতে পারলেও পৃথিবীর কোনো দেশ আশ্রয় দিবে না। জীবনটা নরক হয়ে যাবে।
জিভ মৃদু হাসলেন। আমার বিশ্বাস একটা দেশ স্বাগত জানাবে। শুধু আশ্রয় না, জীবন পাল্টে দেবে।
তাই! কিছুটা অবাক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন রেডফা। কোন দেশ সেটা?
ইসরায়েল। সমস্ত বিপ্লবী আর বিশ্বস্ত মানুষের ঠিকানা। শুধু স্বাগত জানাবে না, জাতীয় বীর ঘোষণা করবে।
সেদিন তারা ওখানে শেষ করলেন এই আলোচনা। অন্য আলাপে গেলেন। খুব সিরিয়াস কিছু দেখালেন না জিভ। রেডফা কিছু ভাবতে চাইলেন না। পরম সুন্দরী সেই কন্যাকে নিয়ে আনন্দে মাততে চাইলেন। পরদিন সকালে রেডফাকে নিয়ে তারা এথেন্স থেকে রোমে চলে গেলেন। রেডফা কিছু বুঝতে পারলেন না। মনে হচ্ছে ওদের হাতের পুতুল হয়ে গেছেন। সেখানে গিয়ে শিমিশ ও তার এক বান্ধবীর দেখা পেলেন। কিছুটা সাহস ভর করল বুকে। রোমে কয়েকদিন অবস্থান করলেন তারা। এরপর এক সন্ধ্যায় রেডফার সামনে জিভ রাখলেন সেই কাঙ্খিত প্রস্তাব। যা প্রত্যাখ্যান করলে রেডফার সামনে মৃত্যু। এথেন্স থেকে দেশে ফিরতে পারবে না স্ত্রী সন্তান। ওখানে মেরে ফেলবে। এই ভয় দেখিয়ে শেষ করলেন না জিভ। বললেন, এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার উপহার। ইসরাইলের নাগরিকত্ব। আর বাড়ি গাড়ি। এসবের জন্য ইরাক থেকে একটি মিগ চালিয়ে ইসরাইলে নামিয়ে দিবেন। খুব কঠিন কাজ না।
এই প্রস্তাব শুনে স্থির হয়ে গেলেন রেডফা। কিছুক্ষণ নিজের ভেতর ছিলেন না। সেদিন কোনো কথাই বলতে পারেননি। কিন্তু জিভ তাকে ছাড়লেন না। মোসাদের নারী এজেন্টদের দিয়ে রঙ্গমঞ্চের ভেতর রাখলেন। যাতে কোনোকিছু ভাবতে না পারে। রেডফার বুঝতে পারলেন আটকে গেছেন মাকড়সার জালে। সুক্ষ্ম হলেও ছিঁড়ে যাওয়া কঠিন। রাজি তাকে হতেই হবে। নাহয় খারাপ কিছু ঘটবে। পরিবারও রক্ষা পাবে না। এর পেছনে যে শিমিশের হাত রয়েছে তাও বুঝতে পারলেন। কিন্তু তার বন্ধুত্ব ও সাহয্য ভিরক্ত হতে দিল না। জীবনকে বাজি রেখে এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। তবে ইরাকের আকাশ অতিক্রম করা মোটেই সহজ না। রাডারে ধরা পড়ে যাবে। যেকোনো উপায় তাকে আটকাবে। না পারলে আকাশে ধ্বংস করে দিবে।
জিভ তাকে চিন্তামুক্ত করতে বললেন, সে প্ল্যান ইসরাইল দেবে।
তাদের কথাবার্তা ওখানে শেষ হলো। জিভ এ খবর জানিয়ে দিলেন মের আমেতকে। ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে রিসার্চ অফিসার ইয়েহুদা পোরাতাও রোমে এলেন। রেডফারকে নিয়ে একান্তে বসলেন। সেখানে অন্য কেউ নেই। জিভ চলে গেছে ইসরাইলে। তার দায়িত্ব শেষ। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এবং রেডফার মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ থাকবে, কখন তারা নিরাপদ মনে করবে বিমান নিয়ে ইসরাইলে ঢুকে পড়ার, সে আলোচনা করলেন। এরপর সিদ্ধান্ত হলো রেডফা যখন ইসরায়েলি রেডিও স্টেশন ‘কোল’ থেকে বিখ্যাত আরবি গান 'মারহবাতেঁ মারহাবতেঁ শুনতে পাবেন, সেটাই হবে তার ইরাক ত্যাগের সংকেত।
দুদিন পরে জিভ এলেন। আরও ব্রিফিংয়ের জন্য রেডফাকে ইসরায়েলে নিয়ে গেলেন। মাত্র ২৪ ঘণ্টা জন্য। সেখানে মের আমেত নিয়ে বসলেন। রেডফা অবাক হলেন। রোমেও সে মেরকে দেখেছেন মনে হয়। লোকটা তাকে অনুসরণ করছে। তারপর শুনলেন মের মোসাদ প্রধান। বিস্তারিত পরিকল্পনা তাকে জানান মের। একটি গোপান কোড দেন। রেডফা বলেন তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা। তারা ইরাকে থাকতে পারবে না। তার ভাই বোনাকে মেরে ফেলবে। নাহয় এমন অত্যাচার করবে যে বাঁচতে পারবে না। মের বললেন, সেটা তারা দেখবেন। তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
