ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প।। একদিন রাতে।। রাহিতুল ইসলাম

তুহিন হেঁটে যাচ্ছিল ব্যাংকপাড়ার রাস্তা ধরে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। অনেকদিন সে এই এলাকায় আসে না। তাদের মফস্বল শহরটা খুব ছোট, তবু দরকার না পড়লে এদিকে আসা হয় না। সেই ফার্স্ট ইয়ারে এখানে সে আড্ডা দিত। তারপর মূলত রনির সাথে গণ্ডগোলের পর তার আর এমুখো হয়নি। এখন তার মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়েছে। অর্থাৎ প্রায় বছর ছয়েক পর এই এলাকায় পা দিল সে। কলেজ জীবনে, তার আগে স্কুলে থাকতেও প্রায় প্রতিদিন এখানে আসত। সারাদিন কাটাতো। কখনও কখনও রনির বাসায় রাতেও থাকেও যেত। ছোটবেলার বন্ধুত্ব ওদের। রনির মাও তাকে নিজের ছেলের মতো দেখত।

কিন্তু রনি এমন একটা কাজ করল, সে আর রনির সাথে বন্ধুত্ব রাখার আগ্রহ পায়নি। বরং এখন সে রনিকে ঘৃণা করে। রনি অবশ্য অনেকবার ফোনে তাকে কিছু বলতে চেয়েছে, কিন্তু ওই কণ্ঠ শোনার সাথে সাথে ফোন রেখে দিয়েছে তুহিন। ছয় সাত মাস আগে একবার রনির সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। রনি তাকে দেখে এগিয়ে এসেছিল কথা বলার জন্য। কিন্তু তুহিন ওর সাথে কথা বলেনি। কেনই বা বলবে! যে মেয়েটাকে সে ভালোবাসত, তাকে নিয়ে তুহিন ঘুরে বেড়াত। এলাকায় সবাই জেনে গিয়েছিল বন্ধুর পছন্দ করা মেয়ের সাথে প্রেম করে তুহিন। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় একদিন তাদের মধ্যে। তারপর থেকে রনির সাথে আর তুহিনের বন্ধুত্ব নেই। নীলাও পরে তুহিনকে খবর দিয়েছিল, কিছু একটা বলতে চেয়েছিল হয়তো, কিন্তু তুহিন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঘৃণাটা নীলার ওপর যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি রনির ওপর।

কিন্তু ব্যাংকপাড়ায় তুহিনকে আবার আসতে হলো। বড় ভাই শাহিন এখানে একটা জমি কিনেছে। এই এলাকায় শহরের সব বনেদি পরিবার থাকে। বেশ কয়েকটা ভালো স্কুল আছে এখানে। সুতরাং এখানকার জমির চাহিদা আর দাম দুটোই বেশি। শাহিন বহুদিন ধরে মালয়েশিয়া থাকে। কিন্তু এখন আর থাকতে চাইছে না। দেশে এসে বিজনেস করবে। ওদের এখনকার বাড়িটা শহর থেকে কিছুটা বাইরে। তাই, শহরে একটা বাড়ি দরকার। আর ভবিষ্যতের কথাও ভাবতে হবে। সারাজীবন তো আর তারা গ্রামে থাকবে না। সে কারণেই জায়গাটা কেনা। জায়গা পছন্দ থেকে কেনা, পুরোটাই করেছে তুহিনের বাবা। রনি মাঝে মাঝে শুনেছে, কিন্তু আগ্রহ দেখায়নি। সাংসারিক কাজে ওর আগ্রহ কম। টুকটাক কাজগুলো হয় কলেজে পড়া ছোট ভাইটা করে, নয়তো বাবা করে।

