ঈদসংখ্যার গল্প।। যার নাম রেনুবালা।। সাদিয়া সুলতানা
ওপেন টু বাইস্কোপ
নাইন টেন টেলিস্কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বিবির বৈঠকখানা
সাহেব বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাটা
স্প্রিং এর চাবি আঁটা
যার নাম মনিমালা
তাকে দেবো মুক্তার মালা।
হাত দিয়ে নির্মিত তোরণের ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি যেতে যেতে মুক্তার মালায় বন্দি হয়ে আমার নাম নিতো রেনুবালা। আমি ততোক্ষণে ছড়ায় ‘মনিমালা’র বদলে রেনুবালা বলে ফেলতাম। যা শুনে দলপতি মানিক হাতের শিকল শক্ত করে রেনুবালাকে আটকে দিতো, ‘তুই খালি ওর নাম নিস ক্যান অভি! দুইটাই চোট্টা! কাল থেকে খেলায় নিবো না তোদের। যা ভাগ।’
আমরা খেলায় যেতাম না। নিজেরাই খেলতাম। বিকেলে দেখা হলেই রেনুবালা রুমালটা চাইতো। এমনিতে আমাদের খুব ভাব কেবল রুমালের ব্যাপারেই আমার যতো ‘না।’ রেনুবালার শত আবদারের পরেও ওকে আমি রুমালটা দিতাম না। বরং ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে কপালের ঘাম মুছতাম। বলতাম, ‘জানিস না, রুমাল দিলে ঝগড়া হয়! জন্মের আড়ি হয়!’
রুমাল না দিলেও এই রুমাল রুমাল করেই আমাদের ঝগড়া হতো। আড়ি হতো। আড়ি দেওয়ার নাম করে রেনুবালা মাঝেমাঝে আমার হাতে এমন খামচি দিতো যে আমি রেগে গিয়ে ওর পিঠে কিল বসাতাম। হুমকিও দিতাম, ওদের বাড়ি গিয়ে কাকাকে সব বলে দেবো।
রেনুবালা জানতো, কাকার মুখোমুখি হবার সাহস আমার নেই। তবু ঝগড়া শেষে খামচি দিয়েই ও ছুটে পালাতো।
আমি রেনুবালার চিরল নখের লাল লাল দাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে মাকে বলতাম, ধোপাখালির জলার ধারে কচুর লতি তুলতে গিয়ে মশা কামড়েছে। মা আমার হাতের পিঠে বিচ্ছিরি এক মলম মালিশ করতে করতে বলতো, ‘ঐ বাড়ি যাসনে। বড় হচ্ছিস, লোকে কখন কী বলে।’
আমি তবু রেনুবালাদের বাড়িতে যেতাম। রেনুবালার বাড়িজোড়া নাম ছিল রেনু। পুরো নাম রেনুবালা সাহা। মা বলে এককালে সাহা বাড়ির নাম-ডাক ছিল খুব। ওদের বাড়ির মতো একটাও বাড়ি ছিল না আমাদের পাড়ায়।
প্রায় সাত-আট কাঠা জায়গার একেবারে মাঝখানে ছিল বাড়িটা। বাড়ির সেই উঁচু ছাদ। বড় বড় কাঠের দরোজা। কপাটগুলো মজবুত ছিল ভীষণ। ঘরও ছিল অনেকগুলো। যেন একদিক দিয়ে ঢুকলে আরেকদিকে হারিয়ে যাবে মানুষ। বাড়ির জানালাগুলো আকারে প্রায় দরজার সমান ছিল। ঐ বাড়ির প্রবেশদ্বারে মাধবীলতার বিশাল ঝাড় ছিল। মাঝে মাঝে পুরো গেটটাই লতানো ঝোপে ঢাকা পড়ে যেতো।
রেনুদের বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা ছিল বাড়ির উত্তর দিক। ঐ দিকটাতেই ছিল মন্দির। মন্দিরের কাছেই ছিল তুলসীতলা। প্রাচীরের ধারে কয়েকটা শ্বেত আকন্দের গাছ আর হলুদ গাঁদার ঝোপ ছিল। দীর্ঘকায় একটা জবা গাছও ছিল। আর ঐ বাড়ির পেছনদিকে ছিল মস্ত এক পুকুর। সামনে থেকে বোঝার উপায় ছিল না পেছনে বিরাট এক পুকুর আছে। পুকুরের যে পাড়ে কয়েকটা ঢ্যাঙা তাল গাছ ছিল সেই দিকের পানিতে সাদা আর গোলাপি রঙের শাপলা ভাসতো।
লোকে বলতো বনেদি বাড়ি। রেনুর বাবা মহাদেব কাকার মধ্যেও বনেদিপনা ছিল ভীষণ। ব্যবসা-বানিজ্য সব কোলকাতার সঙ্গে ছিল বলে মাসে, দুই মাসে তিনি ওপারে যেতেন। মহাদেব কাকা বাড়িতে না থাকলে রোজই রেনুর সঙ্গে দেখা হতো আমার। আমার পাখির ডাক শুনেও রেনু সদর দরোজায় উঁকি না দিলে বুঝতাম কাকা বাড়িতে আছে।
কোনোদিন কাকা বাড়িতে নেই টের পেলে আমি শাপলা তোলার অজুহাতে ভেতর বাড়িতে ঢুকতাম। তখনই রান্নাঘর থেকে লুচি ভাজার ঘ্রাণ আসতো। উঁকি দিলে দেখতে পেতাম মনি কাকী লুচি বেলে গরম তেলে ছাড়ছে। আমি এমন করে মাথা বাড়াতাম যেন কাকী আমাকে ভালোভাবে দেখতে পায়। দেখতে পেলেই কাকী মাথা ঝাঁকিয়ে ডেকে আমার দুই হাতে দুই লুচি আর রসে ডুবডুবা মিষ্টি দিতো।
রেনু তখন ঘরে বসে হারমোনিয়ামে সুর তুলছে, ‘আনন্দলোকে মঙ্গললোকে…।’ আমার খালি হাত দেখতে পেয়ে কাকী বলতো, ‘আর খাবি?’
মনি কাকী এমনিতে কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলতো না। নিজে নিজে আপনমনে বিড়বিড় করতো আর ছুটে ছুটে গিয়ে তুলসী গাছকে প্রণাম করতো। মায়ের কাছে শুনেছি রেনুর একটা ভাই ছিল। ভাইটা ছোটবেলায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল, তারপর থেকেই কাকীর চোখজোড়া এমন শীতল হয়ে গেছে। আমাকে দেখলে কেবল কাকীর চোখ নেচে উঠতো। খুশি হয়ে মানুষটা বলতো, ‘শাপলা তুলবি অভি? আমাকে কটা দিস তো, বেশ ডগডগে হয়েছে লতাগুলো, চিংড়ি কষা করলে বেশ স্বাদ হবে।’
আমি কাকীর হাত ভরে ফুল দিতাম। মায়ের হাত থেকে শাপলার ডাঁটি নিয়ে ফুলকে লকেট করে মালা বানিয়ে গলায় পরত রেনু আর বলতো, ‘দ্যাখ তো অভি কেমন দেখায়।’
আমি তখন সবে হাফপ্যান্ট ছেলে ফুল প্যান্ট ধরেছি। লজ্জায় মালা পরা রেনুর দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতে পারতাম না। পকেটের রুমাল বের করে ভেজা মুখ মুছতাম।
ফুল ছাড়া, মালা ছাড়াও রেনু ছিল সুন্দর। অমন সুন্দরের সংজ্ঞা দেয়া ঐ বয়সে আমার জন্য অসম্ভব ছিল।
আমি লুকিয়েলুকিয়ে রেনুর চোখ দেখতাম, ওর চোখের ভেতরে আমাদের সুরেশ্বর নদী আটকানো ছিল।
আমাদের ছোট শহর ছিল নদীর কোচড়ের ভেতরে। নদীর নাম সুরেশ্বর। এই নদীর একটা আদি গল্প আছে। রেনুই গল্পটা বলেছিল আমাকে, ওকে বলেছিল ওর ঠাকুমা।
আগে সুরেশ্বর নদীর পানি ছিল নোনতা। রেনু বলতো সুরেশ্বরের নোনতা পানি বহু শহর ডিঙিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশতো। একদিন কাকভোরে নদীতে পূজা দিতে গিয়ে মা-ঠাকুমারা দেখলো নদীর গতিপথ বদলে গেছে, পানিও স্বাদু হয়ে গেছে। সব দেখে শুনে ঠাকুমা বলেছিল, মানুষের দেশ ছাড়ার বেদনা আর নিতে পারছে না নদী।
রেনুর কাছে শুনেছি, ওর কাকা-পিসিরা দেশভাগের সময়েই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। কেউ কেউ আসন্ন দাঙ্গার ভয়ে ওপারে গেছে। আবার কেউ এই দেশে থাকলে সম্মান নিয়ে থাকতে পারবে না তাই পাকিস্তানি পাসপোর্ট সারেন্ডার করে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছে। রেনুর বাবা যায়নি। আমাদের শহরে কখনো হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয়নি। সুরেশ্বরের মতো নিস্তরঙ্গ একটা জীবন ছিল আমাদের।
আমার আর রেনুর জীবন ছিল ঐ রুমাল, মাধবীলতা আর শাপলা ফোটা পুকুর ঘেরা। যদিও ওদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বেশ একটা দূরত্ব ছিল।
আব্বা বলতো, মহাদেব মানুষটা অহংকারী। আগের মতো পারিবারিক ঠাঁটবাট নেই তবু অহমিকা যায় না। অহংকার শব্দের অর্থ বুঝতাম না তখন, শুধু বুঝতাম মহাদেব কাকা বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের কথা শুনতে পছন্দ করে না।
অহংকারী মানুষটার খুব গাছ লাগানোর নেশা ছিল। ঐ বাড়িতে গাছের শেষ ছিল না কোনো।
ঐ বাড়ির গেটটাই শুধু মাধবীলতায় ঢাকা ছিল না, পুরো বাড়ি জুড়েই ছিল গাছ আর গাছ। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি রেনুকে ডাকতাম। আমার পাখিডাক শুনে রেনু যখন খোলা গেটের মাঝে এসে দাঁড়াতো তখন বুকপকেট থেকে রুমাল বের করে আমি ঘন ঘন ঘামহীন মুখ মুছতাম। জানতাম রেনু আমার রুমালটা দেখতে চাইবে। মাধবীলতার আড়াল থেকে কাছে এসে রেনু রুমালটা হাতে নিতো। বলতো, ‘রুমালটা আমাকে দিয়ে দে। এটা মেয়েদের রুমাল। ফুলের নকশা করা রুমাল মেয়েদেরই হয়।’
আমি দিতাম না, রুমাল না দিয়েই রুমালে রেনুর ঘ্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
ঈদে দাদাবাড়ি গেলে রেনুর সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা হতো না। আমি ফিরে এলে রেনু বলতো, ‘দাদুবাড়িতে খুব মজা করলি না?’ ওর শুষ্ক চোখ দেখে কেমন একটা মায়া লাগত। বলতাম, তুইও তো পূজার সময় দেশের বাড়িতে যাবি।’ আমার কথা শুনে রেনুর দুচোখে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে দুঃখের নির্মাণ হতো।
রেনু কান্নাচাপা কণ্ঠে বলতো, ‘আমাদের তো কোনো দেশের বাড়ি নেই।’ এরপর ও বড়দের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো, ‘আমাদের নিজেদের কোনো দেশই নেই।’
একদিন খুব রাগ হলো আমার, বললাম, ‘তুই আসলে এই দেশকে ভালোবাসিস না, দেশটাকে নিজের বলে ভাবিসই না।’
বড়ি ফিরে সেদিন খুব ছটফট করছিলাম। বার বার মনে পড়ছিল, রুমালে রেনুর ঘ্রাণ আনা হয়নি। রাতে ঘুমানোর আগে পণ করেছিলাম, সকাল সকাল ঐ বাড়িতে গিয়ে রেনুকে জীবনের মতো রুমালটা দিয়ে আসবো, বিনিময়ে কিছু একটা নিয়ে নিবো। বলবো, ‘একটা মাধবীলতার চারাই না হয় দে।’
শেষ পর্যন্ত একদিন রুমালটা রেনুকেই দিতেই হলো। তবে আমার কাছ থেকে রুমালটা পেয়ে রেনু একটুও খুশি হলো না।
তখন ঢাকায় ভীষণ মারামারি কাটাকাটি চলছে, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে শুনছি মিলিটারিরা কাছাকাছি চলে এসেছে। ওসমান, রাধাবল্লভ কাকাসহ অনেকেই বর্ডার পার হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। মা সেদিন চাপাস্বরে বলছিল, ‘দেখবি একদিন রেনুরাও চলে যাবে।’ আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘মা, আমরা যাবো না?’ আব্বা বলেছিল, ‘আমরাও যাবো।’
একদিন সত্যি সত্যি ইয়াহিয়ার বাহিনী আমাদের ছোট শহরে চলে এলো। বড় রাস্তায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্বরে শ্লোগান উঠল। ওদিকে সুরেশ্বরের ঢেউহীন বুকের মতো নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল বাদবাকি শহরটা।
গোপনে গোপনে পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধেছিল অনেকেই। রাতের আঁধারে শহর ছাড়তে শুরু করলো তারা। মহাদেব কাকাও শহর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
সিদ্ধান্তটা এক দিনের মধ্যেই যেন রেনুকে আমার চেয়ে বড় করে দিয়েছিল। আমার দেওয়া রুমালটা ভাঁজ করতে করতে ও বলেছিল, ‘মিলিটারিরা হাইস্কুলে ক্যাম্প করেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করছে। শুনেছিস তো? আমাদের আর এখানে থাকা হবে না। আমরা রাতেই চলে যাচ্ছি।’
‘আমরাও যাব, আব্বা বলেছে, গ্রামের দিকে সহজে ওরা যায় না। খাল-বিল, নদী-নালা ভয় পায়। কোথায় যাবি তোরা?’
‘ইন্ডিয়া। তোকে বলেছিলাম না, দেশটা কখনো আমাদের হলোই না।’
‘আবার ঐ কথা বলছিস? যুদ্ধ শেষ হলেই তো দেশে ফিরবি।’
উত্তর দেয়নি রেনু। রুমালটা নিয়ে চলে গিয়েছিল। বিনিময়ে কিছুই দেয়নি আমাকে। তাই হয়তো ওর সঙ্গে আমার জন্মের আড়ি হয়ে গেছে।
রেনুরা যে রাতে সুরেশ্বরের বুক ডিঙিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেল তার পরের দিন ভোরে কাউকে কিছু না বলে আমি নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। দেখি সুরেশ্বরের ওপরে অসীম আকাশ। বুকে সাদা-কালো পানি। পানির ধারে থেকে থেকে কানি বক নড়েচড়ে। তীরঘেঁষা শরবনের ওপরে হরেক পাখি ওড়ে। মেঘও ওড়ে। আমিও উড়তে উড়তে নদীর কোলে গিয়ে আজলা ভরে পানি তুললাম। মুখ ভিজিয়ে ঠোঁট নাড়তেই টের পেলাম সুরেশ্বরের পানি ফের নোনতা হয়ে গেছে।