মের আমেতের সঙ্গে কোথায় বসে কথা বলেছেন তা বুঝতে পারলেন না রেডফা। খুবই গোপনীয় অফিস। বহু নিরাপত্তা স্তর ভেদ করে সেখানে পৌঁছতে হয়েছে। সবকিছু অদৃশ্য। ওখান থেকে তাকে নিয়ে আসা হলো অ্যালেনবি স্ট্রিটে। যেটা তেল আবিবের প্রধান সড়ক। সন্ধ্যায় তাফার একটি ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। উন্নত খাবার ও পাণীয় খাওয়ালেন। সেখান থেকে রাতেই এথেন্সে চলে যান রেডফা। সেই স্বাভাবিক অবস্থা নেই তার। কেমন অস্থির। কিন্তু কামিলাকে বুঝতে দিলেন না। সব কিছু লুকিয়ে স্বাভাবিক চলার অভিনয়। কিছুটা সুস্থ হয়েছে কামিলা। এরপর বাগদাদে ফিরলেন তারা। রেডফার সাথে মোসাদের দুই এজেন্টও এলেন। যাতে মত না পাল্টাতে পারে। শিমিশও আছেন পাশে। তিনিও বড় রকমের সুবিধা পাবেন ইসরাইল থেকে।



মের আমেত ব্যস্ত হলেন রেডফার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিতে। তাহলেই নিরাপদ। তার বেশ কয়েকজন বোন ও ভগ্নীপতিকেও ইরাক থেকে বের করে আনলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের পরিবার ইসরায়েলে নিয়ে আসবে। এই পরিকল্পনা সম্পর্কে কামিলা তখনো জানে না। রেডফার সত্যিটা বলতে পারছিলেন না। ভয় হচ্ছিল। কমিলা এটা মেনে নিবে না। সে চিৎকার করবে। তাকে অভিশাপ দিবে। বিশ্বাসঘাতক বলবে। পরিস্থিতি উল্টে যাবে। কামিলা জানতে চেয়েছিল, কেন তারা এখন ইউরোপ যাবে?
রেডফার বললেন, তোমাদের নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য একটা লম্বা সময় ইউরোপে থাকতে হবে।
আর কোনো প্রশ্ন করেনি কামিলা। স্বামীর সহজ উত্তর মেনে নিয়েছিল। দুই সন্তান নিয়ে কামিলাকে আমস্টারডামে পাঠিয়ে দিল। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল মোসাদের একটা টিম। কামিলাকে রিসিভ করে তারা প্যারিসে নিয়ে গেল। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন জিভ লিরন। কামিলা কিছু বুঝতে পারছে না। এরা কারা? কেন এমন আচারণ করছে? জিভ তাদের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে রাখলেন। যেখানে শুধু একটি ডাবল বেড পাতা। তাদের খাবার ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। এরপর নিজের পরিচয় দিলেন, আমি একজন ইসরায়েলি অফিসার। চিন্তা করতে হবে না। রেডফার কাল ইসরাইলে পৌঁছবেন।
কামিলার বুঝতে এক মিনিটও সময় লাগেনি যে তার স্বামী ফাঁদে আটকে পড়েছে। তখন মনে হলো এজন্যই তার স্বামী বিষন্ন ও চিন্তিত ছিল। বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে গেছে। কামিলা সে রাতে কিছুই মুখে তুলল না। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সারা রাত কাঁদল। জিভ তাকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিলেন।
মুখ তুলে রুক্ষস্বরে কামিলা বলল, আমার স্বামী একজন বিশ্বাসঘাতক। এই কথা তার ভাইয়েরা জানতে পারলে ওকে খুন করে ফেলবে।
কিছুই করতে পারবে না। রেডফার ও তার পরিবারের নিরাপত্তা দিবে ইসরাইল। তোমাদেকে ইসরাইলে নিয়ে যাব। একথা বলে সাহস জোগালেন জিভ। কিন্তু কামিলা কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছে না। একসময় বুঝতে পারল এই মুহূর্তে তার সামনে কোনো বিকল্প নেই। সেও আটকে গেছে ওদের জালে। এখান থেকে মুক্ত হতে পারবে না। বুঝে গেছে ওরা কত শক্তিশালী। ওরা যেটা চায় সেটাই করতে পারে। বা করছে। সেটা পৃথিবীর যেকোনো দেশে।



মুনির রেডফার একটি সাঙ্কেতিক বার্তা পেলেন। মানে বিমান নিয়ে আকাশে উড়াতে পারেন। তার পরিবার নিরাপদ আছে। তিনি প্রস্তুতি নিলেন। পরদিন মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান আকাশে উড়ালেন। মাঝ আকাশে হঠাৎ বিমানে ত্রুটি দেখা দিল। তাই নেমে এলেন। পরে বুঝতে পারলেন বিমানটির ত্রুটি খুব বড় ছিল না। ইরাকের আকাশ পেছনে ফেলে ইসরাইলে ঢুকতে পারতেন। আবার কিছুটা ভয়ও কাজ করছে। কেউ বুঝতে পারে কিনা। তার পেছনে মোসাদের গুপ্তচর। শিমিশ তাকে সাহস জোগাচ্ছে। আবার পরিবারের চিন্তা। কোনোভাবেই ফিরে আসার সুযোগ নেই। বাস্তবায়ন করতেই হবে প্ল্যান। দুদিন পর সেই মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান নিয়ে আকাশে উড়ালেন রেডফার। প্রথমে বাগদাদের দিকে গেলেন। যাতে কেউ ধরতে না পারে তার দূরবিসন্ধি। হঠাৎ বিমানটির মুখ ইসরায়েলের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। দ্রুত ইরাকের আকাশ ত্যাগ করার চেষ্টা। কন্ট্রোল রুম তা ধরে ফেলল। ফিরে আসার জন্য বারবার বার্তা পাঠাতে থাকল। রেডফার গুরুত্ব দিলেন না। তার চেষ্টা কতক্ষণে ইসরাইলের আকাশে ঢুকবেন। কন্ট্রোল রুম হুমকি দিল বিমানটি গুলি করে নামিয়ে আনবে। দ্রুত ফিরে আসো। রেডিও বন্ধ করে দিলেন রেডফার। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কন্ট্রোল রুমের সাথে।

রেডফারকে বরণ করতে প্রস্তুত ইসরাইলের আকাশ। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুজন পাইলট অপেক্ষা করছেন। তারা ইসরায়েলের অন্যতম সেরা পাইলট। রেডফার তাদের আকাশে ঢুকতেই ওয়েলকাম জানালেন। তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেলেন। ততক্ষণে মের আমের জানতে পারলেন মিগ-টওয়েন্টি নাইন ইসলাইলের আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘাটিতে নামবে।
বিমানের গতি কমিয়ে দিলেন রেডফার। আঙুল তুলে সঙ্কেত দিলেন অবতরণের জন্য প্রস্তুত। রাত আটটায় বিমানটি হৈজোর বিমানঘাঁটিতে নামিয়ে দিলেন রেডফার। দুঃসাহসিক এক অভিযানে সফল হলেও তার ভেতর আনন্দের ছিটেফোটাও নেই। খুব চিন্তিত, শ্রান্ত ও কিছুটা বিচলিতও। মের তাকে স্বাগত জানিয়ে বুকে টেনে নিলেন। অন্য অফিসারও জড়িয়ে ধরলেন। ইসরাইল যেন পুরো পৃথিবী জয় করেছে। একটা বিমান ছিনতাই করেছে কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পরে। তবু সফল হয়েছে। এরপর মুনির রেডফারকে হৈজোর বিমান ঘাঁটি বেস কমান্ডারের বাসভবনে নিয়ে গেল। সিনিয়র ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এলেন সেখানে। তার সম্মানে পার্টি দিলেন। সে রাতটাকে তারা উদযাপন করতে চাইলেন। রেডফারের মানসিক পরিস্থিতি মোটেই ভালো না। অপরাধবোধ তাকে বোবো করে দিয়েছে। কি হচ্ছে বাগদাদে, সেকথা ভাবছে। দেশের মাটিতে আর ফিরতে পারবে না। সে যন্ত্রণা বুকে। স্ত্রী সন্তানের কথা মনে পড়ল। তাই চুপচাপ এক কোণে বসে রইলেন। একটা কথাও বললেন না। তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন মের। নিজ হাতে মদের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। চুমুক না দিয়েই রেখে দিলেন রেডফার। অনেকক্ষণ পরে জানতে চাইলেন, আমার স্ত্রী সন্তানরা কোথায়?
তারা বিমানে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরাইলের মাটিতে পা রাখবে। চিন্তা করতে হবে না। ওটা আমাদের দায়িত্ব।
পরদিন সকালে একজোড়া ফুলে ওঠা চোখ আর দুটি শিশুকে নিয়ে রেডফার সামনে দাঁড়াল কামিলা। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিস্ময়ের চোখে। এতটা বিধ্বস্ত আগে দেখেনি। একটা কথাও বলতে পারল না। রেডফার মাথাটা নিচু করে ছোট সন্তানটাকে কোলে নিয়ে বসে রইলেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *