ছোটগল্প- গল্পগুরু ছিরালি কাকা -মিনার মেহেদী
আমাদের নতুন বাড়ি তৈরি করার পর থেকেই ছিরালি নামক একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি সারা বছর দিন মজুরির কাজ করত।মূলত সেই বাড়ির সব কাজকর্ম দেখা-শুনা করত।আমাদের সেদিকে ফিরে তাকানোর দরকারই হতনা।
আমি আর আমার ছোট বোন ফুলি তাঁকে কালা কাকা বলে ডাকতাম।তো কালা কাকার চরিত্রে বিশেষ কয়েকটা বৈশিষ্ট্য ছিল।যেমন-সে সাধারণত কানে শুনতে পেতনা।তাকে কিছু বলতে হলে চিৎকার করে বলতে হত।সে এক থেকে চল্লিশের বেশি গুণতে পারতনা।এটা অবশ্য তার নিজের কথা।কিন্তু আব্বুর কাছ থেকে তার পারিশ্রমিকের শত শত টাকা সে কিন্তু ঠিকই বুঝে নিত।আব্বু কখনো কখনো মজা করার জন্য তাকে টাকা দেবার সময় পাঁচ-দশ টাকা কম দিয়ে অপেক্ষা করত।দেখত সে কি করে।ছিরালি কাকা টাকা গুণে কম পেলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে হিসেব করে দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলত, মিস্ত্রী, ক’টাকা কম দিলে নাকি!
আব্বু তখন ভ্রুজোড়া নাচিয়ে একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলত, ভাল করে গুণে দেখ।কম কেন দেব!সে আবার গুণত।কিন্তু হিসেবে মিলত না।তখন সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলত, মিস্ত্রী, মনে হয় এখানে ক’টাকা কম আছে! আব্বু জিজ্ঞেস করত, কয় টাকা কম আছে! মনে তো হয়, পাঁচ টাকা কম আছে।কিছুটা নিশ্চিত হবার ভঙ্গিতে বলত ছিরালি কাকা।আব্বু তাকে টাকা দিতে দিতে ব্যঙ্গ করে বলত, তুমি তো পাড়ার লোকের কাছে বলে বেড়াও এক থেকে চল্লিশের বেশি গুণতে পারনা।এদিকে ভাগে কম পড়লে তো ঠিকই টের পাও! ছিরালি কাকা তখন জিহ্বায় কামড় খেয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে হাসত।কাকা যখন কোন কারণে লজ্জা পেত তখন এরকমভাবে জিহ্বায় কামড় খেয়ে হাসত।বহু বছর পরেও তার সেই জিহ্বায় কামড় খাওয়া হাসি আজো আমার মানসপটে যেন স্পষ্ট দেখতে পাই।
ছিরালি কাকার কিছু উচ্চারণগত সমস্যা ছিল।যেমন-সে কেজি কে গেজি বলত আর মহিলাদেরকে মফিলা বলত।আমি আর ফুলি ছোট বেলায় তার উচ্চারণটা ঠিক করার জন্য কতবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন অবস্থাতেই সেটা শুধরাতে পারিনি।যখন তাকে উচ্চারণ শেখাতাম তখন ঠিকঠাক বলত কিন্তু একদিন দুদিন পরেই আবার আগের মত গেজি আর মফিলা বলতই বলত।অবশেষে হতাশ হয়ে একসময় আমরা দু ভাই-বোন হাল ছেড়ে দিলাম।
আমাদের বাড়িতে কাকা যখন প্রথম কাজ শুরু করে তখন তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি ছিল।যে বয়সে একজন পুরুষ মানুষ ভারি কোন কাজ করতে পারেনা তখন সে ছিল যেকোন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের চেয়েও যথেষ্ট শক্তিশালী।তাকে দেখে বোঝা যায়, যৌবনে তার গায়ের রং ছিল টকটকে ফর্সা।কিন্তু দীর্ঘদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কায়িকশ্রম করত তার ওপর বয়স হয়ে যাবার কারণে গায়ের ফর্সা রংটা হালকা ধূসর টাইপের হয়ে গেছে।তবে তার শারীরিক গঠন ছিল তখনও বেশ মজবুত।সে একা একা মাটি কাটত।একাই মাটি ভর্তি ঝুড়ি মাথায় তুলত।সারাদিন যেন রোবটের মত কাজ করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তার।আমাদের বাড়ির ক্ষেত খামারের যত কাজ ছিল সে সব কাকা একাই করত।নতুন বাড়ি করার পর থেকে ছিরালি কাকা মরার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে শ্রম দিয়ে গেছে নিয়মিতভাবে।
