এখানে কয়েকটি জীবন: জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের সমাহার।। এনাম রাজু
গল্প নিয়ে যতো অল্প কথাই বলি না কেন, তাতে অনেক কথার পথ খুলে যায়। ভুলগুলোও শূল হয়ে আঘাত করে হৃদয়ের বামে। কেননা গল্প মানেই তো জীবনের প্রতিচ্ছবি, সমাজের দৃশ্যপট। গল্পকে গল্পের মতো বা কবিতার মতো লাইন লাইন না বলে যখন ছলেবলে কৌশলে বলা হয়; তখনই তা সাহিত্য হয়ে ওঠে। নইলে তো প্রচন্ড- শীতে আগুনের পোড় গায়ে লাগাতে দাদু-দাদির বা কোনো রসিক মানুষের বলা গল্পগুলোও সাহিত্য হতো। কিন্তু সেই গল্পগুলোও সাহিত্য। সেটাকে সাহিত্যে রূপ দিয়েছে কোনো কথাশিল্পী।
মূল কথা হলো— পাঠক যে গল্প পড়ে আরেকজনকে গল্পের ছলে জানিয়ে দেয়, সেটাই মূলত প্রকৃত গল্প। আর এর মধ্য দিয়েই লেখকের সার্থকতা। সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পও কিছুটা তেমনই। তিনি ছোট ছোট গল্পে
বড় বড় জীবনের নানান কাহিনি নিখুঁত ভাবে তুলে আনতে সক্ষম। তার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ ‘এখানে কয়েকটি জীবন’ এমন একটি বই। মানুষের হাসি—কান্না, চাওয়া—পাওয়ার, আশা—নিরাশার এক চতুর্মুখী পথের
চিত্রিত রূপায়ন। জীবনঘনিষ্ঠ গল্পগুলোর শিরোনাম পড়লেই যে চিত্র ভেসে আসে। তাতেই লেখক সার্থকও বটে। গল্পে শিরোনামগুলো—সোনাবউ, শাড়ি, বিবস্ত্র, দায়ী, জয়শ্রী, কুমারী, নাকফুল, কুকুর, গোলেয়া,
মিঠু ইত্যাদি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পে মন্দের বিপরীত কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি গল্পে সমাজের যা কিছু ভালো, কালোর বিপরীত তাকেই মূল করে এগিয়ে যান। কিন্তু এটা নয় যে, মন্দকে আড়াল করে। মন্দকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। বাতলিয়ে দেন আলো ও কালোর পার্থক্য। তিনি শাড়ি গল্পে একটি পারিবারিক জীবনের প্রশান্তির চিত্র শুরুতেই তুলে ধরেছেন। গল্পের শুরুতেই যখন পাঠক ইতিবাচক কোনো কিছুর সাক্ষাৎ পান তখন সম্পূর্ণ গল্প পাঠে অনুপ্রাণিত হয়। শাড়ি গল্পে মা—ছেলের ভালোবাসার নিদর্শন কীভাবে তুলে এনেছেন—নতুন শাড়িটা হাতে নিয়ে চোখ ছলছল করে ওঠে মজিতনের। একমাত্র ছেলে আজমের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকায়। মুখটা হাসি হাসি করে। তবু চোখের কোণে
আনন্দের জল চিকচিক করে ওঠে। নীরবতা ভেঙে মজিতনই প্রথম কথা বলে—‘অনেক সুন্দর হইছে রে। কত নিছে বাজান?’
‘তোমার পছন্দ হইলেই হইলো মা। দাম দিয়া তুমি কী করবা?’
বহুমাত্রিক লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। তার অনেক লেখার পাঠক আমি। প্রথমত তার লেখা প্রবন্ধগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। একাধারে তিনি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। বিভিন্ন সময়ে তার কয়েকটি গল্পও পড়েছি। পত্রিকার পাতায়। তার বইয়ের সংখ্যা ৯টি। এরমধ্যে চারটি গল্পের বই—সার্কাসসুন্দরী, নিশিসুন্দরী, সুন্দরী সমগ্র, এখানে কয়েকটি জীবন। দুইটি কাব্যগ্রন্থ—মিথিলার জন্য কাব্য, তুমি চাইলে। দুইটি সম্পাদনাগ্রন্থ—আমার আমি, অগ্নিকা- সতর্কতা ও নির্বাপণ কৌশল। একটি উপন্যাস—মমতা।
তবে বই আকারে গল্প পড়া এটাই প্রথম। তিনি যে এত জীবনঘনিষ্ঠ গল্প লিখেছেন—বইটি না পড়লে অজানা থেকে যেত। মেয়ে হয়ে জন্মালে নানান বিপত্তি। হোক সে কানা, খোড়া, লুলা কিবা এতিম, টোকাই। একটা মেয়ে পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই মায়ের কাছ থেকে শিখে নেয়। হয়তো শিখতে বাধ্য হয়। সেই শেখার মধ্যে
সম্ভবত প্রথমত ও প্রধানতম হলো—ধৈর্য। আর এই বিষয়টি কয়েকটি বাক্যে তুলে ধরেছেন বিবস্ত্র গল্পের মাধ্যেমে। একটা এতিম বাচ্চা যার কেউ নেই। যৌবনে পা দিতে না দিতেই সে বুঝতে বাধ্য হচ্ছে পুরুষের
মাঝে বাস করা একটা নরপশুকে। সেটা কতো সুন্দর ও শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন—আস্তে আস্তে অনেক কিছু চেপে যেতে শিখেছে। মেয়েদের না-কি অনেক কিছু চেপে যেতে হয়। রুবির মা-দাদিরা শেখায়নি। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই হয়তো নিজে নিজে শিখে গেছে। তাই মিথ্যা বলেছে বন্ধুদের। কিংবা প্রতিবাদের ইচ্ছা থাকলেও সাহস হয় না। সাহস থাকলেও সুযোগ হয় না। তাই চেপে যায়। এত কিছু ছাপিয়েও গল্পটির মূল আকর্ষণ মনে হয়েছে সুজনকে বুঝে ওঠার আগেই রুবীর ভালোবাসা। এবং রুবীর প্রতি সুজনের
অপ্রকাশিত কিন্তু পিরামিডসম অনঢ় ও অগাধ ভালোবাসার চিত্র। পুরো বইটা জুড়েই যেন জীবনের রেখাপাত। দেখা মেলে একটা দম্পতির সন্তানের প্রতি আশা—আকাক্সক্ষার তীব্রতা। সন্তানের মুখ না দেখার
আক্ষেপও। ‘জীবন’ গল্পটি বর্তমান সময়ের একটি বাস্তব চিত্র। যে গল্পে সাত বছরের দাম্পত্য জীবনে সন্তানের মুখ না দেখার কষ্ট বেদনা ফুটে উঠেছে।
প্রত্যেকটি গল্পেই রয়েছে সমাজের চিত্রণ। অতিরিক্ত শব্দের ভার নেই। নেই কোনো অহেতুক কথন। খুব পরিশীলিত বাক্যে একের পর গল্প সাজানো ও গোছানো। আমাদের দেখা বিষয়গুলো গল্পের উপজীব্য হলেও চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের ত্রুটি—বিচ্যুতি জানিয়ে দিয়েছে।
‘নাকফুল’ গল্পটির প্লট নির্মাণ আমার মন কেড়েছে। যদিও গল্পটি পড়লে যে কোনো পাঠক লেখককেই দাঁড় করাবেন ব্যর্থ চরিত্রে। একটি নাকফুলের ইতিহাস যেভাবে লেখক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তার সরল মনে প্রেমে পড়া, প্রেমে পড়ার অনুভূতি এবং ব্যর্থতার গাথা দিয়ে শেষ টেনেছেন। তা আমার কাছে চমৎকার মনে হয়েছে। সর্বোপরি বইয়ের প্রতিটি গল্পই আমার কাছে ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এতটাই যেমন ভালো লেগেছিল আজমের সাফল্যে তার পিতা-
মাতার। গ্রামে ভালো মানুষের খুব অভাব! কিন্তু খারাপ মানুষের অভাব নেই। বিশেষ করে পরস্ত্রীকাতর মানুষের আনাগোনা দেখা মেলে, যখন স্বামীহীন কোনো নারী বাঁচে সমাজে। এমনই একটা পরিবারের মাধ্যমে লোলুপ
সমাজের চিত্রায়ণ হয়েছে। গল্পটির নাম—কুকুর। স্বামীহীন একমাত্র সন্তানকে বুকে আগলে রেখে বেঁচে থাকা নারীর প্রতি সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিন্মমধ্যবিত্ত পর্যন্ত কেমন দৃষ্টিতে তাকায়, তারই দেখা মেলে এই গল্পে। মায়ের প্রতি গ্রামের মানুষরূপি কুকুরের আনাগোনা থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ছেলে স্বাধীনের কুকুর পোষার ইচ্ছে অভিনব। কিন্তু গ্রামের মানুষরূপি কুকুরের কাছেও কুকুর ছানার পরাজয় বুঝিয়ে দেয়—মানুষ পশু হলে কতটা পশু হতে পারে।
অন্য আরেকটি গল্পে সমাজের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ের উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পের মাধ্যমে সমাজকে চিত্র তুলে আনা নতুন কিছু নয়। তবুও বাস্তবতাই যে গল্পের মূল খোড়াক। সেটা যখন কোনো গল্পকার নিখুঁতভাবে দৃশ্যায়ন করেন শব্দের মিলনে। তখন তা ছবির মতো ফুটে ওঠে। গল্পটির নাম—গোলেয়া। গোলেয়া গ্রামের বৈশাখী মেলার নাম। বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে গ্রামীণ হালখাতার কথা তুলে আনা হয়েছে। ছোট্ট মেয়ে কলির ইচ্ছে পূরণের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ পটভূমির নিখুঁত ছবি ফুটে ওঠেছে।
গল্পের মূল রহস্যই হলো রচনাকৌশল। ছোটগল্পে সর্বদাই কাহিনি পাঠকই বুঝে নেন। বলা চলে পাঠক নিজেই তৈরি করেন। একেক পাঠক একেক ভাবে। কিন্তু সালাহ উদ্দিন মাহমুদের গল্পগুলোর সুন্দর একটি শুরু, সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গল্পের শেষ পাঠকের সামনে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পের ভেতরের আবশ্যিক উপাদান ও উপকরণ যথাযথ ভাবেই
উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পগ্রন্থটিতে ‘নাকফুল’ বর্ণনামূলক গল্প হলেও সম্পূর্ণ গল্পগ্রন্থটি কাহিনিনির্ভর গল্পে সাজানো হয়েছে। আশা করি বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে। আমি বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি। সেই সঙ্গে লেখকের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।