ঈদসংখ্যার গল্প।। পৌরুষ অথবা বিভ্রান্তি।। মো. রেজাউল করিম
গেল ক’মাস সাবেরা খাতুনের দৈনিক কার্যাদির সময়সূচিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। স্বামী আব্দুস সোবহান মাস চারেক হলো চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কোনো চাকরি যে নিয়েছেন তাও না। খবরের কাগজ পড়া, নামাজ, খাওয়া- এর বাইরে আর কিছুই করেন না; চাকরি আবার করবেন কিনা তাও বলেন না। বেসরকারি চাকরিতে জমানো টাকা কতই-বা। এই ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, বাজার খরচ, ঔষধ কেনাকাটা- একটা সংসার চালাতে কত যে টাকা-পয়সা লাগে তার কি কোনো হিসেব আছে?
রোজকার মতো বিকেল বেলায় আব্দুস সোবহান পুরনো আমলের চারতলা ভাড়াবাড়ির সামনের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন অথবা কাগজের দিকে তাকিয়ে আছেন। এক খবরের কাগজ দিনে কতবার তিনি হাতে নেন তার অন্ত নেই। সাবেরা খাতুনের মনে হলো এখন সম্ভবত তিনি বিজ্ঞাপনগুলো পড়ছেন- তা না হলে এত সময় ব্যয় করার মতো সংবাদ খবরের কাগজে থাকে বলে তাঁর মনে হয় না।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শেভ করা মানুষটা এখন তিন কী চার দিন পর পর একবার দাড়ি শেভ করেন। ফলত প্রায় দিনই তাঁকে দেখা যায় খোঁচা খোঁচা দাড়িসমেত। বর্ষা শেষ প্রায়, কিন্তু আবহাওয়ার কী নিদারুন পরিবর্তন। বৃষ্টি নেই দিনের পর দিন, অথচ বৈশাখ মাসের মতো বিকেল বেলায় হালকা ঝোড়ো হওয়া- মাস দুয়েক চুল না কাটা আব্দুস সোবহানের মাথার সামনের দিককার চুলগুলো তার নিজ সীমানা ছাড়িয়ে সামান্য বাতাসেই কপালের ওপরে ঝুলে পড়েছে। সেদিকে তাঁর কোনো খেয়াল নেই। কী এক নৈঃশব্দ হাহাকার তাঁকে অজানা এক ভাবজগতে নিয়ে গিয়েছে। ভ্যাপসা গরমে বারান্দায় বসে আছেন তিনি, কোনো বিকার নেই। সাবেরা খাতুন আব্দুস সোবহানের চেয়ারের সামনে রাখা ছোট টুলটাতে গোটা তিনেক বিস্কুট আর আদা দেয়া এক কাপ লাল চা রেখে চলে এলেন, দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো ফায়দা নেই সাবেরা খাতুন তা জেনেছেন গত চার মাসে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মেয়ে তন্বীর জীবনে অনাকঙিক্ষত ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পরে আব্দুস সোবহান চাকরি ছেড়ে দিয়ে নির্বাক গৃহবাস করছেন।
চা খাওয়া শেষে আব্দুস সোবহান সামনের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। ওদিকে আছে আটতলা ভবনে এক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। এ বাড়ির সামনের বারান্দায় বসলে ফ্যাক্টরির পেছন দিকটা দেখা যায়। আব্দুস সোবহান ঐ দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন, তাঁর মনে কী চিন্তা কাজ করছে তা তিনিই ভালো জানেন। চায়ের ট্রে নিতে এসে সাবেরা খাতুন এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেন আব্দুস সোবহানের দৃষ্টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির পেছন দিকটায়, যদিও ওখানে দেখার কিছু নেই, স্বামীর চোখে বিমর্ষ শুন্যতা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। নিচের রাস্তায় ছোটো ছোটো ছেলেদের ফুটবল নিয়ে খেলা, হৈচৈ কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত করে না। হয়ত-বা মেয়ের ভবিষ্যত কিংবা নিজের বর্তমান অবস্থান নিয়ে ভাবছেন কিংবা পঞ্চান্ন বছরে বয়সে জীবনে পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাব কষছেন।
সাবেরা খাতুন মেয়ের ঘরে ঢুকলেন চা খাবে কিনা জানতে। ঐ ঘটনার পরে তন্বীও বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়নি, কবে যাবে তা জিজ্ঞেস করা হয়নি; হয়ত আর যাবেও না। একদিন মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছে সেমিস্টার লস হলেও সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে- ওখানে নয়। সাবেরা খাতুনের এ-বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই; অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কত টাকা লাগবে তা তাঁর অজানা। সেই টাকা মেয়ের বাবা দিবে কিনা বা দিতে পারবে কিনা তাও জানা নেই। মেয়েকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য বলেছেন- আচ্ছা তাই হবে।
মেয়ে কোনো চূড়ান্ত দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে কিনা সে ব্যাপারে সাবেরা খাতুন অত্যন্ত সজাগ; দিনে তো বটেই, রাতেও ঘুম থেকে উঠে দু’তিন বার মেয়ের ঘরে এসে উঁকি দিয়ে দেখে যান সে কী করছে।
তন্বী ভাদ্র মাসের গরমেও কাঁথা দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা ঢেকে শুয়ে ছিল। এটা তার অভ্যাস- কাঠফাটা গরমেও সে কোমর পর্যন্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো। দরজায় মায়ের আগমন টের পেয়ে ধরমর করে উঠে বসল। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিল সে- ‘দাও মা শুধু চা দাও, আর কিছু দিতে হবে না’। ঐ ঘটনার পরে একবার ছোটভাই রাসেলকে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছে। কয়েকদিন ওখানে থেকে থানা-কোর্ট- কোথায় কোথায় কী কী সব কাজ করে সেই যে এসেছে, তারপর ছোট্ট এক ঘরে অনেকটাই স্বেচ্ছাবন্দীত্ব বরণ করেছে। বাবার সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়ার সাহস নেই। রান্না ঘরে মাকে সাহায্য করার জন্য যে যাবে, বাবার সাথে দেখা হয়ে যায় কিনা সেই ভয়ে রান্না ঘরেও যায় না। বয়সে ছোটভাই রাসেলের সাথে কচিৎ-কদাচিৎ দেখা হয়, যদিও ও পাশের ঘরেই থাকে।
বস্তুত দুঃসহ স্মৃতি-ভারাক্রান্ত তন্বী গত চার মাস একরকম জীবন্মৃত অবস্থায় দিনগুলো পার করছে। নিজের ঘরে টেলিভিশন নেই। খবরের কাগজ- সেটা বাবার দখলে, মোবাইল ফোন রিচার্জ করা হয়নি- ওটাও কার্যত বন্ধ। দুর্ঘটনার পরে নানী-খালা এসেছিলেন, সে মাকে বলেছে সান্ত¡Íনার প্রয়োজন নেই- এঘরে যেন কেউ না আসে। গেল চার মাস সে বেঁচে আছে যে মানুষটিকে নিয়ে তিনি- মা। এঘরে তার অবাধ যাতায়াত। যেহেতু সে ডাইনিং টেবিলে যায় না, মা-ই তিন বেলা খাবার দিয়ে যায়। এ থেকে এটুকু সে বুঝেছে তার এই দুঃসহ দিনগুলোর যাতনা একজন হলেও বোঝেন- তিনি মা। এই বয়সে পরিবারের বাইরে যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিল সে যে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করবে সেটা নিয়েই মেয়েটা ভাবে দিবারাত্র। পুরুষ সম্পর্কে সে যে ধারণা পেয়েছে তাতে ভবিষ্যত জীবন নিয়েও ভাবে। ঘুম ভালো হয় না, ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে; স্বপ্নে সাবেক প্রেমিক মানসকে দেখে- সে তাকে হুমকি দিচ্ছে, বলছে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবে। চিৎকার করতে গিয়েও ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ঘুম ভেঙে যায়, বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছিল। ডিম লাইটের পাওয়ার বাড়িয়ে দেয়, আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না।
তন্বী ভাবে নারী-পুরুষের মিলন ছাড়া তো জগৎ-সংসার অচল হয়ে যাবে। থেমে যাবে পৃথিবীতে মানবসৃষ্টির ধারাবাহিকতা। কিন্তু কোন্ সে পুরুষ, যে সৎ ও ব্যক্তিত্ববান? তাকে চেনার উপায় কী? সেটেল ম্যারেজেই তাকে পাওয়া যাবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? দুই বছর যাকে খুব কাছে থেকে দেখে ভালোবেসেছিল, সে যদি হতে পারে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক, তাহলে অপরিচিত একজন মানুষ, সে যে হবে আদর্শবান অথবা সচ্চরিত্রের তার নিশ্চয়তা কি? সে হয়ত নিজ বউকে অন্যের হাতে তুলে দিবে না, কিন্তু সে যে ঘরে বউ রেখে আরো অন্য মেয়ের সাথে লটরপটর করে বেড়াবে না, তার নিশ্চয়তা কি?
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এরকম কতগুলো ঘটনাই তো ঘটতে দেখল, ডিভোর্সও হয়ে গেল। তাহলে কি বাবা-মায়ের মতো প্রভু-দাসী সম্পর্কই ভালো? বাবা-মা কিংবা আরো অনেক নিকটজনের সংসারচিত্রের কথা চিন্তা করে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের বয়সে বিস্তর ফারাক, সেটেল ম্যারেজ- আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ সংসারবাস তারা করছে। তাদেও সম্পর্কও তো সেই ত্রিশ বছর আগে বিয়ে করা বাবা-মায়ের মতো সম্পর্কÑঅনেকটাই প্রভু-দাসী। আবার পাঁচ কিংবা সাত বছর প্রেম করে বিয়ে হয়েছে, অথচ সংসারে বাদ-বিসম্বাদ লেগেই রয়েছে। কোথায় শান্তি! জেনেশুনে, সম্পর্ক করে বিয়েতে নাকি সেটেল ম্যারেজে- যে বিয়েতে হঠাৎ একদিন অচেনা এক পুরুষের সাথে রাত্রিবাস করতে হয়? চিন্তায় ছেদ পড়ে ঘরে মায়ের আগমণে।
সাবেরা খাতুন স্বামীকে চা-বিস্কুট দিয়ে রান্নাঘর লাগোয়ো ছোটো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। ভবনের পেছন দিকে এক চিলতে মাঠ- এখনো দখল হয়নি পুরোটা। ছোট্ট এক চিলতে মাঠে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলছে। দৌড়ঝাঁপ দেখে বোঝা দায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আর সাথিরা ওর চেয়ে তিন কী চার ক্লাস নিচে পড়ে। ওর মুখভঙ্গি খেলার প্রতি ভীষণ নিবিষ্ট। ও যখন বল করে ব্যাটসম্যান ভয়ে থাকে- না জানি বল মাঠে না পড়ে ব্যাটসম্যানকে মেরে বসে। কোমর ভাঁজ করে হাঁটুতে দুই হাতে দিয়ে ও এখন ফিল্ডিং করছে। একটা বল উড়ে আসতেই শুন্যে লাফিয়ে উঠে বলটা ধরে চিৎকার করে ওঠে ‘হাউস দ্যাট’। গম্ভীর মুখে সতীর্থদের দিকে এগিয়ে যায়, যেন আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ খেলছে- প্রতিপক্ষের খেলোয়ারকে সাজঘরে পাঠিয়ে বিজয়ীর বেশে সতীর্থদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আনন্দ উদযাপন করতে। পড়াশোনা, খেলা- দুটোতেই ও অলরাউন্ডার। সাবেরা খাতুনের শত নিষেধ সত্বেও রাসেল রাজনীতিতে জড়িয়েছে। ওর এক কথা- বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে দল করতে হয় মা। রাজনীতিতে দলাদলি, মারামারি- এসব চিন্তা করে সাবেরা খাতুনের গলাটা শুকিয়ে যায়।
আর ক’দিন পরে নতুন সেমিস্টার শুরু হলেই রাসেল আবার হলে চলে যাবে। ছোট ভাই হয়েও তন্বীর দুঃসময়ে ও-ই কক্সবাজারে ছুটে গিয়েছিল। পরে থানা, কোর্টকাচারি করতে তন্বীর সাথে দ্বিতীয়বারও ও কক্সবাজারে গিয়েছিল। ওখান থেকে ফিরে মাকে বলেছিল, ‘মা, আপু বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়ে যার সাথে সম্পর্ক করেছে তাকে চিনতে পারল না। ঐ শয়তান ছেলেটা তো জেলখানায়, তা না হলে ওকে আমি ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতাম।’ তারপরে স্বগোক্তি করল, ‘শয়তানটা শারীরিক সম্পর্ক করেছে, গোপনে তার ভিডিও করেছে, তারপরে সেই ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেছে তার বন্ধুদের সাথেও আপুকে শারীরিক সম্পর্ক করার দাবিতে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এই পরিচয়ই ওর থাকার কথা না। ও তো অমানুষ- পশু। ও জেলে থেকে বের হলে আমি ওকে মেরেই ফেলব।’ মা চুপ করে শোনেন, তাঁর দু’চোখে তখন অঝোর ধারায় বন্যা নেমেছে।
সেমিস্টার ব্রেকে রাসেল এখন বাসায়। দিনের বেলায় কী করতে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, সন্ধ্যায় বাসায় চলে আসে।
নতুন সেমিস্টার শুরু হওয়ার পরে রাসেল হলে চলে গিয়েছে। বাসায় যেন নিঃসীম নিরবতা ভর করেছে। কয়েকদিন ভেবে সাহস করে রাতের বেলায় স্বামীর কাছে কথাটা তুলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বলব?’
সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘বলো’।
‘বলছিলাম কি, এভাবে বাড়িতে বসে থাকলে জমানো টাকায় কয় মাস চলবে বলো। যেটা হয়েছে সেটাতো মুছে ফেলা যাবে না। এমনতো না যে, ভিডিওটা ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে, সারাদেশের লোক জেনেছে, বাইরের মানুষের কাছে মুখ দেখানোটাই সমস্যা- তাতো না, অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরি খোঁজো, তা না হলে সংসারটা চলবে কিভাবে, রাসেলের পড়াশোনার খরচ-ই বা আসবে কোত্থেকে?’
‘হ্যাঁ, আমিও সেটা ভাবছি।’
‘আর মেয়েটা তো আমাদেরই সন্তান, ভুল করেছে; ফেলে তো দিতে পারব না। আমি বলি কী আস্তে আস্তে মেয়েটার সাথেও স্বাভাবিক হও, ওর মনের যে আগুন জ¦লছে সে কথাও একটু চিন্তা কর।’
‘তুমি কি মনে করো আমি সেটা বুঝি না?’
‘বোঝো-তো বটেই। ওর লেখাপড়া, বিয়ে, ভবিষ্যৎ- এসব কিছু তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না, তাই না। বাবা হিসেবে তুমি ওকে তোমার বুকে আবার ফিরিয়ে নাও।’
‘বললাম তো আমি ওকে মাফ করে দিয়েছি, ওকে কাল আমার ঘরে নিয়ে এসো। তবে তোমার মতো ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে যেন না কাঁদে।’ সাবেরা খাতুন অন্ধকারে মুচকি হেসে স্বামীর গায়ে আলতো করে একটা হাত তুলে দিলেন।
পরদিন সকালে তন্বী মাথা নিচু করে ডাইনিং টেবিলে বসে বাবা-মায়ের সাথে নাস্তা করল। নাস্তা পর্বে আব্দুস সোবহান স্ত্রীর সাথে বাজারঘাট করা নিয়েই কথা বললেন। নাস্তা শেষে উঠে যাওয়ার সময় বললেন ‘তনু চা নিয়ে আয় আমার ঘরে।’
চার মাস পরে বাবার মুখে নিজের পারিবারিক নামটি শুনে তন্বী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে হুঁ হুঁ কে উঠল। সাবেরা খাতুন তাকে সাবধান করে দিলেন, ‘বাবার সাথে কথা বলবি, কাঁদবি না- ধমক খাবি কিন্তু’।
চা নিয়ে তন্বী বাবার ঘরে গেল। আব্দুস সোবহান অতীত না টেনে খুব স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা নিয়েই কথা বললেন। তন্বী কিছুটা নিচু স্বরেই উত্তর দিয়ে গেল। সাবেরা খাতুন কি জন্য যেন রান্নাঘরে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘রাসেলদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ছেলে মারা গিয়েছে। রাতে হলের ছেলেরাই পিটিয়ে মেরেছে’। আব্দুস সোবহান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, কেন মেরেছে। তনু যা তো ওঘরে, টিভিতে দেখে আয় তো কী ঘটনা’। বাসার একমাত্র টেলিভিশনটি ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমে রাখা- যেন সকলেই দেখতে পায়। এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরিয়ে তন্বী শুধু ঐ খবরটুকুই দেখল টিভিতে। বাবাকে এসে বলল। আব্দুস সোবহান মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে রাসেলকে ফোন করলেন। দু-তিনবারের চেষ্টায় ছেলেকে পেলেন। অনেক হৈঁচৈ, কথা শোনা যাচ্ছে না; শুধু এটুকু শোনা গেল, ‘হ্যাঁ বাবা টিভিতে যা দেখাচ্ছে সেটা ঠিকই আছে। আমি বিকেলে বাসায় আসব। দুঃশ্চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি।’ লাইন কেটে গেল।
বিকেল গেল, সন্ধ্যাও পার হলো; রাসেল বাসায় এলো না। রাতে ফোন করে জানাল, হলে ঝামেলা চলছে, আজ হলেই থাকবে, কাল আসবে।
অনেক দিন পর বাসার তিনজন আজ এক টেবিলে খেতে বসেছে। অথচ ছেলে রাসেল নেই। এই দিনটির জন্য সাবেরা খাতুন কত দিন, কতগুলো মাস অপেক্ষা করছেন। টিভিতে রাতের সংবাদে জানা গেল, ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে হল প্রশাসন হলগেটের সিসি-ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। ছাত্রদের দাবি এখন প্রবল আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। রাতে খাওয়ার টেবিলে বসা তিনজনের চোখই টেলিভিশনের দিকে। সাবেরা খাতুন বললেন, ‘বন্ধু কি বন্ধুকে হত্যা করতে পারে? তাই হয়? কী এমন হলো যে মেরেই ফেলতে হবে।’
আব্দুস সোবহান বললেন, ‘গত পঞ্চাশ বছরে বিশ^বিদ্যালয়ে কত ছাত্রই তো মারা গেল। মারল তো ছাত্ররাই। বিচার কি হয়েছে। কয়টা হত্যা হয়েছে আর কয়টা হত্যার বিচার হয়েছে। আমি বুঝি না আঠার বছর বাবা-মা ছেলেদের কী মোটিভেশন দেয়? কোনো বাবা-মা কি ছেলেদেরকে এমন মোটিভেশন দেয় যে, বিরুদ্ধ মতের জন্য বন্ধুকে হত্যা করতে হবে? তাহলে কে বা কারা এই মোটিভেশন দাতা? কি সেই মোটিভেশন যার দরুন ছেলেরা এক বছরেই এতটা হিংস্র হয়ে ওঠে- আঠার বছর বাবা-মায়ের দেয়া মোটিভেশন ভুলে যায়?’
গুরুগম্ভীর কথার ভারে কিংবা ছেলের চিন্তায় সাবেরা খাতুন চুপ করে থাকলেন। হঠাৎ সাবেরা খাতুনের ফোন বেজে উঠতেই তিনি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বাটনে চাপ দিলেন। ছেলে রাসেলের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। ‘মা তোমরা ভাত খেয়েছ? চিন্তা কোরো না। আমি কাল দুপুরে বাসায় খাব। বাবাকে বোলো বাজার থেকে ছোট বাইন মাছ আনতে। হলের পচা খাবার খেতে একদম ভালো লাগে না। ভুনা করে রান্না করবা মা।’ ছেলের কথায় তিনি আশ্বস্ত হয়ে সকালে বাজার থেকে স্বামীকে মাছ আনতে বললেন।
কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে আব্দুস সোবহান ও সাবেরা খাতুন সে রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। পরদিন বেশ দেরিতেই উঠলেন তাঁরা। নাস্তার টেবিলে যাবেন এমন সময় তন্বীর অস্বাভাবিক মা মা ডাকে দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। সাবেরা খাতুন মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে রে, চিল্লাচ্ছিস ক্যান।’ তন্বী হাঁউমাউ করে উঠল। ‘টিভিতে দেখ মা, ভাইয়াকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া নাকি মারা যাওয়া ঐ ছেলেটাকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে বেশি পিটিয়েছে।’