ছিরালি কাকা দারুণ সব রূপকথার গল্প বলতে পারত।আমি আবার রূপকথার গল্প শুনতে ছোটবেলায় খুব পছন্দ করতাম।তাই দুপুরবেলা স্কুল ছুটি হলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি আসার চেষ্টা করতাম।এসেই দেখতাম কাকা প্রতিদিনের মত এক স্থানে গর্ত করছে সেখান থেকে ঝুড়ি ভর্তি মাটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলছে।আমি তার কাছে গিয়ে টুকটাক কথা বলেই গল্প শুরু করতে আবদার করতাম।
সে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলত, এখন তো গল্প বলা যাবেনা বাবাজি! হাতে অনেক কাজ।বেলা মাথার ওপর।রোদ অনেক বেশি।প্রচন্ড গরম।কথা বললে কষ্ট হবে বেশি।এদিকে কেবল তুমি স্কুল থেকে এসেছো।ক্লান্ত শরীর।তাই এখন তুমি বাড়ি গিয়ে গোসল করে বিশ্রাম নেও।দেখবে দেহটা ঝরঝরে লাগছে।মনটাও বেশ ভাল লাগবে।গল্প তোমাকে আমি আরেক দিন বলবক্ষণ।
আমিতো নাছোড় বান্দা।না বললে কিছুতেই সেখান থেকে উঠবনা।গোঁ ধরে বসে থাকতাম।অবশেষে ছিরালি কাকা এক প্রকার বাধ্য হয়ে শুরু করত তার ধারাবাহিক রূপকথার গল্প।বাবাজি, কাল যেন কোন জায়গায় শেষ করেছিলাম! মনে করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা এমন একটা অলিক চিন্তিত ভঙ্গিতে সে আমার দিকে তাকাত।কিন্তু আমি জানি, সে গল্প বলা কোথায় থামিয়েছিল, তা তার ভাল করেই মনে আছে।তারপরও শ্রোতা কতটুকু আগ্রহ ভরে গল্পটা মনে রেখেছে তা যাচাই করার জন্য তার এই নাটকীয়তা।আমি তাকে একেক দিন গল্পের একেক জায়গা থেকে শুরু করতে বলব।তবে গল্প শুরুর আগে তার একটা শর্ত থাকত।তাকে গতদিনের শেষ করা জায়গাটার কিছু অংশ বর্ণনা করে শোনাতে হবে।যেমন – কাকা, ঐ যে পদ্মনগরের রাজকুমার জাহাজে করে রাজকন্যার খোঁজে বের হয়েছিল।কিন্তু সমুদ্র পথে সাত দিন সাত রাত একটানা চলার পরও কোন স্থলভাগের দেখা পাইনি।সবাই চিন্তিত।শুধু চিন্তিত না মহাচিন্তিত।তারা সমুদ্রে পথ হারাল নাকি! পথ হারালে পৌঁছাবে কী করে গোপুননগরের রূপসী রাজকন্যার কাছে!
রাজকুমার দুশ্চিন্তা করতে করতে অনেক রাতে ঘুমিয়ে গেলে সেদিন রাতে রাজকুমার স্বপ্নে দেখল, কেউ একজন তাকে বলছে, আর তিন দিন তিন রাত এভাবে সমুদ্র পথে চলার পর একটা দ্বীপ দেখতে পাবে।সেখানে জাহাজ নোঙর করে দ্বীপে নামতে হবে।যেখানে আছে সুন্দর একটা সুরম্য রাজপ্রাসাদ।হিরা মনি-মানিক্য দিয়ে সাজানো সে প্রাসাদের অলিন্দ।কিন্তু কোন পাহারাদার নেঈ সেখানে।ভেতরে রাজকন্যা বন্দী।তাকে বন্দী করে রেখেছে একটা ভয়ংকর দর্শন গন্ডার।তার ভয়ে সেখানে কেউ পৌঁছাতে পারেনা।যে যায় সে আর ফিরে আসেনা।তাহলে রাজপুত্র কী করে রাজকন্যাকে উদ্ধার করবে ভয়ংকর সেই গন্ডারের হাত থেকে! গতকাল এ পর্যন্ত বলেছিলে তুমি।এখন বল তারপর কী হল-
ও আচ্ছা, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে।বলতে বলতে কাকা নাটকীয়ভাবে মাথা দুলাতে থাকে।তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে কাকার আচমকা প্রশ্ন, আচ্ছা বাবাজি বলত, রাজকুমারকে এই স্বপ্নটা কে দেখিয়েছিল! আমার সব মনে আছে এমন ভাব দেখিয়ে বলব, রাজকুমার যে জাহাজে করে যাচ্ছিল সে জাহাজে একখানা জ্যান্ত তক্তা লাগান ছিল।সেই তক্তাই রাজকুমারকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছিল।এইতো বেশ মনে আছে! তোমার মাথা কিন্তু খুব ভাল, বাবাজি।এটা ধরে রাখতে পারলে একদিন তুমি অনেক বড় হবা।আর তুমি যে অনেক বড় হবা, সেজন্য সব সময় আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করি।প্রত্যেকটা গল্প শুরু করার আগে তার ছোট্ট একটা ভূমিকা থাকে।সে সেটা সুযোগ পেলেই শোনাতে কিন্তু ভুল করবেনা। ভূমিকাটা হল-শোন বাবাজি, এক সময় আমি খুব ভাল গল্প বলতে পারতাম।এখনতো বয়স হয়েছে তাই আগের মত আর বলতে পারিনা।শুধু তুমি জোর কর বলে বলি।অন্য কেউ হলে কখনই বলতামনা।কারণ কি জান? আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলব, নাহ! তখন কাকা বলবে, কারণ তুমি খুব ভাল একটা খোকা, তাই!
ছিরালি কাকা কখনো বাবাজি আবার কখনো খোকা বলে ডাকত আমাকে।তার জীবদ্দশায় কখনো সে আমার নাম ধরে ডাকিনি।কখনো আমাকে দরকার হলে আম্মুকে বলত, খোকা কৈ! স্কুল থেকে এখনো আসেনি! আর যখন গল্প বলার মুডে থাকত তখন আমাকে বাবাজি বলেই সম্বোধন করত।
শোন বাবাজি, আমার যুবক বয়সে আমি বাজি ধরে সারারাত গল্প বলতাম।একবার একজন আমার সাথে বাজি ধরল।তার সাথে গল্প বলে পাল্লা দিতে হবে।আমি তাকে বললাম, ফাও ফাও আমি কারো সাথে গল্প বলে পাল্লা দেইনা।আমি বাজিতে গল্প বলি।কারণ আমার গল্পের একটা দাম আছে।আমার কথা শুনে সে রাজি হল।বাজি হল, যে হেরে যাবে সে তার এক মাসের মাইনে বিজয়ীকে দিয়ে দেবে।
গল্প বলা প্রতিযোগিতা শুরু হল কোন এক ভাদ্র মাসের জোছনা রাতে।সারা দিনের কাজ শেষে রাতে খাওয়া দাওয়া করে, হুঁকো ধরিয়ে প্রত্যেক রাতে একটা করে।একজন গল্প বলবে অন্যজন মনযোগ দিয়ে শুনবে আর হুঁকোতে গুড়গুড় করে টান দিতে থাকবে।এক জনের শেষ হলে অন্যজন শুরু করবে।দুজনেই ছিলাম গল্প বলায় তুখোড়।কেউ কাউকে হারাতে পারিনা।কিন্তু কেউ হাল ছাড়িনা।এভাবে চলতে লাগল একটানা কয়েক মাস। অবশেষে এক সময় তার গল্পের ভাড়ার খালি হয়ে গেল।কিন্তু তখনো আমার কাছে অনেক গল্প জমা আছে।সে বাধ্য হয়ে হার মেনে নিল।
আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইতাম, কাকা, সেই লোকটা কি তোমাকে এক মাসের মাইনে দিয়েছিল? আমার প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে কাকা বলতে থাকে, যখন সে বাজিতে হেরে গেল তার চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।গলা শুকিয়ে কাঠ।ঐ অবস্থায় সে আমার হাতে-পায়ে ধরে মাপ চেয়ে হাউমাউ করে কান্না-কাটি শুরু করে দিল।আমি মজা করার জন্য তাকে আরো চেপে ধরি।বলি, আমার টাকা চা-ঈ চা-ঈ।তোকে আমি পঁঈ পঁঈ করে তখন নিষেধ করলাম আমার সাথে বাজি ধরিসনা।কিন্তু তখন তো তোর মুখে চটাং চটাং কথা।কেউ নাকি তোকে গল্প বলে হারাতে পারেনা।পারবেও না।এখন বোঝ ঠেলা।মনে রাখিস, বাপের ওপরও বাপ থাকে।
শেষে কি হল! তুমি কি তাকে মাফ করে দিলে? আমার কৌতুহলী মন শেষটা জানার জন্য বড়ই আকুপাকু করত তাই প্রশ্নটা তৎক্ষনাৎ কাকাকে করেই ফেলতাম।কি আর করব খোকা! বলতে বলতে হতাশা ঝরে কাকার কন্ঠ বেয়ে।এত করে যখন সে আমার হাত-পা ধরছে তখন তার ওপর আমার একটু মায়াও হল।তাছাড়া সে ছিল বড় গরীব মানুষ।তার একার কামাইতে সাত জনের সংসার চলে।খুব করুণা হল তখন।তাই তাকে মাফ করে দিলাম।ছিরালি কাকার কন্ঠে এবার গর্বিত ভাব ফুটে ওঠে।আর শেষে তাকে সতর্ক করে দিলাম এই বলে যে, জীবনে আর কোন দিন বাজি ধরে গল্প বলে পাল্লা দিবিনা।সবাই কিন্তু আমার মত মাফ করে দেবেনা।তারপর থেকে যতদিন আমি সেখানে ছিলাম সে আমাকে গুরুর মত সম্মান করত।আর সময় সুযোগ পাইলে সে আমার হুঁকার তামাকটা সাজিয়ে দিত।আমার হাতের কাজে সাহায্য করত।
কাকার মুখে বহুবার শোনা গল্পটা আরো একবার শুনতে শুনতে আমি কিঞ্চিত অধৈর্য হয়ে বলে উঠতাম, আমার গল্প কিন্তু এখনো শুরু করনি কাকা! গল্প শুরু করতে করতে তোমার কাজের সময় তো শেষ হয়ে যাবে! তখন আর করতে পারবনা।সত্যি সত্যি অভিমান ঝরে পড়ত তখন আমার কন্ঠস্বরে।
এইতো এবার শুরু করব বাবাজি, বলে হাত দিয়ে কোদালের কাদা ছাড়াতে ছাড়াতে বলত ছিরালি কাকা।কাকা কখনো কাজে ফাঁকি দিতনা।আমার সাথে যতই কথা বলুক কিংবা গল্প করুক, সে কিন্তু বিরামহীনভাবে কাজ করেই চলত।এখানেই অন্যান্য দিন মজুরের তুলনায় কাকা ছিল অনন্য।
কোন কোন দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখব কাকা ক্ষেত কোপাচ্ছে।আমাকে দেখে বলবে, বাবাজি, একটু পানি খাওয়াতে পার! আমার ঘটির পানি গরম হয়ে গেছে।মার কাছ থেকে মাটির কলসের ঠান্ডা পানি আনতে পার।আমি এক ঘটি ঠান্ডা পানি আর সাথে বাড়ির গাছের একটা বা দুটা পাকা বিচি কলা নিয়ে আসব।সেসময় আমাদের নতুন বাড়িতে প্রচুর বিচি কলা হত। তাই ঘরেতে সবসময় পাকা কলা মজুদ থাকত।ছিরালি কাকাও পাকা বিচি কলা খেতে খুব পছন্দ করত।
সে কলা খেয়ে পানি পান করে তারপর নতুন উদ্যমে কাজে লেগে যেত।কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও আমাদের কথোপকথোন চলতে থাকবে অবিরাম।
খোকা বলত, এই বাড়িটা কার!
কেন, এটা আমাদের বাড়ি।প্রত্যুত্তরে খুব দৃঢ়তা দেখিয়ে বলতাম আমি।
ক্যামনে! ভ্রুজোড়া নাচিয়ে কৌতুকচ্ছলে বলত কাকা।তারপর সিরিয়াস হবার ভঙ্গিতে বলতে শুরু করত, শোন বাবাজি, এই বাড়িটা বানাতে তোমার বাবা প্রচুর টাকা খরচ করেছে সত্য।তবে এটাকে সুন্দরভাবে তৈরি করতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছি কিন্তু আমিই।এই বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় আমার পায়ের ছাপ রয়েছে।আমার হাত লেগেছে।আমার দেহের রক্ত পানি করা ঘাম ঝরিয়েছি শুধু এঈ বাড়িটার সুন্দর একটা আকার দেবার জন্য। এগুলো সব সাক্ষ্য দেবে আমার নামে।এখন বল, বাড়িটা কার! কাকার এই জটিল প্রশ্নে আমি ভাল রকমের ধন্দে পড়ে যেতাম।তারপর উপায়ান্তর না পেয়ে দ্বিধান্বিত কন্ঠে মৃদৃ স্বরে বলতাম, তোমার!
কাকা আমাকে দিয়ে সাক্ষ্য দেবার মত করে বলিয়ে নিত, ঠিক করে বল, বাড়িটা তাহলে কার!
আমি আবারো বলব, এই বাড়িটা ছিরালি কালার।
তোমার আব্বাকে বলতে পারবে তো!
আমি মাথা নেড়ে সায় দেই, হুম!
ভয় পাবেনাতো!
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে বলি, পাবনা।যদি তুমি প্রতিদিন আমাকে একটা করে গল্প শোনাও।বলে মিটিমিটি করে হাসতে থাকি আমি।
ছিরালি কাকাও মুচকি হাসি দিয়ে বলে, খোকা, তুমি খুব চালাক! তারপর একটু থেমে বলে, শোনো খোকা, আমি সর্বমোট ৩৬৫ টা গল্প জানতাম।কিন্তু এখন সবগুলো ঠিকঠাক মনে নেই।বয়সের সাথে সাথে ভুলে যাচ্ছি।তাছাড়া এসব জিনিস বলার অভ্যাস না থাকলে মনে থাকেনা।গল্প ভুলে যাওয়ায় তাকে বেশ হতাশ মনে হল।আমি সেটাকে খুব বেশি আমলে না নিয়ে আবদার করে বলি, আজ তোমার গল্পের থলি থেকে খুব ভাল দেখে একটা গল্প বলনা, কাকা!
খোকা, আজ এতক্ষণ ধরে অনেক কথা বলা হল, এবার কাজ করতে হবে।পরে আরেক দিন ভাল দেখে তোমাকে গল্প বলব।তাছাড়া শুধু শুধু গল্প করলে তোমার আব্বা আমার হাজরের দাম দেবে! হাজরের দাম না দিলে আমি চাল কিনব কী করে! আর চাল কিনতে না পারলে আমার বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে।তারচেয়ে তুমি এখন যাও।গোসল কর।দুপুরে ভাত খেয়ে একটা ঘুম দেও।দুপুরে না ঘুমালে রাতে আবার পড়তে পারবানা।কোন কোন দিন আমি তার উপদেশ শুনে মন খারাপ করে চলে আসতাম সেখান থেকে।
বর্ষাকালে ছিরালি কাকাকে ২ মাসের জন্য কিষাণ হিসেবে রাখা হত।ধান ভিজানো, চাতর বানান, জমি প্রস্তুত করা, ধান রোয়া সমস্ত কাজ তার তত্ববধানে হয়ে থাকে।সারাদিন বিলে থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে।আমি বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে থাকি।আর ছিরালি কাকা উঁচু একটা পিঁড়িতে বসে কোষ্টা (পাট) কাটতে থাকে টাকুর দিয়ে।এক মনে এক ধ্যানে সে কোষ্টা ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটা আঁশের সাথে আরেকটা আঁশ জোড়া দিতে থাকে আর নগ্ন উরুর ওপর ফন ফন করে টাকুর ঘোরাতে থাকে।এভাবে একসময় টাকুর ভরে উঠতো পাটের চিকন দড়িতে।
কিছুক্ষণ একটানা পড়ে আমি যখন একটু থেমে রেস্ট নেই তখন কাকা জিজ্ঞেস করে, খোকা লেখা-পড়া ভাল হচ্ছে তো? আমি, মাথা নেড়ে বলি, হুম, ভাল হচ্ছে।সে খুশি হয়ে বলে, ভাল করে লেখা-পড়া করবা।বড় হয়ে চাকরি-বাকরি করে বাবার-মার মুখ উজ্জ্বল করবা।তোমার আব্বা খুব কষ্ট করে তোমাদের লেখা-পড়া শেখাচ্ছে কিন্তু।বড় হয়ে তাদের কোন দিন কষ্ট দেবানা, মনে থাকবে তো! সে এমনভাবে কথাগুলো বলে যেন আমাকে দিয়ে সে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিচ্ছে।আমি মাথা নেড়ে সায় দেই, হ্যাঁ, দেখব।সে খুশি হয়ে যায়।
তারপর কিছুক্ষণ একমনে টাকুর ঘুরাতে ঘুরাতে আমাকে আচমকা প্রশ্ন করে, খোকা, তোমার ছুটি হবে কবে?
শুক্রবার।ছোট করে জবাব দেই।তারপর তার কাছে জানতে চাই, কেন! ছুটির কথা শুনছ কেন!
ছিরালি কাকা টাকুর থামিয়ে নিজের মত করে তার হাতের আঙুলের কড় গুণতে থাকে মঙ্গলবার, বুধবার, বিস্সুদবার তারপর শুক্কুরবার।মানে তিন দিন পর তোমার ছুটি।
শুক্রবারের ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমি তাকে আবারও প্রশ্ন করি, শুক্রবারে কী, কাকা!
শুক্কুরবার দিন সকালে তুমি আমার সাথে বিলে যাবা।
কিন্তু কেন!
তোমার আব্বার কতটুকু জমি-জমা আছে, কোথায় আছে, তা কি তুমি জান!
আমি মাথা নেড়ে জানাই, না।
তখন সে বলে, শোন খোকা, শুধু বই-খাতার লেখা-পড়া শিখলে হবেনা।সাথে সাথে সংসারের জ্ঞানও রাখতে হবে।বাবার কি আছে না আছে জেনে রাখতে হবে।আল্লাহ না করুক, তোমার আব্বার যদি কিছু হয়ে যায় আর তুমি যদি তার সম্পত্তি সম্পর্কে না জান তবে লোকে সব ফাঁকি দিয়ে নিয়ে যাবে।তখন হাতে ঝোলা ছাড়া কিচ্ছু থাকবেনা।বুঝতে পারছ! কাকা কিঞ্চিত ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলে শেষ কথাটা।
আমি মাথা নেড়ে সায় দেই, হ্যাঁ, বুঝেছি।
শুক্রবার দিন সকালে কাকা আমাকে সাথে করে বিলে নিয়ে গেল।আমাদের জমির সীমানা আমাকে চেনাল।তারপর বলল, আজ থেকে সব চিনে নিলে এখন আর কোন ঝামেলা নেই।কেউ আর তোমাকে ঠকাতে পারবেনা।নিজেদের জিনিস নিজেদেরকেই দেখে রাখা ভাল।পরের ওপর কখনো নির্ভর করতে নেই।লোকটার এমন আন্তরিকতায় আমার অন্তরটা আদ্র হয়ে উঠল।আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, রক্তের সম্পর্কের কেউনা, এমনকি আত্মীয়ও না তবুও সে শুধু একজন কামলা হয়েও তার মালিকের সম্পত্তির প্রতি কতটা আন্তরিকতা দেখিয়ে সে সব নিজ দায়িত্বে দেখে শুনে যত্ন করে রাখছে।আর তার সন্তানকে সব কিছু চিনিয়ে দিচ্ছে।যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন দুর্ঘটনা ঘটলেও সম্পদের কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য।সত্যি নিরক্ষর হলেও মহান এঈ মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে যায় সেদিন।
একদিন রাতে বাহিরে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।কাকা শুয়ে আছে আমাদের ঘরের পশ্চিমপাশের বারান্দায়।কাঁথা মুড়ে শুয়ে থাকার কারণে আর কানে কম শোনার জন্য বাহিরে যে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছেনা।বৃষ্টির ঝাপটায় বালিশ-কাঁথা সব ভিজে জবজবে হয়ে গেছে তবুও কাকার কোন সাড়া শব্দ নেই।সে ঘুমিয়ে আছে বেঘোরে।
আব্বু আমাকে ডেকে বলল, বারান্দায় চলতো আব্বু।দেখি তোমার কালা কাকা এই ঝড়-বৃষ্টিতে কী করছে! ঘুমাচ্ছে না বসে বসে ভিজছে।আব্বুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি বিছানা থেকে নেমে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখি তার এই করুণ অবস্থা! আমি তাকে ডেকে তুললাম।সে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।আবার বিরক্তও বটে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মধ্যরাতে যদি কেউ এভাবে আচমকা ডেকে তোলে তবে যা হয় আর কি! আব্বু কাকার এই বিস্মিতভাব দেখে বলল, বেঁচে আছ না মরে গেছ তাই দেখতে এলাম!
কেন! কী হয়েছে! ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায় কাকা।
বাহিরে তাকাও সব বুঝতে পারবা।আব্বু ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বাহিরের দিকে ঈঙ্গিত করে দেখায়।
ছিরালি কাকা বাহিরে তাকিয়ে এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারল।আর নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে লেপ-কাঁথা সব ভিজে জব জব করছে।কাঁথাটা উঁচু করতেই টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল।তা দেখে সে ভারি লজ্জা পেয়ে জিভে কামড় মেরে বলে, আমি তো ঈট্টুও টের পাইনি।কখন থেকে এমন শুরু হয়েচে, মিস্ত্রী!
মরার মত পড়ে থাকলে কিছুই টের পাওয়া যায়না, কালা মিয়া! আধা ঘন্টার মত হল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে।আর এভাবে কিছুক্ষণ চললে তোমার আর গোসল করা লাগতনা! এমনি গোসল হয়ে যেত।প্রত্যুত্তরে বলে আব্বু।
রাতে ঝড়-বৃষ্টিতে ভেজার কারণে পরদিন সকালে খুব জ্বর এল কাকার গায়ে।চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে।শরীর বেশ গরম।এই অবস্থায়ও সে বিলে যেতে চায়।আব্বু বাঁধা দিয়ে বলল, আগে সুস্থ্য হও তারপর বিলে যেও।নইলে বুড়ো মরতে খুনের দায় নিতে হবে আমাকে।আমার পক্ষে এখন তা কোন মতেই নেওয়া সম্ভব না।কাকার দিকে তাকিয়ে মজা করে বলে আব্বু।
কালা কাকার সাথে যখন আব্বু কথা বলে তখন সব সময় এভাবে মজা করে কথা কয়।কিন্তু কালা কাকাকে কখনো রাগ করতে বা মন খারাপ করতে দেখিনি।সেও আব্বুর সাথে সব সময় এভাবে মজা করে কথা কয়।কিন্তু কালা কাকাকে কখনো রাগ করতে বা মন খারাপ করতে দেখিনি।সেও আব্বুর সাথে সব সময় হেসে হেসে কথা বলে।তাদের এ ধরণের কথোপথন বরাবরই আমার বেশ ভাল লাগে।
কাকা ক্ষীণ গলায় বলে, চাতর তো রাতের বর্ষার পানিতে তলাই গেছে।পানি না সেচলে কোলা মুরি যাবে যে!
আব্বু এবার বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল, কোলা মরে মরুক।সে আমার যাবে।তুমি আগে সুস্থ্য হও।তারপর দেখা যাবে কি করা যায়!
কালা কাকার বউ মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসত কাকার কাছ থেকে টাকা নেবার জন্য।সেই টাকা নিয়ে সে বাজার সদাই করে নিয়ে যেত কাছারিবাড়ি বাজার থেকে।বউটার বয়সও খুব বেশি না।কাকার চেয়ে বছর পনের তো কম হবেই।এর চেয়েও বেশি হতে পারে।এটা কাকার দ্বিতীয় বউ।প্রথম বউ মারা গেলে এনাকে বিয়ে করে ঘরে আনে।আগের বউয়ের ছেলে-মেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে এবং তাদের বিয়ে-শাদিও হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় বউয়ের তিন ছেলে-মেয়ে।দুই মেয়ে এক ছেলে।বড় মেয়েটা আর আমি প্রাইমারি পর্যন্ত একসাথে পড়েছি।তারপর সে পড়াশুনা বাদ দিয়েছে।ছেলেটা এখনও স্কুলে যায়।আর ছোট মেয়েটা প্রতিবন্ধী।কালা কাকার বউ সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে তো কালা কাকার বিরুদ্ধে বলতে বলতে বাড়ি মাথায় করে তুলল।আমি তখন সবেমাত্র স্কুল শেষে বাড়িতে এসেছি।এসেই শুনি তার বউয়ের মুখে তাঁর সম্পর্কে কত আজব আজব কথা।কাকা নাকি বাড়িতে ঠিকমত বাজার করেনা।চাল কেনেনা।মাছ কেনেনা।তরকারি কেনেনা।ঝাল-পেঁয়াজ নেঈ বেশ কয়েদিন যাবত।ধার করে চলছে তাদের রান্না বাড়ার কাজ। এভাবে চলতে থাকলেত একদিন তো না খেয়েই মরে যেতে হবে।তাই সে আজ এসেছে, মিস্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে কী করে তাই জানতে।তার ধারণা সে এখান থেকে টাকা নিয়ে তার বড় বউয়ের ছেলে-মেয়েদেরকে দেয়।যার কারণে সে বাজার সদাই করতে পারেনা।
কালা কাকার বউয়ের মুখ থেকে কাকার সম্পর্কে এমন কথা শুনে প্রথমে আমি ধন্দে পড়ে যাই।কিছুতেই আমার সাথে তার ব্যবহার আর তার স্ত্রীর সাথে করা ব্যবহার মিলাতে পারিনা।কালা কাকার বউ তা কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলল, তোমার কালা কাকা তোমারদের সাথে ফেরেশতার মত আচরণ করে আর আমাদের সাথে জালেমের মত আচরণ করে।এজন্য আমি যা বলতিচি তা তুমি মেলাতে পারছনা তাইতো! আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।সে পরক্ষণে বলল, তোমার কাকা একটা আস্ত বদলোক।তা না হলি কী আমাই না খাওয়াই রাখে! আমরা না হয় না খাইয়ে থাকতি পারি।তা বুলি আমার পতিবন্দী অসুস্ত মায়্যিটা কী থাকতে পারে বল! সেদিকে কী তার কোন খেয়াল আছে! আমি নিরবে দাঁড়িয়ে কাকার বউয়ের কথাগুলো অবাক বিস্ময়ে শুধু শুনতে থাকি।
কাকার বউ একটু পর আম্মুর সাথে কথা বলতে রান্না ঘরের দিকে যায়।সেই ফাঁকে কাকা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়।আমি তার কাছে গেলে বলে শোন, তোমাকে আজ আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব।অবশ্য এটার মর্ম বোঝার মত বয়স তোমার হয়নি তবুও মাথায় রাখবা।জীবনে কোন না কোন সময় কাজে দেবে।কথাটা হল, সব সময় মেয়ে মানুষের কথা শুনবানা।শুনবা তো বিশ্বাস করবানা।কারণ মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কম।তারা যেকোন ব্যাপার না জেনে না বুঝে মন্তব্য করে।অশান্তি বাঁধায় পরিবারে।আমার বউও সেই কিছিমের মেয়ে মানুষ।তাইতো আমি সত্য বললেও আমার কথা বিশ্বাস করেনা।কত করে বললাম, গত মাসে একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা একটা বিশেষ কাজের জন্য ধার করেছিলাম।এমাসে তার টাকা দেবার কথা ছিল তাই শোধ করলাম তোমার আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে।টাকা যে তার কাছ থেকে নিছি তা কিন্তু তোমার চাচি জানে।কিন্তু টাকা শোধ করিচি তা আর বিশ্বাস করতি চায়না।এই হইচে সমস্যা।কাকার কথাটা কেন জানি আমার বিশ্বাস হয়ে গেল।আমি সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে চলে এলাম।
রান্না ঘরে তাকিয়ে দেখি আম্মু নীল রঙের পলিথিনের একটা ঠোঙায় পেঁয়াজ, রসুন ও কয়েকটা কাঁচামরিচ দিয়েছে।আর তার আঁচলে কিছু চাল বাঁধা।সে তখন খুশি মনে আম্মুর সাথে কথা বলছে।কিছুক্ষণ পর যাবার সময় আম্মুকে বলে যায়, বু, এবার যখন মিস্ত্রী টাকা দেবে তখন যেন আমাকে একটু সংবাদ দেয়।তা না হলি ও টাকাগুলোনও কি করবেন তার কোন ঠিকঠিকানা নেই।খবরদার খবরদার বু, সে না দেক তুমি অন্তত আমাকে ইট্টু খবর দিও। এর বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা।আমি তখন খুলনায় পড়াশুনা করি।একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এলাম।আম্মু বলল, শুনেছ, তোমার কালা কাকার ক্যান্সার হয়েছে! তোমাকে দেখার জন্য খুব উতলা হয়ে উঠেছে।সংবাদটা শুনে আমি খুব শকড হলাম।এমন একটা ভাল মানুষের এ রকম একটা দুরারোগ্য ব্যাধি হল! মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে কিছু ফল-ফলাদি, খাবার-দাবার কিনে নিয়ে আম্মু আর আমি ছিরালি কাকাকে তাদের বাড়িতে দেখতে গেলাম।কাশিখালের ভেতর পাশে খাস জমিতে তার ঘর-বাড়ি।আমরা পৌঁছে দেখি, ছিরালি কাকা বারান্দায় শুয়ে আছে সটান হয়ে।তাকে দেখে চেনার উপায় নেঈ।সেই শক্ত সামর্থবান মানুষটা আজ কেমন কংকালসার হয়ে গেছে।আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার বুকের ওপর।আমি তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম।কিছুক্ষণ কেঁদে শান্ত হয়ে দুর্বল কন্ঠে বলল, মানুষের মত মানুষ হয়ো বাবা।আর তোমার মা-বাবাকে দেখে রেখ।তারা তোমাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করছে।আমার যে সময় শেষ, তা আমি বুঝতে পারছি বেশ।কোন ভুল করে থাকলে নিজ গুণে মাফ করে দিও আমাকে।আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তুমি কোন ভুল করনি কাকা বরং আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, গল্প শুনতে চেয়ে বিরক্ত করেছি।তাই তুমিই আমাকে ক্ষমা করে দিও।
ফিরতি পথে ছিরালি কাকার জন্য মনটা খুব বিষন্ন হয়ে গেল।কত শত স্মৃতি এই মানুষটার সাথে।আর কয়েকটা দিন পর সে চলে যাবে না ফেরার দেশে! ভাবতেই বুকের ভেতরটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল।আমার অলক্ষ্যে চোখ ফেটে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।ছিরালি কাকা ছিল আমাদের পরিবারেরই একজন।তার এভাবে যাওয়াটা আম্মুও মেনে নিতে পারছিলনা।তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখও ছলছল করছে।হয়ত আমার মত তারও কত শত স্মৃতি মনের দুয়ারে উঁকি দিচ্ছ।