রবি ও ময়নাপাখির ছা।। আবেদীন জনী
রবিদের বাড়ির পাশেই সবুজ বন। বনের পাশেই মাঠ। বিকেল হলে পাড়ার সব ছেলে-মেয়ে ওই মাঠে এসে জড়ো হয়। মেতে ওঠে খেলাধুলায়। রবিও যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে পার করে প্রতিটি বিকেল। একদিন মাঠে না গেলে মনটা কেমন আনচান করে।
রবি একদিন মাঠে খেলতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা ময়না পাখির ছা। খুব সুন্দর। তুলতুলে। ঘাসের উপর শুয়ে চিঁ চিঁ করে ডাকছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। নাড়ছে কোমল ডানা। ডানা দুটি এখনও ভালোভাবে গজায়নি ওর। হয়তো বাতাসের ঝাপটায় গাছের ওপরে বাসা থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়েছে। আর উড়তে পারছে না। খুব ছোট তাই, উড়াল শেখেনি। কোন্ গাছের শাখায় বাসা, কোথায় ওর মা-বাবা জানা নেই। হারিয়ে ফেলেছে মাকে। বাবাকে। ছা-টা দেখে রবির খুব মায়া হল। এভাবে পড়ে থাকলে বনবিড়াল এসে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বাড়িতে।
খাঁচায় ময়না পালন করার শখটা রবির অনেক দিনের। কিন্তু একটা ময়নার ছা জোগাড় করা সহজ কথা নয়। কোথায় পাবে ময়নার ছা ? বাবার কাছ অনেকবার বায়না ধরেও কাজ হয়নি। রাজি হয়নি কিনে দিতে। মাকে বললেও নিষধ করেছে। বলেছে, খাঁচায় পাখি পালন করা ঠিক নয়। মস্তবড় অন্যায়। পাখিদর ঘরবাড়ি হচ্ছে বন। ওরা ঘুমাবে গাছের শাখায়, পাতার ফাঁকে। খড়কুটোর ছোট্ট বাসায়। মায়ের ডানার তলে। যখন-তখন মুক্ত ডানায় উড়বে। ঘুরবে। এ বন ও বন। হাওয়ায় হাওয়ায় ডানা ঝাপটাবে ইচ্ছেমতো। সেই পাখি খাঁচায় বন্দি করে রাখলে দারুণ কষ্ট পাবে। মানুষক কারাগার বন্দি রাখলে যেমন কষ্ট পায়, ঠিক তেমনি। ময়না কিনে দিতে বললেই এরকম একশ একটা উপদেশ শুনতে হতো রবির। কিন্তু আজ রবি নিজেই কুড়িয়ে পেয়েছে ময়না পাখির ছা। কী মজা! রবি যেন আনন্দে এক্কেবারে আগডুম বাগডুম।
ময়নার ছা বাড়িতে নিয়ে আসার পর মাকে দেখাল রবি। দ্যাখো মা, পিচ্চিটা কী সুন্দর! ঠোঁট নাড়ছ। পাখা নাড়ছ। ওকে খাাঁচায় করে পালবো। মা বলল-হ্যাঁ, ময়নার ছা-টা খুবই সুন্দর দেখতে। কিন্তু ওকে তুমি খাঁচায় বন্দি করে রাখবে কেন? এক্ষুনি ছেড়ে দাও। রবি বলল, ও তো উড়াল শেখেনি। ছেড়ে দিলে যাবে কীভাবে ? তাছাড়া, ওকে আমার বড্ড পছন্দ হয়েছে। ছেড়ে দিতেও ইচ্ছে নেই। কতদিন বলেছি একটা ময়নার ছা কিনে দিতে। দাওনি। এবার আমি নিজেই পেয়ে গেছি। তোমাদের তো পয়সা খরচ হয়নি। তা অমন করছো কেন? রবির বাবা ওই একই কথা বললেন। ময়নাটা যেখান থেকে এনেছ, সেখান রেখে এসো। কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না ও। বরং বাবাক একটা খাঁচা কিনে দিতে বায়না ধরল। বলল, খাঁচা কিনে না দিলে ভাত খাব না। ইশকুলে যাব না। পড়ব না। ঘুমাব না। ভীষণ জেদ ধরল রবি। শেষমেশ খাঁচা কিনে দিলেন বাবা। চিকন চিকন লোহার শিক দিয়ে বানানো। রঙিন খাঁচা। যেমন সুন্দর ময়না পাখির ছা, তেমন সু্ন্দর খাঁচা। ময়নাকে খুব মানাবে।
রবি ময়নাকে খুব আদর-যত্ন করতে লাগলো। চার বেলা খেতে দেয়। খাঁচার ভেতরে দুইপাশে দুটো টিনের কৌটা বসানা। একটাতে দেওয়া হয় খাদ্যকণা; অন্যটায় পানি। একটু পরপর রবি ময়নার খোঁজ-খবর নেয়। খাবার ফুরিয়ে গেল কি-না । পানি শেষ হল কি-না। ঠিক মতো খাবার ঠোঁটে তুলছে, না কি চুপটি করে বসে আছে। দিনর বেলায় ময়নার খাঁচাটা ঘরের খোলা বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে কাক এসে ময়নাকে বিরক্ত করে। রবি কাকগুলোকে ইচ্ছেমতো বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেয়। সকালবেলা কমলা রঙের রোদ উঠলে ময়নাকে কিছুক্ষণের জন্য রোদে রাখে। ডানায় কাঁচা রোদের উষ্ণতা মেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে পাখিটার মন। খাঁচার এপাশ ওপাশ ডানা ঝাপটায় । তা দেখে রবিও আনন্দ পায়। রবি যখন ইশকুলে যায় কিংবা বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়, তখন মাকে বলে যায়, ময়নার প্রতি নজর রাখতে। কোনো রকম অযত্ন-অবহেলা যাতে না হয়, সে জন্য রবির চোখ-কান সব সময় খোলা।
দিনে দিনে ময়নার ছা বেশ বড় হল। পরিপূর্ণভাবে ডানা গজাল। কথা বলাও শিখলো। কিন্তু আজব ব্যাপার হল, ময়না যা যা বলে, সবই রবির মনের কথা। রবির যেদিন মন খারাপ থাকে, সেদিন খাঁচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই ময়না পাখিটা বলে ওঠে, ‘কষ্টে আছো! কষ্টে আছো!’ যেদিন রবির মনটা আনন্দে টইটম্বুর, সেদিন বলে, ‘ফুর্তি করো, ফুর্তি করো।’ রবির পড়ার সময় হলে বলতে থাকে, ‘পড়তে বসো, পড়তে বসো।’ ইশকুল থেকে ফিরে রবি যখন ময়নার কাছে যায়, তখন বলে, ‘ক্ষুধা পেয়েছে, খেতে বসো। ক্ষুধা পেয়েছে, খেতে বসো।’
ময়নার কথা শুনে রবি তো অবাক। কেমন করে মানুষর মতো কথা বলে পাখি! শুধু কথা না, রবি যা ভাবে, তাই বলে। ময়না কখন কী বলে, রবি ওর মাকে জানায়। মা বলে, ময়নার কথা আমিও শুনেছি। কী শুনেছো, জানাও না মা? ও বলেছে, ‘ছেড়ে দাও, কষ্টে আছি। মায়ের কাছে যাব।’ আমি যতবার ওর কাছে গিয়েছি, ওই কথাগুলোই শুনেছি।
-তাহলে আমি কি মিথ্যে বলেছি? রবির প্রশ্ন।
-মিথ্যে বলোনি। ভুল শুনেছ।
-না মা, আমি স্পষ্ট শুনেছি।
-না, রবি। আমি যা বলেছি তাই ঠিক। মা এবার জোর দিয়ে বললেন। মা-ছেলের ঝগড়া দেখে বাবা বললেন, তোমাদর কারো ধারণা এক চিলতেও সত্যি না। ময়নাটি কোনো কথাই বলছে না। ও শুধু কাঁদছে। আমি ময়নার কাছে গেলেই ওর কান্না শুনি। লোহার খাঁচায় পরাধীন জীবন-যন্ত্রণার কান্না। ওই কান্নাকেই অবুঝ মানুষেরা কথা বা গান মনে করে।
কি, কাঁদবে কেন? খাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে। আদর-যত্নের একটুও কমতি নেই। কীসের অভাব ওর? প্রশ্ন জাগে রবির। এবার বাবা সহজ ভাষায় বললেন, ও চায় মুক্তডানা। মুক্ত আকাশ। বন্দি জীবন কার ভালো লাগে? ওরও আছে মা-বাবা। তাদের আদর পাচ্ছে না। আছে বন্ধুজন। তাদের সাথে মিশতে পারছে না। খেলতে পারছে না। করতে পারছে না ওড়াউড়ি। কান্না তো করবেই।
এতো করে বলা সত্ত্বেও রবিকে বোঝানো গেল না। ছেড়ে দিতে রাজি হল না ময়নাপাখিটা। ভেতরে ভেতরে মা-বাবা রেগে থাকলেও রবিকে আর এ ব্যাপারে কিছুই বললেন না।
একদিন কি একটা ঘটনা ঘটল! সেই ঘটনা রবিকে একেবারে পাল্টে দিল।
রবিদের ছিল একটি ছাগল। ছাগলের দুটো বাচ্চা। একটা বাচ্চা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রবির বাবা গিয়েছিল অনেক দূরের হাটে। ছাগলর বাচ্চা হারিয়ে চিন্তায় ছিলেন মা। এমন সময় রবি ইশকুল থেকে ফিরল। খাওয়া-দাওয়া করল। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখের পাতায় ভিড় করল দুপুরের ঘুম। ঘুমপরির মায়াবী ডানা ওকে আছন্ন করে ফেলল মুহূর্তেই। এই ফাঁকে মা ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে ছাগলের বাচ্চা খুঁজতে গেলেন। এ বাড়ি ও বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলেন অনেক দূর। এদিক ঘুম ভাঙল রবির। মাকে ডাকল। কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও ডাকল, জোর গলায়। তবুও সাড়া-শব্দ পেল না। এবার বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে গেল। কি, দরজা বন্ধ! কয়েকবার খটখট করল দরজার খিলে। খুলতে পারল না। দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ করা। ভেতর থেকে খোলা সম্ভব নয়। বাবা তো হাটেই গেছেন। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। এ কথা জানে রবি। কি বিপদ! মাকে না পেয়ে ভাবনায় পড়ে গেল ও। একটা জানালা খোলা আছে। জানালায় সারি সারি লোহার শিক গাথা। ময়না পাখির খাঁচার মতো। জানালার ফাঁক দিয়ে গাছ-গাছালি দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মাঠ। ধানক্ষেত। দূরে, পথ দিয়ে লোকজন যাওয়া-আসা করছে। রবি ডাকাডাকি করছে দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য। কেউ শুনছে না। এগিয়েও আসছে না। কী করবে এখন! দুচোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল ওর। ও প্রতিদিন বিকেলে মাঠে খেলাধুলা করতে যায়। আজ যেতে পারছে না। কী সুন্দর বিকেল! বন্ধুরা মাঠে এসে হয়তো ওকে খুঁজছে। খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ করছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে। মাটি হয়ে যাচ্ছে বিকেলটা।
মাঠে যাওয়ার জন্য রবির মনটা কেমন ছটফট করছে। একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে। নেমে আসবে অন্ধকার। তবুও ফিরে আসছে না মা। রাগে-দুঃখে বোবা হয়ে ফের বিছানায় গিয়ে বসে থাকে রবি। বারান্দায় খাঁচার ভেতর ওর মতোই ছটফট করছে ময়না পাখিটা। থেকে থেকে শুনতে পাচ্ছে ডানা ঝাপটানি। ডানা ঝাপটানির শব্দটা রবির কাছে আজ আনন্দের কোনো শব্দ মনে হচ্ছে না। মন হচ্ছে, ময়নাপাখি খাঁচাটা ভাঙার জন্য বার বার ডানা দিয়ে আঘাত করছে। আর কাঁদছে। এই প্রথম রবি ময়নার কান্না শুনতে পেল। কেঁদে কেঁদে বলছে- আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দাও।
তাহলে তো মা-বাবার কথাই ঠিক। ভাবল রবি। মা-বাবা ঠিকই বুঝেছেন ময়নার কষ্ট। বন্দিজীবনের বুকফাটা আর্তনাদ। শুধু আমি বুঝিনি। শুধুমাত্র একটা বিকেল ঘরের ভেতর আবদ্ধ থেকে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পেরে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। ময়না পাখির এরকম কতো বিকেল নষ্ট করেছি আমি। মাত্র একটি বিকেল; এই একটু সময় মা কাছে নেই বলে মনটা কেমন খারাপ লাগছে! হাহাকার করছে বুকটা! আর ময়নাটা কতদিন ধরে মায়ের আদর পায় না। ওর মনে যে কতো কষ্ট!
সব ভুল বুঝতে পারল রবি। মা-বাবার উপদেশ না শুনে যে অপরাধ করেছে, তাও বুঝতে পারল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, কাল সকালে ময়নাকে মুক্ত করে দেবে। খুলে দেবে খাঁচার দরজা।
দীর্ঘ মনেহচ্ছে রাত। দুচোখে ঘুম নেই। কখন সকাল হবে। গুনছে প্রতীক্ষার প্রহর। থেকে থেকে সারারাত ময়নাপাখির কান্না আর ছটফটানি শুনতে পেল রবি। তারপর সকাল হল। সোনারঙের রোদ হেসে উঠল। রবি ময়নাপাখিটা খাঁচায় করে সেই মাঠ নিয়ে গেল, যেখান থেকে ওকে ধরে এনেছিল। তারপর খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে বলল, ক্ষমা করিস, তোকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। ময়নাপাখি ফুড়ুৎ করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে মুক্ত ডানায় উড়াল দিল সবুজ বনের দিকে। আপন মনে স্বাধীনতার গান গাইতে গাইতে।
ভালো লাগলো