রনি অনেকবার চেয়েছে তুহিনের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে। সেজন্য নিজে থেকে ফোন করেছে, দেখা হলে কথা বলতে গিয়েছে। কিন্তু তুহিন কোনোভাবেই সাড়া দেয়নি। বরং এমন ভাব করেছে যেন রনি তার শত্রু। সম্পর্ক না-ই থাকতে পারে, কিন্তু রনি কখনোই তুহিনকে শত্রু মনে করেনি। বন্ধুত্বের শেষ হয়ে গেলে কি দুজন মানুষ স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না? কেন তারা শত্রু হয়ে যাবে। রনি মনেপ্রাণে চায় তুহিন তাকে শত্রু না ভাবুক। যেকোন দুজন চেনা মানুষের মতোই হয়ে থাক তারা। আড়াল থেকে রনি সবসময় তুহিনের ভালো করতে চেয়েছে। কিন্তু রনি খবর পায়, তুহিন সবসময় পরিচিতদের কাছে তার নামে আজেবাজে কথা বলে। দুর্নাম করে। অথচ যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত শত্রুতা পুষে রেখেছে তুহিন, সেটা এমন কোনো বড় ঘটনা না। নীলার সাথে দুজনের কারোই প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। তুহিন তাকে পছন্দ করত, আর রনির সাথে ওর বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু মাঝখান থেকে ভুল বুঝে বসল তুহিন, একবার সেটা খোলাসা করার সুযোগ দিল না।

ব্যাংকপাড়ার এই দিকটার প্রায় সব প্লটেই বিল্ডিং উঠে গেছে। শাহীন কী করে যে এই ফাঁকা জায়গাটার খবর পেল কে জানে। ওদের প্লটের আরও ডানের দিকে একটা ছোট্ট খাল। আগে পরিস্কার পানি ছিল এখানে। এখন খালটা প্রায় নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এই প্লটের পাশে থাকে আকবর গাছি। তাকে একটা কাগজ দেওয়ার জন্যই রাতের বেলায় এখানে আসা। শাহীন ফোন করে বলেছে ইমার্জেন্সি। আজই দিতে হবে। তুহিন আকবর গাছিকে কাগজটা দিয়ে বেশ কিছুদূর যেতেই চারজন তরুণ তাকে ঘিরে দাঁড়াল। দূরের ইলেক্ট্রিসিটির হালকা আলোয় একজনের হাতে ছুরি দেখা যাচ্ছে। এই এলাকায় ইদানিং ছিনতাই বেড়ে গেছে বলে সে শুনেছিল। কিন্তু ভাবেনি সে নিজেই এর কবলে পড়বে।

প্রথম যুবক কিছু না বলেই আচমকা এক ঘুষি বসিয়ে দিল তুহিনের পেটে। অন্যপাশ থেকে ঘাড়ের কাছে এল আরেকটা ঘা। তুহিন পেট চেপে বসে পড়ল। সাথে সাথে মোবাইলটা নিয়ে নিল একজন। অন্য আরেকজন পেছনের পকেটে হাত দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তুহিন কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এর মধ্যে দূর থেকে একটা মটর সাইকেল ওদের জটলাটার দিকে এগিয়ে এল। তুহিন মনে মনে প্রমাদ গুনল, সে ভাবল এটাও ওদের লোক। কিন্তু মোটরসাইকেলের আরোহী বুঝতে পারল এখানে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে। সে দ্রুত এগিয়ে এলো স্পিড বাড়িয়ে। ওকে দেখে ছেলেগুলো পড়িমরি করে ছুটে পালাল। কারণ ছেলেগুলো রনিকে ভালো করেই চেনে। রনি এসে দেখল ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে তুহিন। তুহিনও যেন জীবন ফিরে পেল রনিকে দেখে। রনি ওকে উঠিয়ে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। বন্ধু ছাড়া এই বিপদে কে তাকে বাঁচাত! যার প্রতি এত বিদ্বেষ পুষে রেখেছিল সে, যার ক্ষতি করার অনেক চেষ্টা করেছে সে, আজ সেই রনিই তাকে বাঁচাল।

সকালে রনির এলাকার ছোটভাইয়েরা ছিনতাইকারীদের দুজনকে ধরে নিয়ে আসল। মোবার ফেরত পেল তুহিন। অল্প টাকা ছিল, সেটা আর পাওয়া গেল না। তুহিন বুঝল, সে এতদিন যা করে এসেছে তা ভুল ছিল। রনি তার ওপর কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখেনি। কিন্তু সে সেটা করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *