ছোটগল্প।। মাংসের দোকান।। প্রিন্স আশরাফ
আগের ফ্লাট থেকে উৎখাত হওয়ার পরে সংগোপনে বেনামে নতুন এই ফ্লাটটা ভাড়া নেওয়ার সময় মধ্যস্ততাকারী বলেছিল, ম্যাডাম, মাংসের দোকান বললেই সবাই একনামে চিনতে পারবে। মাংসের দোকানটার ঠিক পেছনেই আপনার ফ্লাট। সন্ধ্যে উৎরানো নিয়ন বাতির আলোয় ফ্লাটের গেটের সামনে নিজে ড্রাইভ করা গাড়িটা ঢোকাতে ঢোকাতে জারার চোখে পড়ে গেল দোকানটা। উপরে সাইনবোর্ডে সামনের মুছে যাওয়া অক্ষরে শুধু মাংসের দোকান লেখাটাই চোখে পড়ছে। গাড়ির গ্যাস না নামিয়েই জোর করে চোখ চালিয়ে দোকানের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। লোহার শিকের ফাকা খাঁচা এবং ভারী পশ্চাদদেশ বাইরের দিকে দিয়ে উবু হয়ে কিছু একটা পরিষ্কার করা রমণীয় অবয়ব দেখা গেল। গাড়ি এভাবে দাড় করানোর রিকশার রাস্তা ব্লক হয়ে যাচ্ছে দেখে জারা তাড়াতাড়ি এপার্টমেন্টের খোলা গেট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
রেডি এপার্টমেন্টের মধ্যে নিজের একটা অতি ব্যক্তিগত বেডরুম ছাড়াও ক্লায়েন্টের জন্য দুটো বেডরুম নরোম হলদেটে ফ্লুরোসেন্টে আলোর নিচে কুয়াশার মতো ছেয়ে আছে। ভারী মজবুত সুসজ্জিত বেড এবং বেডসাইড টেবিল ছাড়া তেমন কোন আসবাব নেই রুমটাতে। আজ রাতটা নিজেকে বিশ্রাম দেবে ভেবেই পয়শোর্ধ জারা এপার্টমেন্টের সাজানো ড্রয়িংরুম, ডাইনিং কিচেন ঘুরে ঘুরে দেখে নিজের বেডরুমে চলে এলো। তার পারমানেন্ট ক্লায়েন্ট ধনকুবের খন্দকার খসরুর রুচি আছে বলতে হবে। নিজ দায়িত্ব নিয়ে এই এপার্টমেন্ট সাজিয়ে দিয়ে গেছে, যদিও পেমেন্টের সিংহভাগ তাকেই করতে হয়েছে। বেডরুমে নিজের বসনবাসন ছেড়ে নগ্ন হয়ে শরীরের কোথায় কমতি, কোথায় অসংগতি দেখতে থাকে জারা।
শরীরে নিয়ে এতো তন্ময় হয়ে ছিল স্মার্টফোনে কল আসতেই চমকে ওঠে জারা। নগ্ন অবস্থায় ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খন্দকারের ভারিক্কী গলা ভেসে আসে। ‘সব ঠিকঠাক আছে তো? গোছগাছ পছন্দ হয়েছে? এতো চুপচাপ কেন? সাথে কোন ক্লায়েন্ট আছে নাকি?’ খন্দকারের এই খবরদারিটা এড়াতে পারলেই মানুষটাকে সহ্য করে নেয়া যায়, যদিও তাদের জীবনে সবই সহ্য করতে হয়, সবই অসহ্য মনে হয়!
‘আজ রেষ্ট নিয়ে বাসাটাকে উপভোগ করো, ঘুমোও। কাল তোমার এখানে এসে নতুন বাসা উদ্ধোধন করব। আজই আসতাম। মেয়ের জন্মদিন পড়ে গেছে। বাইরে খেতে যেতে হবে। আর শোন, নতুন একটা দামী ক্লায়েন্ট বাগিয়েছি। তোমাকে তো নেবেই। ব্যাটার নিত্যনতুন সাপ্লাই লাগবে। তুমি দেখো তো মিডিয়া লাইনে তোমার যে কালেকশন আছে ওখান থেকে স্বাস্থ্যবতী দু’একটাকে কাজে লাগাতে পারো কিনা। তাহলে এই ভাড়ার ফ্লাটটা তোমার নিজের হতে আর বেশিদিন লাগবে না। গাড়িটাতো ওভাবেই করে দিয়েছি, ফ্লাটটাও হবে। শুধু একটু আমার কথা…’
জারা ফোন কেটে দিল। খন্দকারের ভ্যাড়ভ্যাড়ানি ভালো লাগছে না। নিত্যদিন একই কথা!
আবার ফোন, ‘তোমার ওই ফ্লাটে নেটওয়ার্কের সমস্যা নাকি? ফোন কেটে গেল। শোন, কাল রাতে চলে আসব, থাকব। বোতল নিয়ে আসব, তুমি একটু ঝাল ঝাল করে চিকেন রান্না করবে। বাইরের খাবার নয়, তোমার হাতের রান্না, ওকে, বাই। সিমু ডাকছে।’
রুমের এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে নগ্ন শরীরেই বেডের উপর গা হাত পা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল জারা। মোবাইলটা হাতে কল দিতে গিয়েও আবার রেখে দিল। উঠতি মডেলের মধ্যে দুই তিনটা বেশ ভরভরন্ত শরীরের আছে, যেকোন ক্লায়েন্টেরই মনে ধরবে, এদের ডিমান্ডও কম, শুধু চায় মিডিয়ায় পাকাপোক্ত অবস্থান, আর সেজন্য ক্লায়েন্টকে প্রোডিসার পরিচয় করিয়ে দিতে হয়, তাহলে কাজ সহজ হয়ে যায়। সে নিজেই কি একসময় মডেল নায়িকা হওয়ার মধু লোভে দিনের পর দিন ঘুরঘুর করেনি, নায়িকা হওয়ার মধু না পেয়ে নিজেই মক্ষীরাণী হয়ে বসে আছে!
দিনের বেলা কিচেনটাকে গোছগাছ করতেই সময় কেটে যায় জারার। রান্না করতে তার ভালই লাগে, তবে সেই রান্নাটা যদি আপন মানুষের জন্য হয়! এই পথে নামার পরে এখন আর আপন মানুষ বলতে তার আর কেউ নেই, অর্থবিত্তর স্বাচ্ছল্য, গাড়ি হয়েছে, বাড়িও হবে, কিন্তু আপনার মানুষ সবাই পর হয়েছে।
খন্দকারের আবদার মেটাতেই একটু আগে ভাগেই নিচে নেমে এলো জারা। কাল সন্ধ্যেয় মাংসের দোকান ফাকাই দেখেছিল।
মাংসের দোকানে সামনে দাড়াতেই ভারী শরীরের মাঝবয়সী মহিলা দোকানের ভেতরের দিক থেকে এগিয়ে এলো। ‘আসেন, ম্যাডাম, আসেন। আপনি ওই ফ্লাটে নতুন আইছেন দেখছি। কাল সন্ধ্যেয় গাড়ি চালাইয়ে আইলেন, আমার মেয়েডারে দেখাইয়া কইলাম, পড়াশুনা কর, তাইলে তুইও ওইরকম গাড়ি চালাইতে পারবি। ওই সামিরা, এইদিকে আয়। দেখ, ওই গাড়িওয়ালা ম্যাডাম আইছে মুরগি কিনতে?’
ডাকের উৎসের দিকে তাকিয়ে জারা দেখতে পেল মাংসের দোকানের লাগোয়া পেছনে একটা ছোট্ট টিনশেডের ঘর, ওখানেই এরা থাকে। মায়ের ডাক শুনে সাতআট বছর বয়সী ফ্রক পরা সামিরা এগিয়ে এসে হাত উঁচু করে সালাম দিল, ‘স্যালামালাকুম ম্যাডাম, আপনি কিরাম সাইজের মুরগি নেবেন?’
জারা ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে হেসে ফেলল, এই বয়সেই মায়ের মতো পাক্কা ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। ওর মা ধমক দিল, ‘পাকনামী করতে হবে। আমি দিতাছি। তুই ভেতরে গিয়ে পড়।’ তারপর জারার কাছ থেকে মুরগির সাইজ ওজন করে ড্রেসিং হবে না চামড়া ছাড়িয়ে দেবে জিজ্ঞেস করতে করতে বকবক করতে লাগল, ‘বুইছেন ম্যাডাম, মাইয়াডারে খুব লেহাপড়া শিখাইতে চাই। আপনাগো মতো অনেক লেহাপড়া, তখন আপনাগো মতো গাড়ি চড়তে পারবো, দামি ফ্লাটে থাকবার পারবো, ঠিক না কন ম্যাডাম?’
জারা দেখতে লাগল মুরগীওয়ালী বকবক করতে করতেই দ্রুত ব্যস্ত অভ্যস্ত দক্ষ হাতে মুরগির ছাল ছাড়াতে ছাড়াতে লাগল, ‘ওর বাবায় মাইয়া হইছে বইলা আমারে ফেইলা থুইয়া আরেক বেটিরে বিয়া বইছে। তাই বইলা আমি ভাইঙ্গা পড়ি নাই। নিজে দোকান ভাড়া নিয়ে এই ব্যবসা দিছি। আল্লা দিলে আপনাগো দোয়ায় আমার এখন চালু ব্যবসা। মাইয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা জমাইছি। গ্রামের দিকে এককানি জমিও কিনছি…’
কথাগুলো যেন ডিভোর্সী জারার বুকে শেলের মতো গিয়ে বিধতে লাগল। পার্স থেকে টাকা বের করতে করতে জারার বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হতে গিয়েও আটকে গেল। জারা দোকান থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেল মুরগীওয়ালী বলছে, ‘ম্যাডাম আমার মাইয়াটার জন্য দোয়া করবেন, যেন আপনার মতো হইতে পারে!’
রাতে মুরগীর ঝাল ফ্রাই করলেও মাঝবয়সী খন্দকার তা ছুয়েও দেখল না। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে গাড়িতে বসেই ড্রিংকস করে এসেছে, জারার শরীর পাওয়ার জন্য তার আর তর সইছে না। এলোমেলো হাতেই খন্দকার হ্যাচকা টানে জারার পোশাক খুলতে লাগল। বলতে গেলে প্রায় ছিঁড়ে নিতে চাইল গায়ের ব্রাউজ, ব্রা, পেটিকোটের ফিতে। এতো এতোদিন পরে এই প্রথম বিদ্রোহে শক্ত হয়ে উঠতে চাইল জারার বহু পুরুষে অভ্যস্ত শরীর। মাংসের দোকানের ওই মুরগীওয়ালী কি এর চেয়ে দ্রুত, ব্যস্ত, অভ্যস্ত, কুশল হাতে মুরগীর ছাল ছাড়িয়েছিল?
ছাল ছাড়ানো মুরগীর মতো নগ্ন হয়ে কেৎরে একপাশে পড়ে থাকে জারা। মৃত মুরগীর মতো শরীর থেকে কোন বাধা আসে না। তার মনে হয় খদ্দের যেন হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঠাহর করে নিচেছ কোন অংশটা সবচেয়ে মুখরোচক? মাংস, সীনা না রান?
খন্দকারের দুহাত যখন জারার গ্রীবা, বুক, স্তন, কটি, উরু, জানুদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন জারার চোখে ভেসে ওঠে মাংসের দোকান!
মহান আল্লাহ্ সবাইকে সৎপথে পরিচালিত করুন।