শিশুতোষ গল্প

ঈদসংখ্যার শিশুতোষ গল্প ।। বিদেশি ঈদ পোশাক।। ইমরুল ইউসুফ

জামার ভাজ খুলতেই আলো জ্বলে উঠল। লাল নীল হলুদ সবুজ কমলা রঙের আলো। যেন রংধনু খেলা করছে জামাটার মধ্যে। জামার রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ। ঘরটা হয়ে উঠল আরও উজ্জ্বল। প্রিয়তি অবাক। এমন পোশাকতো আগে কখনো দেখিনি। এটা কি জাদুর জামা! নাকি সত্যি সত্যিই একটি জামা? আনন্দে চিৎকার করে প্রিয়তি তার মাকে ডাকল। বলল, ‘মা মা দ্রুত এদিকে এসো। দেখে যাও। খালামনির পাঠানো জামাটা দেখে যাও।’ মা দৌড়ে এসে দেখলেন প্রিয়তি আলো ঝলমলে একটি জামা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা কিছুটা অবাক হয়ে বলল ‘সত্যিইতো। এটা আবার কেমন জামা!’
প্রিয়তির বড় খালা ইংল্যান্ড থেকে জামাটি পাঠিয়েছেন। প্রতিবছর ঈদের আগে খালামনি কিছু না কিছু পাঠান। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এবারের ঈদ গিফটি একেবারেই অন্যরকম। মা প্রিয়তিকে বললেন, ‘তোমার খালামনি একটি জামা পাঠাবে বলেছিল। বলেছিল এবার তোমার জন্য যে গিফটি পাঠাবে সেটি একটু অন্যরকম। এর বেশি কিছু বলেনি। হয়তো ইচ্ছে করেই বলেনি। যাতে আমরা অবাক হই।’
সত্যিই অবাক হওয়ার মতো বিষয়। ঘরের লাইট বন্ধ হলো কি করে! প্রিয়তিকে মা বললেন, ‘তুমি লাইট অফ করেছ?’ সে মাথা নেড়ে বলল, ‘না’। ‘তাহলে লাইট বন্ধ হলো কী করে? অন্য ঘরের লাইট তো ঠিকই জ্বলছে।’ আরও বিস্মিত হলো মা আর মেয়ে। সুইচ অন করা। অথচ লাইট জ্বলছে না। ব্যাপারটা কী? জামাটি দিয়ে এত আলো ঠিকরে পড়ছে যে ঘরের সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আলো আঁধারির এক ধরনের খেলা চলছে ঘরজুড়ে। এমন সময় প্রিয়তি জামাটি গায়ে দেওয়ার জন্য অন্য ঘরে গেল। যেই না ও ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে গেছে অমনি ঘরের আলো জ্বলে উঠল। বাহ্ দারুণ তো। সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার।
সময় যাচ্ছে। বিস্ময় আরও বাড়ছে। জামাটির বিষয়ে জানার আগ্রহ বাড়ছে। প্রিয়তির বাবা বাসায় ফেরার অপেক্ষা বাড়ছে। বাবা বাসায় ফিরলে যদি এবিষয়ে কিছু জানা যায়। প্রিয়তির সঙ্গে তার মা-ও অস্থির হয়ে উঠেছেন জামাটির বিষয়ে জানার জন্য। এজন্য তিনি প্রথমেই ফোন দিলেন প্রিয়তির বাবার কাছে। বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। আজ দারুণ একটি ঘটনা ঘটেছে। তুমি বাসায় না আসা পর্যন্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’ এই কথা বলে ফোন কেটে দিলেন প্রিয়তির মা। এবার ফোন করলেন ইংল্যান্ডে তার বড়ো বোনের কাছে। কিন্তু ফোনটা ধরছে না। আবারও ডায়াল করলেন। না ধরছে নাতো। এখন কেন জানি আরও অস্থির লাগছে। একটু ভয় ভয়ও লাগছে। মনে মনে বলল, বড়ো আপা এটা কী করল। একবারওতো বলল না যে আমি প্রিয়তির জন্য একটি জামা পাঠাচ্ছি জামাটি একটু ভিন্ন ধরনের। একবার বললে কী হতো!
এমন সময় কলিংবেলের শব্দ। প্রিয়তি দৌড়ে দরজার সামনে এসে বলল, ‘কে?’ ওপাশ থেকে শোনা গেল বাবার কণ্ঠ। ‘বাবা এসেছে। বাবা এসেছে।’ বলতে বলতে প্রিয়তি দরজা খুলে দিলো। বলল, ‘বাবা জানো বড়ো খালামনি আমার জন্য একটি ম্যাজিক জামা পাঠিয়েছেন।’ বাবা বললেন, ‘ম্যাজিক জামা তাই না-কি। কই দেখি তো কেমন ম্যাজিক জামা।’ বাবা হাতে নিতেই জামার আলো নিভে গেল। কী হলো! এতক্ষণ তো আলো জ্বলছিল। হঠাৎ নিভে গেল কেন? এমন সময় প্রিয়তির মা এলেন। বললেন, ‘কই আমার হাতে দাও তো দেখি। নাহ্ জ্বলছে না।’ প্রিয়তি বলল, ‘আমার হাতে দাও। দেখবে জ্বলবে।’
প্রিয়তি হাতে নিতেই সত্যি সত্যি জামাটি জ্বলে উঠল। প্রিয়তির মা-বাবা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বাবা মায়ের অসহায় মুখ দেখে প্রিয়তি খুব আনন্দ পেল। আনন্দে নাচতে নাচতে বলল, ‘দেখলে তো তোমাদের কেমন বোকা বানালাম। আমার হাতে থাকলেই শুধু জামাটি জ্বলে। তোমাদের হাতে গেলে জ্বলে না। তার মানে আমার হাতে জাদু আছে।’ ‘হ্যাঁ মা, তোমার হাতে সত্যিই জাদু আছে। তা-না হলে এমটি হতেই পারে না। তুমি এখন জামাটি পরো। দেখি কেমন মানিয়েছে।’ বললেন প্রিয়তির বাবা। ‘না, আজ পরবো না। ঈদের দিন পরব। ওই দিন দেখবে আমাকে কেমন দেখায়। আমার বন্ধুরা অবাক হয়ে যাবে আমার ড্রেসটি দেখে। বলবে, এত সুন্দর ড্রেস তুমি কোথায় পেলে?’
প্রিয়তির এই কথা শুনে মা বললেন, ‘অনেক হয়েছে। এবার পড়তে বসো। কয়দিন থেকে পড়ালেখায় তোমার কোনো মনযোগ নেই। সারাক্ষণ শুধু খেলা আর খেলা। টিভিতে কার্টুন দেখা। আর দুষ্টামি করা। রোজার ছুটির পর স্কুল খুললেই পরীক্ষা, ভুলে গেছো?’ ‘যাচ্ছি মা।’ এই কথা বলে মায়ের হাতে ড্রেসটি দিয়ে প্রিয়তি পড়তে যায়। ড্রেসটির আলো তখনই নিভে যায়। মা সুন্দর করে গুছিয়ে জামাটি প্যাকেটে ভরে রাখেন। ভাবতে থাকেনÑএ আবার কেমন জামা। যার জামা শুধু তার হাতেই জ্বলে!
বাবা ফ্রেস হয়ে লাইট জ্বালিয়ে বসলেন ড্রয়িং রুমে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জামার প্যাকেটের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। বুঝলেন এটা সাধারণ কোনো পোশাক নয়। এটি বিশেষভাবে তৈরি একটি পোশাক। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যাকে বলছে স্মার্ট ড্রেস। মনে মনে বললেন, কাল দিনের আলোয় ড্রেসটি ভালোভাবে দেখতে হবে। আমাদের জন্য হয়তো আরও কিছু বিস্ময় অপেক্ষা করছে।
ঝকঝকে সকাল। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়েছে বারান্দায়। প্রিয়তির বাবা ড্রেসটি নিয়ে বারান্দায় এলেন। সূর্যের আলো লাগতেই দেখলেন ড্রেসটির ভাজ খুলে যাচ্ছে। খুলতে খুলতে ড্রেসটি কাকতাড়–য়ার মতো হয়ে গেল। ড্রেসটি থেকে আলো ঠিকরে বের হতে লাগল। রঙিন আলোর ঝলকানি বারান্দার থাই গøাসে লেগে জায়গাটা আরও আলোকিত হয়ে উঠল। এত আলো দেখে প্রিয়তি ও তার মা ছুটে এলেন। দেখলেন, জামাটি হীরের মতো জ্বলছে। টুকরো টুকরো আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আশপাশের মানুষ আলোর উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কোথা থেকে আসছে এমন চকচকে আলো! প্রিয়তির মা বললেন, ‘জামাটি এখনই ঘরে নিয়ে এসো। তা-না হলে দেখবে আলো খুঁজতে খুঁজতে লোকজন সব বাসায় এসে হাজির হবে।’
প্রিয়তির বাবা জামাটি ঘরে নিয়ে এলেন। দেখলেন জামার আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। জামাটি ভাজ হয়ে যাচ্ছে। চারপাশের আলো কমে যাচ্ছে। বললেন, ‘এই ড্রেসটি দেখছি আলো কিংবা অন্ধকার সবখানেই আলো ছড়ায়। মেয়ে এই জামা পরলে তো আলো ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। না, আমি ওকে এই জামা পরতে দিব না।’ এই কথা শুনে প্রিয়তির মন খারাপ হয়ে যায়। বলে, ‘বাবা শুধু ঈদের দিন জামাটি পরতে দিও। এটি পরে আমি আমার বন্ধুদের চমকে দিব। তারা অবাক হয়ে জামাটি দেখবে। আমার সঙ্গে খেলবে। আমরা একসঙ্গে ঘুরতে বের হব।’ বাবা বললেন, ‘আচ্ছা মা। সে না হয় ঈদের দিন দেখা যাবে। এখন জামাটি মায়ের হাতে দাও। ওয়ারড্রবে রেখে দিতে বলো।’
ঈদের দিন। মা বাবা ঘুমিয়ে। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো প্রিয়তির। ঘটনাটি খুবই বিরল। কারণ প্রিয়তি জানে শতবার ডেকেও তাকে ঘুম থেকে জাগানো যায় না। নতুন জামা পরার আনন্দেই কি আজ তার ঘুম ভাঙলো? কিন্তু বাবা যে বলেছেন জামাটি পরতে দিবে না। বাবা যে একরোখা মানুষ, জামাটি যদি সত্যিই সত্যিই পরতে না দেয়। তাহলে কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতে সে চুপি চুপি ড্রয়ার থেকে ড্রেসটি বের করে। ড্রেসটির ভাজ খুলতেই আলোকিত হয়ে ওঠে চারদিক। প্রিয়তি স্মার্ট ড্রেসটি ঝটপট পরে নেয়। তার সারা গা কেমন জানি শিরশির করে ওঠে। দৌড়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দেখে তার আশপাশের সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠেছে। রংবেরঙের আলো খেলা করছে তার চোখে মুখে। সে যেন ডুবে আছে আলোর সাগরে। সেই সাগরে তার সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *