শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষ গল্প- মরুর জাহাজ- জান্নাতুন নিসা

তিন বছরের ছোট্ট চুচু আর মা চিয়া একাকি হেঁটে বেড়াচ্ছে। জায়গা বেশি না থাকায় তারা বেশিদূর হাঁটতেও পারে না। চুচুর এই বন্দি জীবন ভালো লাগে না। তার ইচ্ছে করে ছুটতে, খেলতে, মরুর বুকে পাড়ি জমাতে। নিজেকে জানতে হাজার প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় তার মনের রাজ্যে। নিজেদের সম্পর্কে জানতে একদিন চুচু তার মাকে জিজ্ঞেস করে- মা, আমাদের পেটের ভেতর কোনো বাড়তি কিছু ছাড়াই পানি জমিয়ে রাখার থলে আছে কেন?
মা হেসে বলে- ওলে বাবাটা, তুমি তো জানো আমাদের মরুভূমির জাহাজ বলা হয়। মরুভূমিতে যখন আমরা দীর্ঘপথ ভ্রমণ করি তখন যাতে খাবার বা পানির কষ্টে পড়তে না হয় এবং খুব কম পানিতেও আমাদের বাঁচার সুবিধার জন্য পানি সঞ্চয় করার থলে আছে।
আর বাবা, তুমি কি জানো- মরুভূমিতে আমরা প্রায় সতেরো দিন পর্যন্ত পানি পান না করে বাঁচতে পারি এবং ইচ্ছে হলে একবারে ১২০ লিটার পর্যন্ত পানি পান করতে পারি। বুঝলে।
হুমম…। আচ্ছা মা আমাদের পা এতো লম্বা আর গোলাকার কেন? আর দেখ গরু চাচ্চুর মতো খুর থাকলেও আমাদের পায়ের তলা এত নরম আর তুলতুলে কেন?
হি হি হি…। মরুভূমিতে তো আর একদিনের জন্য যাওয়া হয় না, অনেকদিনের জন্য যেতে হয়। তাই বোঝাটাও অনেক বড়-ই হয়। অনেক বোঝা নিয়ে মরুভূমিতে হেঁটে যাওয়ার জন্যই আমাদের পা গরু চাচ্চুর পায়ের মতো নয়।
বুঝলাম। আচ্ছা মা আমাদের কুঁজ এত বড় কেন?
আমার বাবাটার এতো প্রশ্ন! আচ্ছা শোনো। যে উটের কুঁজ যত বড় হয় তার মরুভূমিতে চলার শক্তি তত বেশি হয়। ভালো মতো খাবার খেলে আমাদের কুঁজ শক্ত এবং টানটান হয়ে ওঠে। আর তখন কুঁজটি চর্বিতে পূর্ণ হয়। এই চর্বিই আমাদের দীর্ঘদিন চলার পথে মরুভূমিতে শক্তি যোগায়। চর্বির রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের সময় যে পানি তৈরি হয় সেই পানিই আমাদের শরীরের পানির প্রয়োজনীয়তা মেটায়। আর কুঁজের চর্বি শক্তি উৎপাদনে ক্ষয় হওয়ার সময় ক্রমশই কুঁজটি নরম ও থলথলে হয়ে উঠতে থাকে।
বেশ বিজ্ঞের মতো থুতনিতে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর চুচু তার মাকে আবার জিজ্ঞেস করলো- আচ্ছা মা আমাদের চোখের পাপড়ি ময়ূর আন্টির পেখমের মতো এত বড় কেন? এটা কি কোনো কাজে আসে?
মা চুচুকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল- বাবা এই চিকন দীর্ঘ চোখের পাপড়ি মরুভূমিতে ঝড়ের সময় বালি থেকে আমাদের চোখকে রক্ষা করে। বলতে বলতে মা চুচুকে আদর করছিল।
চুচু একেবারে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে বলে উঠল- তা-ই বলো।
আচ্ছা মা মরুভূমিতে থাকার জন্য আমাদের পানি সংরক্ষণের থলে আছে, মরুভূমিতে হাঁটার জন্য আমাদের পায়ের এই বিশেষ ব্যবস্থা, কুঁজ আমাদের মরুভূমিতে কত্ত সাহায্য করে, এমনকি চোখের এই চিকন পাপড়িও মরুভূমিতে বয়ে যাওয়া ভয়ানক ঝড় থেকে আমাদের চোখ বাঁচাতে সাহায্য করে।
তাহলে আমরা চিড়িয়াখানায় কেন? বল না মা, আমাদের এমন বন্দি জীবন কেন? এই বন্দি জীবনে কি আমাদের পানি রাখার থলে, পা, কুঁজ, চোখের পাপড়ি কোনো কিছুই কখনো ব্যবহার করেছি? এমন অলস আর অচল অবস্থা থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব? কবে আমরা পাড়ি জমাবো মরুর বুকে? কবে তৈরি হবে আমাদের অভয়ারণ্য?
চিয়ার মুখে কোনো উত্তর নেই। কেবলি শূন্যতা!
নিজের ছোট্ট সন্তানের প্রশ্নের কাছেই সে নির্বাক। মা এবং সন্তানের দুচোখ বেয়ে কেবল ক’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আর চিয়া চুচুকে জড়িয়ে ধরল পরম মমতায়। চুচুও গা এলিয়ে দিলো মায়ের বুকে। ঠিক যেন মরুর বুকে ছুটে চলা মরুর জাহাজের এক নির্ভীক যাত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *