কবি- রেজাউদ্দিন স্টালিন-কে নিয়ে বিশেষ আয়োজন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন:সীমানা ভাঙার কবি।। মতিন বৈরাগী
“ঘরই বন্দীত্বের প্রথম প্রতীক
ঘর আসন্ধ্যা সকালব্যাপী আমাদের
বন্দী করে রাখে
আর ডাকে আয় আয় দেয়ালের দীর্ঘ শয্যায়”
রেজাউদ্দিন স্টালিনের ঘর কবিতাটি
উত্তর কাঠামোবাদ তত্ত্বের আলোকে পাঠ করলে দেখা যায় যে এটি প্রচলিত বাইনারি বিপরীতগুলোকে ভেঙে দেয় এবং স্থিতিশীল অর্থের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। উত্তর কাঠামোবাদের মূল কথা হলো যে কোনো পাঠ্যে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক থাকে, এবং সেই ক্ষমতা কাঠামোকে বিপরীত করে নতুন অর্থ সৃষ্টি করা যায়। এই কবিতায় কবি মানুষের অস্তিত্বগত অবস্থাকে উন্মোচন করতে গিয়ে কয়েকটি মৌলিক বাইনারিকে উল্টে দেন। প্রথমত, ঘর ও সংসারকে আশ্রয় হিসেবে না দেখে বন্দিত্বের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আধুনিক চিন্তাধারার বিপরীত। দ্বিতীয়ত, মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে বৈপরীত্য স্থাপন করে দেখানো হয়েছে যে প্রাণীরা ঘরে ফিরতে চায় কিন্তু মানুষ চায় না, যা মানুষের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতাকে নির্দেশ করে। তৃতীয়ত, প্রতীক্ষাকে নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে সক্রিয় প্রতিরোধে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যেখানে প্রতীক্ষা শুধু অপেক্ষা নয়, বরং বিদ্রোহের প্রতীক। দার্শনিকভাবে কবিতাটি অস্তিত্ববাদী চিন্তার সাথে সম্পর্কিত, যেখানে মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও সামাজিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চিত্রিত হয়েছে। মানুষের ঘরের প্রতি ঘৃণা এবং তা লুকিয়ে রাখার কথা উল্লেখ করে কবি সত্য ও মিথ্যার বাইনারিকে ভেঙে দেন, যেখানে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ আসলে মিথ্যাচারের আবরণ। অতীতের আরণ্য পথিকের স্বাধীনতা ও বর্তমানের কবিতায় বাইনারিগুলো ক্রমাগত ভেঙে পড়ে যখন দেখা যায় যে মানুষের প্রতীক্ষা আসলে একটি ক্ষোভ, যা পথের শরীরে নখের দাগের মতো আতঙ্ক সৃষ্টি করে। শেষ পঙ্ক্তিতে আবার প্রতীক্ষার কথা উল্লেখ করা হলেও এটি এখন একটি নতুন অর্থ পায়Ñএটি শুধু নিখোঁজ মানুষদের জন্য অপেক্ষা নয়, বরং সমগ্র মানব অস্তিত্বের মুক্তির অপেক্ষা, যা কখনোই আসতে পারে না। এই কবিতাটি উত্তর কাঠামোবাদী পঠনকে সমৃদ্ধ করে কারণ এটি ক্ষমতার কাঠামোকে উন্মোচন করে দেখায় যে কীভাবে সমাজ মানুষকে বন্দী করে রাখে এবং কীভাবে ভাষা সেই বন্দিত্বকে স্বাভাবিক করে তোলে। কবিতাটি শুধু একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং একটি দার্শনিক প্রতিবাদ, যা আমাদের চিন্তার সীমানা ভেঙে দেয়। কবির ভাষা যেমন সরল, তেমনি তীব্র ও প্রতীকী, যা পাঠককে বারবার ভাবতে বাধ্য করে। কবি দেখান যে ঘর ও সংসার আসলে মানুষকে বন্দী করে রাখে, যেমন ফারাও পিরামিড নির্মাণে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করত। মানুষের ঘরের প্রতি ঘৃণা লুকিয়ে থাকে আত্মসম্মানের ভয়ে, কিন্তু সেই ঘৃণা পথের শরীরে নখের দাগের মতো ফুটে ওঠে।
কবিতায় উপস্থিত বাইনারিগুলো স্বতন্ত্রভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিটি বিপরীতধর্মী জোড়া কীভাবে উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তায় ভেঙে পড়ে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে। প্রথম বাইনারি হলো প্রতীক্ষা নিষ্ক্রিয় বনাম চলে যাওয়া , সক্রিয়। কবিতার শুরুতে ‘প্রতীক্ষায় থেকে যারা চলে গেছে’ বলে প্রতীক্ষাকে নিষ্ক্রিয় অবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও শেষে এটি সক্রিয় বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়। ‘পথের শরীরে প্রতীক্ষার ক্ষুব্ধ নখের দাগ’ লাইনে প্রতীক্ষা আর অপেক্ষা নয়, বরং ক্ষোভের প্রকাশ, যা নিষ্ক্রিয়তার বাইনারি ভেঙে দেয়। দ্বিতীয় বাইনারি মানুষ ঘরবিমুখ বনাম প্রাণী ঘরমুখী স্পষ্টভাবে উল্টে যায়। প্রাণীরা ‘রাত্রির আগে ঘরে ফিরে যেতে’ চায়, কিন্তু মানুষ ‘ঘরে ফিরতে চায় না কখনো’। এখানে মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রাণীকে প্রকৃতির সাথে ঐক্যবদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা মানুষ-প্রাণীর ক্ষমতার কাঠামো উল্টে দেয়। তৃতীয় বাইনারি ঘর, বন্দিত্ব বনাম আরণ্য, স্বাধীনতা কবিতার কেন্দ্রে। ঘরকে ‘প্রথম বন্দিত্বের প্রতীক’ এবং আরণ্যকে ‘সমূহ স্বাধীনতার’ স্থান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এখানে ঘর আর আশ্রয় নয়, বরং ফারাওয়ের মতো বন্দিশালা, যা আধুনিক সভ্যতার মৌলিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। চতুর্থ বাইনারি অতীত মানে মুক্ত বনাম বর্তমান বন্দী, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। অতীতের ‘আরণ্য পথিক, ছিল মুক্ত কিন্তু বর্তমানে মানুষ ‘পিরামিড বিনির্মাণে ক্রীতদাস’। এই বাইনারি ইতিহাসের ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্ন করে দেখায় যে সময় কীভাবে মানুষকে বন্দী করেছে। পঞ্চম বাইনারি, ঘৃণা, গোপন বনাম আত্মসম্মান প্রকাশ্য মানসিক দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। মানুষ ঘরের প্রতি ‘জ্বল-জ্বলে ঘৃণা’ অনুভব করে, কিন্তু ‘আত্মসম্মানের ভয়ে’ তা লুকিয়ে রাখে। এখানে ঘৃণা আর নেতিবাচক নয়, বরং মুক্তির আকাক্সক্ষার প্রতীক, যা আত্মসম্মানের কৃত্রিমতাকে ভেঙে দেয়।
প্রতিটি বাইনারি স্বতন্ত্রভাবে কবিতার উত্তর-কাঠামোবাদী পঠনকে সমৃদ্ধ করে, যেখানে ক্ষমতার স্থিতিশীল কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং নতুন অর্থের জন্ম নেয়। এই বাইনারিগুলোর মাধ্যমে কবি দেখান যে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ আসলে মিথ্যাচারের আবরণ, যা মানুষকে বন্দী করে রাখে। কবিতাটি প্রতীক্ষার এক গভীর অনুসন্ধান, যেখানে প্রতিটি বাইনারি স্বতন্ত্রভাবে ভেঙে পড়ে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে। প্রতীক্ষা আর নিষ্ক্রয় অপেক্ষা নয়, ক্ষোভের প্রকাশ। মানুষ প্রাণীর চেয়ে বেশি বন্দী, ঘর আর আশ্রয় নয়, বন্দিশালা। অতীতের মুক্তি আর বর্তমানের বন্দিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব ইতিহাসকে প্রশ্ন করে। ঘৃণা লুকিয়ে রাখা হয় আত্মসম্মানের ভয়ে, কিন্তু সেই ঘৃণাই মুক্তির পথ দেখায়। প্রতিটি বাইনারি কবিতাকে এক দার্শনিক প্রতিবাদে পরিণত করে, যা আমাদের চিন্তার সীমানা ভেঙে দেয়।
১
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা : প্রেম ও মানবিকতার চিত্রায়ন।। হানিফ রাশেদীন
রেজাউদ্দিন স্টালিন, আশির দশকের একজন অগ্রগণ্য কবি। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’। জীবনকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বোধ জাগ্রত করে তাঁর কবিতা। স্টালিনের কবিতায় গভীর দার্শনিক চিন্তা উঠে এসেছে অসাধারণ শৈলীতে। প্রেম, দ্রোহ, মানবিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন তাঁর কবিতা। তিনি বাংলা কবিতাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় প্রেম ও মানবতা একে অপরের পরিপূরক। প্রেমের বোধ থেকেই তো উদ্ভূত হয় সমাজের নানা অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দীপ্ত উচ্চরণ। মানবিক প্রেমের এক নন্দনিক চেতনা সৃষ্টি করেন তিনি তাঁর কবিতায়; যা পাঠককে আত্মজিজ্ঞাসায় উদ্বুদ্ধ করে। গভীর মানবিক বোধ তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য। সেই
কারণেই তাঁর কবিতা আমাদের হৃদয়ের গভীরে মানবতার দীপ জ্বালিয়ে দেয়। প্রেমের সঙ্গে তিনি উপস্থাপন করেন সময়ের বাস্তবতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তাঁর কবিতায় প্রেম শুধু আবেগ নয়; প্রতিরোধ ও মানবতার পুনর্গঠন। তিনি মানুষের জীবনের আনন্দ-বেদনা, সমাজের বৈষম্য ও নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণাকে কাব্যে তুলে ধরেছেন সংবেদনশীল দৃষ্টিতে। স্টালিনের কবিতা আমাদের শেখায়-ভালোবাসা ও মানবতাই জীবনের পরম সত্য।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা পাঠককে কেবল নান্দনিক আনন্দই দেয় না, বরং জীবনকে নতুন করে জানা-বোঝার দিগন্তও উন্মোচন করে। জীবন সম্পর্কে ভিন্ন এক উপলব্ধি তৈরি হয় আমাদের তাঁর কবিতা পাঠে। এর মূলে আছে কবির মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতাই তাঁর কাব্যভুবনকে দিয়েছে এক দৃঢ় ভিত্তি। তিনি যখন কোনো দৃশ্য বা অনুভব বর্ণনা করেন, তখন সেটি ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে সামষ্টিক অভিজ্ঞতায় রূপ নেয়। প্রেম তাঁর কাছে নিছক অনুভূতির প্রকাশ নয়; মানুষকে আরও সংবেদনশীল করে তোলার, মানুষের ভেতরকার জগতকে আরও প্রসারিত করার শক্তি।
কবিতায় রেজাউদ্দিন স্টালিন স্বতন্ত্র ভাষা, চিত্রকল্প ও আধুনিক চিন্তাধারার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কবিতায় ব্যক্তিমানুষের বেদনা যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজের অসাম্য, অন্যায়, বঞ্চনা ও মানুষের স্বপ্নভঙ্গের প্রকাশ। প্রেম ও মানবিকতার চিত্রায়ন, যাপিত জীবনের সংকট, জীবনের অর্থময়তা। তাঁর কবিতার ভাব
হৃদয়গ্রাহী, যতটা না কুয়াশাঘেরা ও আলো-আঁধারিতে আবৃত তারচে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তা-উদ্রেকী। প্রেমের আবেদন ও জীবনের গভীরতা তাঁর কবিতার প্রধান প্রবণতা। গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। আর তাই বুঝি পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন এই কবি।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা বক্তব্যপ্রধান, কিন্তু অনুভ‚তিময় ও নান্দনিক। জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গের বহু বিচিত্র ভাবনা উপস্থাপন করেছেন তিনি কবিতার মায়াজালে। তাঁর কবিতা পাঠকদের মোহিত করে, ভাবায়, খুলে দেয় পাঠকদের ভাবনার হাজার দরজা জানালা। এবং নতুন চিন্তার উদ্রেক করে। পাঠকরা কৌত‚হলী হয়ে ওঠে কবির বোধ ও শৈল্পিক সৌন্দর্যে। অভিনবত্বে। কাব্যিক নাটকীয়তায়। একটি কবিতা দেখা যাক। কবিতাটির নাম ‘বাড়ি ফেরা’-
বিখ্যাত শিল্পীর একক চিত্রপ্রদর্শনী
উদ্বোধনের পর মন্ত্রীর পেছনে পেছনে
গ্যালারির ভেতরে ঢুকে পড়লো দর্শকদের একাংশ
২
অধিকাংশই তরুণ, বয়োবৃদ্ধ দু’একজন
এর মধ্যে উসকো খুসকো চুল উদাসীন শার্টের
এক যুবক অনুসন্ধিৎসু, বেকার বোঝা যায়
প্রদর্শনীর প্রায় সবগুলো ছবিই তেলরংয়ের
ছবির নিচে ক্যাপশন;
কম্পোজিশন-১
সন্ত্রাস
দুর্ভিক্ষ
স্বপ্ন
যুদ্ধ
হঠাৎ একটা ছবির নিচে যুবকের দৃষ্টি দাাঁড়িয়ে গেলো
শিরোনাম- বাড়ি ফেরা….
অনেকগুলো পথ ছবির ভেতর থেকে বেরিয়ে
নানা দিকে চলে যাচ্ছে
বাতাস চিরে ট্রেন আসছে
এলোমেলো চুল দিকভ্রান্ত দৃষ্টি ডানাভাঙা শার্টের একটা লোক
ঊর্ধ্বশ্বাসে আধো অন্ধকারের ভেতর ছুটে যাচ্ছে
যেন ট্রেন আসার আগেই ক্রস করবে রেল লাইন
ছবির ঐ লোকটার সঙ্গে যুবক মিলিয়ে নিলো নিজেকে
তারপর ক্যানভাস থেকে নেমে আসা একটা
পথের দিকে যেতে যেতে ভাবল- শিল্পী কি জানে
রেল লাইন পার হয়ে ঐ লোকটার কখনো বাড়ি ফেরা হয়নি
সম্পূর্ণ কবিতাটাই তুলে দিলাম। কী আছে এই কবিতায়? অসাধারণ প্রতীকী কবিতা। বিচ্ছিন্নতা, পরাজয়, নিঃসঙ্গতা ও দিকহারা জীবনের প্রতিফলন স্টালিনের এই কবিতা। এই কবিতা আমাদেরকে ভাবায়, আচ্ছন্ন করে এর ভাব ও ভাষা শৈলির ব্যাঞ্জনায়। আমরা দেখতে পাই, চিত্রপ্রদর্শনী উদ্বোধনের পর গ্যালারির ভেতরে ঢুকে পড়া দর্শকদের
অধিকাংশই তরুণ; এর মধ্যে এক যুবককে দেখে মনে হয় অনুসন্ধিৎসু, মনে হয় বেকার ও বিষণ্ন। প্রদর্শনীর ছবিগুলোয় সুশৃঙ্খলভাবে চিত্রিত হয়েছে সন্ত্রাস, দুর্ভিক্ষ, স্বপ্ন ও যুদ্ধের উপাদান। যা আধুনিক সমাজের ভয়াবহ বাস্তবতা ও মানুষের মানবিক অবনতির প্রতিফলন। যুবক একটি ছবির সামনে থেমে যায়, ছবির শিরোনাম ‘বাড়ি ফেরা’। বাড়ি ফেরা এ তো কেবল গন্তব্য নয়, না ঠিকানা; আত্মপরিচয় ও আশ্রয়, একটুখানি শান্তি। বাড়ি, একটি স্বপ্ন বা আশ্রয়ের নাম। যেখানে হয়তো কেউ কোনোদিন ফিরতে পারে না।
কবিতাটির ভাষা সহজ, এই সহজতা আসলে তাঁর কাব্যশক্তির প্রমাণ। স্টালিন স্বাভাবিক কথোপকথনের ধারা ব্যবহার করে গভীর চিন্তা নির্মাণ করেন। চিত্রময়তা ও দার্শনিক গভীরতা রয়েছে এই কবিতায়। একটি পঙ্তি যেমন- ‘এলোমেলো চুল দিকভ্রান্ত দৃষ্টি ডানাভাঙা শার্টের একটা লোক’; এই একটিমাত্র পঙ্তিতেই জীবনের ক্লান্তি, হাহাকার
ও দিশাহীনতার ছবি ফুটে উঠেছে। চিত্রপ্রদর্শনীর দৃশ্যের ভেতর দিয়ে জীবনের প্রতীকী চিত্র প্রকাশ করেছেন কবি। সময়ের সঙ্কট, মানুষ ও সমাজের ভেতরকার ক্লান্তি, ক্ষত; এবং এই যে বাড়ি ফেরা-এ কী নিজেকেই এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানো নয় যে, আমরা কোথায় আছি? আমাদের এখন বাড়ি ফেরা উচিৎ। আধুনিক মানুষ দৌড়াচ্ছে,
ছুটছে; কিন্তু কোথায় তার গন্তব্য জানে না-এর বিপরীতে এই কবিতাটি আত্ম-উন্মোচনের এক দিগন্ত।
৩
শেষ পর্যন্ত মানুষ কি কখনো বাড়ি পৌঁছাতে পারে? কবিতাটি মূলত মানুষের অস্তিত্ব সংকটের প্রতিধ্বনি। আধুনিক মানুষের ভেতরকার নীরব হাহাকার। বাড়ি ফেরা মানে মানুষের আশাবাদ, টিকে থাকার অনন্ত সংগ্রাম; যা কোনোদিন শেষ হয় না। রেললাইন পার হওয়ার আগেই হয়তো সময়ের ট্রেন তাকে গ্রাস করে নেয়। কবিতাটিতে উল্লেখিত চিত্রপ্রদর্শনীতে দেখা যায়-এক ব্যক্তি অন্ধকারে দৌড়াচ্ছে, বাতাস চিরে ট্রেন আসছে, আর সে মরিয়া হয়ে ট্রেনের আগে রেললাইন পার হতে চাইছে। চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে যাওয়া যুবক ছবির সেই ব্যক্তির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে থাকে। শেষে কবি ইঙ্গিত দেন-শিল্পী কি জানে, সেই লোকটির আর কখনো বাড়ি ফেরা হয়নি।
মানুষের অন্তর্জগতের নীরব স্পন্দন টের পাওয়া যায় এই কবিতায়। গভীর মনস্তাত্তি¡ক উপলব্ধিই স্টালিনকে তাঁর প্রজন্মের কবিদের মধ্যে আলাদা করে চিহ্নিত করে। যে কবি মানুষের ভেতরটা দেখতে পান, মানুষের মনের কথা বলতে পারেন; তার কবিতাই তো মানুষের মনে স্থায়ী হয়ে থাকে।
রেজাউদ্দিন স্টালিন জীবনকে দেখেন খুব কাছ থেকে-দৈনন্দিন জীবনের নানা অনুসঙ্গ তিনি কবিতার উপাদান করে তোলেন। জীবনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি উঠে আসে তাঁর কবিতায়। জীবনকে তিনি নতুন করে দেখতে শেখান। চারপাশের কোলাহল, মানুষের ভেতরকার যন্ত্রণাকে কবি তাঁর সংবেদনশীল দৃষ্টিতে এমনভাবে নতুন অর্থে প্রতিস্থাপন করেন যে ভিন্ন এক আলোয় উদ্ভাসিত হয় জীবনের রঙ ও রূপ। সামাজিক মুক্তি ও মানবতার পুনর্জাগরণের অভিব্যক্তি।
রেজাউদ্দিন স্টালিন স্বতন্ত্র কাব্যভঙ্গি ও ভাষার নতুন ব্যবহারে কাব্যচর্চায় এক অনন্য পরিমÐল সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন ব্যক্তিমানুষের অন্তর্গত অনুভ‚তির টানাপোড়েন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমাজ-ইতিহাস-রাজনীতির প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি। ভাষার ওপর তাঁর সাবলীল দখল, চিত্রকল্পের নতুনত্ব; এবং মানবিক বোধের গভীরতা তাঁকে সমসাময়িকদের মধ্যে আলাদা করে চিহ্নিত করে। বাংলা কবিতার পাঠক তৈরিতে স্টালিনের অবদান অনস্বীকার্য। আশির দশকের কবিদের মধ্যে তিনি একই সঙ্গে আধুনিকতা, প্রতিবাদ, প্রেম, জীবনচেতনা ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানকে মিলিয়ে এক স্বতন্ত্র কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন। নতুন প্রজন্মের কবিদের অনুপ্রাণিত করছে তাঁর কবিতা।
রেজাউদ্দনি স্টালিন: সমকালীন বাংলা কবিতার কাব্যর্দশন, মানবিকতা ও নতুন নন্দনচেতনার নির্মাতা ।। রাজ মাসুদ ফরহাদ
রেজাউদ্দিন স্টালিন: সমকালীন বাংলা কবিতার কাব্যদর্শন, মানবিকতা ও নতুন নন্দনচেতনার নির্মাতা ।। রাজ মাসুদ ফরহাদ
রেজাউদ্দিন স্টালিন সমকালীন বাংলা কবিতার এক অনন্য উচ্চারণ, যাঁর কাব্যদর্শন, ভাষাবোধ, সৌন্দর্য-ভাবনা ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা কবিতাকে এক নতুন আলোয় প্রতিভাত করেছে। তাঁর কবিতা কেবল ভাষার কারুকাজ বা অলঙ্কারিক বিন্যাস নয়—বরং মানুষের গভীরতম অনুভব, ইতিহাস, মানবসভ্যতার চেতনাবোধ ও নৈতিক অনিশ্চয়তার সুনিপুণ শিল্পরূপ। তাঁর কবিতায় জীবন ও স্বপ্ন, সমাজ ও সভ্যতা, প্রেম ও প্রতিবাদ, বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির এক বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটে—যা তাঁর কবিতাকে সাধারণ থেকে ব্যতিক্রমী উচ্চতায় নিয়ে যায়।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশেরও অধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— দুঃখের প্রজাতন্ত্র, জীবন বলে যদি কিছু থাকে, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা, শিল্পকলা, ৩০০ ভোল্টের ভালোবাসা, হাজার খঞ্জরের রক্ত, সময়ের কাছে সমর্পিত, সূর্যকে লেলিহান লেগেছে, অন্য নক্ষত্রে ঘুম, তোমার মৃত্যুর নান্দনিকতা, বোতলবন্দি নক্ষত্র, মৃতেরা চিঠি লিখছে, উপশহরের রাত্রি, মানুষ মেশিন নদী আর উদাসীন আরশোলা, মানুষ তত্ত্ব, ঘুম-উদাস লাশ ও প্রেম, সূচনা পর্ব, সময় সম্ভবমুখী মন, প্রতিটি পরিবর্তন খুলে দেয় জীবনের অলৌকিক স্বর—প্রভৃতি। প্রতিটি গ্রন্থ যেন মানবজিজ্ঞাসা ও জীবন-দর্শনের আলাদা আলাদা সুর; কখনো প্রশ্ন, কখনো প্রতিজ্ঞা, কখনো জীবনবোধের কাব্যিক আলোকমালা।
তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় মানবসভ্যতার ইতিহাস, শহরজীবনের নিঃসঙ্গতা, প্রযুক্তিনির্ভরতার সাংস্কৃতিক সংকট, বিশ্বাসের পচন, নীতির অবক্ষয়, স্বপ্নের পুনর্জাগরণ, প্রেমের নবতর ব্যাকরণ; আবার কখনো দেখা মেলে শিশুর মতো নির্মল নিষ্পাপ মন, কখনো তীব্র বিদ্রোহী কণ্ঠ, কখনো পুনরাবিষ্কৃত পুরাণ, কখনো মহাকাশের রহস্যময় নৈঃশব্দ। তিনি একই কাব্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে মানবিক কোমলতার সুপ্রয়াস ঘটান—যা তাঁর কবিতাকে একাধারে দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও গভীর রোমান্টিক করে তোলে।
— ল্পকলা” কবিতায় যেমন তিনি বলেছেন—
না — আমি চাই অসীম কোনো দিন / তোমার দৃষ্টির মাকু থেকে নেমে আসা / আদিম শিল্পকলা যতটা স্বাধীন।”
এখানে কবির আকাঙ্ক্ষা কেবল সম্পর্ক বা প্রেমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিল্পের প্রথম জন্ম, চেতনাবোধের প্রথম আভাস, স্বপ্নের প্রথম শাণিত নকশা—এসব কিছুর মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস।
রেজাউদ্দিন স্টালিন মানুষের জীবনের সসীমতার ভেতরে অসীমতার অনুসন্ধান করেন। ুমহাপ্রস্তুতি” কবিতাটি যেন মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎপ্রদর্শক এক কাব্য-ইশতেহার; সেখানে তিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বপ্ন, মৃত্যু ও সমাজবোধের নতুন নির্মাণ তুলে ধরেন। তাঁর কবিতায় ইউটোপিয়া ও ডিস্টোপিয়ার দ্বৈত উপস্থিতি রয়েছে—একদিকে মুক্ত মানুষের স্বপ্ন, অন্যদিকে কৃত্রিম, যান্ত্রিক মানবজীবনের বিশল্যকরণ।
তাঁর কাব্যে কখনো সমাজ-সভ্যতার সংকট, মানবিকতা ও প্রেমের লুপ্তচিহ্নকে নতুনভাবে অনুধাবনের চেষ্টা দেখা যায়—
ুকথা বলা বন্ধ করতে হবে / অচেনাকে চেনা বন্ধ করো / অজানার শ্রাদ্ধদিনে উপস্থিত থাকো”—
এই স্বর কেবল কবিতার নয়, এটি সময়ের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় ‘ঠিকানা’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘নদী’, ‘বৃষ্টি’, ‘পথ’, ‘জিয়নকাঠি’, ‘ইথাকা’, ‘মৃত্যু’, ‘স্বপ্ন’, ‘মহাকাশ’, ‘বানান’, ‘সম্ভবমুখী মন’—এসব শব্দ শুধু অলঙ্কার নয়, বরং প্রতিটি শব্দ তাঁর কাছে মানবজীবনের একেকটি দার্শনিক স্তর, মানবিক অন্বেষার একেকটি দরজা। তাঁর কবিতা বহু সময়েই এক ধরনের আধ্যাত্মিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়—কিন্তু তা কখনো বিমূর্ত অলীক কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। তিনি মানবিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই স্বপ্ন দেখেন, তাই তাঁর কবিতায় দর্শন ও বাস্তবতার অপূর্ব সম্মিলন ঘটে।
তাঁর কবিতার ভাষা নিছক অলংকার-বহুল অথবা সাংকেতিক নয়—বরং অনেক সহজ, স্বাভাবিক, মানুষের মুখের ভাষা। কিন্তু সেই ভাষার ভেতরে থাকে তীব্র মানবিক অভিঘাত, স্মৃতি, সময়, বিস্ময় ও প্রতিবাদের বহুমাত্রিক ধ্বনি। এই কারণেই তাঁর কবিতা সাধারণ ও প্রাজ্ঞ পাঠক উভয়ের কাছেই গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে।
তিনি কবিতায় পৌরাণিক বর্ণনা ও আধুনিক অস্তিত্বের দার্শনিক প্রশ্নকে একত্রে মিশিয়ে এক অনন্য কাব্যধারা নির্মাণ করেছেন। ুজিয়নকাঠি” কবিতাটি যেন লোককথা, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন, যেখানে রাজকুমারী-রাজপুত্রের সন্ধিক্ষণে উঠে আসে মানুষের মুক্তি, সভ্যতার জাগরণ ও জীবনের পুনর্জন্মের প্রতীক।
তাঁর কবিতায় ‘সমকালীনতা’ কখনো কোনো ফ্যাশন বা ট্রেন্ড নয়; বরং সময়ের দার্শনিক অভিঘাত। তিনি মানুষের নিঃসঙ্গতা, সমাজের নিষ্ঠুরতা, সভ্যতার সঙ্কট—এসবকে সুন্দর করে তুলতে চান না, বরং সেগুলোর নগ্ন সত্যকে কাব্যশক্তিতে উদ্ধার করেন। তিনি যেমন বলেছেন—
ুসময় কিভাবে থকথকে হলো ঘৃণায়”—
এ যেন বর্তমান বিশ্বের নির্দিষ্ট সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের এক অসাধারণ কাব্যিক অভিব্যক্তি।
রেজাউদ্দিন স্টালিন আমাদের সময়ের কবি; কিন্তু তিনি শুধু সময়ের কবি নন—তিনি সময়কে অতিক্রমের কবি। তাঁর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানকে যুক্ত করেন, আবার বর্তমানকে মহাজীবনের চেতনায় ফিরিয়ে দেন। তাঁর কবিতা কেবল পড়ার নয়, উপলব্ধির; কেবল শোনার নয়, অনুভবের; কেবল ভাবনার নয়, এক গভীর কাব্যিক জাগরণের অভিজ্ঞতা।
বাংলা কবিতায় রেজাউদ্দিন স্টালিনের বিশেষত্ব হলো—
১. ভাষায় সরলতা, ভাবনায় গভীরতা।
২. মানবসভ্যতা, সময় ও অস্তিত্বের প্রতি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
৩. প্রচলিত কবিতার অলংকারিক আবরণ ছিঁড়ে বাস্তবতাকে কাব্যে রূপান্তর করার ক্ষমতা।
৪. লোকপুরাণ, ইতিহাস, সামাজিক সংকট এবং প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎচিন্তার অনন্য সমাবেশ।
৫. মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রতিবাদের নান্দনিক উজ্জ্বলতা।
আজকের বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলে যখন অনেকেই ভাষার শৈল্পিক উৎসব, জটিল বাক্য ও বিচ্ছিন্ন ভাবনার অলঙ্করণে ব্যস্ত—তখন রেজাউদ্দিন স্টালিন তাঁর কবিতায় এক ধরনের নতুন, দার্শনিক অথচ সহজ মানবিক গভীরতা নির্মাণ করেছেন। তাঁর কবিতায় গল্প আছে, ইতিহাস আছে, মানবতা আছে, দুঃখ আছে, ভালোবাসা আছে, এবং আছে এক চিরন্তন প্রশ্ন—ুজীবন বলে যদি কিছু থাকে, সে কি কেবল বেঁচে থাকা?”
সাহিত্যচর্চায় যাঁরা মানবিকতার প্রতি বিশ্বস্ত, যাঁরা প্রকৃত কবিতার পথ চিনতে চান, যাঁরা শব্দের ভেতর থেকে জীবনকে দেখতে চান—তাঁদের জন্য রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা এক অপরিহার্য পাঠ, এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। আজকের বাঙালি পাঠক, চিন্তক ও কবিমনা মানুষের কাছে রেজাউদ্দিন স্টালিন নিছক একজন কবি নন—তিনি এক অন্বেষক, এক প্রশ্নকারী, এক কাব্যিক দার্শনিক।
তা-ই বলা যায়—রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলা কবিতায় এক সম্ভাবনার নাম, এক প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, এক সময়ের আয়না এবং ভবিষ্যৎ কবিতার দূরবীণ।
জয় হোক কবিতার। জয় হোক মানবতার। জয় হোক রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যদর্শনের।
কবিতা কীর্তিনাশা
রেজাউদ্দিন স্টালিন
ওরা দাঁড়িয়েছে অন্ধকারের আগে,
ওরা দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর পুরোভাগে।
সহ্য হয় না সন্ধ্যার নিরবতা,
যত রাত বাড়ে চাঁদের প্রগলভতা।
প্রেম যাকে খায় আত্মা অবধি নামে,
বিরহ ছড়ায় এলোমেলো কেশদামে।
কে এসে দাঁড়ায় চৌকাঠ জুড়ে ছায়া,
মেঘ দিয়ে গড়া অবয়ব তার কায়া।
হাতের চাবুক পাথুরে ঘোড়ায় হানে,
লক্ষ লক্ষ রণভেরী বাজে কানে।
কৃত্রিম যত বুদ্ধিমত্তা প্রাণী,
এক পায়ে সব টানছে কলুর ঘানি।
নীল হয়ে গেছে নক্ষত্রের দাবি,
তবুও মূর্ত আকাংখা কূলপ্লাবী।
আর ভয় কিসে পাথরের মৌমাছি,
মধু নিতে যাবে মৃতদের কাছাকাছি।
আকাশ পাতালে অগনিত মৃত পাখি,
ডানা ঝাপটায় করে ঘোর ডাকাডাকি।
স্মৃতিতে খোদাই আদিম তৃষ্ণা যত,
নতমুখ তারা লজ্জায় ব্রীড়ানত।
জখমকে যারা ভুলে যায় প্রতারক,
তারা শুধু খোঁজে অনন্ত পরলোক।
যারা ভুল করে পৃথিবীর যত পাপী,
মৃত্যুর মাঠে করে ক্রুর দাপাদাপি।
দাউদের গানে মত্ত মাছেরা ভাবে,
জীবন কেবল ছুরিতেই চমকাবে।
যেমন যিশুর গাধারা বুঝেছে ঠিক,
দিনে দিনে ক্ষুধা সয়ে যাবে ততোধিক।
জেদী গাধা বলে আমাদের ভাগ কই,
আমরা পড়েছি নিষিদ্ধ লাল বই।
এবং শিখেছি সূর্যের বন্দিশ,
ভাগ করে নিতে প্রাপ্য ধানের শীষ।
আর কিছু নয় বিকর্ণ ভালোবাসা,
কেনা জানে নদী কবিতা কীর্তিনাশা।
