গ্রন্থ আলোচনা ।। মাসুদ পথিকের কবিতা: ভিন্ন স্বরে ভিন্ন সুর ।। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ।।
মাসুদ পথিক বর্তমান কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন কবি। পাশাপাশি একজন রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতাও। তাই তো তার নির্মাণেও খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার শরীর। কেননা কবিতার সঙ্গেই তার সব ধরনের সখ্য। ‘চাষার পুত’খ্যাত মাসুদ পথিকের কবিতায় যেন কৃষকের জবান ফুটে ওঠে। ফলে বলাই যায়, কবিতা তার কাছে শৈশবের হারিয়ে ফেলা কাস্তে ও নিড়ানি। কবিতা তার কাছে চাষার গায়ের ঘাম। পান্তা ভাতের তরে শানকিভরা গান। ধান কুড়ানির গ্লানি অথবা ঝরাপাতায় লেখা পূর্বপুরুষের বাণী।
মূল আলোচনার আগে জেনে রাখা ভালো, মাসুদ পথিকের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১ আগস্ট। তিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার এবং কবি। তিনি ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ ২০১৯ সালে ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। তিনি কবিতায় ২০১৩ সালে ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ অর্জন করেন।
এ পর্যন্ত তার ২৩টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কৃষকফুল’। এরপর ‘বাতাসের বাজার’ ২০০৭; ‘ধানের গ্রীবার নিচে কিছু অভিমান’ ২০০৮; ‘সেতু হারাবার দিন’ ২০০৯; ‘ধানচোর’ ২০১০; ‘হাড়ের পাখালি’ ২০১১; ‘মাঠের কোল’ ২০১২; ‘একাকী জমিন’ ২০১৩; ‘চাষার পুত’ ২০১৪; ‘রোলকলের বাইরে থেকে জেনেছি এই কৃষক-জন্মের কারিকুলাম’ ২০১৫; ‘চাষার বচন’ ২০১৬; ‘শাপলা: জলের জন্মান্ধ মেয়ে’ ২০১৬; ‘লাঙলের ভুবন’ ২০১৭; ‘দাদার খড়ম’ ২০১৭; ‘বাতাসের বীজতলা’ ২০১৮; ‘আমন আউশ দুই বোন বা পণ্য অথবা প্রকৃতি আর যা যা’; ‘ঘামের মোকাম’ ২০১৮; ‘সাধের লাউ’ ২০১৯; ‘অনাহারী ধুলোগণ’ ২০১৯; ‘চাষার কাম’ ২০২০; ‘কান্নার কুনাঘর’ ২০২১; ‘ধানবাজারে এইসব নন্দন বেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহল‘ ২০২২ ও ‘ভাতের হারিকিরি’ ২০২২ প্রকাশিত হয়।
এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার বই ‘ধান বাজারে এইসব নন্দন বেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহল’। বইটি প্রকাশ করেছে জাগতিক প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন। বইটিতে ২১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। আজ এই বইয়ের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করবো। তার আগে জেনে নিই তার কবিতা সম্পর্কে সমালোচকরা কী বলেন, ‘মাটি থেকে, নদীর জলের থেকে, বিলের কাদা থেকে, গোবর ও খড়ের গাদা থেকে উঠে আসে মাসুদ পথিকের কবিতা। ভুরভুরে, উদ্ভট আর উৎকট গন্ধ নিয়ে মার্জিত ও দুরস্ত নাগরিক রুচির ওপর কখনো জবরদস্তি, আবার কখনো জবর-দোস্তির মতো সেই কবিতা। কখনো তা বুনো স্বাদের, কখনো তা বিষাদের, বিস্বাদের।’ এমনকি নিজের চলচ্চিত্র কিংবা কবিতা সম্পর্কে কবি মাসুদ পথিক বলেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে র, র-রিয়ালিজম।’
আবার অনেকেই মনে করেন, ‘তার এই আকাড়া চালের মতো কবিতা কারো জন্য স্বস্তির, কারো জন্য অস্বস্তির, আর কারো জন্য প্রশস্তির।’
জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মাসুদ পথিক এ পর্যন্ত এসেছেন। তার কবিতায় যেমন কৃষকের বন্দনা আছে, তেমনই আছে নিজের জীবনের বেদনার সুরও। ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর মাত্র আট বছর বয়সী একমাত্র সন্তানের অকাল মৃত্যু হয়। এতে মুষড়ে পড়েন কবি মাসুদ পথিক। ছেলে হারানোর শোককে বুকে নিয়েই তিনি লিখলেন ‘কবর থেকে বাবাকে লেখা অঋব অনুসূর্যের চিঠি’ নাম কবিতাটি। কবি লেখেন—
‘বাবা, এখানে আমি খুব একা হয়ে গেছি।
মিমি, তোয়া-বান্টি, বারান্দার পাখিগুলো, বই, গিটার, খেলনা, ল্যাপটপ
সবাইকে মিস করছি।’
ছেলে হারানোর শোকে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন কবি। তা তার কবিতা পাঠেই উপলব্ধি করা যায়। তা ছাড়া পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতটা ভাড়ি, তা কবেল ভুক্তভোগী বাবাই উপলব্ধি করতে পারেন।
তবুও জীবন থেমে থাকে না। কবি এগিয়ে যান। কবিতায় মনোনিবেশ করেন নিজেকে। কবি অন্যত্র বলেছেন—
‘অথবা, ভাতটি উড়ে গেল পাখি হয়ে এই বাক্য মুঠোয় পুরে
ছুঁড়ে মারি তোমার খাবার ঘরের দিকে’ (ভাষাতত্ব)
কবির উপলব্ধি গভীরভাবে ভাবায় পাঠককে। তার চিন্তা-চেতনা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ফলে তার কবিতায় কৃষকের ঘাম অথবা ধান-ফসলের ঘ্রাণ পাই। কতিায় কবি যখন বলেন—
‘আমি বিমল ধান
নক্ষত্রের পাশে পাশে একা একা ঘুরছি’ (হাওয়ায় লোকধর্ম)
এই যে কবিতাজুড়ে ধান-ফসলের গান, এ তো তার একার কথা নয়। সামষ্টিক উপলব্ধি। এই ধানের জন্য, গানের জন্য আমাদের কৃষকজন্ম সার্থক হয়।
কবি মাসুদ পথিক কখনো কখনো ভিন্ন স্বরে ভিন্ন সুরে জীবনের গান গেয়ে ওঠেন। কবিতায় খুঁজে পান জীবনের মানে। কবি যখন বলেন,
‘আর, আমার জন্ম এক দুর্যোগকালে
সোনামুখি ধানের গর্ভে
যুদ্ধের আতংক, চারদিকে, বর্গীর হানা
মাকে ধরে নিয়ে গেলো তারা, তার পূর্বেই—
মা আমাকে আউশধানের খড়ে, প্যাঁচিয়ে লুকিয়ে রাখলো গাদায়’ (জন্মরূপান্তর)
এমন গভীর বোধ কেবল মাসুদ পথিকের কবিতা পাঠেই আসে। কবিতায় উঠে আসে ইতিহাস-ঐতিহ্য। আমাদের না বলা কথা, আক্ষেপ, উল্লাস।
মাসুদ পথিকের কবিতার ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ভিন্ন কিছুর সন্ধান দেয়। জীবনানন্দের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার সাহস জোগায়। নিম্নোক্ত চরণসমূহ পাঠে এমনটিই মনে হওয়া স্বাভাবিক। যেমন-
১. ‘কবরের মুধ্যে শুয়ে আছে একটি অবহেলা
তার বুকে দুটি দীর্ঘশ্বাসের ঘাস দুলছে‘ (দিবো স্থান)
২. ‘ঘরে যে নতুন বউ, রান্না করছে অনিদ্রা, অথই
উঠানেই কামুক শালিক’ (শিশিরের চাষ)
৩. ‘প্রাতভ্রমণ শেষে আমরা আরো কিছু করতে পারি দরকারি
যেমন কিনতে পারি সবুজ সবুজ তরকারি’ (মৃত্যুর সঙ্গী)
৪. ‘আমিই সেই ধান—এই ধান আমি
আমারে ঘিরিয়া নিউ কোলাহল ঊর্ধ্বগামী
তবে কি আমি আজ আহত ধানের ডামি?’
(ধান বাজারে এইসব নন্দন বেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহল)
সবশেষে বলা যায়, বইয়ের সবগুলো কবিতাই পাঠককে বিমোহিত করবে। আপ্লুত করবে। ভাবতে বাধ্য করবে। কবি মাসুদ পথিকের এই ধারা অব্যাহত থাকবে, এমন আশা-প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। কবিতার এ বাঁক বদলের খেলা আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। কবিতা পাঠে আগ্রহী করবে। আমি তার কবিতার দীর্ঘ পাঠ কামনা করছি। তার বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করছি।